খাঁচার ভিতর অচিন পাখি 

 মোল্লা কাউসার

বজলুর রহমান সাহেব ভীষণ রাগী মানুষ । সবকিছু নিয়ে তার রাগারাগি না করলেই যেন নয় । রাগারাগি হয়তো উনার বংশগত কারণ উনার পিতারও ছিলো অনেক রাগ । কিন্তু সেই তুলনায় আবিরের কোনো রাগই নেই , নেই বললে অবশ্য ভুল হবে আসলে অন্যের উপরে কোনো রাগ ঝাড়বার তার ইচ্ছে নেই কারণ সব রাগ তার নিজের উপর !

আবির রহমান হলো বজলুর রহমান এবং শাহেদা খানম এর প্রথম সন্তান । তাদের আরো একটি সন্তান আছে, নাম আদর রহমান । দুটো সন্তান নিয়ে রাজাবাজারের একটা দোতলা বাসায় বজলুর রহমান সাহেবের সংসার ।

হটাৎ হটাৎ করেই সন্ধ্যায় বিদ্যুত্ চলে যায় ঘন্টা খানেকের জন্যে । সেই সময় ছাদে উঠে তারা দেখা যায় , আজও আকাশে অনেক তারা দেখলো আবির। তারা আর আকাশের প্রতি অনেক আগে থেকেই দূর্বলতা। তারা দেখলেই আবিরের অনেক দূরের অজানায় হারিয়ে যেতে মন চায় । মাত্র ক্লাস ফাইভে উঠেছে , তাই এই বছর আবিরের উপর পরিবারের চাপ বেড়েছে, কারণ এই বছর বৃত্তি পরীক্ষা । আবিরের মনে হয় বৃত্তি পাওয়া হবে না , তার মাথায় পড়া ঢুকে না তাই একটু কঠিনই হবে। কেন মাথায় পড়া ঢুকে না তা নিয়ে তার মাঝে মধ্যে রাগ হয় । যাই হোক আপাতত আকাশ আর তারা দেখেই দিন পার করছে সে। 

আবিরের পরিবারের কথা বলে নেই আর একটু, একটা সাদামাটা পরিবার। বাবা বজলুর রহমান স্টেশনারী ব্যবসায়ী , ফার্মগেটে একটা বড় স্টেশনারী দোকানের মালিক । মা শাহিদা খানম পুরোপুরি একজন সংসারী মহিলা। রান্না বান্না আর পরিবারের সকলের দেখভাল করাই তার কাজ। আবিরের আর এক ছোট ভাই আছে আগেই জেনেছেন , নাম আদর রহমান এইবার ক্লাস ওয়ানে উঠলো । ও আবার আবিরের থেকে অনেক ভাল ছাত্র। একবার যা পড়ে তা কখনো ভুলে না । সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকে .. হয় সেটা স্কুলের বই কিংবা “ছোটোদের বিজ্ঞান বিচিত্র” বই হোক না কেন ? আদরের একটাই ইচ্ছে, বড় হয়ে বিজ্ঞানি হবে।

আবিরদের বাড়ীটা ছোট্ট একটা দোতলা বাড়ী। আবির আর আদরের একটাই ঘর, বাবা মার একটা, আর একটা বসার ঘর। বজলুর রহমানের যে ব্যবসা তাতে আরো বড় বাড়ী বানানোর সামর্থ্য রাখেন কিন্তু উনি বানান না । পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া দেশের জমি আর ব্যবসার লাভের টাকায় ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে কয়েকটা জমি কিনে রেখেছেন । আরো একটা জমি কেনা নিয়ে হয়তো গন্ডগোল হয়েছে বা অন্য কোনো সমস্যা তাই ছাদ থেকে নেমে বসার ঘরে আবির মোস্তাক মামাকে দেখতে পেলো । যাক আজকে সন্ধ্যায় মনে হয় বেশি পড়তে হবে না কারণ মামার সঙ্গে বজলুর সাহেব কথা বলবে আর আবির আর আদর টিভিতে ম্যাকগাইভার দেখতে পারবে । এই বছর আবিরের বৃত্তি পরীক্ষা উপলক্ষ্যে বসার ঘরের টিভি স্থান বদলে ওদের বাবা মা’র ঘরে নতুন স্থান নিয়েছে । শুধুমাত্র বুধবারই ওরা টিভি দেখতে পায় , তবে আজ আর একটু বেশীই দেখতে পাবে । 

রাতের খাবার টেবিলে বসে আবির আর আদর অনেক খুশি কারণ ম্যাকগাইভার দশটার খবরের পরে একটু বাকি অংশ ছিলো যা দেখতে পেরেছে ( যা অন্য সময় হলে দেখতে পেতো না) আর মোস্তাক মামা বাসায় এসেছে বলে ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়েছে । বজলুর রহমান সাহেব খাবার টেবিলে তেমন কোনো কথা বলেন না, তবুও মোস্তাক মামার দিকে  একবার  তাকিয়ে বললেন ” আগামীকাল রাতেই সবাইকে নিয়ে ঐখানে যাব, তুমি ব্যবস্থা করো”। মোস্তাক মামা খাবার খেতে খেতেই মাথা উপর নীচ করলেন ।

পরেরদিন স্কুল থেকে আসতে আসতে পাচটা বেজে গেলো আবির আর আদরের । হালকা নাশতা করতে না করতে ওদের মা তাড়াতাড়ি ওদের তৈরি করে নিলেন কারণ সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে নাকি আজিমপুরে যেতে হবে । দুটো রিক্সা করে ঢাকা শহরের আলো দেখতে দেখতে ঠিকই সময়মতো পৌঁছে গেলো আজিমপুর । আবিরের ধারণা ছিলো তারা হয়তো কোনো উকিল এর অফিসে আসবে কিন্তু যেই অফিসে ওরা ঢুকেছে, সেটা হলো এক “হস্তবিশারদ” এর অফিস ! অর্থাৎ , হাত দেখে নাকি ভবিষ্যত্ বলে দেয় লোকটা । মনে হয় , সত্যি বলে কারণ অনেক লোক ওদের সঙ্গে অপেক্ষা করছে আবার যারা দেখা করে বেড়িয়ে যাচ্ছে তারা মোটামুটি খুশীই । আবির বুঝতে পারলো না ওরা কেন এখানে ? 

পুরোটা না বুঝলেও আন্দাজ করে নিলো আবির বিষয়টা । হয়তো বাবা’র ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে কিন্তু অন্য কিছু করতে চান তাই ” হাত ” দেখিয়ে কিছুটা আত্নবিশ্বাস পেতে চান । কিন্তু ব্যাপারটা মনে হয় বেশি একটা ভালো যায় নি কারণ  “হস্তবিশারদ” এর কক্ষ থেকে বের হওয়ার পর থেকেই বজলুর রহমান সাহেবের মুখ পুরোপুরি বেজার । অন্য সময় হলে বাসায় বিরিয়ানী’র বা অন্তত মোগলাই পরোটা কিনে ঘরে ফেরা হতো । কিন্তু আজকে কিছুই হলো না , বাইরে থেকে ফিরে তাই আবির আর আদর হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসে গেলো । আবির বুঝতে পারলো হয়তো খারাপ কিছু হবে তাই বাবা আর মা ফিসফিস করে কথা বলছেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন । তারপরে কেটে গেলো অনেক বছর ……..

আবিরের বাসার সামনের বাসায় একটা মেয়ে থাকে। ওদের পুরো পরিবারটিই প্রতিবেশি হিসেবে অনেক আন্তরিক। মেয়েটার নাম তটিনী। মাঝে মঝে আসে আবিরদের বাসায়। ওকে দেখলেই বুকের ভেতর কেমন যেন ধক করে উঠে। ওর মার সাথে খুব ভাব। বাসায় এসে মার সাথে গল্প গুজব করে। আবিরের সাথে খুব একটা কথা হয় না। হঠাৎ সামনা সামনি হয়ে গেলে কথা হয়। তটিনীর সাথে কথা বলাটা আবিরের জন্যে সাহসিকতার ব্যাপার। তাও বলে-
– কেমন আছো তটিনী?
– জী ভাল। আপনি?
– এইতো ভাল। লেখাপড়া কেমন চলছে?
– ভাল। আচ্ছা আমার কেন জানি মনে হয় আপনি একটু কুজো হয়ে হাটেন।
– আ-আ আমি আসি। তুমি যাও মা রান্না ঘরে আছেন।
আবির বুঝতে পারে ওর সাথে দেখা হলেই তটিনী মেয়েটা বিব্রত করার জন্যে নানা ধরনের কিছু না কিছু বলে। তখন আবির আর কথা বলেনা। প্রস্থান করাটাই তখন মুখ্য বলে মনে হয়। তটিনী এবার কোন একটা প্রাইভেট ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হয়েছে। ওরা প্রায় ধনীই বলা যায়। গাড়ি বাড়ি দুই আছে। তটিনীকে কেন জানি বড় ভাল লাগে। তবে ভাল লাগা পর্যন্তই থাকতে হবে। এর আগে যাওয়া যাবে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের এর বেশি যেতে নেই। মেয়েটার সবই ভাল লাগে। খুব বিষণ্ন হাসি আবার ঐ হাসির মধ্যে আছে রাজ্যের রহস্য।

আজকে আবির একটা কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিলো। অনার্স এর পরে সপ্তম ইন্টারভিউ ।  ইন্টারভিউ বোর্ডে তিনজন আছে। তারা কেউ প্রশ্ন করতে ইচ্ছুক না। হয়তো আগেই ঠিক হয়ে আছে কাকে নেওয়া হবে । প্রায় ৫ মিনিট বসে থেকে আবির বললো আমি আসি। তারা যেন হাফ ছেড়ে বাচলো । এখন আবিরের বাসায় যাওয়া উচিত, মাথা ব্যাথা করছে। কারণ তার হটাৎ করেই নিজের উপর ভীষণ রাগ হতে শুরু করেছে । তবু কেন জানি বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। উদ্দেশ্য বিহীন হেটে চললো অনেকটা সময় ,  কারওয়ান বাজার নামক জায়গাটা সরকার প্রচুর টাকা খরচ করে আধুনিক করার চেষ্টা করেছে। তবে বাজার থেকে দুর্গন্ধ দূর করতে পারেনি। আধুনিকের সাথে প্রাচিনতার মিলে মিশে একাকার ।  

টিভি বসার ঘরে। তাই আর আগের মতো দেখা হয় না। তবে আদর মনে হয় কাউকেই ভয় পায় না । বাবাকেও না। ও দিব্যি ঘোরাফেরা করে। আবিরের মনে হয় গত ৪-৫ বছরে বাবার সাথে খেতে বসেনি। তবে মায়ের সাথে আবিরের অনেক মিল। সেইদিনতো মা বললো-
– ও খোকা একটা চাকরি বাকরি কর, করে ঘরে বউ নিয়ে আয়। আমি আর একলা পারি না।
– মা আগে চাকরি তো হোক।
– তোর কি কাউকে পছন্দ আছে। ও বাসার তটিনীকে কেমন লাগে?
– কেমন আবার লাগবে ? ভালই লাগে। তবে তুমি যে ভালো লাগার কথা বলছ তা না।
– ঐ হলেই হল। তুই নাকি তটিনীর সাথে কথা বলিস না।
– কি কথা বলব মা? আর এই চ্যাপ্টার ক্লোজড। ভাত দাও। একটা ডিম ভেজে দাও, আর একটা লাল মরিচ। আর রসুনের আচারটা তো আছে নাকি?
– তুই যা, আমি আসছি।
হাটতে হাটতে এগুলোই ভাবছিলো আবির। সন্ধ্যা যেন ঘটা করেই নামল। বাসায় ফিরেই বাবার সাথে দেখা। বজলুর রহমান সাহেব তার গম গমে গলায় বলল-
– কি ইন্টারভিউ কেমন হল?
– ভালই বাবা।
– ভাল হলে তো ভালই। যাও ফ্রেস হয়ে নাও। আমি বাজারে যাচ্ছি। কিছু লাগবে?
– না বাবা
আবিরের বাবা এমন কেন? সব সময়ই রাগি রাগি একটা ভাবে থাকে।
মা বলল-
– খোকা ইন্টারভিউ কেমন হোল?
– ইন্টারভিউ শূন্য হয়েছে
– শূন্য মানে কিরে খোকা?
– ওরা আমাকে শূন্য প্রশ্ন করেছে, আমি শূন্য উত্তর দিয়েছি। ৫ মিনিট আমার চেহারা দেখে বিদায়।
– বলিস কি ? থাক মন খারাপ করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
– হয়ে গেলে তো ভালই। মা আজ আলু ভর্তা কর তো, আর ঘরে লেবু আছে না?
– তুই যা বোস আমি নিয়ে আসছি, আলু ভর্তা করেই রেখেছি। আর আদর কে ডাক।

আবির আর আদর খাচ্ছে টেবিলে,
– দাদা তোর চাকরিটা কি হবে?
– না মনে হয়
– ধুর তোর চাকরি হলে আমি কিছু জিনিস কিনতাম তোর প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে।
– কি কিনতি?
– কিছু গাছ আর দুটা কচ্ছপের বাচ্চা।
– বলিস কি। কচ্ছপের বাচ্চা দিয়ে কি করবি?
– পালব। চিন্তা করেছি ছাদে একটা ছোট্ট পুকুর বানাবো, ঐ খানেই পালব।
– বাবা আস্ত রাখবে না।
– সে দেখা যাবে।
আবির অবাক হয়ে ভাবে , এই ছেলেটা বাবাকে মোটেও ভয় পায় না কেন ? যাই হোক আবির খাওয়ায় মনযোগ দিলো। আলু ভর্তা আর ডাল বেহেস্তি খাবার।

সকালে বারান্দায় দাড়ালে ভালো লাগে আবিরের । আজও দাড়ালো। কিন্তু পাশের বাসার বারান্দায় তটিনীকে দেখা যাচ্ছে। মনে হয় মাত্র গোসল করে এসেছে। এত কমল আর স্নিগ্ধ লাগছে। অনেক রূপবতি মেয়ে তটিনী এখন আর আগের মত বাসায় আসে না। মেয়েটার মুখটা আগের মত আর হাসিখুসি নেই। ওদের বাসায় আবার কিছু হোল নাকি? একটু খোঁজ খবর নেয়ার দরকার, মা কে জিজ্ঞেস করলে হয়ত জানা যাবে।
ছোট ভাইটার সামনে HSC পরীক্ষা। খোজ খবর নেয়া উচিত কিন্তু আবির তা করছে না, ভাবলো কেন এমন ও? আস্তে আস্তে বাবার উপর থেকে চাপ কমাতে হবে সেটাও ভাবায় আবিরকে ।  বাবা আর আদর নাকি যাবে গ্রামের দিকে। আদরের সামনে পরীক্ষা। তাই গ্রামের কেমন এক দরবেশ চাচা জানি হয় তার কাছে দোয়া চাইতে যাবে । দুইদিনের ব্যাপার, তবুও ঘরটা ফাকা ফাকা লাগবে।

একটা ইন্টারভিউ দিলো আবির। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। এসিসট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে। ৩৫০০০ টাকা বেতন হবে। আবিরের জন্যে যা অনেক। ইন্টারভিউ ভালই হয়েছে, মনে হয় হয়ে যাবে। এখন রাস্তায় রাস্তায় হাটছে। নতুন কিছু কাপড় চোপড় কিনতে হবে। আজ আর কাল চাকরি তো হবেই আর তখন তো কাপড় চোপড় লাগবেই। প্রথম বেতন থেকে আদরকে কিছু টাকা দিব ওর কচ্ছপ কিনতে।
বাসায় আসতেই আবির শুনলো বজলুর রহমান আর আদর রওনা দিয়ে দিয়েছে। আবিরের জন্যে অপেক্ষা করেছিল। দেরি দেখে চলে গেছে। ইন্টারভিউ ভালো হয়েছে শুনে মা অনেক খুশি। খাওয়া দাওয়া শেষ করতেই দেখি তটিনী হাজির। মেয়েটাকে দেখতে কেমন জানি উভ্রান্তের মত লাগছে। চোখ অসম্ভব ফোলা আর লাল লাগছে।। কান্না কাটি করেছে নাকি? হটাৎ করে সামনে এসে বলল-
– আবির ভাইয়া আপনার সাথে আমার কথা আছে।
– আমার সাথে আবার কি কথা? আচ্ছা বল।
– আমরা কাল কানাডা চলে যাচ্ছি। এক্কেবারের জন্যে।
আবিরর ভেতরটা স্তব্ধ হয়ে গেল যেন । খা খা করছে বুকটা কেমন জানি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-
– কই মা তো বলেনি। তুমিও তো বলনি।
– আগে বললে কি হত? আপনি কি আমাকে যেতে মানা করতেন?
– কি আশ্চর্য আমি মানা করব কেন? মাথা খারাপ হল নাকি তোমার?
– না আমার মাথা ঠিকি আছে। তাহলে আমাকে আপনি কিছু বলতে চান না?
– না কি বলবো, ভাল থেক।
তটিনী চলে যাচ্ছে। আবিরের বুকে কেমন জানি এক ধরনের শুন্যতা গ্রাস করেছে, মন চাইছে মেয়েটাকে এক দৌড়ে গিয়ে বলতে – তুমি যেতে পারবে না, তোমাকে আমার কাছেই থাকতে হবে। পারলো না আবির। সবসময় মানুষ যা ভাবে তার সবই মানুষ করতে পারে না ।

আবিরের ঠিকানায় একটা রেজিস্ট্রি চিঠি এসেছে। চাকরিটা হয়ে গেছে আর বলেছে সামনের মাসে জয়েন করতে । আবির মাকে কিছু না বলেই রাস্তায় হাটতে বের হলো। মানুষ দেখতে ভালই লাগে তার। বাতাসে পুরো শীত শীত ভাব। বুকের ভেতর তাও কোথায় জানি একটা শুন্যতা রয়ে গেছে। তটিনীরা চলে গেছে আজ ৪-৫ দিন হল। ও বাড়ির বারান্দাটা আজ শুন্য। পুরো বারান্দা আলকিত করে আর তটিনী দাঁড়িয়ে থাকে না। আমাকে বিব্রতও করে না। পকেটে মোবাইলটা বেজে উঠল। মা ফোন দিয়েছে-
– আবির তুই কই? তাড়াতাড়ি আয় খোকা।
মা কথা বলতে পারছে না। কেমন জানি ফোপাচ্ছে। কাঁদছে। মার কথা শুনেই অনাহূত কোন ঘটনার আশঙ্কায় বুকটা কেপে উঠল।

বাবা আর আদর গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় আসার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে। তারা ঢাকা মেডিকেলে আছেন। মাকে খালার বাসায় রেখে এলো আবির। এখনো জানে না বাবা আর ছোট ভাইয়ের কি অবস্থা। মনে মনে খালি আল্লাহ কে ডাকছে সবাই। সব যেন ঠিক হয়ে যায়।

বাবা আর আদর মারা গেছে আজ ৬ দিন হল। মা এখন কারো সাথেই কথা বলছে না। প্রথম দিন বাবার লাশ দেখেই আবিরের মার কথা বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট ভাইটা তাও দুইদিন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে হার মেনে নিল। আদরের জ্ঞান একটু ফিরেছিল, আবিরের সাথে তখন ওর কথাও হলো।
– দাদা বাবা আর নেই না।
– না। নেই।
আমিও বললাম যন্ত্রের মত।
– আমিও চলে যাব। ঐ যে বাবা আমাকে নিতে এসেছে।
– কথা বলিস না ছোট।
– আইনস্টাইন একটা কথা বলেছিল- (গতি বাড়ালে নাকি সময় থমকে যায়।) কিন্তু দাদা আমি তো স্থির হয়ে আছি, তাও আমার সময় স্থির হয়ে গেছে। আইনস্টাইন বেটার তথ্য ভুল প্রমাণিত হল।
– চুপ করে ঘুমা। তুই ঠিক হয়ে যাবি ।
একেবারেই ঘুমিয়ে গেল। আবির কাঁদেনি এখনো, দুঃখগুলো যেন জমে জমে শুস্ক করে দিয়েছে চোখ । 
এখন অনেক রাত, পুরো ছাদ জুরে ভরা জোছনা খেলা করছে। তটিনী একটা চিঠি পাঠিয়েছে-

আবির ভাই, 

আমি শুনেছি তোমাদের কথা। এত কষ্ট তুমি একা নিতে পারবে না।তোমার একজন দরকার। আমিই তোমার সেই একজন। তুমি জানো না হয়ত আবির ভাইয়া,  তোমার মা কত শক্ত একজন মহিলা, আমি তার কাছ থেকেই শুনেছি সব। তুমি একা না, আমি আছি আজীবন। 

ও, এবার এলে ফিরিয়ে দিবে না তো?
আমি আসছি কিন্তু।

ইতি,

তটিনী


চিঠি পড়তে পড়তে আবিরের চোখ ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। জোছনা যেন উপচে পরছে আজ। আবির তটিনীর জন্যে অপেক্ষা করছে।
অবাক জোছনায় উঠোনোটা যেন কেঁদে উঠছে। ফুলের গন্ধে সারা বাড়ি ভরে গেছে। জেগে আছি আমি আর অপরূপ জোছনা ।

লেখক পরিচিতি

কানাডা প্রবাসী মোল্লা কাউসার বাংলাদেশে একজন চিকিৎসক ছিলেন। লেখালেখি তার হবি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তিনি গল্প, ভ্রমণ কাহিনী লিখে থাকেন।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *