প্রবাসে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম কোনভাবেই যেন নিজের ভাষাটা ভুলে না যায়

সংস্কৃতির চর্চা আমরা শুরু করেছিলাম ঘরোয়া পরিসরে-এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে

জুন ৩, ২০১৮

রেজাউল হাসান ॥ ‘একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পেছনে ফেলে আমরা পাড়ি জমিয়েছিলাম এ দেশে উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডায়। নতুন দেশে এসে একটু স্থিতু হওয়ার পরেই তো মানুষ ফিরে যায় তার চেতনায়-তার ঐতিহ্যে। ফিরে যায় তার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। আমার মনে আছে মন্ট্রিয়ালে যখন আমরা ছিলাম, তখন আমার মেয়ে পরমার এখানকার ভাষা রপ্ত করতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। তখন ওখানকার একজন শিক্ষক আমাকে বললেন, ভাষা শিখে যাবে তোমার মেয়ে-তবে অবশ্যই খেয়াল রাখবে-তোমার মেয়ে কোনভাবেই নিজের ভাষাটা যেন ভুলে না যায়। দিস ইজ ভেরি ইমপরটেন্ট থিং..কথাটা আমার মনে
ধরেছিল। -বলছিলেন, টরন্টোর জনপ্রিয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং রূপসী ফারহানা পল্লব।
যখন তার সাথে কথা বলেছিলাম, তখন ছিল শীত সময়, তার স্কারবরোর বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডে বিশাল জায়গা। জানালেন -ব্যাডমিন্টন খেলার চেষ্টা করি ওখানে। তাও ব্যস্ততার কারণে অনেক দিন আর হয়ে ওঠছেনা।
তার বাড়ির ফ্যামিলি রুমের স্বল্প পরিসরের রুমটিতে আমরা বসেছিলাম-তার পশ্চিমের জানালা থেকে বিকেলের লাজ রক্তিম গোধূলি উঁকি দিচ্ছিল। তার ম্লান হলুদ ছায়ায় রুমটিতে একটা নস্টালজিক আবহ সবাইকে যেন একটু আনমনা করে দিয়েছিল। পল্লব যেন ফিরে গেলেন তার অতীতে। বললেন, ঐ শিক্ষকের কথাটা আমার মনে বেশ দাগ কাটে। তারপর থেকে আমাদের বাড়িতে অমরা কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আমাদের ভাষা চালু রাখি। এই এতো বছর পরে যখন সবাই আমাকে শুধোয় আপনার মেয়ে পরমা এতো সুন্দর বাংলা বলে কি ভাবে! আমি বলি, আপনারাও চেষ্টা করবেন, আপনাদের ছেলে মেয়েরা যেন নিজেদের ভাষা না ছাড়ে। পল্লব বলেন, এই দেখুন না চায়নিজরা এ দেশে আছে শতাব্দী ধরে-তারা কি তাদের ভাষা সংস্কৃতি ভুলে গেছে? বরং তারা আরও অনেক বেশী চৈনিক। পল্লব অবশ্য স্বীকার করেন যে, এটা নির্ভর করে আমাদের মানসিকতার উপর। বাস্তব অবস্থা এমন যে, বাচ্চারা তো বেশীর ভাগ সময় স্কুলে থাকে, লেখা পড়া সব কিছুই তো ইংরেজীতে-সেখানে নিজের ভাষায় কথা বলার সময় কোথায়! এটাও যেমন সত্য, আবার ছোট বেলা থেকে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারে তাদের ভেতরে এক ধরণের উৎসাহের ভিত যদি গড়ে দেয়া যায়-সেটা প্রবাহিত হতে থাকে তাদের রক্তে-যেমন পদ্মপাতাটাই সত্য,তার উপর শিশির বিন্দু দাঁড়াতেই পারেনা!

Pallab 3প্রখ্যাত শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার সঙ্গে পল্লব

ফারহানা পল্লবের মা সুলেখিকা ফরিদা রহমান।
বাবা প্রয়াত ফকির ফজলুর রহমান। অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত ছিলেন আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব। বাড়িতে ছিল সাংস্কৃতির আবহ। ছায়ানটে গান শিখেছেন। ওস্তাদের কাছে গানের রেওয়াজও করেছেন। রবীন্দ্র – নজরুলের গান গাইতে পারেন। তবে দুর্বলতা ছিল নজরুল গীতির প্রতি। নজরুলের গান গাওয়া অতো সহজ নয় এ কথাও অকপটে স্বীকার করলেন পল্লব।
তিনি কানাডায় সপরিবারে পাড়ি জমান নব্বুইয়ের দশকের শুরুতে। এসে ওঠেছিলেন মন্ট্রিয়ালে। ’৯৫ থেকে স্থায়ী ভাবে বাস করছেন টরন্টোতে। গড়ে তোলেন পাঠশালা নামের একটি সংগঠন। তাদের বাংলা ভাষা শেখানো ছাড়াও গান বাজনার ঘরোয়া আসরের আয়োজন করতে থাকেন। পল্লব বলেন, অনেক শিল্পী ও যন্ত্রী এখানে ছিলেন। এই আসরে যোগ দিয়ে তারা যেন শেকড়েরই সন্ধান পেলেন। ধীরে ধীরে সেই ঘরোয়া অনুষ্ঠানের এখন ব্যাপ্তি ও প্রসার ঘটেছে। মিলণায়তনে এমন কি স্টেডিয়ামে পর্যন্ত। আজ যারা প্রবাসে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ও যন্ত্রী, ভাবতে ভাল লাগে-তাদের অনেকেরই শুরু হয়েছিল আমাদের আগ্রহে ও অনুপ্রেরণায়। আমাদের সংস্কৃতি এখন বিকশিত,পল্লবিত। নাচ ও গানের অনেক স্কুল এখন তো সু-প্রতিষ্ঠিত। এখন আর আমাদের জাতীয় দিবসগুলোতে শিল্পীর অভাব নেই। রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে শিল্পী বাছাই করতে হয়।

Pallab 2অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ফারহানা পল্লব

ফারহানা পল্লবের সবচে’ বড় অর্জন ছিল টরন্টো ডাউন টাউন এর ইয়ং আর ডানডাসের সন্ধিস্থলে বিশাল ডানডাস স্কয়ারে বাংলাদেশী সামার ফেস্টিভালের আয়োজন। এই ফেস্টিভাল শুধু বাংলাদেশী কমিউনিটিতে নয়-অন্যান্য কমিউনিটিতে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। ২০০৫ সালে প্রথম ডান্ডাস স্কোয়ারে সামার ফেস্টিভালের আয়োজন করা হয়েছিল। ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তার আগে ২০০৪ সালে মেট্রো কনভেনশন সেন্টারে বড় ধরণের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন ফারহানা পল্লব। তৎকালিন ফেডারেল ইমিগ্রেশন মিনিস্টার বিল গ্রাহাম ঐ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। কমিউনিটি ওয়ার্কের জন্য মন্ত্রী পল্লবকে এ্যওয়ার্ড প্রদান করেন। বাংলাদেশ সেন্টার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তার অবদান ছিল অপরিসীম। পরে অবশ্য এই সেন্টারের
কার্যক্রম থেকে পল্লব নিজেকে গুটিয়ে নেন। প্রতিষ্ঠা করেন ওন্টারিও বেঙ্গলী কালচারাল সোসাইটির। এই সোসাইটির পক্ষ থেকে নিয়মিত আয়োজন করেন সাংস্কৃতিক অনষ্ঠানের। বিশেষ করে বিশ্ব মা দিবস পালন করেন বেশ সাড়ম্বরেই।
পল্লব এখানে এসে গ্রাফিক ডিজাইনের উপর কোর্স করে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন প্রায় পনেরো বছর। এখন নিজেই একটি গ্রাফিক
ডিজাইনের প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। তা নিয়ে ব্যাস্ত থাকেলেও কমিউনিটির জন্যেও তার সময়ের কমতি নেই। অন্যান্য কমিউনিটির সাথে মিলে জব ফেয়ারের আয়োজন করে বেশ সাফল্যও অর্জন করেছিলেন। জব ফেয়ারে আসা বাংলাদেশী কমিউনিটির অনেকের চাকরী নিশ্চিত করেছিলেন তিনি।
মাঝে একবার পারিবারিক কারণে ফিরে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। সেখানে উত্তরায় অবস্থিত শান্তা মারিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। বললেন, ভালই ছিলাম কিন্তু বোঝেনই তো মেয়েদের জন্যে সবসময় সব পরিবেশ স্বস্তিকর নয়। তাই আবার ফিরে এলাম। এখন এখানেই তো বাংলাদেশ-মিনি বাংলাদেশ।