সিবিসি জরিপে ৭৫ ভাগ মানুষই বলেছেন, কানাডা হলো “সব জাতিগোষ্ঠীর লোকদের স্বাগত জানানোর মত জায়গা।’’
বৈষম্য সম্পর্কে মনোভাব জানার লক্ষ্যে পরিচালিত সিবিসি নিউজের এক জরিপে দেখা গেছে, সমাজে এবং শ্রমশক্তিতে ভূমিকার প্রশ্নে অভিবাসীদের ব্যাপারে কানাডীয়দের মধ্যে সাংঘর্ষিক চিন্তা রয়েছে। ১০ নভেম্বর ২০১৪, প্রকাশিত এক রিপোর্টে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সাল থেকে কানাডায় বিদেশী বংশোদ্ভূত অধিবাসীর সংখ্যা ৬৮ লাখ। এটি কানাডার মোট জনসংখ্যার ২০.৬ শতাংশ। এর ফলে শিল্পোন্নত দেশগুলোর গ্রুপ জি-৮-এ কানাডা সেই দেশ যেখানে সর্বোচ্চ সংখ্যক বিদেশী বংশোদ্ভূত অধিবাসী রয়েছে। অবশ্য অস্ট্রেলিয়াতে এধরণের অধিবাসী রয়েছে আরও বেশি ২৬.৮ শতাংশ। তবে অস্ট্রেলিয়া জি-৮ভুক্ত দেশ নয়।
সিবিসি নিউজের জরিপে অংশ নেয়া ৭৫ ভাগ মানুষই বলেছেন, কানাডা হলো ‘সব জাতিগোষ্ঠীর লোকদের স্বাগত জানানোর মত জায়গা।’’
তবে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে যেমন অর্থনীতির প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তার জবাবেও অধিকতর ভিন্নতা দেখা দেয়।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সারাদেশে ৭৯ শতাংশ বলেছেন, তারা ভিন্ন কোন জাতিগোষ্ঠী থেকে আসা কোন ব্যক্তিকে কাজে নিয়োগ দেয়া বা তার সঙ্গে কাজ করা উভয় ক্ষেত্রেই সচ্ছন্দ বোধ করবেন।
এর চেয়ে অনেক কম সংখ্যক মানুষÑ ৫৫ শতাংশ Ñ ‘‘একমত’’ অথবা ‘‘জোরালোভাবে একমত’’ যে, অভিবাসীরা ‘‘কানাডার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে তোলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’
কিন্তু জরিপে দেখা গেছে যে, ৩০ শতাংশ জবাবদাতা একটি বিষয়ে একদম অথবা জোরালোভাবে একমত যে, ‘‘অভিবাসীরা কানাডীয়দের কাছ থেকে চাকরি ছিনিয়ে নিচ্ছে।’’
অ্যাসোসিয়েশন অব কানাডিয়ান স্টাডিজের জ্যাক জেডওয়াব বলেন, ‘‘বহুসংস্কৃতিবাদ সম্পর্কিত চলমান বিতর্কে ওই দু’টি বিষয় প্রায়শই পরস্পরবিরোধী হিসাবে উল্লেখিত হয়েছে।’’
কানাডা ‘একটি সহজ জায়গা হবে’
সিবিসির এই জাতীয় পর্যায়ের অনলাইন জরিপ পরিচালিত হয় গত ২২ থেকে ২৯ অক্টোবরের মধ্যে। এতে ১৮ বছর বয়সের ১,৫০০ প্রাপ্তবয়স্ক অংশ নেয় যাদের মধ্যে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু লোকজন ছিলো ২৬০জন। জরিপে অভিবাসন ও বহুসংস্কৃতিবাদ থেকে শুরু করে জনগণের ‘‘সাচ্ছন্দ্যের স্তর’’ (পড়সভড়ৎঃ ষবাবষ) পর্যন্ত বিভিন্ন ইস্যু ও দৃশ্যপটের প্রেক্ষিতে অংশগ্রহণকারীদের অনুভূতির পরিমাপ করা হয়। জরিপে নিজেদের কমিউনিটিতে বসবাসকারী এবং কর্মরত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোকেদেরও শরিক করা হয়।
টরন্টোর অ্যাসিউরড অটোমোটিভের গাড়ির মেকানিক কার্থ মোফোর্ড (৩৯) একটি দুর্ঘটনায় পড়া মিনি ভ্যান থেকে রেডিয়েটর খুলে সরিয়ে নিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘উচ্চাভিলাষ রয়েছে এমন যে কারও জন্য কানাডাই হবে একটি সহজ স্থান।’’ (জেমস মারে/সিবিসি)
একই কারখানার কানাডীয় বংশোদ্ভূত ম্যানেজার জাফর সুগ্রিম বলেন, জরিপে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ লোকেদের এই মতের সঙ্গে তিনি একমত যে কানাডাকে হতে হবে সব জাতিগোষ্ঠীর লোকেদের স্বাগত জানানোর মত জায়গা।
তিনি বলেন, ‘‘যত বেশি লোক থাকবে অর্থনীতির জন্য ততই ভালো।’’
কার্থ মোফোর্ড বলেন, তিনি ক্যারিবীয় অঞ্চলের সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রানাডাইন্স থেকে লেখাপড়া করার জন্য কানাডায় আসেন। পরে এদেশকে ভালবেসে ফেলার কারণে এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি বলেন, ‘‘কানাডা খুব ভালো, এটি বহুসংস্কৃতির দেশ, এখানে প্রত্যেকেরই পাওয়ার আছে। উচ্চাভিলাষ রয়েছে এমন যে কারও জন্য কানাডাই হবে একটি সহজ স্থান।’’
অঞ্চলভেদে মনোভাবও ভিন্ন হয়
জরিপে দেখা গেছে যে, ৬৫ শতাংশ মানুষ যখন বলছেন যে ‘‘কানাডার বহুসংস্কৃতিবাদী গঠনপ্রকৃতির জন্য তারা গর্বিত,’’ তখন কানাডায় অঞ্চলভেদে জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি মনোভাব উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন।
উদাহরণস্বরূপ, আটলান্টিক প্রদেশে ৭২ শতাংশ এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ৭৩ শতাংশ মানুষ বলেছে যে, ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কারও সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে তারা সাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। কিন্তু অন্টারিওতে একই ধরণের মনোভাব প্রকাশ করেছে ৬৫ ভাগ এবং কুইবেকে ৬৩ শতাংশ মানুষ।
সালোম সালেহী যখন শিশু তখন ইরান থেকে কানাডায় আসেন। বর্তমানে টরন্টোতে বসবাসকারী মিস সালেহী নিজেকে বর্ণনা করেন কানাডীয়-ইরানীয় বলে। (রবার্ট পার্কার/সিবিসি)
পারিসা দুররানী ও সালোম সালেহী উভয়েই ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। দুররানীর ক্ষেত্রে অবশ্য এটা জরুরী বিষয় যে তিনি এবং তার প্রেমিক আলী হামিদ একই বিশ্বাস লালন করেন। তিনি তার সন্তানদের মধ্যেও তার মূল্যবোধ ও বিশ্বাস সঞ্চারিত করার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, ‘‘আপনি আপনার সঙ্গীর সঙ্গে একই বিশ্বাস লালন করেন এটা জানলে অনেক কিছুই অনেক সহজ হয়ে যায়।’’
অন্যদিকে বাবা-মার সঙ্গে ইরান থেকে কানাডায় আসা সালোম সালেহী তার নিজ বিশ্বাসের বাইরের একজনকে বিয়ে করেছেন, যাকে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী ইংরেজ জার্মান আমেরিকান কানাডিয়ান। তার যুক্তি, ‘‘আমি জানি, এটি একটু জটিল, কিন্তু আপনার নিজের ধরণে এটি অনেকটা নিকটাত্মীয়দের মধ্যে সন্তান জন্মানোর মত।’’
আটলান্টিক প্রদেশে ৮৬ শতাংশ মানুষ বলেছেন, ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কেউ তার সেরা বন্ধুকে বিয়ে করলে তিনি সাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। কিন্তু প্রেইরি অঞ্চলে একই ধরণের মন্তব্য করেছেন ৭১ শতাংশ মানুষ।
ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ৭২ শতাংশ মানুষ কানাডার সাংস্কৃতিক কাঠামো নিয়ে গর্বিত হওয়ার বিষয়ে ‘‘একমত’’ অথবা ‘‘জোরালোভাবে একমত’’ বলে মত দিয়েছেন। কিন্তু কুইবেক প্রদেশে এই বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন মাত্র ৫৭ শতাংশ লোক।
অঞ্চলভেদে মনোভাবের ভিন্নতার আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো, উপকূলীয় অঞ্চলের ৮৬ শতাংশ মানুষ বলেছে যে, তারা ‘‘সচ্ছন্দ’’ বা ‘‘অত্যন্ত সাচ্ছন্দ্য’’ বোধ করবেন যদি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কোনও মানুষ তাদের প্রতিবেশি হিসাবে আসেন। এদিকে প্রেইরি অঞ্চলের ৭২ শতাংশ লোক একইরকম মতামত দিয়েছে।
জরিপের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্ঘাটন ছিলো সাধারণভাবে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোকদের প্রতি মনোভাবের তুলনায় আদিবাসী (ধনড়ৎরমরহধষং) জনগণের প্রতি মানুষের মনোভাবের বিষয়টি। সমীক্ষায় দেখা গেছে, সার্বিকভাবে ৭৯ শতাংশ মানুষ প্রতিবেশি হিসাবে আদিবাসীদের চেয়ে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে পেলে ‘‘সাচ্ছন্দ্য’’ বা ‘‘অত্যন্ত সাচ্ছন্দ্য’’ বোধ করবেন। অন্যদিকে পাশের বাড়িতে আদিবাসী মানুষ পেলে সাচ্ছন্দ্য বা অত্যন্ত সাচ্ছন্দ্য অনুভব করবেন ৭৫ শতাংশ মানুষ।
বিভিন্ন অঞ্চলে এসব বিষয়ে মানুষের মনোভাব আবার বিভিন্ন রকমের। অন্টারিওতে ৮০ ভাগ লোক বলেছেন তারা আদিবাসীকে প্রতিবেশি হিসাবে পেলে সাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন বা অত্যন্ত সাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। প্রেইরি অঞ্চলে এধরণের মানুষের সংখ্যা মাত্র ৬১ শতাংশ।
২০১১ সালের পারিবারিক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, কানাডায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা ১৪ লাখ এবং এদের বেশিরভাগই অন্টারিও ও পশ্চিমের প্রদেশগুলিতে বসবাস করে।- সিবিসি
ডিসেম্বর ১, ২০১৪