শৈশব স্মৃতি
শুভ্রা শিউলী সাহা
দিনের ক্লান্তি শেষে চোখে ঘুম নামলেই দেখি মা এসে বলে – সীমু তোর হাতের লেখা একেবারে পড়ার অযোগ্য, কতবার বলি অক্ষরগুলো পরিষ্কার করে লেখ। বাবা বলে আদর্শ লিপিতে পড়িস নি – হস্তাক্ষর সুন্দর হইলে পরীক্ষায় অধিক নম্বর পাওয়া যায়। সামনে বৃত্তি পরীক্ষা প্রায় ভোর হয়ে এলো, উঠে পড়তে বস- ভোরের বেলা পড়লে মনে থাকে রে। যে চাষা আলিস্যি ভরে বীজ না বপন করে পক্ব শস্য পাবে সে কোথায়? তোর দাদা বৃত্তি পেয়েছিল, তুই না পেলে তোর মা তো অনেক কষ্ট পাবে।
দামোদরের পারে আমাদের কাঠের দোতলা ঘরের জানালা দিয়ে দেখতাম কত নৌকা চলা। দরজায় কড়া নেড়ে ডাক পিয়ন ডাকতো- হীরা লাল বাবু বাড়ি আছেন। দৌড়ে গিয়ে নিতাম আমার দাদার বিদেশ থেকে পাঠানো চিঠি বা টেলিগ্রাম। চিঠি পেলে বাবা মা কি যে খুশী হত। কত বার করে যে পড়তো। প্রথম লাইনে থাকতো – পূজনীয় মা, প্রণাম নিও। আমার একটু হিংসা আর অভিমান হতো। ভাবতাম বাবা মা বুঝি দাদাকে বেশি ভালোবাসে। মা বাবা আমরা তিন ভাইবোন, আত্মীয়, পাড়া পড়শীদের নিয়ে বড্ড সাধারণ, সহজ, সুখী জীবনধারা। সেই কবেই কৈশোরক, শৈশব কে পেছনে ফেলে এসেছি। এখন আমি আমাদের পিরোজপুরের সেই বসত ভিটা থেকে কত হাজার হাজার মাইল দূরে। সেখানে কেউ আর আমাকে নাম ধরে চিৎকার করে না।

মনে হয় এই তো সেদিন পিরোজপুরের উত্তর পাড়া প্রাইমারি স্কুলে পরতাম। সেই বিজয় স্যার আমাদের হেড মাস্টার ছিল, খুব কড়া। একদিন সকালে না গেলে বাড়ি বাড়ি এসে খোঁজ নিতেন সন্ধ্যা বেলা, পড়াশোনা ছাত্ররা করে কিনা। বীরেন স্যারের হাতে বেত থাকতো, অঙ্ক না পারলে মাইর একটাও নীচে পরতো না। মনের মাঝে হাজারো কথা উঁকি দেয়। স্কুলের সামনে ডাঁসা ডাঁসা পেয়ারা আর বড় বড় আমড়া এখনো কি বিক্রি করে? আমাদের রাজারহাটে এখনো কি সপ্তাহে দু-দিন হাট বসে ? ব্রীজ এর নীচে খালের পারে আমাদের ঘরের কাছে অনেক নৌকা এসে থামে কি? বরুণ সাহার দোকানের সামনে কত লোক সাপের খেলা দেখিয়ে ওষুধ, মাদুলি, গাছ গাছড়া বিক্রি করে কি এখনো? প্রতি রবিবার আমাদের পাড়ায় হাট বসতো। সকালে নাম মাত্র স্কুলের পড়া টুকু সেরে মাকে কোন মতে বুঝিয়ে বেরিয়ে যেতাম হাট এ- সাপের খেলা, ওষুধ বা তাবিজ/ মাদুলি বিক্রির জমায়েত এ ওদের গান, নাচ, যাদু, ভেলকি বাজি দেখতে। কীভাবে ওরা কথা বলে লোক জড়ো করতো সেটা দেখতে ভালো লাগতো।
রায়েরকাঠীর ভাংগাচোরা জমিদার বাড়িটার সামনে আজও কি মেলা বসে? দেখতাম ধুপ আর চিনির বাতাসা কিনে মহাদেবের পাটে পুজো দিত সবার নামে নামে। পূজারি বলতে – ‘ধুপ দেও ধুপতিতে, ধুপে কর বর যার নাম জানি, যার নাম না জানি ভোলা মহেশ্বর’। আমাদের পাড়ায় মাটি দিয়ে কুমির বানিয়ে বাস্তু পুজো হত। মহা প্রসাদ আর খিরাই বেশ খেতে। পাল পাড়ায় এখনো কি ঠাকুর বানায়? সরস্বতী পুজোয় প্রতিমা আনতে এখনো কি সবাই যায়? সব সকুলে সকুলে কি নিমকি মিষ্টি প্রসাদ দেয় এখনো? বড় একটা রিজার্ভ পুকুরের পাশদিয়ে সাধনা ঔষাধালয়ে যেতাম আমার মায়ের সাথে তার থেকে একটু দূরেই সরকারী হাসপাতাল কি আছে? তার পাশেই ছিল আমার মায়ের অফিস- সমাজ কল্যাণ সরকারী অফিস। একটাকা রিক্সা ভাড়া ছিল, আমি আমার মায়ের অফিসে হেঁটেই যেতাম। আখড়ায় গেলে এখনো কি নকুলদানা দেয়? কালি বাড়িতে এখনো কি বছরে একবার নাম কীর্তন হয় ? কালি ঠাকুরের ঘরে সাপ ছিল, কাউকে কিছু করতো না। সোনাই ঠাকুরের নাম শুনেছো ,গুনে সব অজানা বলে দিতে পারতো।
রামকৃষ্ণ মিশনে শ্যামা পুজোর সময় কি ভাল শ্যামা সংগীত হত- কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন…। কি ভাল কবির লড়াই।
সে সময়ে আমার দাদা বলতো তোকে আমরা কুড়িয়ে পেয়েছি তাই তুই ফরসা আর আমি কালো আর আমি সেটা বিশ্বাস করে কত মন খারাপ করতাম সবাই কে বলতাম। অরুণ টেইলরের এর দর্জির দোকান আছে কি। পুজোর সময় মাপ দিয়ে ছিট কাপড়ের জামা বানাতে যেতাম। বলাই মামার মিষ্টির দোকানে ঐ রকম বড়বড় রসগোল্লা আর ছানার জিলাপি কি বানায়? স্মৃতি যেন বেদনার রংয়ে রংয়ে ছবি আঁকে। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। শনপাপড়ি, লাল হলুদ আইসক্রিম ওয়ালার হাঁক কানে বাজে। সিনেমার এ্যাডভার্টাইজে যে বাজনাদাররা বাজাতো তাদের মধ্যে একজন খুব ভাল সানাই বাজাতো।
আমাদের পাড়ার পুতুল দি, ডলি দি টেলিভিশনে গাইতো। তখন পদ্ম বাবুর বাসায় সাদা কালো টিভি ছিল, মাঝ মধ্যে দেখতে যেতাম। মনে আছে সকুলে অসিতা দিদিমনি গান শেখাতেন। কবিতা দি গাইতো ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ’ কি মিষ্টি কণ্ঠে। জানিনা ভোর বেলায় আমাদের উঠোনে বকুলী বৈষ্ণুবী আর আসে কিনা। গায় কিনা – রাই জাগো গো, শ্যামের মনমোহিনী বিনোদিনী। কার্তিক মাস শেষে মাকে এসে বলতো- সেবার জন্য ভিক্ষা দেও গো। যাদের সাথে বিকেলে খেলতাম তারা কি আছে ওখানে? কল্যাণী খুব জোরে দৌড়াতে পারতো তাই ওকে বৌচি খেলায় বউ বানাতো। ‘আমি যাব আকাশে জল খাব গ্লাসে’ এসব কি কি বলতে বলতে অন্যদের তারা করতাম আর এ সুযোগে বউ পালাতো। আমি করতাম খেলাঘর। ২১ শে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরিতে এখন কারা গান গায়? ক্ষমা দাস গুপ্তা রেডিওতে গান গাইতো। টাউন হলে এখনো কি জুয়েল আইচ দাদু দেখাতে আসে? অমর সাহার কথা মনে আছে? প্রথম আলেতে দারুণ লিখতো।
আমাদের গার্লস স্কুলে যাবার পথে কৃষ্ণচুরা গাছটা মনে হয় এখনো আছে। রাস্তার ধারে তালের শাঁস কেটে এখনও বিক্রি করে কি? বাজারে মিষ্টি আখ কেটে কেটে বিক্রি করে নিশ্চই? সেসময়ে আমাদের পরি দি চালতার আর আমের আচার বানাতো গুড় দিয়ে। মা চালতার ডাল রান্না করতো। রানীদি আম মাখালে পারার সবাইকে দিত ঘুরে ঘুরে। সেকি কালবৈশাখী ঝর, কত বারির চাল উড়িয়ে নিত। আষাঢ়ে সেই রকমের অঝর ধারায় বৃষ্টি। শ্রাবনে নদীটাতে সে কি স্রোত। হুলারহাট যাবার রাস্তাটা ঐ যেখান থেকে ঢাকা যাবার ইস্টিমার ছাড়তো, রিক্সায় ছায়াঘেরা পথ দিয়ে যেতে কি ভাল লাগতো। ঐ দিকেই মুক্তকেশী বা ছায়াঘেরাছায়াঘেরা
মার যে কত খেতাম মায়ের হাতে। কত যে দস্যিপনা করতাম, গরমের দিনে ডুবাতাম। বন্ধুদের সাথে আড়ি ঝগড়া -ছি! ছি! কিনা করতাম। তুষার দাদা আমাকে কি কি বলে খেপাত, আমার একটু একটু রাগ হত তবে কিছু বলতাম না। তারা সব ভাই বোন লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল। শুধু ওরাই না পাড়ার সব ছেলে মেয়েরাই খুবই মনোযোগী ছিল। আমাদের স্কুল গেটের উপর ছড়িয়ে থাকা সাদা- গোলাপি মাধবীলতা, শান বাঁধানো পুকুর পার এখনো চোখে ভাসে। মনে হয় এই তো সেদিন স্কুলের নজরুল জয়ন্তীতে গাইতাম- মোরা আকাশের মত বাঁধাহীন.. চিত্ত মুক্ত শতদল।
বিকেলে মাঠে খেলতে গিয়ে আমার নতুন বাটার জুতো জোড়া ফেলে এসেছিলাম। রাতে ঘুমাতে গিয়ে মনে পড়ল আর তখন তো আনার উপায় ছিল না – সেখানে রাতে ভূত বেড়াত। কষ্টে রাতে আর ঘুম আসছিল না কখন সকাল হবে। বকা খাওয়ার ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারছিলাম না। ভোর বেলা পুজোর ফুল তোলার ডালি হাতে সেই জুতো খুঁজতে গেলাম এবং পেলাম। সে চামারার জুতো আর ফ্রক কিনে দিয়েছিল আমার দাদা যখন খুব ছোট বেলায় বাবার সাথে প্রথম ঢাকায় এসেছিলাম। দাদা তখন ঢাকায় পড়ে। পরদিন বাবা গিয়েছিল অফিসের কাজে হেড অফিসে আর আমার বায়নাতে দাদা নিয়ে গিয়েছিল চিড়য়াখানা দেখতে, আর সেদিন দাদার ছিল প্রচণ্ড জর। ও একটা গাছের নিচে বসেছিল আর আমি একা একা পুরো চিড়িয়াখানা ঘুরে ওর কাছে আবার ফেরত এসেছিলাম।
ভোরে দাঁত মাজতে মাজতে আমাদের পাড়ার পারুল পিসিমার বাড়ির পুকুর ঘাটে যেতাম। পিসিমা দেখলেই লাল আউশ চালের ফেনা ভাত, বেগুন ভাজি,নতুন আলু সেদ্ধ দিয়ে খেতে দিত। কখনো বা চিতই পিঠা নারকেল গুঁড় দিয়ে খেতে দিত। উঠোনের কুল বড়ই আর পেয়ারা গাছটাও ছিল দারুণ। ডাঁসা পেয়ারা ভেতরে লাল, পাড়ার দস্যি ছেলেদের অত্যাচারে পিসিমা আমার জন্য লুকিয়ে রেখে দিত বলতো নে ধর তোর বাবাকেও দিস কিন্তু। বিকেলে তোদের বাড়ি যখন যাবো তোর চুল বেধে দেবো। ওদের জাম গাছটা বয়সের ভারে পুকুরের দিকে নুয়ে পরেছিল তাই গরমের দিনে রোজ পুকুরে সাঁতার কেটে স্নান করার সময় জাম খেতাম পেট ভরে। পুকুরের পাড় বসে কেউ কেউ আবার বড়শি ফেলে পুঁটি মাছ ধরতো। মাঝে মধ্যে মা এসে তাড়া করে টেনে তুলতো, ঘণ্টা খানেকের কমে উঠতাম না। আমি একা না তো, সঙ্গে আমার পাড়ার অন্যসব বন্ধুরাও থাকতো।
পিসিমার মেজো মেয়ে অন্জুদি ভীষণ পড়ুয়া ছিল, যখনই যেতাম দেখতাম সে পড়ছে তবে আমরা ছোটারা দুষ্টামি করলে কোন বকা দিত না। তবে মাঝে মধ্যে অনেক ঝাল দিয়ে আম মাখাত। মা বকা দিত টক খাবি না, গলা নষ্ট হয়ে যাবে। মায়ের খুব শখ ছিল আমাকে আমাকে গান শেখানোর, গানের মাস্টার দিয়ে অনেক চেষ্টা করেছিল বটে কিন্তু আমাকে দিয়ে গান হলো না। পরীদি দেখতাম আচার শুকাতে দিত আর দেখা হলেই চালতা- বরইয়ের আচার কিংবা নারকেলের নাড়ু হাতে দিত। সকাল থেকে সন্ধ্যা বাড়িতে কত ধরনের লোকজনের আনাগোনা ছিল, কখনোই একা লাগতো না -গ্রাম থেকে সাইকেল করে আসা দুধওয়ালা, চাল, মুড়ি, চিড়ে, সবাই বাড়িতে দিয়ে যেত। ফেরি করে যারা বিক্রি করতে আসতো বাদাম বাহার, শনপাপড়ি, আইসক্রিম আরও কত কি, দেখা হলেই বলতো ভালো আছিস তো মা?
স্মৃতির ভেলায় চড়ে শৈশব কে খুঁজে ফেরা। স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে যাই শৈশবে আর আনন্দে ভাসি। জীবনের এ প্রান্তরে এসে আমার মত সবারই কি শৈশবের স্মৃতি গুলো মনের মাঝে উকি দেয়? আজও সেই স্মৃতির জালনা খুলে বসে থাকি… মাতৃভুমির ঋণ মনে হলে চোখ জলে ভরে যায়।
শুভ্রা শিউলী সাহা
টরন্টো