বিচার ব্যবস্থায় পদ্ধতিগত বর্ণবাদ, ক্ষমা চাইলেন নোভা স্কশিয়ার প্রিমিয়ার
বর্ণবাদ নির্মূল করতে বিচার বিভাগ পুনর্গঠনের পরিকল্পনা নিচ্ছে প্রাদেশিক সরকার
নভেম্বর ৩,২০২০
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : প্রিমিয়ার স্টিফেন ম্যাকনিল বিচার ব্যবস্থায় পদ্ধতিগত বর্ণবাদ থাকায় মঙ্গলবার ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। কারণ এই বর্ণবাদ নোভা স্কশিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসীদেরকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। খবর সিবিসি নিউজের।
প্রাদেশিক সরকার বলেছে, বর্ণবাদ নির্মূল ও সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য তারা বিচার ব্যবস্থার পুনর্গঠনের চিন্তা করছে।
ম্যাকনিল বলেন, “পুলিশ থেকে শুরু করে কোর্ট পর্যন্ত আমাদের বিচার ব্যবস্থা কৃষ্ণাঙ্গ কমিউনিটির অনেক সদস্যকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা যে ব্যবস্থার, নিজেদের গায়ের রঙের কারণে সেটিকে আপনারা ভয় করেন।
তিনি বলেন, “আজ আমি বলছি, ‘যথেষ্ট হয়েছে’। আমি চাই যে, আপনারা জানবেন, আমি আপনাদের কথা শুনি, আমি আপনাদের দেখি, আপনাদের বিশ্বাস করি এবং আমি দুঃখিত।”
ম্যাকনিল বলেন, তার সরকার নোভা স্কশিয়ায় “বিচার ব্যবস্থার পুনর্গঠনের” চিন্তা করছে। এজন্যে সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ, আইনজীবী ও কমিউনিটির সদস্যদের নিয়ে একটি রূপরেখা প্রণয়ন টিম গঠন করা হয়েছে। এই টিমকে পুনরুদ্ধারের পদ্ধতি গ্রহণের ক্ষমতা অর্পন করা হয়েছে যা নোভা স্কশিয়ায় জননিরাপত্তার রূপান্তর ঘটাবে।
গত বছরের এক রিপোর্টে দেখা যায়, হ্যালিফ্যাক্সে পুলিশ কৃষ্ণাঙ্গদেরকে রাস্তায় শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে অন্তত ছয়গুণ বেশি তল্লাশি করে। গত অক্টোবরে নোভা স্কশিয়ার বিচার বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, তিনি রাস্তায় তল্লাশি স্থায়ীভাবে বন্ধ করবেন। এক পর্যালোচনায় রাস্তায় তল্লাশি করার বিষয়টি অবৈধ হিসাবে চিহ্নিত হবার পর তিনি ওই ঘোষণা দেন।
আদিবাসী লোকেদের সঙ্গে যেন যথাবিহিত আচরণ করা হয় সেজন্যে নোভা স্কশিয়ার সরকারি কৌসুলী পরিষেবার পক্ষ থেকে গত বছর একটি নীতিমালা প্রকাশ করা হয়। প্রদেশের জনসংখ্যার মাত্র তিন শতাংশেরও কম আদিবাসী। কিন্তু তাদের ৮ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ জেলে বন্দি। এই পরিসংখ্যানের আলোকে ওই নীতিমালা প্রকাশ করা হয়।
নোভা স্কশিয়ার বড় ধরণের ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো চলতি বছরের শুরুর দিকে হ্যালিফ্যাক্স পুলিশের হাতে এক কৃষ্ণাঙ্গ নারী স্যানটিনা রাওয়ের গ্রেফতার। এসময় তার হাতের কব্জি ভেঙ্গে দেয়া হয়, মাথায় আঘাত করা হয় এবং তার শরীর থেঁতলে যায়। পরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নেয়া হয়।
ফেব্রুয়ারি মাসে এক কৃষ্ণাঙ্গ টিনএজারকে বেডফোর্ড মলের সামনে থেকে গ্রেফতার করার সময় তাকে আহত করে পুলিশ। পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই করেনি। নোভা স্কশিয়ার পুলিশের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী সিরিয়াস ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম ওই গ্রেফতারের বিষয়টি তদন্ত করছে।
সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারবে একটি টিম: ম্যাকনিল
ম্যাকনিল বলেন, রূপরেখা প্রণয়ন টিম বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করবে এবং আগামী ১৮ মাসের মধ্যে সরকারের কাছে সুপারিশমালা পেশ করবে। বিচার ব্যবস্থা থেকে বর্ণবাদ নির্মূলে কী ধরণের নীতি, আইন এবং সরকারি ব্যবস্থা পরিবর্তন করা দরকার সুপারিশে সেসব বিষয় থাকবে। তিনি বলেন, সুপারিশ পাবার পর তার ভিত্তিতে সরকার ব্যবস্থা নেবে এবং সমস্যার সমাধান করবে।
তিনি বলেন, “রূপরেখা প্রণয়ন টিম এবং জনগণের কাছে আমরা জবাবদিহি করবো বা সরকারগুলো জবাবদিহি করবে। এই টিমের মেয়াদ ১৮ মাস হলেও এর পরও তাদের কাজ নিশ্চিতভাবে অব্যাহত থাকবে এবং সত্যি বলছি, এটি হবে তাদের আজীবনের কাজ যাতে তারা সার্বক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করতে পারেন যে, আমাদের বিচার ব্যবস্থা বর্ণবাদী নয়।”
রূপরেখা প্রণয়ন টিমের একজন সদস্য মার্টিন মরিসন। তিনি ত্রিদেশীয় আঞ্চলিক শিক্ষা কেন্দ্রের আফ্রিকান-কানাডিয়ান এজুকেশন-এর আঞ্চলিক কো-অর্ডিনেটর।
মরিসন বলেন, “আমি যে কারণে এই কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছি সেটি হলো এই যে, নোভা স্কশিয়ার আফ্রিকান কমিউনিটি কখনই সরকারের কাছে সত্য বলতে ভীত হয়নি আর এটি হলো সেই উত্তরাধিকার আমিও যার সদস্য হিসাবে গর্বিত।”
তিনি বলেন, “জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুসহ বর্ণবাদের বেশ কিছু ঘটনা ভিডিও আকারে ছড়িয়ে যাওয়া এবং এর পরিণতিতে বিশ্বজুড়ে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার এবং কৃষ্ণাঙ্গ-বিরোধী বর্ণবাদী আন্দোলন হবার পর এখন হলো ব্যবস্থা নেবার সময়।”
“আশার কথা এটাই যে, এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের সন্তান, আমাদের পরিবারের ওপর, আমার সন্তান ও আমার পরিবারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টিকারী অসাম্যের বিষয়ে কথা শুনবে, স্বীকার করবে এবং সাড়া দেবে।”
টিমের অন্য সদস্য হলেন বিচার বিভাগীয় ডেপুটি মন্ত্রী মিজ. ক্যানডেন্স টমাস। তিনি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সামাজিক উদ্ভাবন ও সমন্বিত উদ্যোগ দপ্তরেরও ডেপুটি মন্ত্রী।
তিনি বলেন, “ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটিকে সাধারণত আমি তেমন গুরুত্ব দিই না। কিন্তু প্রিমিয়ার যখন বক্তৃতা করছিলেন তখন দেখি আমার বুক কাঁপছে। সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও জনগণ সঠিক কাজটি করার জন্য, এই প্রদেশে জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে বর্ণগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কায়েমি ব্যবস্থার অর্থবহ পরিবর্তনের পথচিত্র প্রণয়নে একযোগে এগিয়ে এসেছে।”
হ্যালিফ্যাক্স-এর একজন আঞ্চলিক কাউন্সিলর লিন্ডেল স্মিথের নামও রূপরেখা প্রণয়ন কমিটিতে ছিল। কিন্তু তিনি টুইট করে জানান, সরকারের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তার নাম থাকুক তা তিনি চান না। স্মিথ এর গঠন কাঠামো কি হবে এবং আমাদের কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভালমন্দ দেখার কাজে নিয়োজিত সামাজিক সংগঠনগুলোকে কীভাবে এতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে সে সম্পর্কে কোনওরকম আলোচনা ছাড়া আমি এই উদ্যোগে সমর্থন দিতে পারি না।”
“পদ্ধতিগত বর্ণবাদ কীভাবে কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসী সম্প্রদায়কে ভোগাচ্ছে সে বিষয়ে বিবেচনা করার যে কোনও প্রক্রিয়া আমাদের সম্প্রদায়ের অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সুস্পষ্ট সুফল দেবে এটা আমাদের নিশ্চিত করা দরকার।”
সম্প্রতি সিবিসির পাওয়ার অ্যান্ড পলিটিক্স অনুষ্ঠানে ম্যাকনিল বলেন, স্মিথ অন্তত একটি মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, “রূপরেখা কমিটির প্রথম মিটিংয়ে উপস্থিত লিন্ডেল-এর সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তিনি (লিন্ডেল) বলেছেন, তিনি এর সঙ্গে আছেন এবং পরের অগ্রগতি দেখার অপেক্ষায় আছেন।”
“তবে আমি আপনাদের জানাতে চাই যে, লিন্ডেল এই সংলাপের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তেমনই নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য তাদের সম্প্রদায়ের আরও যেসব সদস্য এই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন তারাও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”
এটি হতে যাচ্ছে একটি দীর্ঘমেয়াদি বিষয়
হ্যালিফ্যাক্স-এর সহিংসতাবিরোধী সক্রিয় কর্মী কুইনট্রেল পোভো বলেন, তার মনে হয়, এই “প্রদেশটি ক্ষমা চেয়ে দারুণ কাজ করেছে।” তিনি এখন দেখতে চান, কী ব্যবস্থা নেয়া হলো।
“বেশ কিছু ঘটনায় অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারা একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসাবে পদ্ধতিগত এই ইস্যুতে বহু মানুষের জীবনকে প্রভাবিত হতে দেখেছি।”
প্রোভো বলেন, যে পরিবর্তনই আনা হোক তাতে সময় লাগবে।
“অসংখ্য মানুষ এটা বুঝে নিয়েছেন যে, এতে কেবল এক বছর বা দু’বছর লাগবে নাÑ এটি হতে যাচ্ছে একটি দীর্ঘমেয়াদি বিষয়, কারণ দশকের পর দশক ধরে চলে আসা একটি ইস্যু আপনাকে সমাধান করতে হবে।”
রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের (আরসিএমপি) সার্জেন্ট ক্রেইগ স্মিথ নোভা স্কশিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতি কেন্দ্রের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য। তিনি বলেন, প্রিমিয়ারের ক্ষমা চাওয়াটা আশাব্যঞ্জক এবং ঐতিহাসিক।
“সম্ভবত এটি হবে একটি সূচনাবিন্দু এবং যা ঘটতে যাচ্ছে জাতীয় ও অন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার আদর্শ নমুনা।”