প্রবাসী বাংলাদেশীদের গর্ব অমিত চাকমা

কানাডা অনেক ভাল একটি দেশ : এখানে নিজেকে নিকৃষ্ট বা হীন ভাবার কোন কারণ নেই : অমিত চাকমা

নভেম্বর ৮, ২০১৪: প্রফেসর অমিত চাকমা কানাডায় বাংলাদেশীদের কাছে একটি অহংকারের নাম। একটি গর্বের নাম। একটি অনুকরনীয় আদর্শের নাম। তিনি কানাডার ওয়েস্টার্ন ইউনিভারসিটির প্রেসিডেন্ট ও ভাইস চ্যান্সেলর। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে তিনি এই দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি একই পদে। থাকবেন ২০১৯ সাল পর্যন্ত। ২০০৫, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ওয়েস্টার্ন ইউনিভারসিটি কানাডার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পায়। শুধু কানাডায় নয়, গোটা উত্তর আমেরিকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই প্রথম বাংলাদেশি উপাচার্য। তাঁকে নিয়েই প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের এবারের আয়োজন। লিখেছেন প্রবাসী কন্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক খুরশিদ আলম।

অমিত চাকমা একটি অমিত সাফল্যের নাম। অমিত চাকমার মূল নাম অমিতাভ চাকমা। কিন্তু কানাডার লোকজন তাঁর নাম ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারেন না। তাই নিজেই বদলে দিয়েছেন নিজের নাম, হয়ে গেছেন অমিত চাকমা। জন্মের পর যে শিশু সন্তানটির নাম রাখা হয়েছিল অমিতাভ সে শিশুটি যে একদিন বড় হয়ে সত্যি সত্যি অমিতাভ (অমিত আভা বা জ্যোতি যাঁর) হয়ে যাবেন তা কে জানতো? অমিতাভ থেকে অমিত নাম ধারণ করেও তিনি অসীম বা অপরিমেয়ই রয়ে গেলেন সাফল্যের মাপকাঠিতে। অমিত শব্দের অর্থ অপরিমেয়। যাকে মাপা যায় না।

অমিত চাকমাকে আসলেই মাপা যায় না। এত যার সাফল্য, এত যার জ্যোতি সেই অমিত চাকমা কিন্তু একেবারেই মাটির মানুষ। অহংকার নামের শব্দটি তাঁর অভিধানে নেই। অত্যন্ত মিশুক প্রকৃতির দীর্ঘদেহী সুদর্শন এই মানুষটির মুখে সর্বদাই হাঁসি লেগে থাকে।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর অমিত চাকমাকে টরন্টোতে এক নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়। নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল টরন্টো প্রবাসী বাংলাদেশীরা। ইউনিভারসিটি অব টরন্টোর স্কারবরো ক্যাম্পাসের লেকচার থিয়েটারে এই নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়। আগে থেকেই পরিকল্পনা করা ছিল ঐ দিন অনুষ্ঠান শেষে প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেয়া হবে। আয়োজকদের অন্যতম কানন বড়ূয়া সব ব্যবস্থা করে রাখবেন। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষে অটোগ্রাফ আর ফটো সেশন পর্ব শেষ হতেই অনেকটা সময় ব্যয় হয়ে যায়। রাত তখন সাড়ে দশটা। হাতে আর সময় নেই। তাদের ফিরতে হবে লন্ডনে। রাতে আবার ডিনারের আয়োজনও ছিল স্কারবরোর বোম্বে প্যালেস হোটেলে। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো ডিনারের ফাঁকে ফাঁকেই অমিত চাকমার সাক্ষাৎকার নেয়া হবে।

লন্ডন থেকে সড়ক পথে তিন ঘন্টার জার্নি, বিকেল তিনটা থেকে রাত সাড়ে দশটা অবদি একটানা লোকজনের সঙ্গে কথা বলা, দীর্ঘ বক্তৃতা দেওয়া ইত্যাদি কোন কিছুই তাকে ক্লান্ত করতে পারেনি। হোটেলের ডাইনিং রূমে বসেও তিনি অনবরত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছিলেন অত্যন্ত সহনশীলতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে।

ওয়েস্টার্ন ইউনিভারসিটির প্রেসিডেন্ট ও ভিসি নির্বাচিত হওয়ার পর অনুভূতিটা কি ছিল? তাঁর কাছে প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে এটি ছিল প্রথম প্রশ্ন। জবাবে তিনি বলেন, তেমন কোন অনুভূতি ছিল না। তবে প্রথমেই আমার মনে পড়েছিল আমার বাবার কথা। তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন আমার পিএইচডি শেষ করার অল্প কিছু দিন আগে। আমার বাবা আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চই খুব খুশী হতেন।

অমিত চাকমার বাবা প্রভাত কুমার চাকমা ছিলেন সার্কেল অফিসার। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮৭ সালে। অমিত চাকমারা তিন ভাই ও এক বোন। সবার বড় অমিত চাকমা। ছোট দুই ভাইয়ের একজন অরুনাভ চাকমা। থাকেন আমেরিকায়। একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আরেক ভাই স্মরণাভ চাকমা থাকেন টরন্টোতে। স্থানীয় একটি ফর্মাসিউসিটিক্যাল কোম্পানীতে তিনি চাকরী করেন। একমাত্র বোন হ্যাপি চাকমা ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ক্যান্সারে মারা যান।

অমিত চাকমা কানাডায় এসেছিলেন উচ্চতর ডিগ্রি নিতে। তার আগে আলজেরিয়ার বিখ্যাত আলজেরিয়ান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট থেকে ‘রাসায়নিক প্রকৌশল’ বিষয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৮২ সালে। এরপরই কানাডায় চলে আসেন মাস্টার্স ও পিএইচডি করার জন্য। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে রাসায়নিক প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা শেষে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

টরন্টোতে নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অমিত চাকমা ও তার স্ত্রী মীনা চাকমা (বাঁ থেকে ২য়) ছবি: মনির বাবু

অমিত চাকমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল কানাডা আসার পর প্রথম তার কি অনুভূতি হয়েছিল। উত্তরে তিনি জানান, খুব ভাল লেগেছিল। আমি এসেছিলাম গ্রাজুয়েট কোর্সে পড়াশুনা করতে। আমি ভাবতাম কানাডায় খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টরা আসে গ্রাজুয়েট কোর্সে পড়তে। আমি সেই সুযোগ পেয়েছি ভেবে আমার খুব ভাল লেগেছিল।

শৈশবে অমিত চাকমা কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি তেমন মনোযোগী ছিলেন না। তিনি পড়তেন রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। অভিবাবক ও স্কুলের শিক্ষকরা তাকে নিয়ে মোটামুটি হতাশই ছিলেন। তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবেন কি না সেটাই ছিল সবার আশংকা। কিন্তু সকলের আশংকাকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উর্ত্তীর্ণ হন। পরে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ঢাকা কলেজ থেকে। এর পরই শুরু হয় তার বিদেশ যাত্রার পালা। তবে কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতা এবং কিছুটা ভুলের কারণে বিদেশ যাত্রার প্রথম দিকটায় তাঁকে একাধিকবার মত পাল্টাতে হয়েছে তিনি কোন দেশে যাবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে।

অমিত চাকমা বিদেশ যাবেন। উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরবেন বা বিদেশেই থেকে যাবেন, এই জাতীয় কোন চিন্তা বা স্বপ্ন আসলে ছিল না তাঁর শৈশবে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে বন কর্মকর্তা হবেন। রাঙ্গামাটিতে তাঁদের বাড়ির কাছেই ছিল বিভাগীয় বন সংরক্ষকের বিশাল ও সুদৃশ্য বাংলো বাড়ি। হয়তো সেই বাড়িটির সৌন্দর্যই তার কিশোর মনে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। কিন্তু সে তো ছিল শৈশবের কল্পনা। বাস্তবতা যখন সামনে এসে হাজির তখন তিনি যুবক। জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় তখন। দেশেই থাকবেন না বিদেশে যাবেন উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায়?

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর অমিত চাকমা জানতে পারেন ভারত সরকার ফরেস্ট্রিতে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি দিচ্ছে। হয়তো তখনো তার মন থেকে বনকর্মকর্তার হওয়ার স্বপ্ন দূর হয়ে যায়নি। আবেদন করেন তাতে। আবেদনকারীদের মধ্যে তিনি চতুর্থ হন। তবে শুরুতেই জটলা বাঁধে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি ভুলের কারণে তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায় তাঁর নাম। ফলে অমিত চাকমার বনকর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্নটা ধুলায় মিশে যায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবশ্য পরে আরেকটা সুযোগ দেয় তাঁকে। বলা হয়, টেক্সটাইলে একটি বৃত্তি নেওয়ার সুযোগ আছে। এই বিষয় নিয়ে পড়তে চাইলে তিনি ভারতে যেতে পারেন। কিন্তু টেক্সটাইল নিয়েও তাঁর পড়া হলো না। কারণ এরই মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে খনি প্রকৌশলবিদ্যার ওপর আরেকটি বৃত্তি পেয়ে যান অমিত। প্রস্তুতিও প্রায় সম্পন্ন। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেটিও হয়ে উঠলো না। রাশিয়া তাঁর কাছে পছন্দ হচ্ছিল না। মনে মনে তিনি অন্য কিছু খুঁজছিলেন। শেষ পর্যন্ত মিলেও গেল।

তখন মাটির নিচের তরল সম্পদ জ্বালানি তেলের ওপর উচ্চশিক্ষা নিতে বৃত্তি দিচ্ছিল আলজেরিয়া সরকার। সেই বৃত্তিটা পেয়ে যান তিনি। আলজেরিয়া তখন ফরাসিদের উপনিবেশ। ১৯৭৭ সালে আলজেরিয়ান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউটের বৃত্তি নিয়ে সে দেশে চলে যান অমিত। এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাননি অমিত চাকমা। একের পর এক একাডেমিক সাফল্য তাঁকে ক্রমশ নিয়ে গেল সিদ্ধি লাভের চূড়ায়।

কিন্তু এই সিদ্ধি লাভ আপনা আপনিই হয়ে যায়নি। অনেক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে অমিত চাকমাকেও। বোম্বে প্যালেসের ডাইনিং রূমে বসে যখন তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছিল তার মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই তিনি তাঁকে দেয়া নাগরিক সবংর্ধনা অনুষ্ঠানে বলছিলেন, আপনারা অনেকেই আমার কাছে জানতে চেয়েছেন আমার আজকের এই অবস্থানে আমি কি করে পৌঁছেছি। এটি কিন্তু আসলে খুব সহজ পথে হয়ে উঠেনি। আমি যখন পাশ করে বের হই তখন আমাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরীর আবেদন করার পর সেখান থেকে আমার নামে শত শত রিজেক্ট লেটার এসেছে। সেগুলো দেখলে অনেকেই অবাক হবেন। আমার একটি আলাদা বাইন্ডারই ছিল ঐ রিজেক্ট লেটারের জন্য। আমার স্ত্রী ঐ রিজেক্ট লেটারগুলো দেখে খুব হতাশ হয়ে পড়তেন। ঐ রিজেক্ট লেটারের সংখ্যা দেখলে অনেকেরই পাগল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমি হতাশ হয়নি। সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছি। তারই ফলাফল আমার আজকের এই অবস্থান। তাই আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ করবো, ডোন্ট গিভআপ। হতাশ হবেন না।

উল্লেখ্য যে, অমিত চাকমা ওয়েস্টার্ন ইউনিভারসিটি থেকে বছরে বেতন পান ৪৭৯,৬০০.০০ ডলার। অর্থাৎ প্রায় হাফ মিলিয়নের কাছাকাছি।

অমিত চাকমার ইর্ষনীয় সাফল্যের পিছনে রয়েছে অমিত পরিশ্রম। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল ফল করতে হলেও পরিশ্রম করতে হয় অপরিসীম। তার উপর আবার বিদেশে পড়ালেখা। ভাষাও নিজের নয়। পরিবেশও নিজের নয়। কিন্তু এর কোনাটাই অমিত চাকমাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অমিত চাকমা আরো বলেন, প্রথম যখন এসেছিলাম তখন একটু নিরাপত্তাহীনতায় ছিলাম। বাংলাদেশী পরিচয় দিতে একটু সাবধানে দিতাম। এটি নিরাপত্তাহীনতার কারনেই হতো। গরীব দেশ থেকে এসেছি, কে কি মনে করে। তবে একটা সময়ের পর আর সে রকম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিনি। নিরাপত্তাহীনতার ভীতিটাকে পরাজিত করে সোজা হয়ে দাড়িয়েছিলাম। এটি সম্ভব হয়েছে কিছুটা নিজের সাহস সঞ্চয়ের ফলে এবং বাকিটা এ দেশের পরিবেশের কারণে। কারণ কানাডা অনেক ভাল একটি দেশ। এখানে নিজেকে ইনফিরিয়র বা নিকৃষ্ট বা হীন ভাবার কোন কারণ নেই। কানাডা সম্পর্কে অমিত চাকমা বলেন, আমি যখন এ দেশের জাতীয় সঙ্গীত “ও কানাডা”শুনি তখন আমার মনে হয় এটিই আমার দেশ, এটিই আমার জন্মভূমি।

অমিত চাকমার স্ত্রী মীনা চাকমার (ডানে) সঙ্গে কানন বড়–য়া ও জনপ্রিয় শিল্পী শান্তা – ছবি: মনির বাবু

শিক্ষা খাতে ও তাঁর নিজের গবেষণা ক্ষেত্রে নানা অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন একাধিক পুরষ্কার। ৪০ বছরের কম বয়সী যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তাঁদের বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয় কানাডায়। ১৯৯৮ সালে সেই পুরস্কারটি পেয়ে যান অমিত চাকমা। কানাডা সরকার তাঁকে ৪০-এর নিচে সেরা ৪০ বা ‘টপ ৪০ আন্ডার ৪০ অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত করে। চলতি বছর অমিত চাকমা কানাডার সর্ববৃহৎ ব্যাংক রয়েল ব্যাংক অব কানাডার ‘টপ ২৫ কানাডিয়ান ইমিগ্রেন্ট’পুরষ্কারে ভূষিত হন।

অমিত চাকমার গবেষণার মূল বিষয় প্রাকৃতিক গ্যাস প্রকৌশল এবং পেট্রোলিয়াম বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। তিনি পেট্রোলিয়াম রিসার্চ এবং এনার্জি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে খ্যাতনামা একজন বিশেষজ্ঞ। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে তাঁর শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস পৃৃথকীকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, জ্বালানি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, গ্রিন হাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণ কৌশল, এনার্জি ও পরিবেশ সিস্টেম মডেলিং গবেষণায় অন্যতম আগ্রহের বিষয়।

১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগেরির রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপনা করেন। এরপর ইউনিভার্সিটি অব রিজাইনাতে চলে যান। সেখানে রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৯৯ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ইউনিভারসিটি অব রিজাইনার ভাইস প্রেসিডেন্ট রিসার্চ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০০১ সালে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটার লু’র একাডেমিক ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রভোস্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৮ সালে তিনি কানাডিয়ান একাডেমী অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফেলো পদে ভূষিত হন। বর্তমানে তিনি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব কানাডার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ওয়েস্টার্ন ইউনিভারসিটির প্রেসিডেন্ট ও ভিসি হিসেবে অমিত চাকমার লক্ষ্য এই প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের সারিতে পৌঁছে দেওয়া। তিনি অন্টারিও সেন্টার অব এক্সিলেন্সের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের একজন সদস্য । কানাডার সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশন কাউন্সিলের সদস্যও তিনি। একই সঙ্গে কানাডার ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন স্ট্যাটেজি-বিষয়ক উপদেষ্টা প্যানেল কমিটির সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন। কানাডায় উচ্চশিক্ষায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সালে পেয়েছেন কুইন্স ডায়মন্ড জুবিলি মেডেল।

নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং চীনের হুনান, পিকিং ও হুয়াজং বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে ডাক পড়ে তাঁর। ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দিতে যান নিয়মিত। কাজ করছেন কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রায় দেড় শ বিজ্ঞান এবং জ্বালানিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ও সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদ ও উপদেষ্টা হিসেবে।

এত সাফল্যের পরও অমিত চাকমা কিন্তু দেশকে ভুলে যাননি। ফেলে আসা দেশ, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব এদের জন্য এখনো তার মন কাঁদে। প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রথম দিকে সবার জন্যই খারাপ লাগতো। এখনো লাগে। তবে কাজের চাপে যখন ব্যস্ত থাকি তখন তেমনটা মনে পড়ে না। কিন্তু যখন কোন কারণে ইমোশনাল হয়ে পড়ি তখন দেশের গান শুনি।

দেশকে তিনি যে ভুলে যাননি তার আরেকটি প্রমাণ- চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া । সময় সুযোগ পেলেই তিনি ছুটে যান দেশে। বাংলাদেশের বাঙ্গালীরা খুব চমৎকার বলেও প্রবাসী কন্ঠের কাছে মন্তব্য করেন অমিত চাকমা।

পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় কানাডার বর্ণবাদ পরিস্থিতি অনেক উন্নত বলা যায়। কিন্তু তারপরও বর্ণবাদের সমস্যা কিছু কিছু ক্ষেত্রে রয়ে গেছে এখনো এই এদেশটিতে। অমিত চাকমা আজ সাফল্যের শিখরে অবস্থান করছেন। তাঁকে কি সাফল্যের এই শিখরে উঠতে গিয়ে কখনো বর্ণবাদকে মোকাবেলা করতে হয়েছিল এই কানাডায়? এমনি একটি প্রশ্ন ছিল অমিত চাকমার কাছে প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে।

উত্তরে অমিত চাকমা বলেন, সরাসরি কখনো বর্ণবাদের শিকার হইনি কানাডায়। এর প্রধান কারণ আমি বলবো আমার এটিচ্যুড। আমি ধরেই নেই যে, কিছু লোকের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব থাকবেই। ধরা যাক আপনি কোন নতুন দেশে গেলেন এবং সেখানে কোন বাঙ্গালীর দেখা পেলেন। এখন স্বাভাবিকভাবেই আপনি তার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বা আবেগ অনুভব করবেন। একই ভাবে আমি যদি কানাডায় কোন চাকরীর জন্য চেষ্টা করি তবে আমাকে কিছু বাস্তবতার মুখোমুখি হতেই হবে। আমার জন্ম কানাডায় নয়। আমি এখানকার কালচারের সঙ্গে অতটা সম্পৃক্ত নই যতটা এখানে জন্ম নেয়া একজন প্রার্থীর আছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সে কিছুটা বাড়তি সুযোগ পাবেই আমার তুলনায় যদিও আমাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা একই।

অমিত চাকমা আরো বলেন, আমি কানাডায় সরাসরি বর্ণবাদের শিকার হয়নি, তার মানে এই নয় যে বর্ণবাদ এদেশে নেই। এ ধরণের সেন্টিমেন্ট আছে। কিন্তু দেখতে হবে তা কতটা প্রকাশ্যে হচ্ছে। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে বর্ণবাদের শিকার হইনি তার আরেকটা কারণ হতে পারে, আমি কানাডায় আসার পর শুরু থেকেই ইউনিভারসিটির আবহ বা পরিবেশের মধ্যে আছি। সেখানকার পরিবেশ দেশের অন্যান্য সাধারণ এলাকা থেকে একটু ভিন্ন থাকে। সেখানকার লোকজন তুলনামূলকভাবে অন্যান্য সাধারণ এলাকার লোকজন থেকে আধুনিক ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার হয়ে থাকেন।

অমিত চাকমা আজ নিজেই একজন প্রথম সারির ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তারও তো প্রিয় ব্যক্তিত্ব থাকতে পারে। জানতে চাওয়া হয়েছিল প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে। প্রশ্ন রাখা হয়েছিল – আপনার প্রিয় ব্যক্তিত্ব কে?

অমিত চাকমা এর উত্তরে বলেন, আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব অনেক। আমি একজন কাউকে অন্ধভাবে প্রিয় ব্যক্তিত্ব মনে করিনা। আমার কাছে একেক জনের একেক গুণ পছন্দ হয়। কানাডায় আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব যারা আছেন তাদের একজন হলেন টমি ডগলাস যাকে মেডিকেয়ারের জনক বলা হয়। আরো আছেন পিয়ের ট্রুডো যিনি কানাডাকে মাল্টিকালচারাল সোসাইটিতে পরিনত করেছেন। আর বাংলাদেশে প্রিয় ব্যক্তত্ব কে তা আমি ঠিক বলতে পারবো না। কারণ আমি খুব ছোটবেলায় দেশ ছেড়েছি।

প্রবাসে আমাদের একটি আশংকা যে, আমাদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম হারিয়ে যাবে। অর্থাৎ, আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি আমাদের ভাষা এগুলো থেকে তারা অনেক দূরে চলে যাবে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত বা ভাবিষ্যত বানী কি? এটি ছিল অমিত চাকমার কাছে শেষ প্রশ্ন।

অমিত চাকমা বলেন, ইউ ক্যান্ট হেলপ ইট। তবে থার্ড জেনারেশন বা ফোর্থ জেনারেশন হয়তো টোটালি লস্ট হবে না। কিছু কিছু থাকবে। বাট দে উইল বি ডিফারেন্ট। বাংলাদেশের কথাই ধরুন, সেখানে আমাদের জেনারেশন আর আমাদের দাদা নানাদের জেনারেশন কি একই চিন্তাধারার?

তবে তাদেরকে আমাদের মূল্যবোধটা শিখাতে হবে। যেমন লেখাপড়ার গুরুত্বটা তাদেরকে বুঝাতে হবে, শিখাতে হবে কি করে গুরুজনদেরকে শ্রদ্ধা করতে হয়। এগুলো এক জেনারেশন থেকে আরেক জেনারেশনে ট্রান্সফার করা যায়। আর কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো নিয়ে যে কিছু করা যাবে না তা নয়। কিছু কিছু করা যাবে।

অমিত চাকমা বিয়ে করেন ১৯৮৭ সালে। স্ত্রী মীনা চাকমা। হবির মধ্যে আছে বই পড়া, পত্রিকা পড়া, গান শুনা আর সুযোগ পেলে ভ্রমণ করা। রবীন্দ্র সঙ্গীত তার প্রিয়। অমিত ও মীনা দম্পত্তির বড় ছেলে ক্যালিফোর্নিয়ায় চাকরী করেন। ছোটটি এখনো ছাত্র।

শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছিল, সাফল্যের শিখড়ে পৌঁছেও অমিত চাকমা এখনো মাটির মানুষ। মানুষকে তিনি ভালবাসেন। মানুষের মধ্যে জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করাই শিক্ষক হিসেবে তাঁর প্রধান কাজ। গত ১৩ সেপ্টেম্বর তাঁর সম্মানে টরন্টোতে আয়োজিত এক নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে খুব কাছে থেকে দেখা গেছে তিনি মানুষকে কতটা কাছে টেনে নিতে পারেন অত্যন্ত সহজ ও সাবলিলভাবে। গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে তিনি নিজের চারপাশে কোন অদৃশ্য দেয়াল নির্মান করে রাখেননি। সকলের সাথে তিনি হাত মিলিয়েছেন আন্তরিকতার সঙ্গে। ফটো সেশনে অমায়িক হাঁসি হেসেছেন সবার সঙ্গে। মঞ্চে শিল্পীদের পারফরমেন্স দেখে তিনি আবেগআপ্লুত হয়েছেন, নিজের আসন থেকে উঠে গিয়ে প্রতিটি শিল্পীকে আদর আর স্নেহের আলিংগন দিয়েছেন। সকল শিল্পীর প্রসংসায় হয়েছেন পঞ্চমুখ। সাফল্যের শিখরে পৌঁছা একজন মানুষের আর কি গুণ থাকা আবশ্যক?

ছবি : প্রচ্ছদে ব্যাবহৃত ছবি তুলেছেন মুনির বাবু। তথ্যসূত্র : অনলাইন