‘বাংলাদেশী সোসাইটি অব ক্যালগারি ‘র উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপন

শৈলেন কুমার দাশ : কানাডার ক্যালগারিতে বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর আন্তরিকতায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয় গত শুক্রবার, ২১শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫। নগরীর রেনফ্রিউ কম্যুনিটি হলে এই মহতী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশী সোসাইটি অব কেলগেরি (বিএসসি)। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন নগরীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত কম্যুনিটি সদস্যবৃন্দ, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন পেশার নারী পুরুষ ও শিশু কিশোর। যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা হলেন ক্যালগারি নগরীতে বসবাসরত ১০টি এথনিক কম্যুনিটির সদস্যবৃন্দ। তাঁরা আসেন তাঁদের নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের হরেক রঙের পোষাকে সুসজ্জিত হয়ে। তাঁদের উপস্থিতিতে কম্যুনিটি সেন্টারটি বর্ণময় হয়ে উঠে। প্রায় তিন শতাধিক মানুষের আগমনে এক মুগ্ধময় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক মিলন ভূমিতে পরিণত হয় রেনফ্রিউ কম্যুনিটি হল। এ যেন একই বৃন্তে অনেকগুলো কুসুমকলিকে বেঁধে নেয়ার এক মহাপ্রয়াস।

প্রথমে নগরীর বিভিন্ন অঞ্চলের বাংলাদেশী কানাডিয়ানদের সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ সুসজ্জিত শহীদ বেদিতে পরম শ্রদ্ধায় পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এসময় বেজে উঠে গভীর আবেদনময় সেই বিখ্যাত সুরের “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” গান। বাংলা ভাষার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের ভাষায়ও গানটি সুর ছড়িয়ে যেতে থাকে পরম মমতায়। বিএসসি এর একজন ডিরেক্টর হাসান আব্বাস এর সুনিপুণ হাতের স্পর্শে তৈরি ও সাজানো শহীদ বেদী বর্ণিল পুষ্পস্তবকে আরও আকর্ষণীয় ও বর্ণময় হয়ে উঠে।

অনুষ্ঠানের মূল পর্ব শুরু  হয় কানাডা ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। এসময় হল রুমে সমবেত সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। পরক্ষণেই সুকণ্ঠী সঞ্চালিকা নাহিদ চৌধুরী কনক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করেন। এরপর অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক বিএসসি এর ডিরেক্টর ওবায়দুর রহমানকে তাঁর স্বাগত বক্তব্য রাখার জন্য অনুরোধ করেন সঞ্চালিকা। মি. রহমান প্রথমেই তাঁর বক্তব্যে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথে ভাষার জন্য বাংলা মায়ের যে-সব দামাল সন্তানেরা আত্মাহুতি দেন তাদেরকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন। তারপর অতিথিদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানান অনুষ্ঠানে আন্তরিক অংশগ্রহণের জন্য। অতিথিদের উদ্দেশ্যে বলেন আপনারা আজ এই অনুষ্ঠানে এসে আমাদেরকে আলোকিত করেছেন।  আপনাদের উপস্থিতিতে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি।  আপনাদের মাধ্যমে আজ আমরা পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে সমৃদ্ধ হবো। তিনি তাঁর বক্তব্যে বহুভাষিক বৈচিত্র্য এবং বহু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর গুরুত্ব প্রদান করেন। এরপর সঞ্চালিকা অনুষ্ঠানের অতিথি ক্যালগারি ৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাজ ধালিওয়ালকে বক্তব্য রাখতে অনুরোধ করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের ভাষা শহীদের স্মরণ করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশ্ববাসীকে উপহার দেয়ার জন্য বাংলাদেশের অবদানের প্রতি সম্মান জানান। তিনি  কম্যুনিটির উন্নয়নে ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং বহুভাষিকতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

এরপর পর্যাক্রমে আফাগানিস্তান, বাংলাদেশ, কানাডা, চায়না, ইরিত্রিয়া, ইন্ডিয়া, লেবানন, নেপাল, প্যালেস্টাইন, রাশিয়া ও থাইল্যান্ড এর সাংস্কৃতিক গ্রুপগুলো তাঁদের নিজ নিজ মাতৃভূমির ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড উপস্থাপন করেন।  

আফগানিস্তান থেকে আসা একদল অভিবাসী যুবক তাঁদের ঐতিহ্যবাহী আফগান পাঞ্জাবি পোষাকে সজ্জিত  হয়ে তাঁদের বিখ্যাত ছন্দময় নৃত্য আফগান সংগীতের তালে তালে উপস্থাপন করেন। আফগান রমণীর সুন্দর সাজে অর্থাৎ মাথায় লাল দোপাট্টা এবং লাল কালোর সংমিশ্রণে সালোয়ার কামিজে সুসজ্জিতা হয়ে মঞ্চে আসেন এক সুদর্শনা। সাথে সহ পারফরমার। আবৃত্তি করেন ১৩ শতকের বিখ্যাত পারসিয়ান কবি জালাল আল-দিন মোহাম্মদ রুমির কবিতা থেকে অংশবিশেষ।

কানাডিয়ান নেটিভ সোসাইটির প্রাণবন্ত সদস্যা অপরূপ সুরে ধাপে ধাপে উপস্থাপন করেন নেটিভ সংগীতের এক বিচিত্র সুরের সুমধুর মূর্ছনা। যা ক্ষণকালের জন্য শ্রোতাদের নিয়ে যায় সেই নির্জন পাহাড়ি  জীবনের লীলাভূমে। যেখানে প্রকৃতি আর জীবন মিশে ছিল একাকার হয়ে।

চীনা দলটি বিভক্ত ছিল দুটি অংশে। বসন্তের পলাশ রাঙ্গা রঙের আবরণে সেজেছিল চৌদ্দজন নৃত্যশিল্পী। যাদের মধ্যে তিনজন নারী ছিলেন সত্তর বছরের কাছাকাছি বয়স। অসম্ভব গতি, নৃত্যকৌশল আর তাল সম্পন্ন নৃত্যে যেন বার বার বসন্তের অগ্নিশিখায় প্রজ্বলিত হচ্ছিল পুরো হলরুম। মন্ত্রমুগ্ধের মত গোটা হল হারিয়ে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য এই নৃত্যের গহন গভীরে। অন্যদলে দুই কিশোরী বোন চায়নিজ সুরে সাজিয়ে তোলে আলোকোজ্জল হল রুমের পরিবেশকে।

ইরিত্রিয়ার জাতীয় পোষাকে সুসজ্জিতা ইরিত্রিয়ান তিন কন্যা সুরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কিছুক্ষণ।

মানব জীবন ও সভ্যতার বিকাশে ভাষা বৈচিত্র্যের প্রয়োজনীয়তার উপর বাণীর মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন ইন্ডিয়ান অংশগ্রহণকারী।

লেবাবনন ও পেলেস্টাইন এর পোষাকে সজ্জিত দুই শিল্পীর একজন গেয়েছেন সেই অঞ্চলের শক্তিশালী সুরের গান। আর অপরজন বেহালায় তুলেছেন প্রাণকাড়া সুর।

নেপালী সুন্দরী কন্যার সেই পাহাড়ঘেরা শ্যামল ভূমির ছন্দময় নৃত্যে আর ছোট্ট কন্যার সংগীত পরিবেশন মন কেড়ে নেয় সবার। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ যেন কন্যার নৃত্যে এসে দাঁড়ায় পথ আগলে কানাডার সুসজ্জিত এই হলরুমে।

ফিলিপাইনের বারোজন কন্যার সুসজ্জিত নৃত্যের পোষাকে আগাগোড়া সাজানো দলটি আবার চায়নিজ নৃত্যের মত শক্তিশালী নৃত্য পরিবেশন করে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। মুহূর্তের তরে যেন সবাই তাঁদের নৃত্যের তালে তালে বার বার এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছিল। অর্থাৎ তাঁদের নৃত্যশৈলী দর্শকদের গভীরভাবে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে।

রাশিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোষাকে সজ্জিতা রাজকুমারীর অবয়বে মঞ্চে এসে দাঁড়ায় উঁচু ফিগারের সুন্দরী রাশিয়ান কন্যা। রাশিয়ান কথার বর্ণময়তায় ও কবিতার ছন্দময়তায় সাজে তাঁর জন্য নির্ধারিত সময়।

থাই সংগীতের সুরেলা মূর্ছনায় আবার সেজে উঠে মঞ্চ আঙিনা। তিনজনের দলে অভিজ্ঞ দলনেতার সাথে সুরের আলপনা সাজিয়েছেন সুরেলা কণ্ঠে দুই থাই কন্যা।

পরিশেষে বাংলাদেশ দল মঞ্চে আসেন। তাঁরা তাঁদের গিটার, বেহালা, হারমনিয়ামের সুরকে সাজিয়ে তুলে গান ও কবিতার ছন্দে।  যা ছিল মূলত ভাষা আন্দোলনের শহীদদের কেন্দ্র করে। মায়ের প্রতীক্ষার করুণ আর্তি প্রতিধ্বনিত হয়েছে তাঁদের আয়োজনের পরতে পরতে।

সব দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড একই মঞ্চে আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই আসরটি যেন একটি বহুসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের চারণভূমিতে পরিণত হয়। সবার মনে এক বিনিসুতোর মালা যেন জড়িয়ে যায় অপূর্ব স্নিগ্ধতায়।

এ বছরটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ২৫তম বার্ষিকী বা 25th anniversary। কারণ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা বা UNESCO ১৯৯৯ সালে আমাদের মাতৃভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। এবছর এই সংস্থাটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সংস্থাটি বিভিন্ন ক্রোড়পত্র, পোস্টার এবং থিম বা ভাবনা প্রকাশ করে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে এ বছরের UNESCO এর থিম হচ্ছে ‘ভাষাকে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের শক্তিশালী উপায় হিসাবে বিবেচনা করা। সত্যি অতি সুন্দর থিম প্রকাশ করেছে UNESCO। সেজন্য UNESCO কে প্রাণঢালা অভিনন্দন। কারণ কোন উন্নয়ন যখন মানুষের ভাষা বা সংস্কৃতির মধ্যে প্রতিফলিত হয়  তখন মানুষ এর অংশীদারিত্ব অনুভব করে। অর্থাৎ  মানুষের জীবন, জীবিকা, চিন্তা, অনুরাগ, অনুভূতি তথা ভাষা ও সংস্কৃতি যদি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রতিফলন ঘটে তখন সে উন্নয়ন স্থায়িত্বশীল হয়।

UNESCO থিম এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কানাডার বাংলাদেশী সোসাইটি অব ক্যালগারি (বিএসসি) তার থিম এবং পোস্টার প্রকাশ করেছে। বিএসসি এর থিম হচ্ছে “ভাষা হচ্ছে মানুষের জন্মগত অধিকার, বিশ্বের সব মানুষের এ অধিকার সুরক্ষিত হোক।” সেইসাথে বিশেষ পোস্টারে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে “ভাষা হোক শান্তি ও সম্প্রীতির বাহক, হোক যুদ্ধ বন্ধের শান্ত বহিঃপ্রকাশ।”

এই সুন্দর অনুষ্ঠানটির সফল বাস্তবায়নের জন্য বিএসসি ‘র চব্বিশ জন ডিরেক্টর কাজ করেছেন। বিশেষ করে গত একমাস ধরে যে সমস্ত ডিরেক্টররা নিরলস কাজ করেছেন তাঁরা হলেন  সায়মা মাওলা, মো. জাহিদুল হক, আনিসুর রহমান, মো. আলী আশরাফ লস্কর, আহমেদ আল-ইমরান নিক্কন, হাসান আব্বাস, মো. জামাল উদ্দিন, খলিলুর রহমান শম্পা, সজ্জাদ বিপুল, হাবিব ইসলাম হিরণ, ওবায়দুর রহমান ও শৈলেন কুমার দাশ। সেইসাথে যন্ত্রকৌশল ও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থাপনায় গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন বিএসসি ডিরেক্টর মামমুদুল হক খোকন ও সাজ্জাদ বিপুল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *