জোর করে বিয়ে দেয়ার বর্বরতা বন্ধ করতে হবে

জোর করে বিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে কানাডা কঠিন আইন করতে যাচেছ। গত ৫ নভেম্বর কানাডার ইমিগ্রেশন মন্ত্রী ক্রিস আলেকজান্ডার পার্লামেন্টে এ বিষয়ে একটি বিল উত্থাপন করেছেন। মন্ত্রী বলেন, যারা কানাডায় আসতে চান তাদের কাছে আমরা এ বিষয়ে সুষ্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিতে চাই যে এ দেশে কারো মানবাধিকার লংঘন মেনে নেয়া হবে না। এ বিষয়ে কানাডা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করবে।

ক্রিস আলেকজান্ডার বলেন, কানাডায় যে সকল মেয়ে বা মহিলা ইমিগ্রেন্ট হয়ে আসবেন তাদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যই এই আইন।

উল্লেখ্য যে, কানাডায় ইমিগ্রেন্ট মহিলাদের অল্প বয়সে জোর করে বিয়ে দেয়ার একটি সংস্কৃতি বহুদিন ধরেই চলে আসছে। এতে করে মহিলাদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যাসহ নানান পরিবারিক ও সামিজিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করার জন্যই নতুন আইনের প্রস্তাবনা।

ইমিগ্রেশন মন্ত্রী ক্রিস আলেকজান্ডারের এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কারণ, জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া যে কোন অর্থেই একটি অমানবিক আচরণ। মানবাধিকারের লংঘনতো বটেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কানাডার মতো একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক দেশেও অনেক পরিবারে মেয়েদেরকে জোরপূর্বক বিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। কানাডায় এর বিরুদ্ধে সুষ্পষ্ট কোন আইন নেই বলে এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ মানুষ আরো সুযোগ পাচ্ছে। ‘ডযড়/ওভ/ডযবহ ঃড় গধৎৎু’ শিরোনামের রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে অন্টারিওতে জোর করে বিয়ের ২১৯টি ঘটনা ঘটেছে। এতে আরো দেখা যায়, নারী ও পুরুষ উভয়কেই জোর করে বিয়ে দেয়ার মত ঘটনা ঘটছে। তবে শতকরা ৯২ভাগ ক্ষেত্রে এর শিকার হয় নারীরা। এধরণের বিয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের শতকরা ২৫ জনের বয়স মাত্র ১৬ থেকে ১৮ বছর।

রিপোর্টে বিয়ের জন্য চাপ দেয়ার অনেকগুলি কারণ চিহ্নিত করা হয়। সাধারণত পরিবারের সদস্যরা, সমাজের বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং ধর্মীয় নেতারা এধরণের বিয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করে থাকেন। চাপ সৃষ্টির বিভিন্ন কারণের মধ্যে রয়েছে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, পারিবারিক সুনাম ও সম্মান রক্ষা ইত্যাদি। আর প্রায়শ চাপের শিকার নারী বা পুরুষকে সহিংসতার অর্থাৎ মারধরের হুমকি দেয়া হয়।

আমরা মনে করি, নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেয়া যে পরিবার বা সমাজের সংস্কৃতি, যারা এই সংস্কৃতিকে পরিবারের ঐতিয্য ও সম্মান রক্ষার প্রক্রিয়া মনে করেন তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেদেরকেই অসম্মান করেন। লাঞ্ছিত করেন মানবাধিকারকে।

লক্ষ্য করা গেছে যে, কানাডায় সাউথ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত অনেক ইমিগ্রেন্ট পরিবারের অভিবাবকগণ গোপনে তাদের পরিবারের মেয়েদেরকে জোর করে বিয়ে দেন বা দেয়ার চেষ্টা করেন। কানাডায় সম্ভব না হলে কৌশলে নিজ নিজ মাতৃভূমিতে নিয়ে গিয়ে জোর করে বিয়ে দেন। তাদের যুক্তি বা আবেগ হলো, তাদের পূর্ব পুরুষেরা এ কাজটি করেছেন, তাই তাদেরকেও এ কাজটি করতে হবে। অথচ একবারও ভেবে দেখেন না এ কাজটি কতটা অমানবিক। আর এ অমানবিক সিদ্ধান্তটি তারা চাপিয়ে দিচ্ছেন নিজের অতি আদরের কন্যাসন্তানটির উপর! আরো আশ্চার্যের বিষয় হলো, এই অমানবিক সিদ্ধান্তের পক্ষে পরিবারের মহিলা অভিবাবকরাও সমর্থন দেন! এর আরো কারণ হলো, জোর করে বিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে এখানে সচেতনতারও অভাব রয়েছে। অন্যদিকে সরকারও বিষয়টি নিয়ে এতদিন মনোযোগী হয়নি।

অনুন্নত বা গরীব দেশে অধিকাংশ মেয়েদের আর্থিক স্বাধীনতা থাকেনা। থাকেনা শিক্ষা। ফলে সেখানে এই অমানবিক আচরণকে মাথা পেতে নিতে হয় নারীদেরকে। কিন্তু একটি শিক্ষিত সমাজে এসেও যখন কোন কোন পরিবারের পশ্চাৎমুখি আচরণ বদল না হয় তখন তা নিতান্তই দুঃখজনক। আমরা জানি, বর্তমান বিশ্বের কোন সভ্য সমাজে জোর করে বিয়ে দেয়ার এই নীতির প্রচলন নেই। কারণ জোর করে বিয়ে দেয়ার অনেক কুফল আছে। জোর করে দেয়া বিয়ে বেশিদিন টিকেও না। ফলে মহিলাদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যাসহ নানান পরিবারিক ও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। আর এর ব্যয়ভার বহন করতে হয় সরকারকে তথা জনগণের টেক্স মানিকে। সুতরাং বেদনাদায়ক এবং একই সাথে উদ্বেগজনক এই বিষয়টির বিরুদ্ধে যত দ্রুতসম্ভব ব্যবস্থা নেয়া যাবে, ততই তা সমাজ রাষ্ট্র ও পরিবারের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

জানুয়ারী ১, ২০১৫