উদ্বেগ কাটিয়ে ওঠা: কানাডায় নবাগতদের জন্য সহায়ক কিছু টিপস
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : অভিবাসন এবং উদ্বেগ হাত ধরাধরি করে চলে। এক দেশ থেকে অন্য একটি দেশে স্থানান্তরের সময়টা প্রায়শ তেমন মসৃণ হয় না যেমনটা বেশিরভাগ অভিবাসী আশা করেন।
আপনি একজন নতুন অভিবাসী এবং কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়ে খুবই উদ্বেগপূর্ণ মনোভাব নিয়ে তার মোকাবিলা করে যাচ্ছেন। আপনার জন্য সুখবর এই যে, আপনি কিন্তু এই মুহূর্তে একা নন এবং এই মুহূর্তটি হতে পারে নিছক সাময়িক একটি বিষয়। আপনি যখন নতুন দেশে স্থায়ী হবার চেষ্টা করবেন এবং নতুন ভূখণ্ডের সংস্কৃতি, পরিবেশ ও মূল্যবোধের সঙ্গে অধিকতর পরিচিত হতে থাকবেন, তখন আপনার উদ্বেগের পরিমাণ কমে আসবে এবং আপনি আপনার নতুন বাড়িতে অধিকতর সাচ্ছন্দ্য বোধ করতে শুরু করবেন।
নবাগতদের উদ্বেগের কারণ
কানাডায় নবাগতদেরকে প্রাথমিক পর্যায়ে অবশ্য অনেক কঠিন ও কষ্টকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ কয়েকটি হলো:
প্রয়োজন মেটানোর মত একটি চাকরি
কয়েক মাস আগে এদেশে নতুন আসা একটি পরিবার আমার কাউন্সেলিং অফিসে এসেছিলো, কারণ তারা ছিলো চরম মানসিক চাপে ভুগছিলো। ওই দম্পতির দুটি বাচ্চা আছে এবং তারা উভয়েই ছেড়ে আসা নিজের দেশে উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্ন পেশাজীবী ছিলেন। তারা ভেবেছিলেন যে, যেহেতু তারা কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারের দক্ষ শ্রমিক শ্রেণিতে অভিবাসনের জন্য আবেদন করেছেন সেজন্যে তারা কানাডায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ পেয়ে যাবেন। তারা যখন উপলব্ধি করলেন যে, তাদের আগের শিক্ষাগত সনদ কানাডার মান অনুযায়ী উন্নয়ন না করা পর্যন্ত তা এখানে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না তখন তারা ভয়ানক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
কানাডায় এসে বেশিরভাগ অভিবাসী তাদের কর্মজীবন নিয়ে এই একই ধরণের পরিস্থিতিতে পড়েন যা তাদের জন্য মানসিক চাপ ও উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। আর যদি তারা তাদের ওই পরিস্থিতিতে কোনও সুরাহার পথ খুঁজে না পেলে অনেকেই আবার নিজের স্বদেশে ফিরে যাবার কথা ভাবেন।
ভাষাগত বাধা কাটিয়ে ওঠা
অনেক অভিবাসী বিশেষ করে উদ্বাস্তুরা কানাডায় তাদের নতুন জীবন শুরু করতে গিয়ে উৎকণ্ঠায় পড়েন ভাষাগত বাধার কারণে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষায় যোগাযোগ করার অক্ষমতা মানসিক চাপ ও বিচ্ছিন্নতার কারণ। নতুন অভিবাসীদের জন্য বিনামূল্যে ইংরেজি শেখার ক্লাস করার সুযোগ দেয়া হলে সেই শিক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়া তাদের জন্য অধিকতর চাপের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে একইরকম চাপে থাকা অন্যদের দীর্ঘ তালিকার কারণে।
সাংস্কৃতিক আঘাত
ভাষা ছাড়াও অনেক সময় এমন দেশ থেকে অনেক অভিবাসী আসেন যাদের দেশের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ কানাডার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার সিরিয়া, পাকিস্তান, ভারত ও অন্যান্য দেশের খদ্দের আছেন যারা বলেন যে, নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া সহজ নয়। বিশেষ করে বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা নতুন দেশে তাদের সন্তানদের সুষ্ঠু জীবন গড়ে তোলার বিষয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন।
আবহাওয়ায় অভ্যস্ত হওয়া
কানাডা হলো বিশ্বের অন্যতম শীতল দেশ। অনেক সময় অপেক্ষাকৃত উষ্ণ আবহাওয়ার দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য এখানকার অবহাওয়ায় খাপ খাওয়ানো কঠিন হয়ে পড়ে বিশেষ করে যদি তারা শীতের সময় ঠান্ডার মধ্যে এদেশে এসে পৌঁছেন। আবহাওয়ার চরম অবস্তার কারণে তারা যদি সহজে চলাফেরা করতে না পারেন তাহলে সেটি তাদের এদেশে আসার লক্ষ্য অর্জনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
সামাজিক সমর্থন না হারানো
নতুন অভিবাসীদের উদ্বেগের আরেকটি বড় কারণ হলো নিজের দেশে সামাজিক সমর্থনের যে কাঠামো ছিলো তা হারিয়ে ফেলা। কানাডায় নবাগতদের সহায়তার জন্য অনেক পরিষেবা থাকলেও সেগুলো খুঁজে পাওয়া ও গ্রহণ করার মত জানাশোনা না থাকা গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দেয়।
আর্থিক সঙ্কট
সবশেষে বলি, আর্থিক সঙ্কট ঝগড়াঝাটির বিরাট কারণ হতে পারে। তারা নিজের দেশ থেকে যে অর্থ নিয়ে আসে তা বুঝে ওঠার আগেই ফুরিয়ে যায়। যখন অর্থেসঙ্কট তাদেরকে উদ্বিগ্ন করে তোলে তখন চাকরিদাতাদের কাছ থেকে আবেদনের জবাব না পাওয়াটাও কেবল আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে।
উদ্বেগ বহুগুণ বেড়ে যায়
নবাগতরা এরইমধ্যে যেসব উদ্বেগের মুখোমুখি হয়েছেন উপরের উল্লিখিত সেই সবগুলো কারণই আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে যখন তারা
এখানে আসার মূল লক্ষ্যগুলো পূরণের দিকে এগুবেন। অর্থাৎ যখন স্বাস্থ্যসেবার জন্য আবেদন, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া, আবাসনের জায়গা খোঁজা, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করা এবং এরকম আরও অনেক কাজ করতে এগিয়ে যাবেন।
উদ্বেগ থেকে বাঁচতে কিছু টিপস
এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, অভিবাসীরা যখন কানাডায় নতুন তখনই তাদের উদ্বেগ চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকে। যাই হোক, নিচের টিপসগুলো অনুসরণ করলে তা উত্তরণের সময়ে তাদের জন্য সহায়ক হতে পারে।
উদ্বেগের কারণটি জানুন
আপনার উদ্বেগের কারণটি যদি জেনে ফেলেন তাহলে আপনি এ বিষয় নিয়ে পর্যায়ক্রমে এবং পদ্ধতিগতভাবে কাজ শুরু করতে পারবেন। উদ্বেগকে উপেক্ষা করবেন না কারণ এটি স্বাস্থ্যগত অন্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
কাজের তালিকা তৈরি করুন
নবাগত হিসাবে আপনাকে যেহেতু অনেকগুলো বিষয়ে মনোযোগ দিতে হচ্ছে তাই কাজের একটি তালিকা বা দৈনিক কাজের পরিকল্পনা তৈরি করে উদ্বেগ কিছুটা কমিয়ে ফেলতে পারেন। আপনার মস্তিষ্ক যখন বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত সে সময় আপনি গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয়ও ভুলে যেতে পারেন যা উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
চেষ্টা অব্যাহত রাখুন
যখন কোনও কাজই আপনার আশানুরূপ হচ্ছে না তখন অভিবাসীরা অনেক সময় হতশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। এধরণের অসহায়তার অনুভূতি এমন অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে যখন কোনওকিছুই করতে ইচ্ছে করে না, যার পরিণতিতে উদ্বেগ আরও বাড়তে পারে। এধরণের অনীহা এড়িয়ে যাবার মূল চাবিকাঠি হলো সামনে এগিয়ে যাওয়া, কোনভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া বন্ধ করবেন না।
যে শিক্ষা অর্জন করলেন তা উদযাপন করুন
কানাডায় এক দু’মাস এমনকি কয়েক মাস কাটানোর পরও যদি আপনি বেকার, অস্থিতিশীল এবং মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন তাহলে সময়টাকে ঘুরিয়ে দিন এবং খেয়াল করে দেখুন এই সময়ের মধ্যে আপনি কি কি শিখেছেন। এযাবৎ যা কিছু শিখেছেন তা উদযাপন করুন। মনে করে দেখুন এখানে আসার প্রথম দিনগুলোতে আপনি বাসে চড়া, গ্রোসারি শপে যাওয়া, কোনও ক্লিনিক বা লাইব্রেরিতে যাওয়া ইত্যাদির কোনওটিই করতে পারতেন না। দেখুন, এসব কাজ করতে পারার কারনে আপনি যদি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তাহরে আপনার সময়গুলো ভালোভাবেই কেটেছে। আপনি নিজেকে ব্যর্থ বলতে পারেন না; নতুন একটি দেমে প্রতিটি নতুন দিন আপনার জন্য নতুন শিক্ষা নিয়ে আসে, সুতরাং এসবের জন্য কৃতজ্ঞ বোধ করুন।
সাহায্য চান
আপনার চাহিদা ও উদ্বেগের বিষয়গুলো অন্যদের জানাতে সংকোচ করবেন না। প্রয়োজন হলে সাহায্য চান। প্রতিবেশী ও বন্ধু, ধর্মীয় পরামর্শক বা অভিবাসীদের বন্দোবস্তকারী প্রতিষ্ঠানের পরামর্শকের কাছে যান।
স্বেচ্ছাসেবক
স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজের সুযোগ খুঁজে নিন। এতে করে আপনার কাজ পাওযার সম্ভাবনা বাড়বে এবং কানাডার কর্মস্থল সম্পর্কে জানার মাধ্যমে আপনার উদ্বেগ কমাতে সহায়ক হবে। আপনি নতুন বন্ধু বানাতে পারবেন এবং আপনার পরিচিতদের নেটওয়ার্ক প্রসারিত হবে।
উদ্দীপনামূলক বই পড়ুন
আপনার জন্য সহায়ক অথবা অনুপ্রেরণাদায়ক বইপত্র পড়ুন। উদ্বুদ্ধ করার মত বিষয়গুলো পাঠ করলে তা আপনার উদ্বেগ কমাতে এবং আপনার আস্থা ও আত্মসম্মান বাড়াতে সহায়ক হবে।
ইতিবাচক মানুষদের মধ্যে থাকুন
যারা আপনার উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেয় সেইসব নেতিবাচক লোকেদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। তার বদলে যারা আপনাকে উৎসাহ দেয়, আপনাকে সাহায্য করতে চায় তাদের সঙ্গে চলাফেরা করুন এবং জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করুন।
সাময়িকী লিখতে শুরু করুন
আপনার চাপ ও উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে ব্যক্তিগত রোজনামচা লিখতে শুরু করুন। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাগুলো লিখে ফেললে তা আপনার এগিয়ে চলা অব্যাহত রাখার বিষয়ে স্বচ্ছতা দেবে। আর যখন আপনি সত্যি এখানে থিতু হয়ে যাবেন তখন কানাডায় আপনার নতুন জীবনের ঘটনাবলী পাঠ করলে আপনার মুখে কৃতজ্ঞতার এক মধুর হাসি ফুটিয়ে তুলবে।
– সৌজন্যে : কানাডিয়ানইমিগ্রেন্ট.সিএ