প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ১০০ বছর পূর্তি
নভেম্বর ৪, ২০১৮
প্রবাসী কণ্ঠ : মানব ইতিহাসের এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছিলে এখন থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে। ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধ’ নামে পরিচিত ঐ মহারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৯০ লক্ষ সৈন্য ও ৫০ লক্ষ নিরীহ মানুষ নিহত হন। নিহতদের মধ্যে কানাডীয় সৈন্যের সংখ্যা ছিল ৬৬ হাজারেরও বেশী। আর আহত হয়েছিলেন ১ লক্ষ ৭০ হাজারেরও বেশী। প্রতি বছর কমনওয়েলথ দেশসমূহের যে সকল সৈন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিহত হন তাদের স্মরণে প্রতি নভেম্বর মাসের ১১ তারিখে পালিত হয় Remembrance Day। প্রতিক হিসাবে ব্যবহৃত হয় পপি ফুল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৬ লক্ষ ৫০ হাজারেরও বেশী কানাডীয় সৈন্য সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন যার মধ্যে ছিলেন কিছু নারী সৈনিকও (নার্স)। ঐ সময় কানাডার লোকসংখ্যা ছিল ৮ মিলিয়ন বা ৮০ লক্ষেরও কম। সেই হিসাবে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭ জন কানাডিয়ানই ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। বর্তমানে কানাডার জনসংখ্যা ৩৬.৯৫ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৬৯ লক্ষ ৫০ হাজার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯১৪ সালে। ঘটনার সূত্রপাত হয় ঐ বছর ২৮ জুন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে। ফার্দিনান্দ তার স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন বসনিয়ার রাজধানী সেরাজিভোতে। ঐ সময়ই তিনি হত্যাকান্ডের শিকার হন স্ত্রী সহ। হত্যাকারী ছিলেন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় নাগরিক। কিন্তু জাতিতে বসনীয় সার্ব।
সে সময় বসনিয়া ছিল অস্ট্রে-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের অংশ। হত্যাকারী গাভরিলো প্রিন্সিপ ছিলেন ‘তরুণ বসনিয়া’ দলের সদস্য। তারা অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের শাসন থেকে মুক্তি চাচ্ছিলেন।
ফার্দিনান্দ ও তার স্ত্রীকে হত্যা করায় অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় কর্তৃপক্ষ সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং ৪৮ ঘন্টার মধ্যে এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানায়। কিন্তু সার্বিয়ার আচরণে সন্তুষ্ট হতে পারেনি অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের কর্তৃপক্ষ এবং হত্যাকান্ডের ঠিক এক মাস পর ২৮ জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
এবং সেটাই ছিল মানব ইতিহাসের ভায়াবহ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা যা পরবর্তীতে বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয় কিছুদিনের মধ্যেই। ফার্দিনান্দকে হত্যার ঘটনা ছিল একটা উপলক্ষমাত্র। কিন্তু বিশ্ব বিশেষত ইউরোপ একটি ভয়াবহ যুদ্ধের জন্য তাতিয়ে ছিল আরো আগে থেকেই।
কিন্তু কানাডা কেন ঐ যুদ্ধে জড়িয়েছিল? তাও আটলান্টিক এর মত এক মহাসাগরের এপার হতে? কি স্বার্থ ছিল কানাডার? আর কেনই বা ৬৬ হাজারেরও বেশী কানাডীয় সৈন্যেকে প্রাণ দিতে হয়েছিল কানাডা থেকে প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার দূরের ঐ যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে? এবং দীর্ঘ চার বছরের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কানাডা কি পেয়েছিল?
তার আগে একটু দেখা যাক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ কি ছিল এবং কোন কোন দেশ ঐ যুদ্ধে জড়িয়েছিল।
মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াতে ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয় এভাবে – “সে যুগে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ছিলো গোপনীয়তায় ভরা ও জটিল । ফ্রান্সের ঐতিহাসিক শত্র“তার কারণে ব্রিটেন প্রথমদিকে জার্মানীর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলো। কিন্তু জার্মানী ব্রিটেনের সাথে নৌ- প্রযুক্তিতে পাল্লা দিতে শুরু করায় সম্পর্কটি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠে।
ফ্র্যাঙ্কো-প্র“শিয়ান যুদ্ধের পর থেকে জার্মান ও ফরাসিদের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। ফরাসিরা তাই রাশিয়ার সাথে মৈত্রী করে। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী রাশিয়াকে হুমকি হিসেবে দেখতো, তাই তারা জার্মানীর সাথে মৈত্রী চুক্তি করে।
সার্বিয়ার উত্থানের সাথে সাথে স্লাভ জাতীয়তাবাদ জোরদার হয়ে ওঠে। সুযোগ পেয়ে এবার অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী সার্বিয়াকে কোণঠাসা করে ফেলে। সার্বিয়ার মিত্র রাশিয়া, সে জোরে সার্বিয়া হুমকি অগ্রাহ্য করবার সাহস দেখায় ও সৈন্য সমাবেশ শুরু করে। বিভিন্ন মৈত্রী চুক্তি, দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিভিন্ন পর্যায়ে সত্যের বিভিন্ন বিকৃতি রাষ্ট্রনায়কদের যুদ্ধের সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়।
২৮ জুলাই ১৯১৪ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী সার্বিয়ার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পরদিন রাশিয়া সৈন্য সমাবেশের মাধ্যমে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ফলে জার্মানীও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। এদিকে সার্বিয়ার সমর্থনে ফ্রান্স সৈন্য সমাবেশ শুরু করে। যুবরাজের হত্যার পর, জার্মানীর হিসাবে ছিল যে, সার্বিয়ার বিরুদ্ধে একটি সংক্ষিপ্ত, আঞ্চলিক যুদ্ধে বিজয়ের সম্ভাবনা আছে। তাই তারা অস্ট্রিয়াকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে সার্বিয়ায় হামলা করার অনুমতি দিয়ে দেয়। যা হয় বিরাট ভুল!
জার্মানী অস্ট্রিয়াকে নজিরবিহীন সমর্থন দেয়ায় ভবিষ্যৎ জার্মান শক্তির সম্ভাবনায় আতঙ্কিত ফ্রান্স এবং রাশিয়ার তরফ থেকে অনাকাঙ্খিত শত্রুতা ডেকে আনে! রাশিয়া এবং ফ্রান্স সাথে সাথে যুদ্ধে যোগ দিলেও জার্মানী তাদের ভালই মোকাবেলা করছিল, কিন্তু
ব্রিটেনের চোখে রাশিয়া এবং ফ্রান্সের তুলনায় একটি নতুন ও শক্তিশালী জার্মানী ছিল বড় হুমকী তাই তারা পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী ও নিজেদের ক্ষমতার সুরক্ষিত করার জন্যই জার্মানীর বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। ব্রিটেনের মত পরাশক্তির আগমন জার্মানীর জন্য ব্যাপক হুমকী হয়ে দাড়ায়! আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাঝেই রাশিয়া পরাজিত হয়ে যুদ্ধত্যাগ করে। ব্যাপক সৈন্য ও সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি ও কম্যুনিস্ট প্রোপাগান্ডাই সম্রাটের পতন ও রাশান পরাজয় নিশ্চিত করে! ইতোমধ্যেই ৩ বছর ধরে চলা যুদ্ধে এবং শীতকালে রাশিয়ার অভ্যন্তরে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষতির শিকার জার্মান সেনাবাহিনী অদুরদর্শীতার পরিচয় দেয় আমেরিকান জাহাজে আক্রমণ করে! জার্মান নৌ-বাহিনীর আক্রমণ ঘুমন্ত দৈত্য যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে ডেকে এনে চুড়ান্ত জার্মান পরাজয় নিশ্চিত করে!
এছাড়া শিল্পন্নোয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে নব্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা জার্মানীর উত্থান ফ্রান্স, ব্রিটেনের সাম্রাজ্যের জন্য নিশ্চিত হুমকি ছিল এবং এটা ঠেকানোর জন্যই ফ্রান্স-রাশিয়া-ব্রিটেন এবং সবশেষে যুক্তরাষ্ট্র একজোট হয়!”
বিশ্বযুদ্ধে কানাডার জড়িয়ে পড়া
যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে এক মহাসাগর দূরত্বে অবস্থান করেও এবং আপাতদৃষ্টে কোন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ছাড়াই কানাডাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে
যোগ দিতে হয়েছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থ রক্ষার জন্য। কারণ, কানাডা তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ। যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল কানাডার অভ্যন্তরে অবস্থিত সেই সময়কার ইন্ডিপেন্ডেন্ট কলোনী নিউফাউন্ডল্যান্ড-ও। কানাডা ও নিউফাউন্ডল্যান্ড আসলে যুদ্ধে নিজে থেকে যোগ দেয়নি। যেহেতু ব্রিটিশ রাজ যুদ্ধে জড়িয়েছে সেহেতু সয়ংক্রিয়ভাবে কানাডাও জড়িয়ে গেছে। যেমনটা জড়িয়েছিল তখনকার ভারতীয় সেনাবাহিনীও।
উল্ল্লেখ্য যে, বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ১৯১০ সালে কানাডার সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী Sir Wilfrid Laurier এক বক্তব্যে বলেছিলেন, “when Britain is at war, Canada is at war. There is no distinction.”
তবে কানাডিয়ানদের যুদ্ধে যাওয়া নিয়ে ১৯১৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে এক প্রচন্ড বিতর্ক ও বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছিল। কানাডীয় পুরুষদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগদানের বিষয়টি নিয়ে ঐ বিতর্কে দুটি পক্ষ হয়ে যায়। কানাডীয় পুরুষদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগদানের বিপক্ষে ছিলেন ফ্রেঞ্চ কানাডিয়ানরা, কৃষকদের অনেকে, শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যরা এবং নন-ব্রিটিশ ইমিগ্রেন্টরা। কিন্তু পক্ষে ছিলেন ব্রিটিশ ইমিগ্রেন্টরা, ইংলিশ স্পিকিং কানাডিয়ানরা, সোলজার ফ্যামিলির সদস্যরা এবং বয়স্ক কানাডিয়ানরা। তবে শেষ পর্যন্ত সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হন তারা যারা কানাডীয় পুরুষদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগদানের পক্ষে ছিলেন।
কানাডা যুদ্ধে জড়ানোর পর আলোচিত ঘটনাসমূহ
৪ আগস্ট ১৯১৪ : যুদ্ধে জড়ালো কানাডা
১৯১৪ সালের ৪ আগস্ট বৃটেন যখন যুদ্ধে নামে তখনকার নিয়ম অনুযায়ী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিন বিভিন্ন কলোনী ও ডমিনিয়নগুলোও অটোমেটিক্যালি যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। কানাডা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিনে ছিল। ফলে এই দেশটিকে যুদ্ধে জড়াতে হয়েছে যেমন জড়াতে হয়েছে ভারতকেও।
২২ আগস্ট ১৯১৪ : যুদ্ধ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন
এই তারিখে কানাডা ‘War Measures Ac’ নামে একটি আইন পাশ করে যাতে করে সরকার যুদ্ধ বিষয়ক কার্যক্রম নির্ভিঘেœ চালাতে পারে। এই আইনে সরকারকে সেন্সরশীপ প্রয়োগ করার ক্ষমতা দেয়া হয়। আরো ক্ষমতা দেয়া হয় কোন নাগরিককে গ্রেফতার করা ও অন্তরীন রাখার এবং যে কোন সম্পদ এর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার।
২২ এপ্রিল ১৯১৫: Second Battle of Ypres
এটাই ছিল কানাডিয়ান সৈন্যদের প্রথম বড়ধরনের যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে তাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে ক্লোরিন গ্যাসের। পশ্চিম রণাঙ্গনে জার্মানী কর্তৃক মারণাস্ত্র হিসাবে ক্লোরিন গ্যাসের ব্যবহার সেটাই ছিল প্রথম। কানাডীয় সৈন্যদেরকে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়েছিল ঐ যুদ্ধে। প্রতি তিনজনের একজনকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়েছিল। মোট ৬ হাজার কানাডিয়ান সৈন্য নিহত হয়েছিলেন বেলজিয়ামের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ঐ ণঢ়ৎবং এর যুদ্ধ ক্ষেত্রে।
১জুলাই ১৯১৬: battle at Beaumont Hamel
১ জুলাই নিউফাউন্ডল্যান্ড রেজিমেন্ট ফ্রান্সের উত্তরে Beaumont Hamel এলাকায় ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দেয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। কিন্তু সেই যুদ্ধে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ও অসাবধানতার কারণে বিরাট মূল্য দিতে হয় নিউফাউন্ডল্যান্ড রেজিমেন্টকে। মাত্র আধা ঘন্টার মধ্যে এই বাহিনীর ৮০১ জন সৈন্যের মধ্যে ৩২৪ জনকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে অথবা নিখোঁজ হতে হয়। আহত হন ৩৮৬ জন্য সৈন্য। পরের দিন সকালে রোল কলের সময় ৮০১ জন সৈন্যের মধ্যে মাত্র ৬৮ জন্য সৈন্য হাজির ছিলেন।
৯-১২এপ্রিল ১৯১৭: Battle of Vimy Ridge
ফ্রান্সের ঠরসু Vimy Ridge এলাকায় এপ্রিল মাসের ৯ তারিখে শুরু হয় এই যুদ্ধ। সকালের দিকে শুরু হওয়া ঐ যুদ্ধ চলে একটানা ৪ দিন। Vimy Ridge যুদ্ধে কানাডিয়ান সৈন্যরা যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখায়।
২৬ অক্টোবর – ১০ নভেম্বর ১৯১৭
Battle of Passchendaele
বেলজিয়ামের Passchendaele এলাকায় কানাডিয়ান সৈন্যরা যখন যুদ্ধ করছিল তখন সেখানকার আবহাওয়া ছিল ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ অবস্থায়। তারপরও শত্র“পক্ষকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল সৈন্যরা। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটা ছিল বিস্তর। ১৬ হাজার কানাডিয়ান সৈন্য নিহত বা আহত হন সেই Passchendaele -র যুদ্ধে।
৮ আগস্ট – ১১ নভেম্বর ১৯১৮ : The Hundred Days
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্র পক্ষের হয়ে কানাডিয়ান সৈন্যরা যে লড়াই করেছিলেন তার অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল। তবে যুদ্ধের শেষ একশ দিনে কানাডীয় সৈন্যদের অর্জন ও কৃতিত্বটা ছিল সবচেয়ে উল্ল্লেখযোগ্য। ঐ সময়টার একটা আলাদা নামই হয়ে গিয়েছিল যেটা এখনো সবাই “The Last Hundred Day.” নামেই উল্ল্লেখ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের পক্ষ হয়ে সাহসী লড়াই করার জন্য ৭০ জন কানাডীয় সৈন্যকে ‘ভিক্টোরিয়া ক্রস’ পুরষ্কার প্রদান করা হয়।
১১ নভেম্বর ১৯১৮ : যুদ্ধবিরতি
চার বছরেরও অধিক সময় ধরে চলতে থাকা এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটে এখন থেকে একশত বছর আগে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর। সেদিন প্রথম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি ঘটে ১৯১৯ সালের ২৮ জুন ‘ভার্সাই চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর। সমালোচকরা অবশ্য বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের পর শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে যে ভার্সাই চুক্তি সম্পাদিত হয়, সেখানেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ বপন করেছিলো তৎকালীন সময়ের ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র।
১ম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বপ্রথম প্যারিস শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর ধারাবাহিকতায় ফ্রান্সের অদূরবর্তী ভার্সাই নগরে এ চুক্তি সম্পাদিত হয়। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে ভার্সাই চুক্তি সম্পাদিত হয়, অথচ সেই চুক্তিতে জার্মানিকে সম্পূর্ণরূপে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য, শুধুমাত্র জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী করে তাদের উপর বিভিন্ন ধরণের নিষেধাজ্ঞা ও যুদ্ধের সমস্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য বলা হয়, যা ছিল সম্পূর্ণ প্রতিহিংসা মূলক। আর এই প্রতিহিংসা মূলক আচরণের মধ্যেই ২য় বিশ্বযুদ্ধের উত্থানের কারণ নিহিত।
সংক্ষেপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল
১. চারটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। রোমান সাম্রাজ্য ১৯১৭ সালে, জার্মান ও অ্যাস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য ১৯১৮ সালে এবং অটোমান সাম্রাজ্য ১৯২২ সালে।
২. অস্ট্রিয়া, চেক স্লোভাকিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুনিয়া এবং তুরস্ক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে।
৩. অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা অধিকাংশ আরব এলাকা বৃটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যের অধীনে আসে।
৪. ১৯১৭ সালে বলশেভিকরা রাশিয়ার এবং ১৯২২ সালে ফ্যাসিস্টরা ইতালির ক্ষমতায় আরোহন করে।
৫. এ যুদ্ধের অন্য ফল হলো: অ্যামেরিকানরা তুরস্কে গণহত্যা চালায় এবং ইনফ্লুয়েঞ্জায় বিশ্বব্যাপী ২৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কানাডার সরাসরি স্বার্থ না থাকলেও ব্রিটেনের অধিনে থাকার কারণে সেদিন সৈন্য পাঠাতে হয়েছিল। যুদ্ধে জড়িয়ে ব্রিটেনের স্বার্থ রক্ষা করলেও কানাডাকে মূল্য দিতে হয়েছিল চরম। ঐ যুদ্ধে কানাডীয় সৈন্যদের অর্জন ও কৃতিত্ব থাকলেও যে ক্ষয়ক্ষতির শিকার তাদের হতে হয়েছিল সেটি ছিল অপরিমেয়। আগেই উল্ল্লেখ করা হয়েছে ৬৬ হাজারেরও বেশী কানাডীয় সৈন্যকে প্রাণ দিতে হয়েছিল মানব ইতিহাসের ভয়াবহ ঐ যুদ্ধে। আহত হয়েছিলেন ১ লক্ষ ৭০ হাজারেরও বেশী। আর সার্বিকভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৯০ লক্ষ যোদ্ধা ও ৫০ লক্ষ নিরীহ মানুষ নিহত হন।
ঐ মহাযুদ্ধে প্রায় ১৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যক্ষ ও ১৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরোক্ষ খরচ হয়। যা ইতিপূর্বে ঘটিত যেকোনো যুদ্ধব্যায়ের চেয়ে অনেক বেশি।
মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত ফলাফল যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোন রাষ্ট্রের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনেনি। আক্ষরিক অর্থে পৃথিবীর ইতিহাস চর্চায় জার্মানিকে পরাজিত দেশ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয় এবং শুধুমাত্র জার্মানির উপরেই সকল দায়ভার চাপিয়ে জার্মানিকে কোণঠাসা করে দেয়া হয়।
অন্যদিকে ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদা ও প্রভাব পুরো বিশ্বে বৃদ্ধি পায়। কারণ বিশ্বযুদ্ধের ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নানান অর্থনৈতিক সংকট দেখা যায়। এই অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশকে নানানভাবে আর্থিক সাহায্য সাহায্য দিতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মহাজনে পরিণত হয়, ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে বাঙ্গালী
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন ভারত ছিল ব্রিটিশ সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। ৪ আগস্ট যুদ্ধে ইংল্যাণ্ডের যোগদানের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ভারতীয় উপমহাদেশও যেমনটা জড়িয়ে পড়েছিল কানাডা। ঐ সময়ে অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ১২ লাখ সেনা সরাসরি অংশগ্রহণ করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। তবে প্রথম দিকে যুদ্ধে বাঙালি সেনা ছিল না বললেই চলে। মূলত এ যুদ্ধের মাধ্যমেই বাঙালিরা নতুনভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। ১৯১৬ সালের ৭ আগস্ট তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ঢাকা শহরে বাঙালিদের জন্য একটি পদাতিক রেজিমেন্ট গঠনের ঘোষণা দেন। এই রেজিমেন্টই পরে পরিচিতি পেল ‘৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্ট’ বা ‘বাঙালি পল্টন’ হিসেবে। এখান থেকেই কয়েক হাজার সেনা বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেন। বেঙ্গলি রেজিমেন্টে অবিভক্ত বাংলা থেকে সর্বমোট পাঁচ হাজার ৯৫২ জন যোদ্ধা ও ২৩১ জন ফলোয়ার্স যোগ দিয়েছিলেন, এর মধ্যে ঢাকা থেকে যোগ দিয়েছিলেন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক তরুণ। এঁদের সংখ্যা ছিল ৬৭৩ জন। অন্যদিকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও যুদ্ধে বিভিন্নভাবে সরকারকে সহযোগিতার জন্য ঢাকার নবাব হাবিবুল্ল্লাহ ‘দি অর্ডার অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ খতাব লাভ করেন। বিশ্বযুদ্ধে বাঙালি রেজিমেন্ট উল্ল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। বিশ্বযুদ্ধ শেষের পর ১৯২০ সালের ৩০ আগস্ট বন্ধ ঘোষণা করা হয় বেঙ্গলি রেজিমেন্ট।
তথ্য সূত্র : উইকিপিডিয়া, কানাডিয়ান ওয়ার মিউজিয়াম, ভেটেরিয়ান এ্যাফেয়ার্স কানাডা, ডিজিটাল হিস্টোরি, বিডি-প্রতিদিন.কম