আনন্দঘন ও প্রীতিময় উচ্ছাস নিয়ে ক্যালগারিতে উদযাপিত হলো বাংলা নববর্ষ ১৪৩২

শৈলেন কুমার  দাশ : এক অভূতপূর্ব, আনন্দঘন, প্রীতিময় উচ্ছাস, অপূর্ব মিলনের শত রঙের ধারায় আর সুরের এক মোহনীয় আয়োজনে উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ এর এক শ্যামস্নিগ্ধ সন্ধ্যা। ১৯শে এপ্রিল শনিবার মুগ্ধময় সন্ধ্যায় “বৈশাখী উল্লাস” নামে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশি সোসাইটি  অব ক্যালগারি (বিএসসি)।

অপরূপ স্নিগ্ধতায় ভরা আলবার্টার রকি মাউন্টেনের পাদদেশে গড়ে উঠা তিলোত্তমা নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ‘এসটোরিয়া ব্যাঙ্কোয়েট হলে’ অনুষ্ঠিত হয় প্রীতির আলপনায় সাজানো সুরের এই স্নিগ্ধ বর্ষণ ধারা। এক হাজার আসন বিশিষ্ট সুসজ্জিত এই হলে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। আলোর বর্ণিল দীপাঞ্জলী আর অগণিত সুন্দর মানুষের বর্ণময় পোষাক এবং প্রাণের স্পন্দনে সুরের ধারায় স্নিগ্ধ আনন্দের শান্ত মিলনমেলায় পরিনত হয় এই নান্দনিক হল রুম।

অত্যন্ত দক্ষতা আর মমতার সাথে বিএসসি এর কর্মকর্তারা আলোকসজ্জা, সাউন্ড সিস্টেম এবং আসন বিন্যাসের কাজটি সম্পন্ন করেন। হল রুমের প্রধান ফটকে টিকেট প্রদান ও বিভিন্ন কেটাগরির ব্যাজ পড়ানোর কাজে নিপুণ দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন যারা তাঁরা হলেন আনিসুর রহমান, রবিন রউফ, রিয়াজ মুর্শেদ, শান্তা নওরিণ, শৈলেন কুমার দাশ, শাহানারা খাতুন এবং জয়িতা।

অতিথিদের সহাস্যে বরণ করে নেওয়া হয় লুমিনারি, স্পনসর, ভিআইপি এবং জেনারেল ক্যাটাগরির টিকেটের মাধ্যমে।  শিশুদের জন্য ছিল টিকেটবিহীন প্রবেশাধিকার।

বোর্ড অব ডিরেক্টর, লুমিনারি এবং স্পন্সরদের জন্য আকর্ষণীয় নেম ব্যাজসহ অন্যান্য ক্যাটাগরির বিভিন্ন রঙের আকর্ষণীয় হ্যান্ড ব্যাজ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শিশুদের সাথে সম্পর্ক বিনির্মাণ এবং তাদের স্নেহের পরশে বিএসসি কর্মকর্তাদের বরণ ছিল চোখে পড়ার মত। এমন আপ্যায়ন পরিবারবর্গের চোখে প্রীতির ধারা ঝিলিক দিয়ে যায় ক্ষণকালের জন্য। যা আগামীদিনে বিএসসি ‘র কম্যুনিটি সম্পর্ক বিনির্মাণে রঙিন প্রীতির পসরা সাজাবে অনিবার্যভাবে।

হলরুমের ভিতরে অতিথিদের আপ্যায়ণ করে নির্ধারিত আসনে নিয়ে যাওয়ার আন্তরিক দায়িত্ব পালন করেন কনক চৌধুরী। মিজ চৌধুরীর হাস্যোজ্জ্বল অভিব্যক্তি সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে।

অনুষ্ঠানে নগরীর সম্মানিত কম্যুনিটি  সদস্যবৃন্দের সাথে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় এমপি জর্জ চাহাল এবং স্থানীয় এমএলএ মাইলস ম্যাকডোগাল। অতি হাস্যোজ্জ্বল ও আন্তরিক এই দুই নেতা বাংলাদেশি কম্যুনিটির এত লোকের প্রাণবন্ত উপস্থিতিকে অবিশ্বাস্য ও অভিনব বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেন বাংলা নববর্ষ বরণ ১৪৩২ উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংগীতের “বৈশাখী উল্লাস” আপনাদের আরও বেশী করে কম্যুনিটি এনগেজমেন্ট ও ডেভেলপমেন্টে ভূমিকা রাখবে। সেজন্য ভুয়সী প্রশংসা করেছেন আয়োজক বিএসসি ‘র দক্ষতা ও নেতৃত্বের প্রতি। এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখায় তাঁদের সহযোগিতাও অব্যাহত থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন তাঁরা।

অনুষ্ঠানে বিএসসি ‘র পক্ষ থেকে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ডিরেক্টর ডা. আলী আশরাফ লস্কর। তিনি তাঁর বক্তব্যে বাঙ্গালী জীবন ও সংস্কৃতিতে বাংলা নববর্ষের অবদান তুলে ধরেন। বাংলা সংস্কৃতির প্রাঞ্জল ও মাধুর্যপূর্ণ রুপের ধারা বর্ণনা করেন। সংগীত ও শিল্পকলায় সাজানো বাঙ্গালী জীবনের প্রীতিময় অভিনব দিক তুলে ধরেন। তিনি আমন্ত্রিত কম্যুনিটি সদস্য ও অতিথিদের উদ্দেশ্যে বলেন আপনাদের উপস্থিতি আমাদের অনুষ্ঠানকে আলোকিত করেছে। আপনাদের বিশাল উপস্থিতি আমাদেরকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। এই উপস্থিতি ভবিষ্যতে এমন অনুষ্ঠান অব্যাহত রাখার জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে।

বিএসসি ‘র উদ্ভব, বিকাশ ও এর কর্মধারা নিয়ে সুন্দর আলোচনায় অংশ নেন ড. আল ইমরান নিক্কণ এবং হাসান আব্বাস। তাঁরা ক্যালগারি নগরীতে বাংলাদেশি কম্যুনিটির ক্রমাগত বিস্তৃতির কারণে এ ধরনের সংগঠনের একাধিক প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশি কম্যুনিটিকে কম্যুনিটি লাইফে সম্পৃক্তকরণ, বিকাশ ও উন্নয়নে বিএসসির কর্মধারা অব্যাহত থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানে সঞ্চালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন মাহবুবুল হক খোকন।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব উপস্থিত শ্রোতৃমন্ডলী ও অতিথিদের অপেক্ষার পথ ধরে বর্ণিল আলোকে আলোকময় হয়ে উঠে। বেজে উঠে সুরের সুরধ্বনি শক্তিশালী কনসার্টের মধুময় সুরে। মঞ্চে আসেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত দুই গীটারিস্ট এবং একজন বাদ্যযন্ত্র বাদক। তাঁদের ত্রয়ী মিউজিক বর্ষণের সুর ধরে মঞ্চে আসেন প্রিয় গীটার হাতে নিয়ে অতি আকাঙ্খিত সংগীত তারকা বাপ্পা মজুমদার এবং এলিটা করিম। সবার সাথে নিজেদের পরিচয়পর্ব সেরে নিয়ে ও শুভেচ্ছা বিনিময় করে সংগীতের মূল মঞ্চে প্রবেশ করেন তাঁরা। সুরের মধুময় স্রোতস্বিনী এক ঝর্না যেন সুরে সুরে ঝংকার তুলে প্রবাহিত হতে থাকে এই সুসজ্জিত হল রুমের প্রান্ত দিয়ে। বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পী বাপ্পা মজুমদার প্রিয় গীটারে অনবদ্য সুর তুলে একের পর গাইতে থাকেন “আমি তোমার জন্য এনে দেব মেঘ থেকে”, “তুমি চোখে রাখ চোখ”, “গাড়ি চলে না”, “তোমার বাড়ির রঙের মেলায়”, “আজ কেন মন উদাসী হয়ে”, “জীবন কাটে যুদ্ধ করে”, “কেমন করে সইব আমি”, “তুমি আমার বায়ান্ন তাস”, “আগে যদি জানতাম”, ” আমি তোমাকেই বলে দেব”, “বন্ধু তোরে খুঁজে বেড়াই”, “না জানি কোন অপরাধে”, “কারা যেন ভালোবেসে”, “তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম”, “আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে” এবং সহশিল্পী এলিটা করিমও অসাধারণ সুরে গাইতে থাকেন “আমার ময়না বউ”, “আমি ফিরে পেতে চাই আমাকে”, “সোনা দিয়া বান্ধাইয়াছি ঘর”, “তোমার জন্যে আমার এত”, “বিরহ বরষায় মেঘের ইশারায়” এবং আরও কিছু গান। দুই শিল্পীর সুরের মায়াজালে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েন হল রুমে প্রায় বার শ’য়ের অধিক শ্রোতা।

সুবর্ণ সাজে সজ্জিত নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর, যুবক ও যুবতী এই অঙ্গনে যেন আনন্দের দখিনা হাওয়ায় দোল খেতে থাকে। মোবাইল ফোনে লাইভ সম্প্রচার, ভিডিও ক্লিপ ও নিরন্তর ছবি তোলা হল রুমকে অন্য এক সুন্দরের মাত্রা দান করে। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে তরুণ তরুণীরা এগিয়ে আসেন মঞ্চের দিকে এবং গানের সাথে সবাই মনকাড়া নাচে মেতে উঠেন যা গীটার ও পারকিউসনের সুর মেশানো গানের সাথে নাচের এক মাধবী প্রহর রচনা করে। দুই গীটারিস্ট ও পারকিউসনিস্টের শক্তিশালী সুরের মূর্ছনা এবং সেই সাথে দুই শিল্পীর যুগল কণ্ঠের সুরের আবেদন সবার মনে ছড়িয়ে দিয়ে শেষ হয় রাত সাড়ে দশটায়। সুরের শেষ আবেশ ছড়ানো পর্যন্ত সবাই নিজ নিজ আসনে বসা ছিলেন। পরে শিল্পীদ্বয় রিফ্রেস হয়ে আসলে অনেকেই তাঁদের সাথে ফটোসেশনে অংশ নেন। রাত সাড়ে এগারটায় এই সুরের আসরের পরিসমাপ্তি ঘটে আগামীদিনে এমনি সুন্দর সুরে সুরে সাজানো আলোকজ্জল অনুষ্ঠানের প্রত্যাশা রেখে।

অনুষ্ঠান থেকে ফিরে গিয়ে MLA Myles McDougall এর অফিস বিএসসি ‘র একজন ডিরেক্টরকে SMS পাঠিয়ে অনুষ্ঠান সম্পর্কে যেভাবে তাঁদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন তা নিম্নরূপ: Thank you for the video, links and photos, dear Shailan Kumar Dash! What an incredible event! The energy was amazing, the photos captured the magic perfectly, and the audience was absolutely electric. Truly unforgettable! MLA অফিসের এই SMSই প্রমাণ করে বিএসসি আয়োজিত এই অনুষ্ঠানটি ছিল সফলতার শীর্ষে। যা বিএসসি ‘র পরিচালকদের কর্মদক্ষতা ও কম্যুনিটির প্রতি কমিটমেন্টের এক অনন্য প্রকাশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *