নিভৃতে

রীনা গুলশান

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

এসব অনেক আগের কথা, তখন সারা ফ্রাঙ্কের প্রেমে মত্ত। এবং ওরা অনেক দূর এগিয়েও গেছে। তবু সারা ফ্রাঙ্ককে একটি নিবিড় মুহূর্তে বলেছিল-

: ফ্রাঙ্ক, কিছু দিন আগে তোমাকে একটা রেস্টুরেন্টে অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখা গিয়েছিল, মেয়েটি কে?

: আচ্ছা কে দেখেছিল?

: সেটা বিষয়বস্তু নয় ফ্রাঙ্ক! মেয়েটি কে? তাই বল।

: ওহ! তুমি স্টেফানির কথা বলছো?

: কে এই স্টেফানি? আমি তো একে চিনি না, কখনও এর নামও শুনেছি বলে মনে পড়ছে না!

: হ্যাঁ ঠিকই বলেছো স্টেফানি জারট্রুডো হলো আমার একজন কাজিন। মানে আমার একটা দুঃসম্পর্কের ফুপু। সে অনেক আগে জার্মান চলে গিয়েছিল। বিয়েও করেছে জার্মানী ছেলে। স্টেফানি সেই ফুপুর মেয়ে। ইটালি এসেছিল বেড়াতে। আমি একটু টুরি‌্যজমের কাজ করছিলাম।

: ওহ।

: কেন, তুমি কি আমাকে সন্দেহ কর?

: না, না জানু, আমি কি তোমাকে সন্দেহ করতে পারি?

বলতে বলতে ফ্রাঙ্কের বুকের ভেতরে তার মাথা গুঁজে দিয়েছিল গভীর ভালোবাসায়।

তখন সারা ফ্রাঙ্কের ভালোবাসায় এতটাই উন্মত্ত হয়েছিল যে রীতিমত হীতাহীত জ্ঞানশূন্য হয়েছিল। কোন কিছু দেখেনি। কারো কোন কথায় কর্ণপাতও করেনি। ভালোবাসার মরীচিকা প্রবাহে কেবল হারিয়ে গিয়েছিল।

আজ এতদিন পর তার ভালোবাসার উন্মত্ত মোহনায় ঢেউগুলি কেমন থিতিয়ে আসছে। এখন শুধু দেখছে শুকনা বালুকণা। সারা এখন অনেকটা দিশেহারা।

হৃদয়ের গভীর কোণে কেবলই চাপা যন্ত্রণা গুমরে মরছে। এবং ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছে, ও ভুল করেছে। শুধু ভুল নয়। গভীর গাড্ডায় পড়েছে। আর এর থেকে কিভাবে বের হবে সারা নিজেও বুঝতে পারছে না। ভেতরে ভেতরে ও প্রচণ্ড বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এখন ও নিজেও খুবই বিরক্ত অনুভব করে ফ্রাঙ্কের আচরণে-

: কি ব্যাপার ফ্রাঙ্ক, তুমি এখন দেখি রোজই রাত করে বাসায় ফিরছো?

: হ্যাঁ, আমার কাজ থাকে।

: তা কি কাজ শুনি?

: যাই হোক, তোমাকে কৈফিয়ত দেব নাকি?

ফ্রাঙ্ক চিৎকার করে। কারণ সে তখন বদ্ধ মাতাল।

: তুমি আবার মদ খেয়ে বাড়ি এসেছো? কোনো কাজের বেলায় নাই! লজ্জা করে না তোমার! শ্বশুর বাড়ি পড়ে থাকো, আর বৌয়ের টাকা দিয়ে মদ খাও। স্পাইনলেস, এ্যাম্বিশনলেস একটা-

: কি, কি বললি, তোর এত বড় স্পর্ধা আমাকে টাকার খোটা দিস। আরে আমিতো মনে করেছিলাম তোরা অনেক টাকার মালিক। বেশ বড় সড় ব্যবসা করবো। কিন্তু তোর বুড়ো বাপ তো ট্যাক থেকে একটা পয়সাও ছাড়ে না।

: ফ্রাঙ্ক মুখ সামলে কথা বল। খবরদার আমার বাবার নামে যদি আর একটা কথাও বল।

: কি করবি? আরে তোর তো শুধু একটু রূপ আছে, তাও তো গাইয়া মার্কা, আর স্টেফেনি। তার যেমন রূপ তেমনি স্মার্ট। এমনকি সে তো আমাকে জার্মানে নিয়ে তাদের বিশাল ব্যবসার অংশীদারও করবে বলেছে।

: কি, কি, তুমি.. কি বললে?

: চুপ, হারামজাদী, বেশি ক্যাট ক্যাট করিস না!

বলেই ঝুপ করে বিছানায় শুয়েই নাক ডাকতে শুরু করে।

আর সারা? ওর বাকি রাত চলে যায় চোখ চেয়ে। একি শুনলো সে? ও কাঁদতেও পারে না। বুকের ভেতরে সমস্ত কান্নাগুলো মরে গেছে। অসম্ভব আঘাতে ও যেন পাথর হয়ে যায়। এমনিতেই বেশ ক’দিন ধরেই সারা বেশ ডিপ্রেশনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। ফ্রাঙ্ক কোন কাজ কাম করছিল না বলে সে তার বাবা-মা’র সামনে যথেষ্ঠ লজ্জিত ছিল। তবুও ছোট্ট ফাবিয়ানের মুখ চেয়ে ও সব সহ্য করে যাচ্ছিল। কিন্তু আজ ও এ কি শুনলো? তাহলে তার ব্রেস্টফ্রেন্ড রোডিকা যা বলেছিল, তার প্রতিটি বর্ণ সত্যি ছিল। কিন্তু ও ‘মুখপুড়ি’, রোডির কথা সে সময়ে বিশ্বাস করেনি। তাছাড়া রোডির বয়ফ্রেন্ড কেভিন মারকেজেও তার ভায়ের মত। ওদের একই এলাকার ছেলে। ওদের দু বছরের সিনিয়র ছিল। কিন্তু খুবই ভদ্র, সৎ এবং ভাল ছাত্রও ছিল। যেহেতু রোডিকার বয়ফ্রেন্ড সেই জন্য কেভিন তাকেও খুব পছন্দ করতো। তবে কেন সে কেভিনের কথা, বিশ্বাস করলো না? উল্টো ঐ ঘটনার পর থেকে সে কেভিনের সাথে ভালো করে কথাও বলেনি। এমনকি গত মাসে তো রোডিকা আর কেভিনের এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠানেও সে যায়নি ফাবিয়ানের অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে।

উহ্! এখন সারা কি করবে? কিন্তু সারার একটুও কান্না পায় না। বরং তার বুকের মধ্যে অসম্ভব রকম ক্রোধ আর জেদ চেপে বসে। ভালোবাসার বিশ্বাস ভঙ্গতায় সারা পাগলের মত ঘর থেকে বের হয়ে যায়। কারণ ফ্রাঙ্কের সাথে এক ঘরে রাত কাটানোর কথা ভাবতেও তার প্রচণ্ড ঘৃণা হচ্ছিলো। রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়। সারা বাড়ির পেছনে তার অনেক প্রিয় জলপাই গাছের গুড়িতে যেয়ে বসে থাকে। রাতের আকাশে তারাগুলো নীরব প্রহরীর মত জ্বলতে থাকে। এই সব চিরচেনা বাতাবরণ কেন আজ সব কিছু এত অচেনা মনে হচ্ছে? কেন এক লহমায় সারার সমস্ত সাত রঙের পৃথিবীটা বদলে গেল? এতক্ষণে সারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। সারা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলে-

: কে, কে এখানে? সারার বাবার কণ্ঠ।

কণ্ঠটা ক্রমশ কাছে চলে আসে-

: একি? সারা, মা, তুই? এত রাতে এখানে? সারার বাবা খুবই ব্যাকুল হয়ে পড়ে। সারা তার একমাত্র আদরের মেয়ে। অনেক বেশি বয়সে এই মেয়েটি হয়েছিল। বিয়ের দশ বছরেও কোন বাচ্চা হয়নি। ডাক্তার বদ্যি কত যে করেছে তার কোন হিসাব নাই। তারপর সৃষ্টিকর্তার কাছে অনেক কান্নাকাটি করেছিল আলবার্ট আর আমান্ডা। তারপর প্রায় বারো বছরের মাথায় এই ফুটফুটে পরীর মত তাদের সারা জন্মেছিল। এই মেয়ে তার নয়নের মণি। কলিজার টুকরা। আর তার সেই নয়নের মণি রাতের আঁধারে এমন করে কাঁদছে-

: ওরে, আমার সোনার মেয়ে কি হয়েছে তোর? বল? শিঘ্রী বল? আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে? তুই কি জানিস না, তোর কান্না আমি সইতে পারি না!

: বাবা, বাবা, আমার সব শেষ হয়ে গেছে।

: কি হয়েছে? কি শেষ হয়ে গেল? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনারে সোনা।

: বাবা, ফ্রাঙ্ক, ফ্রাঙ্ক আমার সাথে প্রচণ্ড চিট করেছে।

: কি বলছিস? আমি বুঝতে পারছি না।

সারা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তারপর ধীরে ধীরে সব বলে চলে। এমনকি স্টেফেনির কথা যে, সে বিয়ের আগেই শুনেছিল রোডিকার কাছে; সেটাও বলে। কিন্তু সে বিশ্বাস করেনি। তাছাড়া সে সময়ের তার প্রেগন্যান্সিও ধরা পড়েছিল। তখনতো সে ফ্রাঙ্কের প্রেমে দিশেহারা। তাকে সে তখন অন্ধের মত বিশ্বাসও করতো।

: বাবা, আমার এখন কি হবে? আমি এ কি করলাম? আমি তোমাদের কারো কথা শুনিনি।

: ঠিক আছে মা, এখন আর ওসব বলে কি হবে? যা হবার তাতো হয়েই গেছে! তাই না?

: না, বাবা, হয়ে তো গেছেই। আমার জীবন তছনছ হয়ে গেছে। আর তাছাড়া এখন আমার জীবনের সাথে আর একটা জীবন জুড়ে গেছে। বাবা, তাকি তুমি ভুলে গেছো?

: ফাবিয়ানের কথা বলছিস?

: হ্যাঁ বাবা, আমার ফাবিয়ান। ওর কি হবে?

: ওর আবার কি হবে? ওর কথা তোর চিন্তা করতে হবে না। ও আমার নাতি। আমার জান। আমার সবেধন নীলমণি।

: কিন্তু, বাবা! বাপ ছাড়া একটা বাচ্চা কিভাবে বড় হবে?

: সেটা তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তাছাড়া বাপ হিসাবে ফ্রাঙ্ক এমনিতেই কি করেছে ওর জন্য?

: তা ঠিক, ফাবিতো তোমাদেরই সব। ফ্রাঙ্কতো ওকে ছুঁয়েও দেখে না।

: তাহলে এটা নিয়ে ভাবাভাবিটা আমার উপর ছেড়ে দে । তুই এখন ঘরে চল।

পর দিনের সকালের সূর্যটাও সারার চোখের উপরই একটু একটু করে আলোকিত হলো। এবং এক সময় ফ্রাঙ্ক ঘুম থেকে উঠলো। দেখলো তার বিছানায় সারা নাই। তখন ফ্রাঙ্কের একটু একটু করে রাতের মত্ততার কথা মনে হলো। সে সারা’র নাম ধরে কয়েক বার ডাকলো। কিন্তু সারাকে কোথাও দেখলো না। একটু পর দেখলো ঘরের দরজায় তার শ্বশুর আলবার্ট বারটুচির দীর্ঘ ছায়া। ফ্রাঙ্ক তাকে দেখে খুবই ঘাবড়ে গেল। কিন্তু আলবার্ট কোন সিনক্রিয়েট করলো না। খুব শান্ত স্বরে বললো-

: ওকে ফ্রাঙ্ক, অনেক হয়েছে। এবার পথ দ্যাখো। তোমার কাপড়-চোপড় যা কিছু আছে বেঁধে সোজা রাস্তা মাপো।

: আমি, আমি খুবই দুঃখিত কাল রাতের জন্য।

: না, না দুঃখিত হবার কিছুই নাই। আর তুমি জানো, আমি খুবই প্র্যাকটিক্যাল ধরনের মানুষ। এসব আলগা দুঃখ আমার আসে না। তুমি কথা না বাড়িয়ে সোজা রাস্তা মাপো।

: কিন্তু, আমার বৌ-বাচ্চা?

: বৌ-বাচ্চা? এবার আলবার্ট বিকট স্বরে হুঙ্কার ছাড়লো-

: তোর আবার কখনো বৌ-বাচ্চা ছিলো নাকি?

: কিন্তু, আমার বাচ্চা রাখার আপনার কোনই অধিকার নাই?

: কি বললি? যদি মার খেতে না চাস অথবা পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভার না হতে চাস তো সোজা আমার চোখের সামনে দিয়ে চলে যা।

: কিন্তু আমি সারার সাথে একটু কথা না বলে যাবো না।

: ওকে। কথা বল। সারা মা, এদিকে আয়তো, ফ্রাঙ্ক তোর সাথে কথা বলবে।

: না বাবা, আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই না- সারা দূর থেকে চিৎকার করে।

: সারা আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই। ফ্রাঙ্ক চিৎকার করে।

: ওকে, বল, তোমার আর কি বলবার আছে।

সারা এতক্ষণে ফ্রাঙ্কের সামনে আসে তার উদভ্রান্ত  রাত জাগা চেহারা নিয়ে। চোখ দুটি রক্তের মত লাল। চুল এলোমেলো। ফ্রাঙ্ক অবাক হয়ে চেয়ে থাকে সারার দিকে। সারাকে চেনাই যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এক রাতে বয়স বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ওর শরীরের এবং হৃদয়ের উপর একটা টর্নেডো চলে গেছে।

: ওকে, তোমরা তাহলে কথা বল, আমি ওদিকে যাচ্ছি। আলবার্ট সারাকে এগিয়ে দিয়ে, নিজে চলে যায়।

ফ্রাঙ্ক দৌড়ে এসে সারাকে জড়িয়ে ধরতে চায়, সারা এক ধাক্কা মেরে ফ্রাঙ্ককে সরিয়ে দ্যায়। তারপর ঠিক পাগলের মত গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করে-

: খবরদার, আমাকে ছোবে না। তোমার এত বড় স্পর্ধা! আবার আমাকে টাচ করো, ইউ লুজার।

: সারা, সুইট হানি- আমি গত রাতের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। আমি খুবই লজ্জিত। প্লি­জ, প্লি­জ, ক্ষমা করে দাও। আর কখনো এরকম হবে না।

: আর কখনো, কি হবে না? মাতলামি করবে না? নাকি বৌ থাকতেও অন্য মহিলার সাথে প্রেম করবে না? তুমি, তুমি জানো, তুমি কি? তুমি একটা অপদার্থ, চরিত্রহীন, মাতাল? কোন সম্পর্কের জন্যই তুমি যোগ্য নও। আমি মরে গেলেও তোমাকে আর, না না, আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

: তুমি কি চিন্তা করে বলছো?

: অবশ্যই চিন্তা করে বলছি। আমি সমস্ত জীবন একা থাকবো তবুও তোমার মত চরিত্রহীন, লোভী, অপদার্থের সাথে আর নয়।

: ঠিক আছে, তবে আমি যাচ্ছি। তবে আমি বলে দিচ্ছি এটা তুমি ভালো করলে না। কোর্ট থেকে আমি ফাবিয়ানকে নিয়ে ছাড়বো।

: চেষ্টা করে দ্যাখো, সারা ঘৃণায় মুখ বাকায়।

এরপর ফ্রাঙ্ক আর বেশীক্ষণ সারাদের বাসায় থাকেনি। কিন্তু যাবার পর সে আর কোর্টমুখোও হয়নি। মিথ্যে আস্ফালনই করেছে।

যার নিজের সারভাইব করবার মতই অর্থ নাই, সে আবার কোর্টে কি যাবে? বরং সারার বাবাই একতরফাভাবে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। আর ফ্রাঙ্ক সিগনেচারও করে দেয়।

সাত

এরপর অনেকগুলো দুঃসহ নির্জিব সময় অতিক্রান্ত  হয়। সারার সময় মনে হয়, থেমে আছে একটি জায়গাতে। সে জায়গার সামনে এগিয়ে যাবার কোন ঠিকানা নাই।

এর মধ্যে তার প্রিয় সখী রোডিকার আর কেভিনের বিবাহ হয় বেশ ধুমধাম করে। যদিও বিবাহের সময় রোডিকাও পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলো। বিয়েতে যদিও সারার যাবার খুউব ইচ্ছা ছিল না, শেষ পর্যন্ত  রোডি আর কেভিনের প্রচন্ড জোরাজুরির কারণে, ফাবিয়ানকে নিয়ে ওদের বিয়েতে অংশগ্রহণ করে। ওখানে যেয়েই তাদের অন্যান্য কমন কিছু বন্ধুদের কাছে শুনতে পায়, ফ্রাঙ্ক নাকি সেই স্টেফানি জারট্রুডোকে বিয়ে করে জার্মান চলে গেছে এক সপ্তাহ আগেই। সারা নির্বিকারভাবে সব শুনে গেলেও ওর বুকের মধ্যকার উথালপাথাল কান্নাগুলো থমকে যায়। জীবনের প্রথম প্রেম! প্রথম বিশ্বাস ভঙ্গতায় সারা যেন পাথর হয়ে যায়। ফাবিয়ানকে অনেক জোরে বুকে জড়িয়ে, নিজের ভেতরের কান্নাগুলোকে শক্তিতে পরিবর্তনের আপ্রাণ চেষ্টা করে। সারা কি এই জীবনে তার প্রথম প্রেম, তার বাচ্চার বাবাকে কখনোই ভুলে যেতে পারবে? আসলে মানুষ অনেক কিছুই পারে না। ঝরে যাওয়া ফুলকে ধরে রাখতে পারে না। তার এই অবিরত ঝরতে থাকা অশ্রুকে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। তার নিজেরই ভুলের মাশুলে ডেকে আনা দুঃখকে আর কখনোই ফিরিয়ে নিতে পারবে না। হয়তো বাকি জীবনটা অতিক্রান্ত  হবে, এই দুঃখ-এর ছায়াগুলোকে সঙ্গী করে।

যখন দুঃখ আসে, তখন চারদিক ঘিরে আসে। কারণ, তার জীবনের এই অসম্ভব ঘন ঘোর আমাবস্যার মধ্যে তার বাবাও হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লো। তার হার্ট এ্যাটাক হলো। আসলে সারার এই অনভিপ্রেত দুঃখ আলবার্ট নিতে পারেনি। সারার ক্রন্দসী ছায়া আলবার্টকে পলে পলে মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেছে। তাকে হাসপাতালে নেবার প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর জ্ঞান ফেরে। সারাকে ডাক দেয়-

: মা সারা, আমার বোধহয় ডাক এসেছে।

: বাবা, এসব বলো না প্লি­জ। একটি বার ভাবো, তুমি চলে গেলে আমার কি হবে? আর আমার ফাবির, তার তো তুমি ছাড়া আর কে আছে?

: না মা, ওসব চিন্তা করো না। সৃষ্টিকর্তার উপর আমার অপার বিশ্বাস। উনি তোমাদেরকে ভালো রাখবেন। আমি তোমাকে ডেকেছি অন্য একটা কারণে, আমি কিছু দিন আগে একটা উইল করেছি। আমার বেড রুেেমর কালো দেরাজের মধ্যে রাখা আছে। নীল রঙের একটা ফাইল। আমার সব প্রোপার্টি তোমাদের তিনজনের নামে সমান ভাগে লিখে দিয়েছি। তোমাদের কোন রকম অর্থনৈতিক অসুবিধা হবে না। টনি সব দেখাশুনা করবে। তুমি জানো, টনি খুবই বিশ্বস্ত। তোমার নামে ব্যাংকে বেশ কিছু টাকা রাখা আছে। তুমি পড়াশুনাটা শেষ করবে। আর সব স্থাবর সম্পত্তি ফাবির নাম-এ দিয়েছি। ওগুলো দেখাশোনা তোমার মা করবে।

আর মা সারা, জীবনটা তুমি থামিয়ে রাখবে না। এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটা আমার বিশেষ অনুরোধ।

: বাবা, তুমি এই সব কি বলছো? তোমাকে ছাড়া আমাদের আর কিছুই দরকার নাই।

সারা অঝোরে কাঁদতে থাকে। পাশে ফাবিয়ানকে কোলে নিয়ে আমান্ডাও কাঁদতে থাকে। ফাবিয়ানের তখন ২ বছর হতে আর ৩ মাস বাকি ছিল। ওদের সবাইকে ওভাবেই কান্নার সাগরে ডুবিয়ে আলবার্ট এই পৃথিবীর সব মায়া ছেড়ে চলে গ্যালো। কারো কান্নাই তাকে ধরে রাখা গ্যালো না।

ফাবিয়ান কত দিন ‘নানা’ ‘নানা’ করে ডেকেছে। দুই চোখ দিয়ে খুঁজে বেড়িয়েছে সারা বাড়িঘর।

এক দিকে ফ্রাঙ্কের সাথে বিচ্ছেদ অপরদিকে তার প্রিয় বাবার মৃত্যু সারাকে যেন স্থবির করে দেয়। তখন আমান্ডাই ফাবিয়ানকে আরো আঁকড়ে ধরে। আর সারা নিজেকে এতদিন পর যেন সব হারিয়ে নিজের ভেতরে নিজেকে ফিরে পেল। বাবা নাই। একা মা আর কত দিকে সামলাবে। সারাও তখন সংসারের কিছু কিছু দায়িত্ব নিতে শুরু করলো। ফাবিয়ানকে বড় করতে হবে।

এর মধ্যে তার প্রিয় বন্ধু রোডিকার একটা কন্যা হলো। সারাই তার নামকরণ করলো ডোরিন মারকেজে। ঠিক যেন একটা ফুটফুটে পুতুল। এখন সারা অনেকটা সময় রোডির সাথে কাটায়। একদিন রোডিকাই বলে-

: সারা, বসে না থেকে একটা কিছু কর।

: কি করবো, বলতো? আমারও আর এভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। ফাবিয়ানের ২ বছর বয়স হয়েছে। আর ওতো মা’র কাছেই থাকে।

: তাহলে এখন কলেজে ভর্তি হয়ে যা।

: নাহ্! আমার ও রকম লং কোর্স করবার মত এনার্জি নাই!

: তাহলে কি করতে চাস?

: ভাবছি, ছোটখাটো কোন একটা ডিপ্লে­ামা কোর্স করবো।

তখন পাশ থেকে হঠাৎ কেভিন বললো-

: সারা, তাহলে তুমি বরং ‘হেয়ার স্টাইলিস্টের’ কোর্সটা কর।

: হু! এটা খুউব ভালো একটা আইডিয়া দিয়েছো। আমিও এরকম কিছু একটা ভাবছিলাম।

: তা কি রকম খরচা পড়বে তুমি কি জান?

: ঠিক আছে সারা, আমি কালই এই ব্যাপারে ডিটেলস জেনে তোমাকে জানিয়ে দেব।

সারা খুউব আনন্দ নিয়ে বাড়িতে এসে মাকে সব বললো। আমান্ডাও খুউব খুশি হলো। তারও মনে হলো তার একমাত্র কন্যাটি বড় বেশি মৃয়মান হয়ে পড়েছে। ওর একটা কিছু করা উচিত। এই ভয়ঙ্কর দুঃখের স্রোত থেকে ওর বের হওয়া দরকার।

কেভিন পর দিনই সব তথ্য নিয়ে ওদের বাড়িতে আসে। ঠিকানাও দিয়ে যায়। আর বলে সব মিলিয়ে কত ‘ইউরো’ লাগবে?

সারাতো পরবর্তী সেমিস্টারেই ভর্তি হয়ে গেল। এবং কিছু দিনের মধ্যেই সারা তার হারানো উদ্যম ফিরে পেল। মজার ব্যাপার কোর্সটা সারার খুবই ভালো লেগে গেল। সে অতি উৎসাহের সাথে কোর্সটা সম্পন্ন করলো। ঐ স্কুল থেকেই সারাকে একটি পার্লারে পাঠিয়েছিল কো-অপ করার জন্য, তারাই ওকে হায়ার করলো ফুলটাইম। সারা চাকরিতে জয়েন করেই যেন হারানো জীবন ফিরে পেল। সে এখন মাত্র বাইশ বছরের তরুণী। তার রূপ যেন এখন ফেটে পড়ছে। আর তাই চারপাশে উৎসাহী তরুণের ভিড়ও কম হলো না। তবে সারা এখন যথেষ্ঠ সাবধানী হয়েছে। মানসিকভাবে পরিপক্ক। এখন চট করে আর কাউকে তেমন বিশ্বাস করে না। মাথার মধ্যে ফাবিয়ানের চিন্তাতো আছেই। তবে বয়স? সে তো কথা বলবেই। বাইশ বছরের ঐ রকম সুন্দরী তরুণী। সারাক্ষণই ওকে কেউ না কেউ উত্যক্ত করছে।

ফাবিয়ান ইতিমধ্যে দুই বছর পেরিয়ে তিনে পড়েছে। মা আর নন্না ছাড়া কিছুই বোঝে না। আমান্ডার জীবনও ফাবিয়ানময়। তাছাড়া তার স্বামীর রেখে যাওয়া জমিজমা দেখাশুনা তাকেই করতে হয়। যদিও তার জন্য লোকও আছে। তথাপি এখন আমান্ডার নিঃশ্বাস নেবারও ফুরসৎ নাই। তবুও আমান্ডার বুকের মধ্যে এখন যথেষ্ঠ স্বস্তি। কারণ তার একমাত্র কন্যা আবার হাসতে পারছে। অবশ্য মাঝে মধ্যে বেশ খানিকটা মৃয়মান হয়ে যায়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। হয়তো বা লুকিয়ে কাঁদে। আমান্ডা একদিন দেখে ফেলে তার কলিজার টুকরা সারা নীরবে কাঁদছে-

: সারা মা, তুই কাঁদছিস?

: না মা, ঠিক আছে। আমি ভালো আছি।

: না, তুই কাঁদছিস? কার জন্য? ঐ ফ্রাঙ্কের জন্য? যে কিনা তোকে নরকের জীবন দিয়েছিল?

: না মা, আমি ওর জন্য কাঁদছি না। ওকে আমি আমার হৃদয়ের গভীর থেকে উপড়ে ফেলেছি। আমি কাঁদছি বাবার জন্য। আমার ফাবির জন্য।

: আমি জানি তুই তোর বাবাকে কত ভালোবাসতিস।

: হ্যাঁ মা, সেই জন্যই কাঁদছি যে, যে বাবাকে আমি এত ভালোবাসি। সেই বাবাকে আমি কত কষ্টই না দিয়েছি!

: ঠিক আছে সারা, ওসব ভেবে আর কি হবে? অল্প বয়সে মানুষ ঐ রকম অনেক ভুল করে।

: হ্যাঁ মা, আর আমার সেই ভুলের মাশুল দুটো জীবনকে দিতে হলো! বাবা, আমার দুঃখে, হতাশায় পলে পলে মরেছে।

: সারা ওসব কথা থাক মা।

: না মা, আমাকে বলতে দাও। কত কষ্ট পেয়ে বাবা মরেছে। যে বাবা আমার কোন চাওয়াকে কখনো না বলেনি। আমি সেই বাবাকে কত কষ্ট দিয়েছি।

: কিন্তু তোর বাবা তোকে অনেক ভালোবাসতো। তোর দেওয়া কোন কষ্টই তাকে স্পর্শ করতো না। আর তাছাড়া সেও জানতো এটা তোর একটা ভুল ছাড়া আর কিছুই নয়। সে বরং সারাক্ষণ ফাবিয়ানের কথা ভেবে কষ্ট পেত।

: হ্যাঁ মা, আমার ছেলেটার কি হবে? ওতো জীবনে কখনো বাবাকে পেল না। বাবার ভালোবাসা জানলো না!

: তা ঠিক বলেছিস। একটা সন্তানের জন্য তার বাবার ভূমিকাও কম নয়। এই যে তুই, তোকে আমি শুধু জন্মই দিয়েছি। বাকি সব তোর বাবাই করতো। তোর বাবার মতো সন্তানের প্রতি এরকম ডিভোটেড বাবা আমি খুব কম দেখেছি।

: হ্যাঁ মা, ঠিক বলেছো। আমার বাবা ছিল বেস্ট ফাদার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।

মা-মেয়ে দুজন দুজনার গলা জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদে আলবার্টের জন্য।

(চলবে)

রীনা গুলশান

লেখক পরিচিতি

লেখক রীনা গুলশান বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিকে তার কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, রম্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে কানাডার বিভিন্ন বাংলা পত্রিকাতেও। তিনি ‘প্রবাসী কণ্ঠ’ ম্যাগাজিন এর একজন নিয়মিত কলামিস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *