আকাশের ঠিকানায়
ফারহানা পল্লব
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
১৫- রাধার চিঠি
প্রিয় সৌম্য,
কেমন আছো? অনেকদিন কথা হয়নি মাঝে। একটু ব্যস্ত ছিলাম। কাজ সংসার সব মিলিয়ে।
তুমি ঠিকই বলেছিলে, যে বালুর ঘর সাজিয়েছিলাম সেটা আবারো মনে হয় ভেঙে গেল। আমার সংসারের পার্টনার বার বার বিদেশে চলে যায়। অনেক কথা বলেছি, আমি অভিমান করে মুখ লুকিয়ে কাঁদার মানুষ নই। আমি সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছি। শুধু মিথ্যে আশ্বাস পেয়েছি। আমি যতই সযত্নে অতি সাবধানে আমার ঘর সংসার সাজিয়ে বাঁচিয়ে রাখিনা কেন, অপর পক্ষে যদি একটুও ইচ্ছা না থাকে সে সংসার টিকবে কি করে বলো? কিন্তু অবাক বিষয় হল যে মানুষটা ১২ বছর সংসার করে চলে গেল মিথ্যে বলে। একটিবার সত্যি করে যদি বলে যেত আমার কোথায় কোন দোষ হয়েছে, বা চলে যাচ্ছে সেটাও যদি জানিয়ে যেত, আমি আমার মত চলতে পারতাম। এরকম তো বার বার মুখ থুবড়ে পড়েছি আবার ঝেড়ে ঝুড়ে উঠেও দাঁড়িয়েছি। তাহলে এরকম ধোঁকার মধ্যে ফাঁকির মধ্যে ফেলে চলে যাবার কি যুক্তি হয় বলতে পারো? সমাজের কাছে আমাকে কত শত প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় সেটা কি তার ধারনা আছে? ছেলে মেয়ে জামাই মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। আমার বন্ধুবান্ধব, পরিবার ভাই বোন সবার কাছে কি উত্তর দেবো বলতো? রোদে জ্বলে যাওয়া গামছাটাকেও সযন্তে রেখেছিলাম। সেটা এভাবে ছিড়ে টুকরো করার কি দরকার ছিল বলো? বয়স হয়ে যাচ্ছে আর কয়দিন বা বাঁচবো। এ সময়ে একটু স্বস্তি চেয়েছিলাম। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যত যাই হোক আমরা সংসার করে যাব একসাথে। এখন এই মাঝ পথে কিছু না বলে কয়ে ছেড়ে চলে গেল, ভাবতেই অবাক লাগে।
মনে মনে নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অনেক দোষ খুঁজি। হয়তো যথেষ্ট যন্তবান ছিলাম না, হয়তো মনযোগী ছিলাম না তার প্রতি। হয়তো কোথাও মনের ভুলে অবহেলা করেছি। নিয়মিত রান্না কি করিনি সেজন্য? ভালবাসিনি, সম্মান করিনি। তাকে ঠকিয়ে তো কখনো অন্যকে প্রাধান্য দেইনি। কিন্তু কোথাও তো কমতি দেখিনা যত্নের। কাছের বন্ধু বান্ধবের সাথেও ঝালাই করে নেই আমার ভুলটা কোথায়? সকলের একই কথা। আপনাদের মত সুখী দম্পতি তো দেখিনি। আপনি তো কত সুন্দর করে সংসার করছিলেন। আমার সম্পর্কে সে কারো কাছে অভিযোগও তো করেনি। অনেক প্রশংসা করেছে সবসময়। আমি কতটা কেয়ারিং। আমি কিভাবে সবার যত্ন নেই। একহাতে সংসারের সবদিক সামলাই – এসব প্রশংসা করেছে সবসময়। আমার কোন লোভ নেই তেমন কোন চাহিদা নেই। খুব অল্পতে কিরকম খুশী হয়ে যাই, এসব গল্প সে নিজেই করেছে নিজের ভাই বোন আর বন্ধুবান্ধবের কাছে। আমিও তো কখনো অভিযোগ করিনি। তার সাধ্যমত আমাকে সুখে রাখার চেষ্টা করেছে। মাঝে মধ্যে হতাশ হয়ে যেত, নিজে ক্যারিয়ারে যত ভাল করতে চেয়েছে ততটা হয়তো অর্জন করতে পারেনি কিন্তু আমি সবসময় সাহস দিয়ে গিয়েছি, উৎসাহ দিয়েছি আরো ভাল কিছু করার। এমন কি শেষে অন্য দেশে গিয়ে নতুন ব্যাবসা করতে চেয়েছে, তাতেও বাধা দেইনি, গত তিন চার বছর ধরে যাতায়াত করেছে ব্যবসা শুরু করতে। আমি একাই এখানের সংসার ধরে বসে আছি। ফিরে এসেছে কখনো দামী ডিনার সেট নিয়ে, কখনো হীরের আংটি নিয়ে। আবার কখনো নতুন বেডরুম সেট কিনে দিয়ে চমকে দিয়েছে আমাকে। আমার জন্মদিনে কন্যাকে নিয়ে সবসময় সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে। আমি রাগও করতাম, খুশিও হতাম। এক জীবনে আমার জন্মদিন কেউ মনে করে একটা গোলাপও আনেনি, সেখানে আমাকে ঘিড়ে এত আয়োজন, গোলাপের তোড়া, প্রিয় লিনডোর চকোলেটোর বন্যা বইয়ে দিয়েছে। সারপ্রাইজ করতে গিয়ে অতি দামে শাড়ি কিনে আমার বকা খেত। আমার পছন্দের দিকে ছিল সদা সতর্ক। আমিও নিশ্চিন্তে সংসারে তাকে সযত্নে রেখেছিলাম। তাহলে ভুলটা কোথায় হল যে এই মানুষ হঠাৎ কিচ্ছু না বলে ব্যবসার নামে একেবারে চলে গেল। আর কোন খোঁজ খবর যোগাযোগ রাখলো না। প্রথমে খুব দুশ্চিন্তা হত, ঠিক আছে কিনা কোন বিপদে পড়ল কিনা। তারপর তার ক্লায়েন্ট, বন্ধুবান্ধবের কাছে শুনলাম সে ভাল আছে। ব্যস্ত আছে। এর চাইতে বেশী জিজ্ঞেস করা গেল না, আমি স্ত্রী হয়ে কোন যোগাযোগ নেই কেন সে জবাবটা আসলে আমারই জানা নেই।
তোমাকে আমার সংসারের সাতকাহন শুনিয়ে বোর করছি নাতো? আসলে তোমাকে যখন লিখি অনেকটা নিজের সাথেই যেন কথা বলি। তাই এত কাহিনী। আচ্ছা বলতো আমার বৈবাহিক সম্পর্ক এখন কি হতে পারে? আমি কি সিঙ্গেল, বিবাহিত নাকী ডিভোর্সড? বিরাট এক প্রশ্ন আমার সামনে। তারপর আছে কম্যিউনিটিতে মানুষের প্রশ্নের ঝড় , সে কোথায়, কেন গেল? কি হয়েছিল? কেন আমি খোঁজ করতে যাই না, নিশ্চই কিছু হয়েছে নইলে কি কেউ এভাবে চলে যায়? এরকম নানা প্রশ্নের শিকার। আমাকে এরকম পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য খুব রাগ হয়। আমার যে দোষটা কোথায় সেটাই বুঝিনা। আমি আমার বন্ধুবান্ধব, সংগঠন কাজ আর পুত্র কন্যা নাতনী নিয়ে ব্যাস্ত থাকি।
আর তুমি তো আছই, অনেক ক্লান্তির মাঝে একটু বিশ্রাম যেন তুমি। অনেক হেরে যাবার পরেও একটু জেতার সুখ পাই তোমার সাথে কথা বলে। তোমার কাছেই শান্তি। তোমাকে সবসময় সংসারের এত কথা বলা হয়নি। কারণ তোমার মনে হতে পারে আমি সুখে নেই। আমি আসলে সুখেই ছিলাম জানো! আমি এখনও সুখে আছি। আরেক রকম মিষ্টি একটা যন্ত্রণা। সুখের মাঝেও একটু একটু বেদনা। মন্দ না তাই না? নিরবিচ্ছিন্ন সুখ তো সুখের হয় না।
‘বলো জীবন কি সুন্দর হতো এমন
যদি একটুও ব্যথা নাই থাকতো’॥
১৬- সৌম্যর চিঠি
প্রিয় অনুরাধা,
তোমার এই দু:খ বিলাসিতা আমার আর ভাল লাগেনা। সবসময় সুখের মত করে অভিনয় করে যাচ্ছ। তোমার মত এত গুণী সংসারী একটা মেয়ে যদি পুরোপুরি সংসার করতে না পারে সেখানে তোমার কোন সমস্যা দেখি না। সমস্যা তোমার সঠিক পার্টনার বাছাই করতে। তুমি এ জীবনে যাদের নিয়ে সংসার সাজিয়েছো তারা তোমাকে বুঝতেই পারেনি। আমি বলবো তাদের সে যোগ্যতাই নেই। তুমি যেন আবার মন খারাপ কোরোনা। আসলে হীরার মূল্য যেমন জহুরী বোঝে তেমনি মানুষের মূল্যায়নের জন্য সঠিক মানুষটি প্রয়োজন। প্রথমেই তোমার সংসার শুরু করেছো ভুল মানুষের সাথে। তারপর শুধু সামাজিকতা আর লৌকিকতার জন্য সংসার গড়েছো। নিজের মন কি বলে একটিবার কি ভেবেছো? যখন প্রথম সংসারেই সুখী হলে না তখন কেন আমার খোঁজ করনি? আমি তো তোমার সুখের ডালি নিয়ে বসেছিলাম। তুমি একদিন এসে মালা গাঁথবে সে স্বপ্নে। দেখ আমার স্বপ্ন আজ সত্যি হতে চলেছে। শুধু শুধু জীবনের এতগুল বছর আমরা নষ্ট করেছি।
আমি আর তোমার দুঃখ বিলাসিতায় অংশ নেব না। তুমি কেন এভাবে নিজেও একা কষ্ট পাও আর আমাকেও বন্চিত করছো? আমার কি কোন স্থান নেই তোমার কাছে? এত কিসের ভয় সমাজ সংসারকে? আমরাই তো সংসার গড়ি আমরাই তো সমাজ। নিজেদের বিবেকের কাছে স্বচ্ছতাই বড় বিষয়। তুমি একবার সামনে আসো দেবী দেখ সব কত সহজ। তোমার কষ্টের পালা শেষ, আমার অপেক্ষার পালাও। তোমাকে একপলক দেখতে চাই, এতটুকুতে কেন কার্পণ্য তোমার? আমাকে বিশ্বাস হয় না? আমি যে আর পারি না। এত বছরের প্রতিক্ষা তবুও শেষ হয় না। কি দোষ করেছিলাম জানিনা। কোন অভিশাপে সৃষ্টিকর্তা এরকম শাস্তি দিচ্ছেন।
সৌম্যর চিঠি ১৪
প্রিয় রাধা,
তুমি কেমন আছ? জানি তুমি বলবে ‘ভাল আছি’। সবসময় যা বলো।
কারণ এই হল আমার রাধা। কখনোই মন্দ থাকে না। হয়তো মন্দকে জয় করে ভাল থাকার এক অসীম শক্তি তোমার। আমি বারবার বিস্মিত হই। ভগবানের বিশেষ কৃপা তোমার প্রতি। যত তুমি সহ্য করো, তার চাইতে কষ্টের মাত্রা প্রতিনিয়ত বেশী করে তোমাকেই যেন জগতের সকল পরীক্ষার জন্য আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি করার এক যজ্ঞ শুরু হয়। কেন এরকম সর্বংসহা হতে হবে তোমাকে?
আমার ভাল লাগে না তোমার এত উদারতা। সমাজ সমাজ করে নিজেকে যে শেষ করে দিলে, তাতে সমাজের কি উপকার হল আমি বুঝিনা! নিজে যদি ভাল না থাকো, সমাজের কথা চিন্তা করে একা একা জীবন কাটানোর কোন মানেই আমি দেখিনা। আমি জানি তোমার উদারতার কাছে দেবী হার মানে। তাই বলে তুমি তো দেবী নও, মানুষ তুমি, নারী তুমি। যেমন কারো মা আবার কারো কন্যা, তুমি কারো প্রিয়তমাও তো হতে পারো। সকলের মন বুঝে চলো, নিজের মনের খবর কি রেখেছো? কাঁদতে জানোনা তুমি, শুকনো চোখের কোণে যে কালি জমেছে সে খেয়াল আছে! কতদিন কাজল দাওনি চোখে? লিপস্টিকে রাঙিয়ে রেখেছো যে ঠোঁট, সে খরায় ফেটে চৌচিড় হয়ে আছে, তা বুঝতে পারো? যে মিস্টি হাসিতে দু:খগুলো লুকিয়ে রাখো, সেই গালে কতকাল টোল পরেনি, তা কি কেউ দেখেছে? বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈ চৈ করে বেড়ানো তোমার কি একটা যুগল ছবির সাধ থাকতে পারেনা? তোমার এই সমাজ সংসারের দোহাই আমার মাথায় আসে না।
তুমি আমারে যতবার জিজ্ঞেস করবে ততবার আমি বলবো, তোমার আমার দেখা হবার মধ্যে কোন পাপ নেই। মনের সকল অপরাধবোধ তুমি ঝেড়ে ফেলতে পারো। আমাদের শুদ্ধ মন। পরিণত বয়সে এসে কোন ভুল ভ্রান্তির কথা চিন্তায় এনো না। তোমার প্রতি আমার যে অনুভূতি তা কিছু দিয়ে পরিমাপযোগ্য নয়। আমাদের একের অপরের প্রতি যে শ্রদ্ধা, তা সদা সতর্ক পরস্পরের সম্মান রক্ষায়। সমাজ সংসার সকলের কাছে তুমি শুনে দেখো, আমাদের আবার দেখা হবে বলেই এত আয়োজন। তুমি যদি এক পা আগাও, আমি সাত সমুদ্র পার করতে পারি। আমি তোমার জন্য তিন যুগ বসে আছি, বাকী জীবন না হয় এভাবেই থাকবো। তুমি একবার দেখা দিলে আমার এই পথ চাওয়া স্বার্থক হয়। আমার উপরে আস্থা রাখো দেবী, আমি তোমার অসম্মান হয় এমন কিছুই কখনো চাইবো না।
আর কোন কথাই আমি শুনবো না। এবার আমাকে তারিখ দিতেই হবে। তুমি সারাদিনের জন্য আসো। আমরা ঘুরবো, তোমার প্রিয় স্টেক খাবো, আর এত বছরের সব গল্প শুনবো।
তোমার সাথে এতবছর পর দেখা হবে সে স্বপ্নও দেখছি অনেকদিন ধরে। তুমি কত বড় হয়ে গিয়েছো! কি সুন্দর গুছিয়ে শাড়ি পরতে শিখেছো। মনে মনে ভাবি, তুমি টুকটুকে লাল রঙের একটা শাড়ি পরে এসেছো। আমি তার চাইতেও গাড় লাল গোলাপের তোড়া হাতে তোমার অপেক্ষায়। প্রথম দেখায় কি করবো তাও ভেবে রেখেছি। কপালে একটা চুমু দেবো। যা আগে কখনো করতে পারিনি।
তারপর আমরা হাত ধরে সারা শহর ঘুরে বেড়াবো। ক্লান্ত হয়ে পথের ধারে কোন বেঞ্চে গিয়ে বসবো। কফি খাবো তোমার প্রিয় টিম হর্টনস-এ। টু ক্রিম নো সুগার, তোমার কফির অর্ডারও আমার জানা আছে। আমি শুধু ব্ল্যাক টি। তোমার কি একটু ঠান্ডা লাগবে? দুপুর গড়িয়ে এটকু ঠান্ডা পরতে পারে। তখন আমার ব্লেজারটা তোমার পিঠে ঝুলিয়ে দিয়ে তোমাকে গরম রাখবো। তারপর তোমার পছন্দের স্টেকের রেস্টুরেন্টে ঢুকে আমি স্যামন আর তুমি স্টেক খাবে। সাথে পছন্দের রেডওয়াইন। চুমুকে চুমুকে চলবে আমাদের গল্প। আমি শুনবো আর ওয়াইন গ্লাসের মধ্য দিয়ে তোমাকে দেখবো। আমি জানি বেহায়ার মত আমি চোখ ফেরাতে পারবে না। লজ্জা পেলেও আমি তোমাকে দেখবো। আমাকে সেদিন বাধা দিওনা।
আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। এবার দেখা দাও।
আমি আমার শহর থেকে ফ্লাইটে আসি আর তুমি গাড়ি চালিয়ে চলে আসতে পারবে মধ্যবর্তি কোন শহরে। সারাদিন শহর ঘুড়ে আবার যার যার শহরে ফিরে যাব। তোমাকে কিচ্ছু ভাবতে হবেনা।
কতদিন ধরে ভাবছো। এবার একটু সাহস করো। দেখ জীবনটা কত সহজ। মনের স্বচ্ছতা আমাদের কখনোই ঝাপসা হয়নি। তোমার সেই সৌম্য আজো তেমনি আছে। কখনোই তোমাকে হতাশ করবেনা। এবার আর কোন কথাই শুনবো না। বার বার রাজী হয়ে তুমি আবার পিছিয়ে যাও। এবার আমি আসছি, দেখা না করে যাবো না। এরপর তুমি ভেবে দেখ কি করবে।
তোমার সৌম্য
১৭ রাধার চিঠি
সৌম্য,তোমাকে বার বার বলেছি এরকম হবার নয়। তুমি কথা শুনতে চাও না। দেখ তো কেমন হল? এত সাহস সঞ্চয় করে, আয়োজন করে সকলকে ফাঁকি দিয়ে যদি দেখা করতে মন স্থির করলাম।
এখনো এদেশ ওদেশ করতে কোভিড টেস্ট করতে হয়। অনলাইনে খোঁজ করে দেখি ২৪ ঘন্টা আগে টেস্ট করতে হয়। তখন খোঁজ খবর নিয়ে কাছের এক হেল্থ সেন্টারে অনলাইনে এপয়েন্টমেন্ট করলাম। সেখানে গিয়ে সকাল সকাল লাইন ধরে বসলাম। চারদিকে তাকিয়ে দেখি পরিচিত আবার কারো সাথে দেখা হয়ে যায় কিনা। যদিও যে কোন কারণেই কোভিড টেস্ট করানো যায়, কিন্তু মনে যে ভয় তার থেকে পালানোর উপায় কি? গুটিশুটি দিয়ে বসে রইলাম নিজের নাম ডাকা পর্যন্ত। নাকের ভিতরে লম্বা কটন বাড্স ঢুকিয়ে তারপর হাচি দিতে দিতে কোভিড টেস্ট দিয়ে এলাম। পরেরদিন রওণা করবো। সারারাত ফোনে ফেইসটাইমে পাখী পরানের মত রাজী করাও কিন্তু দিনের বেলা আবার আমি মত পাল্টে ফেলি। এরকম করে কয়েক সপ্তাহ পার হয়েছে। এবার শক্তি সঞ্চয় করে আছি, মতে দৃঢ় থাকতে হবে।
কোন জামা পরবো, এখনো ঠান্ডা আছে। কোন জ্যাকেটে ভাল মানাবে। খুব বেশী সাজাও ঠিক হবে না। পাসপোর্ট গুছানো, মনের মধ্যে ঘর পালানোর মত আশঙ্কা। শূন্য ঘরের প্রতি পাহাড়সম দায়বদ্ধতা, নিজের কাছে যত রাজ্যের জবাবদিহিতার অবসান ঘটালাম। সেমি ফর্মাল সুন্দর হালকা পেস্ট কালারের টপ পড়লাম সাথে একই রঙের আর ধূসর চেক প্যান্ট-উপরে আমার প্রিয় হলুদ স্প্রিং জ্যাকেট। পায়ে ছাই রঙা আরামদায়ক জুতো পরে রওণা করলাম ভোর বেলা। ভোরের নরম আলো আর হালকা শীতের বাতাস আমাকে যেন স্বাগত জানালো নতুন পথে। এই প্রথম একা একা বর্ডার পেরুবো। সব প্রিয় গানগুলো ছেড়ে গাড়ি চালানো শুরু করলাম। সকালেই কথা হয়েছে তোমার সাথে। এয়ারপোর্ট থেকে রওণা করা পর্যন্ত, আমি বিছানায় শুয়েই কথা হয়েছে। আমি যখন যাত্রা শুরু করি তুমি তখন প্লেনে। একেবারে সিনেমার মত এক্সাইটমেন্ট। কি জানি কি হয় দেখা হলে। তোমাকে কেমন লাগবে, আমাকে তোমার ভাল লাগবে তো? এত বছরের ব্যাবধানে কত না পরিবর্তন! বয়স বেড়েছে, পরিবর্তন হয়েছে চেহারার। এই আমি তো তোমার সেই অনু নেই। বয়স হয়েছে- পরিনত বয়স পেড়িয়ে এখন সূর্যাস্তের দিকে ঢলেছি। (চলবে)
লেখক পরিচিতি

কানাডা প্রবাসী ফারহানা পল্লব একজন লেখক, সঙ্গীত শিল্পী, সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং গ্রাফিকস্ শিল্পী। বর্তমানে তিনি অন্টারিও বাঙ্গালী কালচারাল সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক।