কানাডা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা সমর্থন করে
৫৭টি মুসলিম দেশের পক্ষ থেকে গাম্বিয়া আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছে : রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে সুচির বিরুদ্ধে প্রথম মামলা
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, ১৪ নভেম্বর ২০১৯ : মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যার ঘটনায় দেশটির নেত্রী অং সান সুচিসহ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনায় মামলা করা হয়েছে। এতে করে প্রথমবারের মতো শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সুচির বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা হল। খবর দ্যা গার্ডিয়ানের।
বুধবার রোহিঙ্গা ও লাতিন আমেরিকান মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ মামলা দায়ের করে। আর্জেন্টিনার আইনে গণহত্যা বিষয়ক কোনো ফৌজদারি আইন না থাকায় গণহত্যা মামলা করা যায়নি। ‘ইউনিভার্স জুরিসডিকশন’ বা ‘বিশ্বজনীন বিচারব্যবস্থা’র আওতায় আর্জেন্টিনায় মামলাটি করা হয়েছে।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগসহ নির্যাতনের মুখে দেশটি থেকে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর আগে সোমবার ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে মামলা করেছে ওআইসিভুক্ত দেশ গাম্বিয়া।
৪৬ পৃষ্ঠার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ এবং তাদের আবাস ধ্বংসের কথা বলেছে গাম্বিয়া।
কোনো স্থানে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ বেশি ভয়াবহ হলে যে কোনো দেশেই তার বিচার হতে পারে, এমন ধারণা থেকে আর্জেন্টিনায় ‘ইউনিভার্স জুরিসডিকশন’ বা ‘বিশ্বজনীন বিচারব্যবস্থা’ সংক্রান্ত আইন করা হয়েছিল।
এর আগে আর্জেন্টিনার আদালতে স্প্যানিশ স্বৈরশাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো ও চীনের ফালুন গং আন্দোলনের বিচার হয়েছিল এই আইনের আওতায়।
আইনজীবী টমাস ওজিয়া বলেন, অভিযোগে অপরাধী, সহযোগী ও তথ্য গোপনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়। আমরা আর্জেন্টিনার মাধ্যমে এটা করছি, কারণ অন্য কোথাও এই অভিযোগ করার কোনো আইনি সুযোগ নেই।
মামলায় মিয়ানমারের সুচির মতো শীর্ষ রাজনীতিক ও সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাংয়ের মতো সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ওজিয়া আশা করছেন, এই মামলার পর তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতে পারে।
বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের প্রেসিডেন্ট তুন খিন বলেন, ‘দিনের পর দিন মিয়ানমার সরকার আমাদের উৎখাতে চেষ্টা করে গেছে। আমাদের হত্যা করা হয়েছে কিংবা দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।’
এদিকে কানাডার প্রবীন রাজনীতিক বব রে বলেছেন, সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলমানকে বলপূর্বক দেশ থেকে বের করে দেওয়ার কারণে মিয়ানমারের সরকারের বিরুদ্ধে দায়ের করা গণহত্যার মামলার পক্ষে সমর্থন আদায়ে সহযোগিতা করার জন্য তিনি মিয়ানমার বিষয়ক কানাডার বিশেষ দূত হিসাবে ফিরে আসবেন। খবর কানাডিয়ান প্রেস এর।
বব রে একজন আইনজীবী এবং লিবারেল পার্টির সাবেক অন্তর্বর্তীকালীন নেতা। তিনি অন্টারিও প্রভিন্সের প্রিমিয়ার হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে। তিনি বলেন, তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে পর্দার অন্তরাল থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। ১০ দিন আগে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং করেছেন। সেখানেই তিনি জানতে পারেন, গাম্বিয়া ৫৭টি মুসলিম দেশের সংগঠন ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার পক্ষ থেকে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এক বিবৃতিতে বলেন, এই পদক্ষেপ গণহত্যার মত অপরাধের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। গণহত্যার অপরাধের মধ্যে রয়েছে, নির্বিচার হত্যা, পদ্ধতিগতভাবে বৈষম্য সৃষ্টি, ঘৃণাপ্রসূত বক্তব্য এবং যৌন সহিংসতা। কানাডার সরকার গাম্বিয়ার আইনী পদক্ষেপে সমর্থন জানানোর উপায় খুঁজে দেখবে এবং বব রে’র সহযোগিতার বিষয়টি আমলে নিয়েছে।
গত সোমবার বব রে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “মন্ত্রী ফ্রিল্যান্ড এ বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তিনি আমাকে এ সম্পর্কে বিশেষ দূত হিসাবে থেকে যেতে বলেছেন। আমার কাজের একটি অংশ হবে কানাডা কীভাবে গাম্বিয়ার মামলার আবেদনে সমর্থন দেওয়া যায় এবং কীভাবে আমরা এই সমর্থন আরও সম্প্রসারিত করতে পারি সে বিষয়ে আলোচনা করা। আমি পর্দার আড়ালে এই বিষয়ে কাজ করছিলাম এবং এখন আরও বেশি কাজ করতে পারবো বলে আশাবাদী।”
তিনি জানান, এরই মধ্যে তিনি জাতিসংঘে কানাডার রাষ্ট্রদূত মার্ক আন্দ্রে বøানচার্ড-এর সঙ্গে পরামর্শ করেছেন এবং গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবু বকর তাম্বাদোউয়ের সঙ্গে দেখা করেছেন।
বব রে বলেন, “তিনি আমাকে সেসময় পরামর্শ দেন যে, এই বিষয়টি নিয়ে তারা কাজ করছেন এবং আমি নির্বাচনের আগেই তাকে আভাস দিয়েছিলাম যে, আমি সরকারকে বলেছি যে, আমার মনে হয়, আন্তর্জাতিক বিচারাদালত (ICJ) মামলা দায়েরের সম্ভাব্য স্থান হতে পারে।” তিনি বলেন, “আমার জানামতে পরামর্শ গ্রহণ করা হয়েছে।”
মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি মিয়ানমারের নেতাদের বিচার করার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে আইনগত যেসব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হবে সে সম্পর্কেও বব রে পূর্বাভাস দেন। তিনি বলেন, প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে একটি স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যে ট্রাইব্যুনাল মামলার শুনানী করবে। তিনি উল্লেখ করেন যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা ও প্রাক্তন যুগোশ্লাভিয়ায় এধরণের ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিলো।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে কানাডার হাউস অব কমন্স রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধকে গণহত্যা হিসাবে উল্লেখ করে একটি প্রস্তাবনা সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন করে। সেই প্রস্তাবনায় মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাঠগড়ায় তুলতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বানও জানানো হয়।
প্রস্তাবনাটি জাতিসংঘের একটি তথ্যানুসন্ধানী দলের রিপোর্ট প্রকাশের সময়ই গ্রহণ করা হয়। জাতিসংঘ দলের রিপোর্টে বলা হয়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে, তাদের শত শত গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে, জাতিগত নির্মূল অভিযান চালিয়েছে এবং ব্যাপক গণধর্ষণ চালিয়েছে। রিপোর্টে মিয়ানমারে শীর্ষ জেনারেলদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা এবং গণহত্যার দায়ে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার আহবান জানানো হয়।
উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দেশটির সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধ চরমপন্থীরা মিলে এই নৃশংস মানবতা বিরোধী অভিযান চালায়। সেই অভিযানে ধর্ষণের শিকার হয় ১৯ হাজার নারী ও কিশোরী। বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয় ৪৩ হাজার। জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হয় আরও অন্তত ৩৬ হাজার রোহিঙ্গাকে। প্রচন্ড প্রহারে আরও কমপক্ষে ১ লাখ ১০ হাজার রোহিঙ্গার হাড়গোড় ভাঙা হয়। এই নৃশংস অত্যাচার সইতে না পেরে সেই সময় দেশ ছেড়ে পালিয়েছে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। আর এদের সবাই আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে।
কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে চার দফা প্রস্তাব করেছেন। প্রস্তাবগুলো হলো- এক. রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন এবং আত্তীকরণে মিয়ানমারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পূর্ণ প্রতিফলন দেখাতে হবে। দুই. বৈষম্যমূলক আইন ও রীতি বিলোপ করে মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থা তৈরি করতে হবে এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের উত্তর রাখাইন সফরের আয়োজন করতে হবে। তিন. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বেসামরিক পর্যবেক্ষক মোতায়েনের মাধ্যমে মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। চার. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণগুলো বিবেচনায় আনতে হবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অন্যান্য নৃশংসতার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, সুরক্ষিত ও সম্মানের সঙ্গে স্বেচ্ছায় রাখাইনে নিজগৃহে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।