নিভৃতে
রীনা গুলশান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ফাবিয়ান বাড়িতে পৌঁছানো মাত্রই নানীর মুখ তো ঝলমল করে উঠলো। কি করবে, কি খাওয়াবে বুঝেই পাচ্ছে না। বেশ রাতে তার অবসর হলো। ফাবিয়ান তার ঘরের বালিশ নিয়ে নানীর কাছে শুতে এলো। কতকাল নানীর গায়ের গন্ধ পায় না। নানীকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করলো। আমান্ডা হাসে আর বলে-
: কিরে? ব্যাপার কি? ভাবসাবতো ভালো মনে হচ্ছে না? কারণ, তোকে তো চিনি? ছোটবেলা থেকে দেখছি তোর যখনই কিছু দরকার হয় তখনই আদরের বহর বেড়ে যায়!
: কি যে বলনা নন্না, কত দিন পর তোমাকে কাছে পেলাম।
: সে তো ঠিকই, এবারে তো প্রায় ৪ মাস পর এলি!
: কি করবো বল, শেষ সেমিস্টার, তাছাড়া থিসিসের কাজ এবং একই সঙ্গে ডিফেন্স দিয়ে তারপর এলাম। সকাল থেকে কখন রাত পৌঁছেছে তাই-ই বুঝিনি।
: হ্যাঁ, তাইতো বলি এবারে খুব রোগা হয়ে গেছিস!
: কি যে বল, তুমি আর কবেই বা আমাকে স্বাস্থ্যবান দেখলে?
: তা ফাবি, তোর মাকে তো অনেক দিন ফোন করিসনি! সারা সেদিন ফোন করে খুব কাঁদছিল। তুই ফোন করিস না। এমনকি সে করলেও তুই কেটে দিস!
: তা কি করবো! তার কি সময় জ্ঞান আছে। দেখা গেল আমি তখন আমার থিসিস গাইডের সাথে আলোচনা করছি তার ফোন তখন আসলো!
: তা অবশ্য ঠিক।
: অনেক রাত হলো নন্না এখন ঘুমাও।
পর দিন সকালে নাস্তা খেয়ে প্রথমেই গেল রোডিকা আন্টি আর কেভিন আঙ্কেলের সাথে দেখা করতে। আর ডোরিন তো আছেই। ডোরিনের জন্য খুব সুন্দর একটা গিফট এনেছে।
রোডিকা আর কেভিনতো ওকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করলো। রোডি তো চেচামেচি শুরু করলো-
: ওরে বাব্বা, আমার ছেলেটাতো অনেক সুন্দর হয়েছে! তারপর কি খবর কি বল? বল? তোর মিউজিক, গান।
: আহা, ওকে একটু ঠান্ডা হতে দাও- তারপর সব খবর নাও।
ওদিকে ডোরিন সমানে অসহিষ্ণু উঁকিঝুকি মারছে। কেভিনের চোখে সেটা ঠিকই পড়েছে।
: কিরে ডোরিন এদিকে আয় মা।
: না, আমার কাজ আছে। তখন ফাবিয়ান নিজেই সরি বলে ডোরিনের কাছে যায়।
: ডোরিন কি খবর তোর?
: আমার আবার কি খবর?
: কি ব্যাপার খুব রেগে আছিস মনে হচ্ছে!
: না, রাগবে না- গত ৪ মাসে ক’বার ফোন করেছো শুনি?
: কি করবো বল, থিসিস ডিফেন্স এসব নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। আচ্ছা এখন চল একটু লেকের পাড়ে যাই, কথা আছে।
ওরা দুজন সেই ছেলেবেলার মতন হাত ধরাধরি করে লেকের পাড়ে যায়। অনেকক্ষণ দুজনে কোন কথাই বলে না। প্রকৃতির নির্জনতা ওদেরকেও চুপ করিয়ে দেয়। ফাবিয়ান আবার ছেলে বেলার মতন একটা কাগজের নৌকা বানিয়ে লেকে ভাসিয়ে দিল এবং অপেক্ষা করলো, কত দূর ভেসে যায়। তারপর খুব মজা করে ডোরিনকে বললো-
: চোখ বন্ধ কর।
: কেন? বলেই আবার চোখ বন্ধ করে।
ফাবিয়ান পেছন থেকে একটা ‘ডোরিন’ লেখা ১৮ ক্যারেটের যিরঃব মড়ষফ-এর নেকলেস পরিয়ে দেয়।
: এবারে চোখ খোল।
ডোরিন চোখ খুলে স্বচ্ছ পানিতে তার ছায়া দেখে তারপর খুশিতে রীতিমতো চিৎকার করে ওঠে-
: ওমা! কি সুন্দর ফাবি- এত সুন্দর ডিজাইন।
: তোমার ভালো লেগেছে?
: দারুন, দারুন- এত চমৎকার ডিজাইন আমি কখনো দেখিনি।
: ধন্যবাদ। তোমার ভালো লাগলেই আমার কষ্ট সার্থক।
: কিন্তু, এত দামী হার- এটাতো সোনার মনে হচ্ছে ফাবি।
: হ্যাঁ ডোরিন, এটা সোনারই। যিরঃব মড়ষফ—। দামী তো অবশ্যই, তবে তোমার থেকে কোন দিক দিয়েই মূল্যবান নয়।
: বাব্বা! আজকাল যে সাহেব খুব কথা বলতে শিখেছে। কি ব্যাপার বলতো? কোন খবর আছে নাকি?
: খবর? নাহ্- কিসের আবার খবর?
প্রায় ১৫/২০ দিন হয়ে গেল ফাবিয়ান না নানী, না ডোরিন- কাউকেই বলতে পারছে না। রোজই কোন না কোনভাবে চেষ্টা করছে। এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেল। একটা মেঘলা বিকেলে জেসন আর রায়ান তার বাসায় বেড়াতে এলো। ওরা তিনজন লেকের পাড়ে চলে গেল। একটু পর ডোরিনও ওদের দলে যোগদান করলো। ওরা ছেলেবেলার মত হৈ হৈ আড্ডায় মেতে উঠলো।
হঠাৎ জেসান ডোরিনকে বললো-
: ডোরিন তোর পাখীতো উড়ছে রে।
: মানে কি?
: কেন, তুই কিছু জানিস না?
: নাতো? কি ব্যাপার বলতো? ঢং করিস না।
: না বাবা, ফাবিয়ান যখন বলেনি তখন আমি এর মধ্যে নাই।
: এই ফাবি, কি ব্যাপার? জেসন এসব কি বলছে?
: না মানে, ঐ আমরা সবাই মিলে অনেক আগে কানাডা যাবার জন্য আবেদন করেছিলাম- জাস্ট ফান করে। ওটা হয়ে গেছে।
: হয়ে গেছে, মানে কি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
ডোরিনের মুখ একদম ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তখন ফাবিয়ানও বেশ নার্ভাস হয়ে যায়। রায়ান তখন হাল ধরে। তারপর গত চার বছর ধরে ইমিগ্রেশনে যা সব হয়েছে, রায়ান একটু একটু করে সব বললো। এমনকি আর ২ মাসের মত সময় আছে তাও বলতে ভুললো না। সব শুনে ডোরিন চুপ মেরে গেল। একটিও কথা বললো না। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে উঠে চলে গেল।
: মরেছি, এখন কি হবেরে রায়ান? জেসন তুই তো ফাটালি, এখন আমি কি করি?
: তুই হারামজাদা এখনো বলিসনি তোর গার্লফ্রেন্ডকে তা আমি কি করে জানবো? আর আমাকে উল্টা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত যে শেষ পর্যন্ত আমিই সব বললাম।
: হ্যাঁ ঠিকই বলেছে জেসন, সম্মতি প্রকাশ করলো রায়ান। দ্যাখ ফাবিয়ান ভালোবাসার মানুষের কাছে কিছু লুকানো উচিত নয়! তুই কাজটা মোটেই ঠিক করিসনি দোস্ত।
: আরে আমি এখনো নন্নাকেই কিছু বলিনি।
: সে কিরে? মোটে আর দু’মাস, এখনো টাকার যোগাড় করলি না!
একটু একটু করে রাত নামে। ওরা ঘরে ফেরে। বাড়িতে এসে দেখে নানী রান্না ঘরের বারান্দাতে মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছে। ফবিয়ান দেখলো তার চোখ দুটো জবা ফুলের মত লাল হয়ে আছে। বুঝলো ডোরিন নন্নাকে সব বলে দিয়েছে। ফাবিয়ান এসে নানীকে জড়িয়ে ধরলো। বললো-
: নন্না, সব রবার্ট করেছে। আমি তো ভাবতেই পারিনি, আমাদের ইমিগ্রেশন হয়ে যাবে। ভাবতেই পারিনি। এখন তুমিই বল এত্ত বড় একটা চান্স ছেড়ে দেব? এখানে আমার ক্যারিয়ারের কোন আশাই দেখছি না!
: আমাকে এত দিন বলিসনি কেন? আমাকে কিনা শুনতে হলো পাড়ার লোকের কাছে!
: নন্না মাফ করে দাও প্লিজ, ভুল হয়ে গেছে। আসলে খুব ভয় পাচ্ছিলাম, তুমি কিভাবে নাও!
: আমার কথা যেন কত তুমি ভাব? কেন হায়ার স্টাডিজের জন্য তোকে কালাব্রীয়াতে যেতে দেইনি?
: সেটাতো দেশের মধ্যে ছিল! এটাতো অন্য দেশ! তাছাড়া…
: আবার কি?
: নাহ্ থাক, আসলে যাওয়া আমার এমনিতেই ক্যানসেল করতে হবে!
: কেন? নানী বিরক্ত কণ্ঠে বলে।
: বেশ কিছু ডলার লাগবে। আমার তো কোন চাকরিও নাই। তাছাড়া তুমিই বা এতগুলা ডলার এখন কোথা দিয়ে যোগাড় করবে! এমনিতেই এই ৬ বছরে কম তো খরচ করো নাই!
: কত লাগবে তাই বল?
: ৬ হাজার ডলারের ত সাথে নিতে হবে। আর ব্যাংকের মানি স্টেটমেন্টের কাগজপত্রও দেখাতে হবে। অবশ্য জেসনের মামা বলেছে, সে আমারটা দিয়ে দেব্ েকারণ, জেসন চান্স পায়নি।
: ঠিক আছে ৬ হাজার ডলারের চিন্তা আমার উপর ছেড়ে দাও।
: কিন্তু নন্না, তুমি এতগুলো ডলার কোথায় পাবে।
: সেটা তোমার চিন্তার বিষয় নয়।
আসলে আমান্ডার তেমন খরচ নাই। ফাবির নানা আলবার্ট বারটুচির মৃত্যুর পর তার সমস্ত ক্ষেত ও ফসলের জমিজমা সব কিছু নগদ জমায় লাগিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া সারাও তার ছেলের জন্য প্রায় প্রতি মাসে কিছু না কিছু ডলার পাঠায়। আমান্ডা ২ সপ্তাহের ভেতরেই সব টাকা-পয়সা দিয়ে দ্যায়। এমনকি ফাবিয়ানকে ৪/৫টা শীতের পোশাকও বানিয়ে দ্যায়। ২টা বড় বড় ওর নানার ওভারকোটও দিয়ে দিল। বেশ নির্বিকারভাবে তার স্যুটকেস নিজের হাতে গুছিয়ে দিল। আমান্ডা খুব ভাল করেই জানে যে ফাবিয়ানের জীবনের সমগ্র ভূবন শুধুমাত্র সে। তাই আমান্ডা নিজের কাছেই নিজে প্রতিজ্ঞা করেছে, জীবনে কখনো সে ওর ব্যক্তিগত কোন সিদ্ধান্তে বাধা প্রদান করবে না। ফাবিয়ানের কষ্ট, স্বপ্ন, ভালোবাসা এ সব কিছুই আমান্ডা যদি বুঝতে না পারে তাহলে কে বুঝতে পারবে? ফাবিয়ান যে প্রতিনিয়ত তার অতীত, তার সব থেকে আপন জন তার বাবা, মা এদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে চেয়েছে। তা কি আমান্ডা জানে না? এইটুকু বয়সে ছেলেটা যেন তিন ভূবনের ভার নিয়ে একাকী পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এখন তার লক্ষ্য গান, গান আর গান। তাই এই গানের জন্য ফাবি যা কিছু করতে চাইবে তার সব কিছুই সে সমর্থন করবে।
ফাবিয়ান যেখান দিয়ে সব থেকে ভয় পেয়েছিল সেই নানী চমৎকারভাবে তাকে সমর্থন করে গেল। আর যেটা সে ভাবেইনি, সেই ডোরিন খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে আঘাত করলো। নানীর কাছ থেকে টাকা পাবার পর ফাবিয়ান খুশিতে আত্মহারা হয়ে প্রথমেই ডোরিনের কাছে ছুটে গেল। ডোরিন তখন তার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল-
: ডোরিন, কিরে ভর দুপুরে দিবা নিদ্রা দিচ্ছিস?
: না, একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম- কি ব্যাপার?
: আরে ব্যাপারতো দারুন, নন্না একদম হান্ড্রেট পারসেন্ট ফিট!
: মানে?
: আরে নন্না একদম রাজি আমাকে এমনকি সব টাকা-পয়সা দিয়ে দিল। এমনকি বলেছে, আমার যেখানে মঙ্গল হবে সেখানেই যেতে পারি! সোজা কথা নন্নার কোন আপত্তিই নাই।
: তাহলে আর কি? সব কিছু ঠিকঠাক। এখন যাত্রা শুরু কর।
: আরে তুই এভাবে কথা বলছিস কেন?
: তো কিভাবে কথা বলবো?
: ডোরিন, মাথা ঠান্ডা কর- শোন অনেক কথা আছে প্লিজ। একটু লেকের পাড়ে চল।
: নাহ্! আমার এখন ভালো লাগছে না।
: প্লিজ, প্লিজ- প্লিজ।
: ঠিক আছে চল।
ওরা দুজনে সেই ছেলেবেলার মত লেকের পাড়ে হাটতে থাকে। শুধু পার্থক্য হলো তখন ডোরিন ক্রমাগত বকবক করতো আর ফাবিয়ান বেশির ভাগই হু-হ্যাঁ করতো। আর আজকের এই পথ চলাতে পার্থক্য হলো আজ ফাবিয়ান অনর্গল কথা বলে চলেছে, আর ডোরিন কোন কথাই প্রায় বলছেই না। তবু ফাবিয়ান অতি ধৈর্য্যরে সাথে ডোরিনকে বুঝিয়েই চলেছে। লেকের পাড়ের কাছে এসে ওরা একটা খুব পুরানো পাইন গাছের গুড়ির নিচে বসে। আর ফাবি তার ভবিষ্যত পরিকল্পনার নানা ধরনের ছবি ডোরিনের মনে আঁকতে থাকে।
: বুঝলি, রবার্টের গার্লফ্রেন্ডের মিউজিক লাইনে খুব ভালো সোর্স। যেয়েই আমরা কোন একটা ক্লিক পেয়ে যাবো। আর দেখতে দেখতেই আমি ফেমাস হয়ে যাবো।
: আচ্ছা তারপর?
: না, মানে- তারপর আর কি? একটু পায়ের নিচে মাটি হলেই আবার উড়ে চলে আসবো।
: কেন?
: কেন আবার? তোকে বিয়ে করতে!
: তারপর?
: তারপর কি? তোকে নিয়ে আবার চলে যাবো!
: আর তোর নন্না? তার কি হবে? তার কথা একবারও ভাবনি না? যে তোকে সেই ১ দিনের বাচ্চা থেকে আজ এই এত বড়টি করেছে?
: বারে নন্না তো আমাকে হাসি মুখেই পারমিশন দিল যাবার জন্য।
: আর তার হাসির আড়ালে যে এক সাগর কান্না লুকিয়ে আছে, সেটা দেখলি না!
: বারে আমিতো নানীকে ছেড়ে কালাব্রীয়াতেও গিয়ে ছিলাম পড়তে, তখন তো এই কথা বলিসনি!
: কারণ, সে যাওয়া আর এই যাওয়া এক নয়। অনেক অনেক পার্থক্য।
: কি রকম? সেটাও পড়বার জন্য গিয়েছিলাম। আর এবারও যাচ্ছি, আমার সমস্ত স্বপ্নের রঙগুলোকে হাতের মুঠোয় ভরতে! আমিতো কোন পার্থক্য দেখছি না।
: তা কেন দেখবি? তোর সেই চোখ থাকলে তো!
: কি বলতে চাচ্ছিস? আমার চোখ নাই, খালি তোরই চোখ আছে।
: চোখ থাকলেই সব দেখা যায় না ফাবিয়ান। চোখের ভেতরে অন্তর্দৃষ্টি থাকা চাই।
: খুব যে দর্শন কপচাচ্ছিস!
: তো, কি করবো? তুই তো নিজেকে ছাড়া কিছু দেখতেই পাচ্ছিস না!
: তুই কি বলতে চাচ্ছিস, খোলাখুলি বল।
: এটা একটা সিম্পল ব্যাপার! তোর নানী বুড়ো হয়েছে, এতকাল তোকে কালাব্রীয়াতে পাঠিয়ে অপেক্ষা করেছে, কবে তার ফাবিয়ানের পড়ালেখা শেষ হবে? তারপর নানীর কাছে ফিরে আসবে?
: তার মানে কি? ফাবিয়ান খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়ে চিৎকার করে বলে…
: আমি কি তাহলে লেখাপড়া করেছি এই গ্রামে এসে ক্ষেত-খামারের কাজ করবো বলে?
: তা কেন? এই ইটালিতে কি কোন মিউজিসিয়ান নাই? নাকি এখানে কোন মিউজিসিয়ানের কোন ভবিষ্যত নাই? তুমি এখানে কি চেষ্টা করে দেখেছো সর্বত্র?
: অবশ্যই দেখেছি! গত ছয় বছর ধরে তাহলে করেছিটা কি? এমনকি তুমি তো জানো আমাদের একটা ছোট্ট গানের দলও ছিল, কত জায়গাতে যে গান করেছি তার ঠিকানা নাই। কিন্তু ঐ পর্যন্ত! কোন ক্লিক করলো না। পাবলিক তো পারলে ফ্রি গান করায়! বুঝলে?
: তো, তুমি বুঝলে কি করে যে কানাডাতে গেলেই ভাগ্যের চাকা ঘুরবে?
: না, তা তুমি ঠিকই বলেছো, তবে কিনা চেষ্টাতো করতে হবে তাই না?
: ওকে, তুমি দ্যাখো চেষ্টা করে। তবে আমি তোমাকে আগেভাগেই বলে রাখছি যে আমি কিন্তু কানাডাতে যাবো না!
: কেন? জানতে পারি কি?
: হ্যাঁ, কারণ আমি আমার মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। আমার একটা দায়িত্ব আছে ওদের উপর। আমি চলে গেলে ওরা একা হয়ে যাবে না?
: কেন, আমার মাও তো একমাত্র কন্যা ছিল, সেকি তার বুড়ো মাকে ছেড়ে চলে যায়নি? সেতো তার সন্তানকেও ছেড়ে চলে গেছে সুদূর সুইডেনে।
: সেটা আলাদা ব্যাপার! তোমার বাবা যদি তোমার মায়ের সাথে ঐ রকম চিট না করতো তাহলে তোমার মাকে ঐ সব কিছুই করতে হতো না!
: ঠিক আছে বুঝলাম! আমার বাবা না হয় একটা গারবেজ।
: আমি তোমার বাবাকে কিন্তু মোটেই গারবেজ বলিনি!
: তা বলবে কেন? মুখে কি সব বলা লাগে? আমি নিজেই জানি যে, সে একজন গারবেজের থেকেও বেশি যদি কিছু হয় সে তাই ছিল!
: তুমি ভালো করেই জানো যে, এ ব্যাপারটা প্রসঙ্গক্রমে উঠে গেল তাই বললাম।
: হু, সে যাই হোক- সব মেয়েরাই তো বিয়ে করে স্বামীর ঘরেই যায়! অথবা নিজেরা ঘর বানায়! আমার নানী, তোমার নানীও তার বাপের বাড়ি থেকে চলে এসেছিল!
: তা এসেছিল, আমিও ভেবেছিলাম বিয়ের পর তোমাদের বাড়ি যেয়ে থাকবো!
: এটা আমার বাড়ি না। নানার বাড়ি। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। নিজের ঘর বানাতে চাই। আমার বাবার যে ‘অপদার্থ’ অপবাদ আছে, সেটা আমি ঘুচাতে চাই।
: সেটা এখানে বসেও হতে পারে।
: ডোরিন, আমি একটা বেটার চান্স পেয়েছি চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?
: ওকে দ্যাখো। আমি তো মানা করিনি। আমার সামনে ঘ্যান ঘ্যান করছো কেন?
: আমি তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি!
: আমি কচি খুকি নই যে আমাকে তুমি বোঝাতে পারবে!
: হ্যাঁ, তাইতো দেখছি।
: ওকে, তাহলে আমি যাচ্ছি। আশা করি তোমার কথা শেষ হয়েছে।
ফাবিয়ান এ কথার কোন জবাব দিল না। চুপচাপ লেকের পানিতে ছোট্ট নুড়ি ছুঁড়তে লাগলো। আর ডোরিন বড় বড় পা ফেলে তার চোখের উপর দিয়ে চলে গেল। ফাবিয়ান বিস্ময়ে যেন পাথর হয়ে গেল। গত ছয় বছরে ডোরিনের অনেক পরিবর্তন হয়েছে! যখন থেকে স্কুল গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে শেষে কলেজে সাইকোলজিতে গ্র্যাজুয়েশন করেছে, ও দেখেছে ডোরিনের একটু একটু পরিবর্তিত অবয়ব। কিন্তু ও কালাব্রীয়াতে ছিল বলে বুঝতেই পারেনি। তবুও ও ভাবলো দোষটা তারই, হয়তো বা আগে ভাগে ওর সাথে আলোচনা করেনি বলেই তার এত রাগ হয়েছে।
ফাবিয়ান খুব ক্লান্ত পায়ে বাড়ি ফিরলো। আমান্ডা দেখলো তার নাতির দুঃখী মুখ। বুঝলো কিছু হয়েছে। জোর করে খাবার খাইয়ে পাশে বসিয়ে আদর করে বললো-
: কি হয়েছে সোনা! মুখটা এত মলিন কেন?
: কিছু হয়নি।
: আমাকে বল সোনা, তুই তো আমাকে কখনো কিছু গোপন করিস না।
তখন ফাবিয়ান নানীর কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে কান্না চেপে একে একে তাদের কথোপকথন সবই বলে গেল। আমান্ডা চুপচাপ সব শুনে গেল। তারপর ফাবির চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে ধীরে ধীরে বললো-
: দ্যাখ সোনা, আমার বয়স হয়েছে। জীবনে অনেক কিছু দেখলাম। তোরা এক সাথে দুটিতে বড় হয়েছিস। কিন্তু ছেলেবেলার কথা আলাদা। এখন ডোরিন বড় হয়েছে। তার নিজস্বতা গড়ে উঠেছে। ছোটবেলায় দেখেছি তুই যা বলতিস, সবই ও মেনে নিত। কিন্তু এখনো তোর প্রত্যাশা যদি তাই হয়, সেটা কি ঠিক হবে?
: না, আমি তো তা বলিনি? আমি ওকে অনেক বোঝালাম! ও কিছুতেই বুঝতে চাইছে না নন্না আমি এখন কি করি বলতো?
: দ্যাখ সোনা, আমি জীবনে কখনো তোর কোন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিনি বা তোর কোন সিদ্ধান্তে বাধা প্রদানও করিনি। তাই বলে সকলেই যে একমত হবে তার কোন মানে নেই, তাই না?
: হু তা ঠিক।
: আমি একটা কথাই বলতে চাই যে, আমি কখনো জীবনের কোন ক্ষেত্রে তোকে পরাজিত দেখতে চাই না। আবার এটাও চাই না যে তুই কোন হঠকারিতা করিস। ডোরিনের সাথে তোর আজন্মের লালিত একটা সম্পর্ক তাই তোর এই সিদ্ধান্তে যদি সম্পর্কের টানপোড়েন হয়, তবে অবশ্যই তোকে দু’বার চিন্তা করতে হবে।
: এখন আমার আর পিছু ফেরার উপায় নাই নন্না।
: হ্যাঁ, সেটাও ঠিক। তবে এমন কিছু করিস না যে পিছু ফেরারও আর কিছু রইবে না।
প্রায় সারা রাত আমান্ডা আর ফাবিয়ান কথা বললো। ভোরের আলো জাগতে শুরু করেছে। আমান্ডা বিছানা ছেড়ে উঠলো…
: ফাবি তুই একটু ঘুমাবার চেষ্টা কর সোনা, তুই তো ১২টার দিকে রওনা দিবি তাই না?
: হ্যাঁ নন্না, আজ কালাব্রীয়াতে রওনা দিব। আগামীকাল রোম হয়ে পরশু রাতে আমার কানাডার ফ্লাইট।
: ঠিক আছে, আমি সব গুছিয়ে ফেলিগে।
এগারোটার মধ্যে রায়ান এবং তার বাবা-মা ছোট ভাই- সব ফাবিয়ানকে নিতে এলো। ফাবিয়ান রেডি হয়েই ছিল। ওদের দেখে চটজলদি রোডিদের বাড়ি দৌড়াল। রোডিকা আন্টি আর কেভিন আঙ্কেলের কাছ থেকে বিদায় নিল। তারা খুবই মৃয়মান। বিশেষ করে রোডি আন্টি তো ওকে জড়িয়ে খুব কাঁদলো। অতপর ডোরিনের কক্ষে গেল-
: ডোরিন, যাবার সময় হলো- তাহলে আমি কানাডাতে পৌঁছে ফোন করবো।
: আচ্ছা এসো। আর ফোন করতে ইচ্ছা করলে করবে! তবে তার আর কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
ফাবিয়ান একদম হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো ডোরিনের দিকে। তার আজন্মের চিরচেনা সেই ডোরিন! আজ তাকেও চিনতে পারছে না। এমনিতেই ওর মন খুবই খারাপ। উৎকণ্ঠায় হৃদয় ব্যাকুল হয়ে আছে। নতুন ঠিকানা, নতুন দেশ, সবাইকে ছেড়ে যাওয়া ইত্যাকার বিষয় নিয়ে সে রীতিমত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আছে। উপরন্তু ডোরিনের এই রকম রহস্যময় উদাসীনতা তাকে প্রচন্ড আপসেট করে দিয়েছে।
সকালে মা’ও ফোন করলো। ফাবিয়ানকে বললো কানাডা পৌঁছে একটা খবর দিস। বাড়ি থেকে বেরুবার আগে নানী তাকে বুকের মধ্যে খুব জোরে জড়িয়ে তার মাথায় চুম্বন করলো। কিন্তু একটুও কাঁদলো না। ফাবিয়ান খুবই অবাক হলো। নানী তার কথায় কথায় কান্নাকাটি করে। সেই মানুষ আজ একটুও কাঁদলো না। ফাবিয়ানও নিজেকে খুব শক্ত করে ফেলেছে। আসবার আগে অবশ্য বার বার পেছন ফিরে দেখছিলো তার চিরচেনা ভ্যালেলংগাকে। (চলবে)

রীনা গুলশান বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিকে তার কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, রম্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে কানাডার বিভিন্ন বাংলা পত্রিকাতেও। তিনি ‘প্রবাসী কণ্ঠ’ ম্যাগাজিন এর একজন নিয়মিত কলামিস্ট।