নিভৃতে

রীনা গুলশান

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পাঁচ

‘Giro giro tondo,
casca il mondo,
casca la Terra,
tutti giù per terra!’

একটি ঘুম পাড়ানি গান, নাকি ছড়া? একটি মিষ্টি মধুর কণ্ঠের আওয়াজ। ফাবিয়ানকে গভীর তলিয়ে যাওয়া ঘুম থেকে জাগিয়ে দিল। একি? এ কার কণ্ঠস্বর? এ কণ্ঠতো ফাবিয়ান সেই কবে ভুলে গেছে। নাকি ভুলতে চেয়েছে। কেন তবে তার ঘুমিয়ে পড়া হৃদয়ে বার বার এই কণ্ঠস্বর জেগে ওঠে? এটি তার নানীর কণ্ঠ? নাহ, এ তার নন্নার নয়? তবে, ফাবিয়ান কিছুতেই সেইসব স্মৃতির কাছে ফিরতে চায় না। এ সব স্মৃতিকে সেতো কবেই কফিনে পুরে মাটি চাপা দিয়েছে। তবে কেন এসব মিথ্যে স্মৃতির পাখিরা তার হৃদয়ে হানা দ্যায়? কেন বার বার রক্তাক্ত করে?

ফাবিয়ান জানে এই কণ্ঠস্বরটা কার? ওর মায়ের। যার প্রতি ওর সব থেকে বেশি দুর্বলতা, আর একই সাথে যাকে ও সব থেকে বেশি ঘৃণা করে। আর বাবা? তার কথা ওর মনেই পড়ে না। আবছা আবছা একটা ছায়া। সেই ছায়াটার সাথে ছোটবেলায় ও অনেক অনেক কথা বলতো। স্কুলে যখন জুনিয়র গ্রেডে ও পড়তো, তখন ও সব থেকে বেশি মিস করতো ঐ ছায়াটাকে। ওর সব বন্ধুদের বাবা-মা এক সাথে আসতো প্যারেন্টস ডে-তে। বাৎসরিক উৎসবে। স্কুলে যখন অন্য সব বন্ধুদের বাবা বা মা স্কুলে পিকআপ, ড্রপঅফ করতে আসতো ফাবিয়ানের বুকের ভেতরে খুব খুউব ফাঁকা লাগতো। এক সময় গভীর কষ্ট শুরু হয়ে যেত। ও খুব ঘ্যান ঘ্যান করতো। আর ওর মা তার বাবার প্রতি গভীর ঘৃণায় ওর সাথে চিৎকার করতো-

: ফাবি, আমি তোমাকে বলেছি, আর কখনো তার নামও মুখে আনবে না।

: কেন? কেন আনবো না তার নাম? আমি বাবাকে দেখবো!

: তোমার বাবা মরে গেছে!

: না, আমার বাবা মরেনি, আমি জানি!

: কে বলেছে তোমাকে?

: নন্না, নন্না বলেছে, বাবা মরেনি। বাবা চলে গেছে। তুমি বাবাকে ডাক, আমি তাকে দেখবো।

তখন ওর মা গভীর হতাশায় কেঁদে ফেলতো। ফাবিয়ানকে বুকে জড়িয়ে গভীর কান্নায় ভেঙ্গে পড়তো। তখন ওর আরো কষ্ট হতো। মা কাঁদলে ওর খুব খারাপ লাগতো। তখন মায়ের গলা জড়িয়ে মাকে চুমোয় ভরে দিত আর বলতো-

: মাম্, ঠিক আছে আর কখনো বাবাকে দেখতে চাইবো না। সরি, মাম্, সরি!

: হ্যাঁ, ফাবি সোনা… তুমি কেন বুঝতে চাও না, আমার কিছুই করার নাই।

: আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি আর কখনো বাবাকে দেখতে চাইবো না। কিন্তু তুমি আবার আমাকে ছেড়ে কোথাও চলে যেও না বাবার মত।

: না, না, আমি তোকে ছেড়ে কোথায় যাবো বাবা?

কিন্তু আবারো যখন ‘ফাদারস ডে’ আসতো, ওর সব বন্ধুরা রায়ান, জেশন, ডোরিন সবাই কত রকম প্ল­্যান করতো, বাবাকে কি দেবে? সবাই তার পকেট মানি বাঁচিয়ে ওদের বাবার জন্য কত রকম গিফট কিনতো। আর ডোরিনতো ওর সাথেই প্ল­্যান করতো, কি দেওয়া যায় বাবাকে? ফাবিয়ানও প্রতিবার ‘ফাদারস ডে’তে একটা কার্ড নিজে বানাতো আর তাতে কত কি যে লিখতো-

: বাবা, তুমি কোথায়? আমি তোমাকে দেখতে চাই! আমি, আমি তোমাকে খুউব মিস করি। তুমি আসো বাবা, আমি তোমার খুব লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকবো। কখনো কিছু চাইবো না। একটুও বিরক্ত করবো না। কত কি যে লিখতো ফাবি। তারপর যখন সবার বাসায় ‘ফাদারস ডে’র উৎসব হতো, হাসি-আনন্দে ভরে উঠতো বাচ্চার আর বাবার আনন্দ হাস্যে; তখন ছোট ফাবিয়ান তার ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে তাদের বাড়ির পেছনে জলপাই বাগান ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে ওদের একটা মাঝারী সাইজের লেক আছে- সেই লেকের পাড়ে ফাবিয়ান বসে থাকতো। পানির ভেতরে নিজের ছায়া দেখতো। সেই ছায়ার সাথে কথা বলতো। কারণ, ওর নানী ওকে সব সময় বলতো, সে নাকি দেখতে একদমই ওর বাবার মত। ফাবিয়ান তার ছায়াকেই বাবা মনে করে কথা বলতো-

: বাবা, দ্যাখো আমি তোমার জন্য কার্ড এনেছি! কার্ডটা আমি নিজেই বানিয়েছি। তারপর ফাবিয়ান কার্ডটা তার ছায়াকে পড়ে শুনাতো।

: বাবা, তোমার কি কার্ডটা ভালো লেগেছে? আমি এক সপ্তাহ ধরে তোমার জন্য এই কার্ডটা বানিয়েছি! তোমার কি পছন্দ হয়েছে? এই দ্যাখো বলেই ফাবিয়ান কার্ডটা নৌকার মত ভাসিয়ে দিত। কার্ডটা একটু পর ভাসতে ভাসতে ডুবে যেত। আর ফাবিয়ান ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ভাসাতো। চারপাশের শূন্যতা ওকে শুনিয়ে দিত, ওর বাবা নাই। এক সময়ে পানির উপর সূর্য্যরে শেষ ছায়া পড়তো, বাতাসে বেদনার গন্ধ নিয়ে ফাবিয়ান টলটলে সেই পানির উপরে আলোছায়ার খেলা দেখতো। আর তখুনি আর একটি ছোট নরম হাত ওকে ছুঁয়ে দিত-

: ফাবি, তুই এখানে? আমি জানতাম! সারা বাড়ি খুঁজলাম, আমাদের জলপাই গাছের খেলাঘরে খুঁজলাম, পেলাম না। তখন ঠিকই বুঝেছি তুই এখানে এসেছিস!

: কেন এসেছিস এখানে? বেশতো এনজয় করছিলি তোর বাবার সাথে ‘ফাদারস ডে’র!

: স্টুপিড! আমি কখনো তোকে ছাড়া কোন কিছু এনজয় করেছি? আমি তো এমনকি বাবাকে তার ‘গিফট’ও দেইনি।

: কেন দিসনি? আমি কি মানা করেছি?

: বারে, আমি তো তোকে নিয়ে এক সাথে দিব। কারণ, কার্ড বানাবার আইডিয়া তো তোর ছিল। আর বাবার প্রিয় ক্যান্ডিও তো তুই কিনে এনে দিয়েছিস! তো, তোকে ছাড়া আমি কিভাবে ঐসব দিব! আর মা’ও তো আজ তোর প্রিয় পাস্তা করেছে। সাথে স্টবেরি টার্টার।

: সত্যি? ফাবিয়ানের চোখে খুশির ঝলকানি।

ফাবিয়ান জ্ঞান হবার পর থেকে তার প্রতিটি ‘ফাদারস ডে’ সে ডোরিনের বাবার সাথেই করেছে এবং ডোরিনের বাবাও তাকে তার ছেলের মতোই দেখতো। কিন্তু দুধের সাধ কি ঘোলে মেটে? ফাবিয়ানের শূন্যতা দিনে দিনে তার বয়স বাড়ার সাথে সাথে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তবুও ওর জন্য ডোরিনের মমতা, ভালোবাসা এবং নিমগ্নতা ফাবিয়ান সারা জীবন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে।

একটি তীব্র ফোনের আওয়াজ, ওর মাথার ভেতরে এখনও কেমন জানি ভার হয়ে আছে-

: হ্যালো?

: ফাবিয়ান? কি খবর? কি হয়েছে তোমার? তুমি জানো, আমি কতবার তোমাকে ফোন করেছি?

: উম! নাওমী আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। শরীরটা ভাল লাগছে না। আমি তোমাকে পরে রিং ব্যাক করি? প্লি­জ, কিছু মনে করো না?

: না, না, ইটস ওকে। তুমি বরং রেস্ট নাও। তবে কিছু লাগলে আমাকে বলো-

: ওকে নাওমী।

ফাবিয়ান আড়মোড়া ভাঙে। ওয়াশ রুেেম যেয়ে চোখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিলো। তারপর কিচেনে যেয়ে বড় এক মগ কফি বানালো, সাথে একটা চকোলেট চিপস দেওয়া মাফিন নিল। তারপর টিভির রিমোর্ট নিয়ে একটার পর একটা চ্যানেল চেঞ্জ করে। অবশেষে বাচ্চাদের একটা কার্টুন চ্যানেলে এসে থেমে যায়। বাচ্চাদের এইসব চ্যানেল ওকে প্রচুর আনন্দিত করে। এটা নিয়ে সিসি প্রচুর টিজ করতো ওকে-

: কাম অন হানি, গ্রো আপ।

: কেন? এখনও বাচ্চাদের কাছে অনেক কিছু আমাদের শেখার আছে।

: মেয়বি, সেটা তোমার ক্ষেত্রে। সিসি নাক সিটকায়-

: হয়তোবা, তবুও বলছি ওরা আমাকে নির্মল আনন্দ দেয়।

আবার সিসিলিয়ার কথা ভাবছে? কেন? সিসি ওকে শারীরিকভাবে প্রতিনিয়ত সুখের সমুদ্রে ডুবিয়ে রেখেছিল, তাই কি? কিন্তু তবে কেন অহর্নিশ একটা কাঁটা ফুটতো ওর বুকের ভেতরে। ডোরিনের জন্য? কেন ডোরিনের কথা ভেবে মাঝে মাধ্যে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। তবু ওকে টেলিফোন করবার সাহসটুকুও পায়নি। এমনকি নানীর কাছেও কখনও ওর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবার সাহস হয়নি। কারণ ও জানে নন্নার কি উত্তর হবে? ইটালি ছাড়বার আগে নানী ওকে প্রচুর বুঝিয়েছে-

: ফাবি, সোনা আর একটি বার ভেবে দেখ! তুই কি ঠিক ডিসিসান নিছিস? কোথাও কোন ভুল হচ্ছে নাতো?

: নন্না, তুমি বুঝছো না কেন, এখানে থাকলে আমার কিছুই হবে না। আমাকে অনেক অনেক বড় হতে হবে।

: জানি, ফাবিয়ান, তবুও। তোর আর ডোরিনের এতদিনের একটা সম্পর্ক! পরে হয়তোবা আর পিছু ফিরতে পারবি না।

: জানি, জানি, তুমি ছাড়া পেছনে আমার আছেটা কি? এক বুক যন্ত্রণা বৈতো নয়!

এই একটা বাক্যে ও নানীকে বরাবর চুপ করিয়ে দ্যায়। সেটা ফাবিও জানে। নানীর জন্য এটা একমাত্র শেষ মারণাস্ত্র। কারণ এটাতো নানীর একমাত্র দুর্বল জায়গা।

আর তখন নানীর কথা শোনার মত তার মনের অবস্থা ছিল না। তখন সে অতি উত্তেজনায় ফুটছে। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, নতুন ক্যারিয়ারের স্বপ্নে সে তখন আকুল। বন্ধুরাও সারাক্ষণ তাকে স্বপ্নের ভেতরে ঘর বাঁধতে সাহায্য করতো। ওরা তিন বন্ধু যেন তিন রত্ন। একই বয়সী। এক সাথে বেড়ে উঠেছে। একই এলাকার এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ওদের একই রকম ব্যাক গ্রাউন্ড। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। ওদের সবার বাবারাই জমিজমারই কারবার করতো। নিজেরাই চাষবাস করতো সাথে অবশ্য লোকও নিয়োগ করতো। শুধু ওদের ঘরে পরুষ বলতে এক ছোট্ট ফাবিয়ান ফ্রাঞ্জিপেলে। ওর মা সারা বারটুচি আর নানী আমান্ডা বারটুচি। ওর নানা ফাবিয়ান তখন বেশ ছোট তখন মারা যায়। নানীর কাছে তার অনেক গল্প শুনেছে। ওরা নানা আলবার্ট বারটুচি বেশ প্রভাবশালী লোক ছিল ‘ভ্যালেলঙ্গার’। ওদের গ্রামের উন্নতির পেছনে প্রচুর খাটাখাটনি করেছে মানুষটা। প্রচুর জমির মালিক ছিল। নিজে যদিও দেখাশুনা করতো, আবার বেশ কিছু লোকও নিয়োগ করেছে সে সব দেখাশুনার জন্য। এই ভ্যালেলঙ্গারে আগে ইলেক্ট্রিটিসিও ছিল না। নানী আমান্ডার কাছে সব ফাবিয়ান শুনেছে। ওর নানা গ্রামের মাতবর শ্রেণীর ছিল। অসম্ভব এলাকাপ্রেমী ছিল। যেমন হ্যান্ডসাম ছিল তেমনি অসম্ভব কঠোর পরিশ্রমী ছিল। প্রায় সাড়ে ৬ ফুটের কাছাকাছি লম্বা ছিল। আর নানী ছিল ছোটখাটো মানুষ। দেখতেও খুব সুশ্রী ছিল না। তবুও তাদের ভালোবাসার কমতি ছিল না। তবে তার মা সারা বারটুচি একদম তার নানার মত দেখতে ছিল। অসম্ভব সুন্দরী। ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির দীর্ঘ শরীর। মডেলদের মত তার কাঠামো। টকটকে গোলাপী গায়ের রঙ। দীঘল গাঢ় নীল বর্ণের চোখ। আর কোমর ছোঁয়ানো গোল্ডেন ব্লন্ড চুল। ওর মায়ের রূপ গ্রামে রীতিমত সাড়া ফেলেছিল। তার মা, নানার একমাত্র কন্যা হওয়াতে আদরের সীমা ছিল না। সেই জন্যই বোধহয় খুব অল্প বয়সেই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছিল।

ওর বাবা ফ্রাঙ্ক ফ্রানজিপেনের প্রেমে পাগল হয়েছিল। ওর বাবা ছিল আসলে একটা প্লেবয় টাইপের ‘মাকাল’ ফল। পাশের গ্রামের এক বাউন্ডুলে বখে যাওয়া ছেলে। কিন্তু অসম্ভব হ্যান্ডসাম ছিল। ৬ ফুট ৩ ইঞ্চির দীর্ঘ পাকানো শরীর। হালকা বাদামী চোখের বর্ণ। মন ভুলানো মার্কা কথায় সে ছিল ওস্তাদ। বাড়ির অবস্থা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। লেখাপড়াও তেমন করেনি। স্কুলের গন্ডিটাই পেরিয়েছিল। তারপর সারাদিন বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আডডা মারাই ছিল তার একমাত্র কাজ। এরই ভেতরে তার চোখে পড়ে গেল ‘সারা বারটুচি’। অসম্ভব সুন্দরী এবং দাম্ভিকও। তবুও কিভাবে যেন ফ্রাঙ্ক তার প্রেমের জাদুতে সারাকে ঘায়েল করেছিল। শুধু তাই নয়, সারা রীতিমত ফ্রাঙ্কের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। হীতাহীত জ্ঞানশূন্য হয়েছিল। তখন সারা মাত্র গ্রেড টুয়েলভ-এ। স্কুল শেষ হতেই ফ্রাঙ্কের সাথে ঘোরাঘুরি শুরু হতো। এমনকি মাঝে মধ্যে স্কুল ফাঁকিও দিতে শুরু করলো। আর ফ্রাঙ্কের তো সোনায় সোহাগা। একদিকে রূপ অন্যদিকে রূপা- দুটোই ফ্রাঙ্ককে আকৃষ্ট করেছিল। ফ্রাঙ্কের প্রেমে তখন সারা দিশেহারা। কি যে করছে নিজেই জানে না। এরই মধ্যে যা হবার তাই হলো। সারা অনুভব করলো তার কিছু ভালো লাগছে না। মরনিং সিকনেস। এমনকি কিছুই খেতে পারে না। এরই মধ্যে সে আবিস্কার করলো তার তিন মাস পিরিয়ডও হয়নি। তখন সে রীতিমত উদভ্রান্ত  হয়ে ফ্রাঙ্কের কাছে ছুটলো। ফ্রাঙ্ক তখন খুবই হালকা চালে বলল-

: ওকে, সুইটি- এটা কোন ব্যাপার না। চলো হাসপাতালে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

: কিন্তু, ফ্রাঙ্ক… প্রায় ৩ মাস।

: এটা কোন ব্যাপারই নয়।

তখন বাধ্য হয়ে সারা ফ্রাঙ্কের সাথে একটা দূরের হাসপাতালে গেল। ডাক্তার আবার ফ্রাঙ্কের দূরের মামা। কিন্তু ডাক্তার সারাকে চেকআপ করিয়ে খুব গম্ভীর হয়ে গেল।

: তোমরা খুউব দেরি করে ফেলেছো। এখন বাচ্চাকে এ্যাবোর্ট করতে গেলে বাচ্চার সাথে সাথে মায়েরও ক্ষতি হতে পারে।

সারাতো তখন কান্নাকাটি শুরু করলো-

: এখন আমার কি হবে, ফ্রাঙ্ক?

: ওকে, আমাকে ভাবতে দাও।

যাইহোক, সারাই ব্যাপারটি মাকে জানালো। ওর মা আমান্ডাতো ভয়ে, লজ্জায় স্তম্ভিত। তবু সে অনেক সাহস করে ওর নানাকে বললো। ওর নানাতো লজ্জায় এবং ভয়ঙ্করভাবে রেগে তার এত আদরের কলিজার টুকরা কন্যাকে সপাটে চড় মারলো-

: তুই মরলি না কেন? এত বড় একটা খবর দেবার আগে তুই আমার মানসম্মানটাও একবার ভাবলি না? এই ভ্যালেলঙ্গারবাসী আমাকে কত শ্রদ্ধা করে! আর আমার মেয়ে হয়ে কিনা তুই এই কাজ করলি।

ছয়

তারপরও আলবার্ট বারটুচি তার জীবনের সব থেকে সেরা কমপ্রোমাইজটা করলো। তার থেকে সামাজিক ও আর্থিক দিকে থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা একটা ছেলের সাথে তার একমাত্র অনিন্দ্য সুন্দরী কন্যার বিবাহ দিল। বিবাহের মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই ফাবিয়ানের জন্ম হলো। সময়ের প্রায় ৫ সপ্তাহ আগেই জন্ম হলো। পুত্র সন্তান নানা-নানী খুবই খুশি হলো।

নানাই নাম রাখলো ফাবিয়ান। যেহেতু তাদের ঘরে কোন পুত্র ছিল না, তাই ফাবিয়ানের আদরের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। দেখতে যদিও বাবার মত আবার নানার সাথেও মিল আছে অনেক ফাবিয়ানের। নানাতো খুশিতে একেবারে আত্মহারা। সারাক্ষণ ফাবিকে দেখতে চায়। তাকে বুকে করে রাখে। ফাবি কাঁদলে তার নানা বিকট স্বরে চিল্লাপাল্লা শুরু করে দেয়। বিবাহের পর ফ্রাঙ্ক অবশ্য সারাদের বাড়িতেই এসে থাকা শুরু করলো। সারাদের বাসাতেই থাকে, খায়। আবার বাবার কাছে থেকে পকেটমানী নিয়ে ফুর্তি করে বেড়ায়।

এদিকে ফাবিয়ানের জন্মের পর পর সারার শরীর খুব ভেঙ্গে পড়েছিল। অল্প বয়স তাইতে প্রেগন্যান্সির সময়ে অত মানসিক টানাপোড়েন। অনাকাঙ্খিত দ্বিধায় সন্তান জন্মানোতে মায়েদের মনের যতটা আনন্দ হওয়া উচিত, তা হয় না। তাছাড়া ফ্রাঙ্কও এত জলদি বাচ্চা হওয়াতে মোটেই খুশি ছিল না। যদিও তার কোল জুড়ে এসেছিল রাজপুত্রের মত ছেলে। তবু ফ্রাঙ্ক একটুও খুশি ছিল না। বাচ্চাকে আদর করতো না বললেই চলে। তার চোখ ছিল সারার রূপ এবং রূপার উপর। সেই রূপেও ভাঙ্গন শুরু হলো। সারা মারাত্মক ‘এ্যানামিয়া’তে আক্রান্ত হলো। ওদের এলাকা ছেড়ে ওর বাবা ‘কাটিনজারো’তে নিয়ে গেল বড় ডাক্তার দেখাবার জন্য। সেই ডাক্তার আবার অনেক কমপ্লিকেশন দেখিয়ে তার একজন প্রফেসরকে রেফার করলো ‘কালাব্রিয়া’তে। সারা ছোট ফাবিকে তার মা আমান্ডার কাছে রেখে তার বাবার সাথে গেল চিকিৎসায়। ফ্রাঙ্ককেও রেখে গেল ছোট্ট বাচ্চাকে দেখাশুনা করবার জন্য একজন পুরুষের দরকার। প্রায় ৩/৪ মাস চিকিৎসার পর সারা তার বাবার সাথে আবার ভ্যালেলংগারে ফিরে এলো।

সারা এসে দেখলো তার ছোট্ট সোনামণি তখন ৯ মাসের। রীতিমত হামাগুড়ি দিতে শিখেছে। সারা তাকে ৫ মাসের রেখে গিয়েছিল। তখন সে সারা বাড়ি হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায়। মাকে দেখে ফিক ফিক করে হাসে। ছোট্ট হাতে মায়ের চুল টানে। এতদিন পর যেন সারার মাতৃত্ব জেগে ওঠে। আহ্, কি সুন্দর তার ছেলেটা।

: দেখেছো ফ্রাঙ্ক, আমাদের বাবুটা কি সুন্দর দেখতে হয়েছে। ওর হাসিটা একদম তোমার মত।

: আর চোখ দুটো তোমার মত গভীর নীলাভ সবুজ।

: হু! মনে হচ্ছে খুব লম্বাও হবে! দেখেছো কি লম্বা লম্বা আঙ্গুল!

: কিন্তু চুলের রঙও তোমার মত গোল্ডেন ব্লন্ডই হলো! লাইট ব্রাউন হলে আরো ম্যানলি হতো।

: ইস! বলেছে তোমাকে। আমার বাবা বুঝি কম ম্যানলি।

: হু, তা অবশ্য ঠিক। ফ্রাঙ্ক ওর বাবার কথায় পাশ কাটায়। কারণ ফ্রাঙ্ক সারার বাবাকে অতটা পছন্দ করে না। ও ঠিকই জানে ওর এ বাড়িতে যতটুকু কদর, তার সবটুকুই তার বউ আর বাচ্চার জন্য। তার শ্বশুর যে তাকে একটুও পছন্দ করে না তা ও ঠিকই বুঝতে পারে। তবে শাশুড়ি তাকে বেশ আদর-যত্ন করে। প্রায় তার প্রিয় খাবারের তালিকা অনুযায়ী তাকে সেগুলো বানিয়ে খেতে দেয়। তবে শ্বশুর মোটেই তা পছন্দ করে না। এর মধ্যে তো একদিন শ্বশুর তাকে তার ঘরে ডেকে পাঠালো-

: সুপ্রভাত।

: সুপ্রভাত। তা ইদানিং করছোটরছো কি?

: জি, মানে ফ্রাঙ্ক আমতা আমতা করে।

: তা কতকাল আর এভাবে চলবে? বিয়ে হলো, বাচ্চাও তো এক বছরের মত হতে চললো! আর কতকাল এভাবে ঘুরে ফিরে বেড়াবে?

: নাহ, ভাবছি কোন একটা ব্যবসা শুরু করবো।

: সেতো ভালো কথা, তা ব্যবসা যে করবে, পকেটে পয়সাকড়ি আছে তো?

: জি? জিনা, মানে ভাবছিলাম…

: কি ভাবছিলে, আমার মাথায় কাঁঠাল ভাঙবে, তাই না?

: না, মানে, আমারতো কোন…

: ঠিক আছে, ওসব ব্যবসা করার চিন্তা আপাতত ছাড়ো। আমার জমিজমা নেহাত কম নাই। ওসব দেখাশুনা করার জন্যও একজন লোক রাখা আছে। এখন থেকে তুমিই ওসব দ্যাখো। ভবিষ্যতে তো এসব তোমাদেরই হবে। আমি আর কতদিন?

: না, আমি আসলে কোন ব্যবসাই করতে চাই… ফ্রাঙ্ক তবু তার বক্তব্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়।

: ওকে, তোমার যা খুশি করার অধিকার তোমার আছে। তবে আমার কাছে কিছু আশা করবে না। আর মনে রেখো, তোমার বৌ-বাচ্চার দায়িত্বও তোমাকেই নিতে হবে।

: জী, তাতো অবশ্যই।

কিন্তু ঐ পর্যন্তই। ফ্রাঙ্ক কোন কাজেরই চেষ্টা করে না। গায়ে ফু দিয়ে ফুল বাবুটি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। সেই বিয়ের আগের মত বোহেমিয়ান জীবন যাপন। আর রাতের বেলায় সারার শরীরের ভাজে ভাজে নিজের স্থুল সুখ খুঁজে ফেরে। এমনকি সারা যদি কখনও কোন আপত্তি করে তো এক প্রকার জবরদস্তি করে।

মাঝে মধ্যে সারা রাতের অন্ধকারে কেঁদে বালিশ ভেজায়। এ কান্না কাউকে দেখাতে পারে না। তার দুঃখের কথা কাউকে বলতেও পারে না। এ যে গভীর লজ্জার। কাকে বলবে এ লজ্জার আর দুঃখের কথন? যার জন্য জীবনে এত বড় একটা ভুল করলো তারতো কোন অনুভূতিই নাই। এখন তো সারার প্রতিনিয়ত মনে হয়, এ মানুষটা তাকে কোনদিন ভালোবাসেনি। শুধু তার রূপের এবং রূপার উপর আকর্ষিত হয়েছিল। এবং প্রকৃত নজর ছিল তার রূপার উপর। এ যে তার নারীত্বের উপর গভীর লজ্জার এবং অপমানের। আর এই গভীর লজ্জা, দুঃখ সে কারো সাথে শেয়ারও করতে পারে না। এমনকি তার বেস্ট ফ্রেন্ড, তার ছোটবেলার খেলার সাথী রোডিকা মারকেজে, তাকেও নয়। কারণ রেডিকা তাকে বার বার বলেছিল-

: সারা, আমি তোকে বলছি- ফ্রাঙ্ক ভালো ছেলে না। আমি ওকে চিনি, তুই ওর কাছ থেকে সরে যা…

: কি বলছিস তুই এসব? তুই জানিস আমি ওকে কত ভালোবাসি?

: কিন্তু, সারা- এতো শুধু ভালোবাসা নয়… এটাতো সমস্ত জীবনের ব্যাপার। তোকে বুঝতে হবে!

: কিন্তু, তুই জানিস আমরা কত দূর এগিয়েছি।

: আমি সেটা জানি। সেই জন্যই বলছি, কারণ।

: কি কারণ, বল?

: না, মানে- বলা ঠিক হবে কিনা ভাবছি, তুই আবার কি ভাবে নিবি?

: না, না, তুই বলনা।

: না, মানে সেদিন কেভিন মানে আমার বয়ফ্রেন্ড বলছিল, সে ফ্রাঙ্ককে অন্য আর একটা মেয়ের সাথে রেস্টুরেন্টে দেখেছে!

: যাহ্, কি বলছিস এসব!

: মায়ের কসম, আমি তোকে মিথ্যা বলবো?

: কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না। ফ্রাঙ্ক এরকম কিছু করতেই পারে না।

: ওকে, এটা তোর ব্যাপার সারা। আমার কর্তব্য ছিল তোকে এটা জানানো।

: সে জন্য অবশ্য তোকে ধন্যবাদ।

: তবে একটা অনুরোধ আমার, আমার নামটা দয়া করে ফ্রাঙ্ককে বলিস না। ওকি ভাববে বল?

: না, না, কি যে বলিস, আমি অত মিন নই।

: ধন্যবাদ সারা, আমি চাই তোরা সুখী হ। (চলবে)

রীনা গুলশান

লেখক রীনা গুলশান বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিকে তার কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, রম্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে কানাডার বিভিন্ন বাংলা পত্রিকাতেও। তিনি ‘প্রবাসী কণ্ঠ’ ম্যাগাজিন এর একজন নিয়মিত কলামিস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *