আমার দুরন্ত কৈশোর

কাজী সাব্বির আহমেদ

কৈশোরের শুরুতে আমি ক্লাস সিক্স-এ ধানমন্ডি গভর্মেন্ট বয়েজ হাই স্কুলে ভর্তি হই। আমাদের যুগে প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ক্লাস সিক্স-এ উঠা মানে বড় হয়ে উঠার ক্ষেত্রে একটি মাইলস্টোন অতিক্রম করা। ক্লাস সিক্স-এর মহিমা ছিল মূলত দুইটি। এক, হাই স্কুলের সূচনা। দুই, মর্নিং শিফট থেকে ডে-শিফটে প্রমোশন। কৈশোরের শুরুতে এই দুইটি পরিবর্তন আমাদের মতন নব্য কিশোরদের আচরণে বেশ প্রভাব ফেলে। আমরা নিজেদেরকে বড় হিসেবে ভাবতে শুরু করি। বিভিন্ন রকম অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকি। মানুষের মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ ডেভেলপমেন্ট কৈশোরের এই শুরুর সময়টায় হয়ে থাকে। ফলে একজন মানুষের সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে তার কৈশোরের বেড়ে উঠার পরিবেশ এবং প্রক্রিয়া উভয়েই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে দেখছি যে একটি স্বাধীন দেশে কোন প্রকার জাতিসত্ত্বা কিংবা ধর্মীয় নিগ্রহ মুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠা কিশোরের মানসিক শক্তির তুলনায় পরাধীন দেশে কিংবা ধর্মীয় অথবা জাতিসত্ত্বার কারণে নিগৃহীত হয়ে বেড়ে উঠা কিশোরের মানসিক শক্তি অনেক কম হয়। পরবর্তী জীবনে তাদের ভেতর এই পার্থক্যের ছাপ সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। আমি এই ব্যাপারটা প্রথম টের পাই ১৯৯৫ সালে যখন মাস্টার্স করার জন্য মালেয়শিয়ার কুয়ালালুমপুরে অবস্থিত ‘ইউনিভার্সিটি অব মালেয়া’-এ এনরোল করি। সেখানকার ভারতীয় বংশোদ্ভূত ছাত্রদের ভেতর এক ধরনের দ্বিধা বা ভীতি কাজ করতে দেখতাম কিন্তু পক্ষান্তরে ভূমিপুত্র মালয় ছাত্রদেরকে দেখেছি ‘বোল্ড এন্ড লাউড’।
আমার প্রথম স্কুল ছিল লালমাটিয়া গার্লস স্কুল যার দূরত্ব আমাদের বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটার পথ। এই স্কুলে ক্লাস থ্রী পর্যন্ত কো-এডুকেশন বা ছেলেমেয়েদের একসাথে পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে আমার ক্লাস থ্রী-র পাঠ শেষ হলে ক্লাস ফোর-এ আমি ভর্তি হই লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি বয়েজ হাই স্কুলে। স্কুলটির অবস্থান লালমাটিয়ার এ-ব্লকে, আমাদের বাসা থেকে প্রায় পনেরো মিনিটের হাঁটার দূরত্ব। এই স্কুলে এসে প্রথম যে জিনিষটার সাক্ষাৎ পাই সেটা হলো শিক্ষকদের কড়া শাসন। এই কড়া শাসন আমার কচি মনে এক বিভীষিকার সৃষ্টি করে। শিক্ষকদেরকে অবশ্য একতরফাভাবে দোষ দেয়া যায় না কারণ সেখানকার ছাত্ররাও যে ছিল অতি দুরন্ত। সেই সব দুরন্ত বালকদেরকে সোজা রাখতে শিক্ষকদেরকে বেত হাতে নিয়ে ক্লাসে যেতে হতো। অবশ্য ছাত্রদের যত বাঁদরামি সেগুলো ছিল নিজেদের মধ্যে। শিক্ষকদের সাথে তারা বেয়াদপি করত না। বরং তাদেরকে যমের মত ভয় পেত। তবে প্রথম পিরিয়ডে রোল-কলের সময় একেক ছাত্র একেক রকমভাবে উচ্চস্বরে তাদের উপস্থিতি জানান দেয়ার সময় মাঝে মধ্যেই হাসির রোল পড়ে যেত। আর সেই হাসিকে সামাল দেয়ার জন্য ক্লাস টিচারকে কঠোর হতে হত। আমাদের সময় প্রতিদিন ক্লাস শুরুর আগে স্কুল প্রাঙ্গণে এসেম্বলি হতো যেখানে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত এবং সমবেত কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হতো।
লালমাটিয়া বয়েজ স্কুলে বেশ কিছু ক্লাসমেটের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয় যাদের সাথে আজো সেই বন্ধুত্ব অটুট রয়েছে। সেই বন্ধুদের মধ্যে একজন হচ্ছে রিপন। তার কাছ থেকে আমার প্রথম স্ট্যাম্প কালেকশনের হাতেখড়ি। আমার সবচেয়ে বড় বোন এবং ছোট চাচা তখন নাইজেরিয়াতে থাকতেন। তাদের পাঠানো চিঠি থেকে সেই দেশের স্ট্যাম্প পেতাম নিয়মিত। আমার বড় বোন আবার একই ধরনের স্ট্যাম্প না পাঠিয়ে সব সময়েই চেষ্টা করতেন নতুন ধরনের স্ট্যাম্প পাঠানোর। যে স্ট্যাম্পগুলি একের অধিক হয়ে যেত সে গুলিকে এক্সচেঞ্জ করে অন্য দেশের স্ট্যাম্প নিতাম অন্যদের কাছ থেকে। রিপনের দুই ভাই থাকতেন জাপানে, ফলে আমার নাইজেরিয়ার স্ট্যাম্পের বিনিময়ে তার কাছ থেকে জাপানের স্ট্যাম্প পেতাম নিয়মিত। আমি অনেক আগেই স্ট্যাম্প জমানো ছেড়ে দিয়েছি, কিন্তু বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী রিপন এখনও স্ট্যাম্প জমিয়ে যাচ্ছে। তার কাছে রয়েছে অনেক দুষ্প্রাপ্য স্ট্যাম্পের কালেকশন। লালমাটিয়া বয়েজ স্কুলের হেড মাস্টার আব্দুল হাই স্যারের ছোট ছেলে তারেকও পড়ত আমাদের ক্লাসে। ক্লাস ফাইভে প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষার জন্য ক্লাস রেজাল্টের ভিত্তিতে কিছু ছেলেকে সিলেক্ট করা হলো যাদের জন্য বিকেলে বিনা মূল্যে কোচিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। আমি এবং তারেক দুজনেই সেই বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের দলে ছিলাম এবং সেই সূত্রে তারেকের সাথে আমার কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়। অবশ্য আমাদের স্কুল থেকে একমাত্র তারেকই বৃত্তি পেয়েছিল। লেখাপড়ার প্রতি মোটেও মনোযোগী না থাকার কারণে আমি বৃত্তি পাই নি। অবশ্য সেটা নিয়ে আমার কোন আফসোস কিংবা মাথা ব্যথা ছিল না। বরং বিকেলে মাঠে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলা এবং বাকী সময়গুলোতে গল্পের বই নিয়ে মেতে থাকাটাই ছিল আমার জীবন তখন। এই সময় আমার বাজার করার হাতেখড়ি হয়। এর আগে আম্মা আমাকে দিয়ে শুধু বাসার কাছের মুদির দোকান থেকে ডিম, মিল্কভিটার দুধ এবং ‘মডার্ন ব্রেড’ পাউরটি এইগুলি কিনাতেন। মোহাম্মদপুরের শহীদ পার্ক সংলগ্ন বাজার থেকে মাছ-মাংসের বাজার করার উত্তেজনাই ছিল আলাদা। কিশোরবেলার সেই বাজার করার অভ্যাস যেন আজও আমার রক্তে মিশে আছে। তাই ‘গ্রোসারি শপিং’-এ এখনও আমি বেশ এনজয় করি।
লালমাটিয়া বয়েজ স্কুলে আমি মাত্র দুই বছর পড়েছি। ক্লাস সিক্স-এ আমি ধানমন্ডি গভর্মেন্ট বয়েজ হাই স্কুলে ভর্তি হই। এই স্কুলের ইউনিফর্ম ছিল ড্রিল কাপড়ের নেভি ব্লু ফুল প্যান্ট, সাদা ট্রেটনের হাফ-হাতা শার্ট এবং সাদা কেডস। আমাদের বাসা থেকে প্রায় ত্রিশ মিনিটের হাঁটার দূরত্বে অবস্থিত আমার এই নতুন স্কুলটি। এই স্কুলের সবচেয়ে মজার ব্যাপারটি ছিল ‘টিফিন’। প্রতিদিন প্রথম পিরিয়ডে ক্লাস চিটার রোল কল শেষ করতে না করতেই দপ্তরি এসে ক্লাসে উপস্থিত ছাত্র-সংখ্যা তার নোটবুকে টুকে নিয়ে যেতেন। টিফিন পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজলে ক্লাস ক্যাপ্টেন গিয়ে তার ক্লাসের টিফিন নিয়ে আসত একটি বড় স্টিলের বালতিতে করে। ক্লাস টিচারের উপস্থিতিতে ক্লাস ক্যাপ্টেন আরো কয়েকজন ছাত্রের সহযোগিতায় সেই টিফিন প্রত্যেক ছাত্রের ডেস্কে পৌঁছে দিত। সবাই টিফিন পেয়েছে সেটা নিশ্চিত হওয়ার পরেই কেবল ক্লাস টিচার ক্লাস রুম ছেড়ে চলে যেতেন। আমরা সেই টিফিন কোন রকমে সাবাড় করেই বেরিয়ে যেতাম খেলতে। স্কুলের বারান্দার দু’মাথায় চেয়ার দিয়ে গোলপোস্ট বানিয়ে টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলতাম। ভীষণ উত্তেজনাপূর্ণ ছিল সেই খেলা। যখন ওয়ার্নিং বেল পড়ত তখন ছুটে যেতাম স্কুলের গেটে আইসক্রীম খাওয়ার জন্য। সেখানে চটপটি, আমড়ার আচার, ঝালমুড়ি ইত্যাদি নানা ধরনের খাবার পাওয়া যেত। আবার রাস্তার উল্টা পাশে ছিল কামাল কনফেকশনারীর বনরুটি আর চপ। ধানমন্ডি স্কুলে আমার প্রথম বন্ধুত্ব হয় লালমাটিয়ার বাইরের ছেলেদের সাথে। যেমন একজন আসত সেই মীরপুর থেকে। অনেকেই আসত সোহবানবাগ থেকে। রায়েরবাজার এবং পশ্চিম ধানমন্ডি থেকেও বেশ কিছু ছাত্র আসত। ধানমন্ডি স্কুলে আমার ক্লাসমেটদের ভেতর দুইজন ছিল বিখ্যাত পরিবারের সন্তান। একজন ছিল বাংলাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব বেবী ইসলামের ছেলে। অন্যজন ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আবুল মনসুর আহমেদের নাতি। ধানমন্ডি স্কুলে পড়ার সময় প্রথম স্কুল ফাঁকি দেয়া শিখি। টিফিনের পর বইখাতা নিয়ে দেয়াল টপকে সোজা চলে যেতাম আবাহনী ক্লাবের মাঠে। সেখানে তখন প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগের কিছু কিছু খেলা হতো। স্কুল পালিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই খেলা দেখে স্কুল ছুটির সময়ের সাথে মিল রেখে বাসায় ফিরতাম। তারপর খেয়েই ছুটতাম খেলার মাঠে।
১৯৮০ সালে আমি ধানমন্ডি স্কুল ছেড়ে রংপুর ক্যাডেট কলেজে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হই। আমার ক্যাডেট কলেজে ভর্তির পেছনে ছিল আব্বার অনেক দিনের স্বপ্ন। ছোটবেলায় আব্বা আমাদেরকে দাদাবাড়ীতে ঈদ করতে নিয়ে যেতেন। যাওয়ার পথে চোখে পড়ত ‘মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজ’ (বর্তমানে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ)-এর বিশাল গেট। আমি তখন হয়ত ক্লাস টু কিংবা থ্রী-তে পড়ি। আব্বা আমাকে এবং আমার ইমিডিয়েট বড় ভাইকে সেই গেট দেখিয়ে বলতেন যে একদিন এখানে ভর্তি হতে হবে। ছোটবেলা থেকেই এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতি তৈরি হয়েছিল আমার মনে ক্যাডেট কলেজ সম্পর্কে। তাই ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন ক্যাডেট কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করাটা আমার জন্য খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার ছিল। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমাদেরকে ডাকা হলো ভাইভা এবং মেডিকেল এক্সামিনিশনের জন্য। আমাদের দোতলায় তখন ভাড়া থাকতেন বাংলাদেশ বিমানের পাইলট ক্যাপ্টেন কামাল মাহমুদ। উনার সবচেয়ে ছোটভাই তখন মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকনোমিকস-এ অনার্স পড়ছেন। উনার কাছে পরামর্শ চাইলে উনি আমাকে মেডিকেলের ব্যাপারে বললেন যে তারা বেসিক্যালি ‘ফ্ল্যাট ফিট’ এবং ‘নক-নি’ আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখবে। আর ভাইভার সময় আমার কারেন্ট এফেয়ার্স সম্পর্কে কি জ্ঞান রয়েছে সেটা তারা যাচাই করে দেখবে। আমার যেহেতু ‘ফ্ল্যাট ফিট’ কিংবা ‘নক-নি’ এই দুইটির কোনটাই নাই তাই মেডিকেলের ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম। আর ভাইভার প্রস্তুতির জন্য মুখস্ত করা শুরু করলাম ‘বাংলাদেশের ডায়েরী’। কয়েকদিনের মধ্যেই ‘ইটালীর মুদ্রার নাম লিরা’ কিংবা ‘চীনের দুঃখ হোয়াংহো’ এই জাতীয় জ্ঞান আমার ঠোটস্থ হয়ে গেল। কিন্তু ভাইভাতে পাঁচ-সতেরোতে কত হয় সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারার কারণেই হয়ত প্রথম চয়েস ‘মোমেনশাহী’-তে চান্স না পেয়ে পেলাম মাত্র এক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত রংপুর ক্যাডেট কলেজে। সেটা অবশ্য ছিল ‘ব্লেসিং ইন ডিসগাইজ’, কারণ নতুন ক্যাডেট কলেজ হওয়ার কারণে বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজ থেকে সেরা সেরা টিচারদেরকে বদলী করে এখানে আনা হয়েছিল। প্রিন্সিপাল ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন মাহতাবউদ্দিন স্যার। অ্যাডজুডেন্ট হিসেবে ছিলেন মেজর কীর্তি রঞ্জন চাকমা, আমার দেখা সবচেয়ে চৌকস অ্যাডজুটেন্ট। এছাড়াও ক্যাডেটদের পিটি, প্যারেড, গেমস এবং সার্বিক ডিসিপ্লিন মেনে চলার জন্য আর্মির যে সব নন-কমিশনড স্টাফদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তারাও ছিলেন অত্যন্ত কর্তব্য পরায়ণ এবং দক্ষ। আমরা তাদেরকে ‘স্টাফজী’ বলে সম্বোধন করতাম। আমাদের জাহাঙ্গীর হাউজের সাথে যুক্ত ‘মিজান স্টাফজী’ ছিলেন ডিসিপ্লিনের ব্যাপারে অত্যন্ত কড়া। দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা মিজান স্টাফজী যুদ্ধের সময় ছিলেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। অপারেশন ‘সার্চ লাইট’ অর্থাৎ ২৫শে মার্চের পর যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন মনে করেছিল যে ‘মিশন অ্যাকমপ্লিশড’ ঠিক তখনই বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট। সেখানে মিজান স্টাফজী সরাসরি পাকিস্তানি সেনা অফিসার এবং সৈন্যদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন। দীর্ঘ নয় মাস তিনি অকুতোভয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি প্রায়ই আমাদেরকে তার নিজ অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে মুক্তিযুদ্ধের রোমহর্ষক কাহিনী শোনাতেন। কিন্তু তিনি সবসময়ই আমাদেরকে এই মেসেজটি দিতেন যুদ্ধ মানেই বীভৎস একটি ব্যাপার যা কোনভাবে কারোরই কাম্য হতে পারে না। অনেক বছর পরে আমি যখন রোমান পোলানস্কি-এর ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ মুভিটি দেখি তখন মিজান স্টাফজীর কথা বার বার মনে পড়ছিল।
আমাদের বাসা থেকে রংপুর ক্যাডেট কলেজের দূরত্ব দুইশো মাইলেরও বেশী। আসাদ গেট থেকে ভোর সাতটায় ঢাকা-রংপুরগামী বাসে উঠতে হত। আমরা সাধারণত যারা ঢাকা থেকে কলেজে যেতাম তারা সবাই একই বাসের টিকেট কাটতাম। সকাল নয়টা সাড়ে নয়টার দিকে বাস গিয়ে পৌঁছাত আরিচা ঘাটে। সেখানে জড়ো হওয়া সব বাসগুলিকে লাইন দিয়ে উঠতে হত নগরবাড়ীগামী ফেরিতে। লাইনে যাতে পিছিয়ে না পড়তে হয় সেই জন্য আরিচা রোডে বাসগুলির মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। ফেরিতে উঠা-নামার সময় নিরাপত্তার কারণে যাত্রীদেরকে বাস থেকে নেমে যেতে হত। বিআইডব্লিউটিএ বা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের শাহজালাল কিংবা শাহমাখদুম ফেরি করে পার হত সেই বাস। তখন এই ফেরি দুটি মাত্র বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল ফলে উত্তাল যমুনা পার হয়ে নগরবাড়ী পৌঁছাতে এই দুইটি ফেরির সময় লাগত অন্যান্য পুরাতন ফেরি থেকে অপেক্ষাকৃত কম। চার ঘন্টাতেই গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যেত। বাস যখন নগরবাড়ীতে পৌঁছাত তখন দুপুর পেরিয়ে যেত। আমরা অবশ্য ফেরিতেই মুর্গি আর ডাল দিয়ে দুপুরের ভাত খেয়ে নিতাম। অপূর্ব ছিল সেই খাবারের স্বাদ। নগরবাড়ী থেকে রংপুর পৌঁছাতে সময় লাগত আরও চারঘণ্টার মতন অর্থাৎ বাস যখন আমাদেরকে কলেজের গেটের সামনে নামিয়ে দিত তখন ঘড়িতে বেজে যেত পাঁচটা থেকে ছয়টা।
কঠোর নিয়মের ছকে বাঁধা ক্যাডেট জীবন। সেই ভোর পাঁচটায় বিগিউলের শব্দে ঘুম থেকে উঠে প্যারেড কিংবা পিটি দিয়ে দিন শুরু হতো। আর শেষ হতো রাত সাড়ে দশটায় লাইটস আউটের ঘণ্টা শুনে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়া দিয়ে। মাঝখানে ব্রেকফাস্ট, একাডেমিক ক্লাস, দুপুরের লাঞ্চের পর এক ঘণ্টার ন্যাপ, দুপুরের প্রেপ ক্লাস, বিকালের গেমস, সন্ধ্যায় কলেজ মস্কে গিয়ে মাগরিব প্রেয়ার, রাতে আবারও প্রেপ ক্লাস তারপর ডিনার এবং সবশেষে লাইটস আউট। ঘড়ির কাঁটার সাথে মিলিয়ে সব কাজ। ক্যাডেট কলেজের যে জিনিষটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশী ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে সেটা হলো হোস্টেলে থাকা। লালামাটিয়াতে বেশ কিছু ছেলেকে চিনতাম যারা ছিল মোহাম্মদপুর রেসিডেন্টশিয়াল মডেল স্কুলের আবাসিক ছাত্র। তারা ছুটিতে এসে তাদের হোস্টেল জীবনের মজার মজার সব ঘটনা বলত। তারা ফুটবল, ক্রিকেট এবং টেবিল টেনিস ছাড়াও হকি, বাস্কেটবল এবং ভলিবল খেলার সুযোগ পেত। তখন তাদেরকে হিংসে হতো। ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়ে তাদের মতন হকি, বাস্কেটবল এবং ভলিবল খেলার সুযোগ পাওয়া যাবে সেটা ভেবে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। তবে ক্যাডেট কলেজে গিয়ে মনে হয়েছে ক্যাডেট কলেজের সবচেয়ে মজার ব্যাপারটি হচ্ছে প্রতি উইক এন্ডের রাতের ফিস্ট। আমাদের সময় সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল রবিবার। শনিবার ছিল হাফ-ডে। শনিবার দুপুরে কিংবা রাতে কোন প্রেপ ক্লাস ছিল না। বিকেলের গেমসও ছিল অপশনাল। সন্ধ্যায় নামাজের পর চলে যেতাম কমন রুমে টেবিল টেনিস খেলার জন্য। ঘণ্টা খানেকের বেশী সময় টেবিল টেনিস খেলার পর যেতাম ডিনারে। ডিনারের পর টিভি রুমে গিয়ে বাংলা নাটক কিংবা সেটারডে নাইট’স মুভি দেখা হতো। আমাদেরকে প্রতি সেমিস্টারে একবার করে এসকারশনে (শিক্ষাসফর) আশে পাশের দর্শনীয় স্থানগুলিতে নিয়ে যাওয়া হত। সেই সুবাদে আমার দিনাজপুরের রামসাগর, কান্তজীর টেরাকোটা মন্দির, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প, বগুড়ার মহাস্থান গড়, পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহার ইত্যাদি বিখ্যাত স্থানগুলি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
ক্যাডেট কলেজে আমি কলেজ টিমে ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলেছি। ইন্টার হাউজ টেবিল টেনিস প্রতিযোগীতায় সিঙ্গেলস-এ চ্যাম্পিয়নও হয়েছি যখন আমি ক্লাস টুয়েলভ-এ। বেইজিং-এ আন্ডারগ্রেড করার সময়ও নিয়মিত টেবিল টেনিস খেলতাম। সেখানে নর্থ কোরিয়ান স্টুডেন্টদের সাথে টেবিল টেনিস খেলার বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম। একবার ফরেন স্টুডেন্টদের মধ্যে টেবিল টেনিসের এক প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান দখল করেছিলাম। সিঙ্গাপুর পলিটেকনিকে চাকরি করার সময় ২০০২ সালে ইন্টার ডিপার্টমেন্ট টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় আমার ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে ডাবলস-এ অংশ নিয়ে রানার্সআপ হই। ২০১৬ সালে কানাডাতে আমার চাকরিস্থলে অনুরূপ এক প্রতিযোগিতায় সিঙ্গেলস-এ রানার্সআপ হই। এখনও আমি সময় সুযোগ পেলে টেবিল টেনিস নিয়ে মেতে উঠি, ফিরে যাই আমার সেই দুরন্ত কৈশোরে।
ক্যাডেট কলেজে এসে আমি খেলাধুলার পাশাপাশি সম্মানিত শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় লেখাপড়াতেও মনোযোগী হয়ে উঠি। ধানমন্ডি স্কুলে থাকতে আমার রোল নম্বর থাকত চল্লিশের ঘরে, অথচ সেই আমি ১৯৮৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বাদশ স্থান অর্জন করি। আমি মনে করি আমরা যে ভাবে আমাদের কৈশোরকে উপভোগ করেছি সেভাবে হয়ত এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা উপভোগ করতে পারবে না। কারণ আমাদের যুগে বাবা-মারা আমাদেরকে নিয়ে অতটা চিন্তিত ছিলেন না। আমাদেরকে শুধু কাল্পনিক ‘ছেলেধরা’-র ভয় দেখিয়েই উনারা মনে করতেন যথেষ্ঠ করা হয়েছে। ফলে আমরা পেয়েছি অনেকখানি স্বাধীনতা। কিন্তু এ যুগে মাদক, কিশোর গ্যাং ইত্যাদি রূপে সেই ‘ছেলেধরা’ সামাজিক ব্যাধি হিসেবে সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে বাধ্য হয়েই বাবা-মাদেরকে ‘হেলিকপ্টার প্যারেন্টিং’-এর আশ্রয় নিতে হচ্ছে। তবে যুগের পরিবর্তনে এ যুগের ছেলেমেয়েদের চাহিদাও ভিন্ন। তারা তাদের মতন করে তাদের শৈশব এবং কৈশোরকে উপভোগ করুক সেই কামনা রইল তাদের প্রতি।
পুনশ্চঃ লখোটি যখন শষে করে এনছেি তখন বাংলাদশেে ঘটে গলে একটি অভূতর্পূব ঐতহিাসকি ঘটনা। পনরেো বছর ধরে জঁেকে বসা স্বরৈাচার সরকারকে উৎখাত করে দয়ে সারা বাংলাদশেরে অকুতোভয় কশিোর এবং সদ্য-তরুণ ছাত্রছাত্রীর দল। মৃত্যুকে পরোয়া না করে তারা একটি বনিাভোটরে রাজনতৈকি দলরে সরকার প্রধানকে যনিি কনিা কঠোর হাতে যে কোন বরিোধতিা দমন করার জন্য কুখ্যাত তাকে স্বল্প সময়রে নোটশিে দশেত্যাগ করতে বাধ্য করছে।ে তাদরে এই জয়রে সাফল্য পুরো বশ্বিকে তাক লাগয়িে দয়ে। আজ তাদরে কাছ থকেে অনুপ্ররেণা নচ্ছিে অন্যান্য দশেরে তরুণরা যারা তাদরে দশেরে সরকার দ্বারা নপিীড়তি এবং নর্যিাততি। আশা করি সইে সব কশিোর এবং তরুণরো ভবষ্যিতে বাংলাদশেকে এগয়িে নয়িে যাবে বহুদূর যা কোন রাজনতৈকি দল করতে পারনেি আজ অবধ।ি

কাজী সাব্বির আহমেদ
কলাম লেখক । টরন্টো