মহান ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী

শৈলেন কুমার দাশ

“হে নূতন,

দেখা দিক আর – বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।।

তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন

সূর্যের মতন।”

এই অপূর্ব সৃষ্টিশীলতা আর সুরের মাধবী মিলন যার গানের মুগ্ধতর চয়নে, তাঁর এই অনুপম সৌন্দর্য্যের সুর মেশানো গানের মাধুরিমা দিয়েই শ্রদ্ধাঞ্জলির কুসুম কলি অর্পণ করছি আজ সেই মহান সাহিত‍্য রুপকার বাংগালীর প্রাণের কবি; বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪তম জন্মজয়ন্তীর শুভক্ষণে। আঁধার নাশিতে, করিতে পরাভব দূর, গ্লানি অহংকার করে বিদুরিত সাজাতে নুতন জীবন, মঙ্গল আরতীতে ঢাকিয়া কুহেলিকা নবীণ স্বপ্ন সুন্দরে সাজাতে দিবসের প্রথম কিরণ আজ বড়ই প্রয়োজন তোমার, হে মহান সুন্দরের স্রষ্টা ভালোবাসার আর অনুরাগের স্রষ্টা মহান বিশ্বকবি! অশান্ত অবণী অঙ্গণে শান্তির বারিধা বর্ষিত হোক তোমার সুরে গানে। মানবিক প্রেমের হাসি হাসুক মানুষের অন্তরে অন্তরে। শান্তির বিমল সমীরণে স্নিগ্ধ হোক দশদিক। প্রাণের কোণে ছড়িয়ে যাক প্রীতির দীপালি নব নব জ‍্যোতির বর্ণালী আলোকে। হাসুক ধরিত্রী আবারও মধুর মিলনে, মনের গহনে প্রীতির ছন্দে ছন্দে। এই প্রত‍্যাশার সূচি স্নিগ্ধ অপরূপ লাবণ‍্যে সাজিয়ে মন প্রণমী তোমায় অমিয় সৌরভে, শ্রদ্ধার মাধবী গৌরবে। প্রাণের শত বীণায় শ্রদ্ধার মাধুরী আঁকা মনের দখিণা অঙ্গনের হাজারো প্রীতির রংগে সাজানো আজ আমার এ লেখার অঞ্জলি শুধু তোমারই তরে।

“কথায় মাধুর্য, কর্মে কল‍্যানবোধের ব‍্যঞ্জনা, চোখে প্রীতির প্রভা আর আচরণে সুরুচির সামগ্রীক লাবণ‍্যই সংস্কৃতি।” যার  অপূর্ব এই সুন্দর উক্তি দিয়েই আজ হরেক গুণের বিচিত্র মিলনে সাজানো এই মহান কবি, সাহিত‍্যিক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, ছড়াকার, সুরকার, গায়ক, নাট‍্যকার, অভিনেতা, দার্শনিক, সামাজ সংস্কারক, রাজনীতিক, জমিদার, শিল্পী এবং সর্বোপরি এক অপূর্ব সুন্দর মানবিক মানুষকে স্মরণ করছি অনন্ত প্রীতিতে ও অনন্ত শ্রদ্ধায়।

“আমাদের প্রাণের বীণায় মিশে আছেন সুরের সৌন্দর্য্যে, নব নব ভাবনা ও শব্দমালার মাধবী রংগে, চিন্তার ললিত‍্যময় মাধুর্য‍্যে, কর্মের নবীন সুন্দর প্রেরণায়, কঠিন সময়ে সাহসের রাঙ্গা পলাশ হয়ে আর অনুরাগে নবীণ প্রেমের ময়ূরী হাসি হয়ে! তিনি ফিরে আসেন আমাদের প্রাণের দেবতা হয়ে আমাদের মাঝে বারে বারে শত ভাবনা, চিন্তা, সংগীত, কবিতার বর্ণালী শব্দ চয়নে, অনুপম শিল্পকলার মাধুরী সুন্দরের ভাঁজে ভাঁজে আর নিরুপম সুন্দরের আলপনায় মোড়া শৌর্য‍্যে-সাহসে এবং বজ্র কঠিন প্রেরণায় ও উদ‍্যমে !” তাইতো তিনি আমাদের সখা, মিত্র, পাত্র, বন্ধু এবং একান্ত আপনজন। সুসময়ে, অসয়মে এবং কঠিন সময়েই তিনি আমাদের পাশে পাশে থেকে পথ দেখান অবলীলায় দুস্তর গিরি, কান্তার, মরু পাড়ি দিতে। জয় করতে কঠিন পথ। তিনি আমাদেরকে হাত ধরে নিয়ে যান প্রত‍্যাশার দিগন্তে যেখানে নবীণ আলো পরশ বুলায় আপন মমতায়। তিনি জাগিয়ে তোলেন আমাদেরকে শত রাগে, অনুরাগে; বিহর বেদনায় পলাশের রাঙ্গা হাসি হয়ে জেগে উঠতে। তাইতো তিনি আপন অজান্তেই লিখেছেন সেই অমিয় গীত। সাজিয়েছেন অপরুপ প্রাণোহরা সুরে।

“আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে বসন্তের বাতাস টুকুর মত, সে যে ছুঁয়ে গেল নুয়ে গেল রে ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত।”

তিনি শততই আমাদের অজান্তে, আনমনে শত কুসুম ফুটিয়ে দিয়ে যান আমাদের মনে, চিন্তায়, ভাবনায়, আমাদের কর্মের হাজারো প্রেরণায়!

হাজারো সমস‍্যায়, শংকায় তিনি আমাদেরকে নবীণ উদ‍্যমে পথ চলতে, নবীণ স্বপ্ন দেখতে শেখান। শক্তি প্রেরণার বাণী রুপে সেই পরম শক্তিকে জাগিয়ে তোলেন তিনি আমাদের মনে। যার অপূর্ব  সৃষ্টির বাণী ও সুরে তারই প্রকাশ সেই গানে।

“তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে, এসো গন্ধে বরণে এসো গানে।”

আমরা সত‍্যি তাঁর প্রেরণায় সমস‍্যা সংকুল পথে নব নব রূপে সেই পরম শক্তিকে মনে ধারণ করে নব নব রূপে জেগে উঠি। শত নব সুন্দর চিন্তার পসরা বসে আবার জীবন পথের বাঁকে বাঁকে।

আজ ২৫শে বৈশাখ, ১৪৩২। আমাদের প্রাণের কবি,  বিশ্বমানবতার কবি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪তম জন্মজয়ন্তী। এ দিনটি শুধু একটি জন্মদিনের সীমারেখার বন্ধনে আবৃত নয়। এই শুভদিন বা তিথি বাঙালী জীবনের চেতনা, ভালোবাসা ও সংস্কৃতিতে জড়িয়ে থাকা এক বিশেষ দিন! বাঙ্গালী হৃদয়ের মাধবী আলপনায় আঁকা, উৎকর্ষ চেতনা ও ভালোবাসার উৎসব। বাঙ্গালী  হৃদয়ের ভালোবাসার বর্ণে বর্ণে আঁকা শ‍্যামলী ছবি। অনুরাগ আর অনুভূতির শীতল পরশ মনের মাধবী দখিণা হাওয়ায়।

ব্রিটিশ উপনিবেশিক নিপীড়ন থেকে মুক্তির তরে বাঙ্গালী নবজাগরণের অগ্নিঝরা দিনে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেন স্বাধীনতাকামী মানুষের মনে আশার প্রদীপ্ত শিখা। বাংলা সাহিত‍্য, সংস্কৃতি, সমাজনীতি ও রাজনীতির দশদিকে বিচরণকারী এই কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সুরস্রষ্টা, চিত্রশিল্পী, দার্শনিক ও নোবেল লরিয়েট হয়ে উঠেন ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের চিন্তা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক জাগরণের জ‍্যোতির্ময় মহাপুরুষ, মহাকবি। সাহিত‍্যে নোবেল বিজয়ের পর হয়ে উঠেন বিশ্বসমাজের আদৃত আলোচনার বিষয়। অবলীলায় স্হান করে নেন তিনি বিশ্বমানবের মনে। এক্ষেত্রে স্বপ্নীল সোনালী আসর বসিয়েছে সসম্মানে তাঁর সাহিত‍্যকর্ম বিশ্ব আসরে। বাংলা সাহিত্যের এক নতুন বর্ণালী দিগন্তের আসর সেজে উঠেছে তাঁরই বিশ্বনন্দিত সাহিত‍্যকর্মের সোনালী পথ ধরে। তাঁর লেখায় দেদীপ্যমান হয়েছে যেমন প্রেম, পূজা, আরাধনা, স্রষ্টার শক্তির প্রতি বিনম্র নিবেদন, আত্মনিবেদন, প্রকৃতি ও জীবন, তেমনি স্হান পেয়েছে মানবতা, বিদ্রোহ, আত্মোন্নয়ন ও জাগরণের গভীর আহবান, সম্প্রীতি ও স্বদেশ গড়ার মন্ত্র এবং বিশ্বজনীনতা।

তিনিই বাংলা মায়ের সোনার ছেলে ও প্রথম বাঙালি কবি যিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়ে বিশ্ব আসরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে গৌরবময় স্থানে অধিষ্ঠিত করেন। দিকে দিকে প্রজ্বলিত করেন বাংলা সাহিত‍্যের বর্ণালী দীপশিখা। বিশ্ব আসর জানতে পারে বাংলা সাহিত‍্যের উন্নত লীলাভূমি! বিশ্ব আসর সম্মানের সাথে উৎকর্ষ বাংলা সাহিত‍্যের গুণমহিমা প্রচার করতে থাকে। তাঁর সাহিত‍্যে নোবেল বিজয়ের সেই শুভবর্ষ ১৯১৩ থেকে বাংলা সাহিত‍্য বিশ্ব আসরে আলোচনায় উজ্জ্বল হয়ে  উঠে।

তাঁর লেখা ” জনগণমন-অধিনায়ক অধিনায়ক জয় হে” ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে অনন‍্য সম্মানের সাথে গৃহীত হয়েছে। যেদেশে প্রায় ১২২ টি প্রধান ভাষা এবং ১৫৯৯টি অন‍্যান‍্য ভাষা রয়েছে। সে দেশে একজন বাঙ্গালী কবির লেখা সংগীত জাতীয় সংগীত হিসাবে স্হান করে নেয়া সত‍্যি এক অসাধারণ ও অসম্ভব কাজ বলতে হবে! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের লেখা “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। 

রবীন্দ্রনাথ সমাজ, রাজনীতি, ভারতবর্ষের মর্যাদার প্রতি কতটুকু দৃঢ়সংকল্প ছিলেন তা কয়েকটি ঘটনা বর্ণনা করলেই বুঝা যায়। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার রবীন্দ্রনাথের অনন‍্য প্রতিভার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাঁকে ব্রিটিশ রাণীর অতি সম্মানিত ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশরাজ কতৃক নীরিহ মানুষদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই  উপাধি পরিহার করেন। এ ই অনুভূতি তাঁর দেশের ও দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের প্রতীক। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সংগীতের উন্নয়নের জন‍্য ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন। তাতে এই মহান মানুষের মানসে দেশ ও মানুষের প্রতি গভীর মমতাই প্রকাশ পায়। ১৮৬৩ সালে (১২৭০ বঙ্গাব্দে) পিতা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহের কাছ থেকে দু’টি ছাতিম গাছসহ ২০ একর জমি বার্ষিক ₹৫ (ইউএস$ ০.০৬) ইজারায় কিনেছিলেন। সেখানে তিনি একটি অতিথিশালা তৈরি করে নাম রেখেছিলেন “শান্তিনিকেতন” (শান্তির স্থান)। ক্রমশ সমগ্র এলাকাটি শান্তিনিকেতন হিসেবে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ এই প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্বখ‍্যাত বিদ‍্যানিকেতনে পরিনত করেন। শান্তিনিকেতনের প্রতিটি ধূলিকণার সাথে রবীঠাকুরের নাম ও স্মৃতি একাকার হয়ে মিশে আছে। এই প্রতিষ্ঠানটি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া ব‍্যাপী সাহিত‍্য অনুরাগী, সংগীত পিপাসু উন্নত সংস্কৃতিজন সৃষ্টিতে অনন‍্য ভূমিকা রেখেছে। আজ এই ধারা সমগ্র বিশ্বে বিস্তৃত ও সমাদৃত।

আজ এই  শুভদিনে আমরা পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি বিশ্বকবি ও মহান মানুষটিকে। যিনি আমাদের সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতিকে করেছেন  উজ্জ্বল; করেছেন অমর। স্বদেশের গন্ডি পেরিয়ে নিয়ে গেছেন বিশ্ব আসরের জ্ঞানতীর্থে!

শতবর্ষ পরে আজও রবীন্দ্রনাথ জীবন্ত! স্বমহীমায় উজ্জ্বল তাঁর সাহিত‍্যে, সংগীতে, সৃষ্টিশীল চিন্তায় ও দর্শনে মানুষের মননে। রয়েছেন তিনি চির উজ্জ্বল হয়ে আমাদের প্রতিদিনের সুশীল কর্মে, চিন্তায়, অনুভবে, আর সৃষ্টির শত অনুপ্রেরণায়!

জন্মজয়ন্তীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি বিশ্বকবিকে!

শৈলেন কুমার দাশ

ক্যালগারি, কানাডা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *