শুচিতা

নজরুল ইসলাম

(কানাডার দৈনন্দিন বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য রেখে কাল্পনিক এই উপন্যাস ‘শুচিতা’। লিখেছেন কানাডা প্রবাসী নজরুল ইসলাম।

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পরের উইকেন্ডে মানস মন্ট্রিয়েল এসে নিমির সঙ্গে দেখা করে এবং নিমি ওকে নিয়ে বাবা ললিতের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। ললিত বলে, যেহেতু তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো, তোমরা মন্দিরে চলো, আমি ছোটখাটো করে মন্ত্র পড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেব। পরে দুজনে একসময় দেশে গিয়ে মা-বাবা ভাইবোনকে নিয়ে বড় করে অনুষ্ঠান করে নিয়ো। মানস বলে, বাবা আমি ভেবেচিন্তে পরে আপনাকে জানাব। নিমি ভেতরে-ভেতরে অসন্তুষ্ট হয়ে বলে, তুমি যাও, আমি পরে কথা বলব।

মানসকে বিদায় দিয়ে নিমি বাসায় এসে চোখের পানি ফেলে, আমার কপাল ঠিক শুচিতার মতো। শুচিতা যেভাবে তার স্বামী সুমিত এবং তাদের পরিবার থেকে নাজেহাল হয়েছে, এভাবেই আমাকেও মানসের নিজের এবং পরিবার থেকে নাজেহাল হতে হবে। সে কয়েক সপ্তাহ নিজ থেকে কথা বলা বন্ধ করে দিয়ে চুপ করে থাকে।

মানস কয়েকবার নিমিকে টেলেফোনে না পেয়ে শেষে মন্ট্রিয়েল এসে নিমির সঙ্গে দেখা করে বলে, তুমি তো আমার সঙ্গে রাগ করেছ। নিমি বলে, আমি আপাতত বিয়ে করব না।

মানস বলে কেন?

নিমি বলে, বাবার অসুখ, আমি একটু টেনশনে আছি। বাবার অসুখ ভালো হলে চিন্তা করে দেখব। মানস বলে, বাবার বার্ধক্যজনিত রোগ তা রাতারাতি ভালো হওয়ার মতো না। নিমি বলে, বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। আজ তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারলাম না, তুমি যেতে পারো, আমাকে যেতে হবে।

মানস তাকিয়ে থেকে বলে, এ কোন নিমি?

আমি যেই নিমিকে তিন বছর থেকে চিনি,এ কী সেই নিমি?

মানস অনেক দিন যোগাযোগ করেও আর নিমিকে রাজি করাতে পারেনি।

এভাবেই তাদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়।

নিমি কাজ থেকে এসে তাড়াহুড়া করে রান্না চড়িয়েছে। অদিতি ও প্রিয়ব্রত এই উইকেন্ডে মন্ট্রিয়েল আসছে। ওরা সরাসরি বাবাকে দেখার পর নিলয়কে নিয়ে নিমির বাসায় উঠেছে। রাতের খাবার খেয়ে ওরা নিলয়কে নিয়ে বসে অধিক রাত পর্যন্ত টেলিভিশন দেখে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে নিমি ও অদিতি সকালের নাশতা খেয়ে বাইরে বের হয়েছে। প্রিয়ব্রত নিলয়কে নিয়ে বাসায় রয়েছে। ওরা ঘণ্টা দুয়েক পরে বাজার করে ঘরে ঢোকে।

প্রিয়ব্রত বলে, মানস একটু আগে আমাকে টেলিফোন করেছে। সে এখন মন্ট্রিয়েল আছে এবং বাসায় আসতে চায়। আমি বলেছি যে নিমি বাসায় নেই, এলে টেলিফোন করবে। ওরা রান্না করে খাওয়াদাওয়া করে কিছু সময় রেস্ট নিয়ে বাবা ললিতকে দেখতে গিয়েছে। গিয়ে দেখে মানসও বাবার ওখানে আছে।

মানস বলে, আমি তোমার বাসায় যাব বলে ঠিক করেছি। কিন্তু তুমি বাসায় নেই সে জন্য যাইনি; তোমার বাসার ঠিকানাও জানি না। নিমি কিছুই বলছে না। বাবা বলে, মানস আমাকে বলেছে, সে রাজি আছে এবং আমার কথামতো ছোটখাটো করে বিয়ে করে নেবে। অদিতি বলে, মানস, তুমি এখানে যদি বিয়ে করতে চাও, আমরা তোমাদের বিয়েতে আশীর্বাদ করতে পারব। তোমরা পরে সময় করে দেশে গেলে দেশের লোকজনকে নিয়ে আনন্দ করবে। মানস বলে, ঠিক আছে বাবা মিলিয়ে দিলেই হবে। প্রিয়ব্রত বলে, ঠিক আছে ওদের আর একটু সময় নিতে দাও। ওরা যখন দুজনে মিলে বলবে, ওসব ব্যবস্থা করা যাবে।

মানস অটোয়া চলে যাওয়ার পর অদিতি বলে, নিমি, সে কী সিরিয়াস বিয়ে করার ব্যাপারে?

নিমি বলে, ও তো বিয়ে করতে চায়। কিন্তু দেশে গিয়ে মা-বাবাকে নিয়ে, এখন মন পরিবর্তন করেছে। দেখি কিছু সময় যাক, পরে দেখা যাবে। ঠিক আছে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। ললিত বলে, মানস রাজি হয়েছে, তুমি দেরি কেন করো?

বাবা, আমাকে একটু সময় দাও, আমি বুঝেশুনে তোমাকে জানাব।

ললিতের ডান হাঁটু প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছে; এখনো ওয়াকার নিয়ে চলাফেরা করে। নার্স সপ্তাহে তিন দিন এসে তাকে ব্যায়াম ও গোসল করিয়ে বিছানা পাল্টিয়ে নতুন বেডশিট লাগিয়ে দিয়ে ময়লা কাপড় লন্ড্রি করে রেখে যায়।

বিকেলের দিকে ওরা নিলয়সহ ঘোরাঘুরি করে নিমিকে নামিয়ে দিয়ে অটোয়া চলে যায়। নিমি বাসায় ফিরে এসে সারা দিনের থালাবাসন ধুয়ে, ঘর পরিষ্কার করে টেলিভিশন নিয়ে বসে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে, আজ সন্ধ্যার দিকে তুষারপাত হবে। কানাডার শীত শুধু অতিরিক্ত ঠান্ডাই নয়, তার সঙ্গে ঝোড়ো বৃষ্টি এবং তুষার মিলিয়ে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়।

নিমি মন্ট্রিয়েল এসে এ নিয়ে কয়েকবার দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সম্মুখীন হয়েছে। সাদা তুলার মতো তুষার পড়ে, দেখতে বেশ ভালো লাগে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে চারদিক সাদা বরফে ঢেকে যায়। নিমি ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। এ সময় কে যেন দরজায় নক করছে, নিমি ঘরে ঢুকে দরজার কাছে গিয়ে বলে, কে। মেয়েলি গলার কণ্ঠস্বর, দরজা খুলুন; দরজা খুলে দেখে পাশের অ্যাপার্টমেন্টের নমিতা ঘর থেকে কিছু খাবার নিয়ে নিমিকে দেখতে আসছে। নিমি বলে, দিদি, ঘরে এসো। সে বলে, না, আমি কিছু খাবার দেওয়ার জন্য এসেছি। আর একদিন আসব। এই বলে খাবারের বাটি হাতে দিয়ে চলে যায়। নিমি ঢাকনা খুলে দেখে কিছু মিষ্টি জাতীয় খাবার দিয়েছে। সে বাটি টেবিলে রেখে পুনরায় ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে সাদা তুষার পড়া দেখে, এক ঘণ্টার মধ্যে সারা শহর সাদা তুষারে ঢেকে গেছে। দেখতে বেশ ভালো লাগছে। এদিকে স্নোব্লোয়ার দিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির লোক রাস্তা পরিষ্কার করা শুরু করেছে।

নিমি ঘরে ঢুকে টেলিভিশনের সামনে বসে নমিতার দেওয়া মিষ্টি খাচ্ছে আর অটোয়া থাকাকালে ডে কেয়ারে কাজ করা এবং বাচ্চাদের নিয়ে তুষার ও বরফের মধ্যে বাইরে হাঁটাহাঁটি করা নিয়ে ভাবছে। টেলিফোন রিং হচ্ছে শুনে সে গিয়ে ধরে এবং শুচিতা বলে, নিমি, কেমন আছ?

নিমি অবাক হয়ে বলে, আমি ভাবছি তোমাকে নম্বর দেব। শুচিতা, তুমি কী করে আমার টেলিফোন নম্বর পেলে?

শুচিতা বলে, তোমার বন্ধু নাহিদ আমাকে দিয়েছে।

তুমি কেমন আছ এবং ধ্রুব কেমন আছে?

আমরা সবাই ভালো।

তোমার একাকী জীবন মন্ট্রিয়েলে কেমন কাটছে?

দাদা, অদিতি ও নিলয় কাল এসেছিল এবং মানসও আমাকে দেখতে এসেছে।

মানসের সঙ্গে তোমার কোনো কিছু কি হলো?

না, সে গতকাল আমাকে দাদা, অদিতি ও বাবার সামনে বলেছে, এখানেই বিয়ে করবে। তুমি কী বললে?

আমি বলেছি, একটু চিন্তা করতে দাও। তার কারণ ওর আগের প্ল্যান ছিল ইন্ডিয়া গিয়ে সবাইকে নিয়ে আমরা বিয়ে করব। আমাদের কেউ রাজি হয় না দেখে সে রাজি হয়েছে। দেখো চিন্তা করে কোনটা ভালো হয়।

আঙ্কেল ও আন্টি কী ইন্ডিয়া থেকে ঘুরে এসেছে?

না, এখনো আসেনি।

সুমিতের কী অবস্থা?

ও এখনো হাসপাতালে আছে এবং শরীর অনেকটা ফুলে গেছে।

ডাক্তার কী বলে?

ডাক্তার বলে, ওর শরীরে পানি নেমেছে। ও হাঁটাহাঁটি করতে পারছে না। আমি আজ ওকে দেখতে গিয়েছিলাম।

নিমি, তোমার বাবার কী অবস্থা?

বাবা এখনো নার্সের কেয়ারে আছে। একথা-সেকথা বলে টেলিফোন রেখে দেয়।

নিমি ভাবে বাবা আস্তে আস্তে ওয়াকার ঠেলে ঠেলে হাঁটে। আমি প্রতিদিন বিকেলে কাজ থেকে বের হয়ে বাবাকে দেখতে যাই। বাবা আমাকে দেখলেই হেসে বলে, ‘মা, কেমন আছ?’

বাবা টিম হর্টনের কপি পছন্দ করেন। সঙ্গে একটা ডেনিস বা একটা ডোনাট বা মাফিন নিতে ভুল করি না। বাবা দেখলে খুব খুশি হয়ে হাত বাড়িয়ে নিয়ে অতি তৃপ্তির সঙ্গে খায়। আমি এর ফাঁকে বিছানার চাদর, বালিশের কভার, আলমারি খুলে কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখি। জুতা, স্যান্ডেল অগোছালো অবস্থায় থাকে যা গুছিয়ে রাখি। তার রুমমেট বলে তুমি বাবার অনেক খেয়াল রাখো। রান্নাঘরের বাবুর্চির সঙ্গে আলাপ করে জানি, বাবা ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া করে কি না।

বাবাকে ওয়াকার ঠেলে ঠেলে বাইরে নিয়ে একটু কথা বলি। বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, বাবা, তুমি একা না, আমি তোমার কাছেই থাকি। মাঝেমধ্যে উইকেন্ডে বাবাকে বাসায় নিয়ে আসি এবং বাবার পছন্দের এটা-সেটা তৈরি করে সামনে দিই। বাবা আগের চেয়ে অনেক সুস্থ বোধ করছে, তা ছাড়া বাবা চিকিৎসা নিতে অবজ্ঞা করে না। মানসিক রোগীদের অধিকাংশই নিয়মিত স্নান এবং পয়-পরিষ্কার থাকে না।

বাবা মনখোলা মানুষ, জিজ্ঞেস করে মানসের সঙ্গে তোমার বিয়ের কী হলো?

আমি বলি, বাবা, একটু সময় নিচ্ছি, তোমাকে বলব যদি কিছু হয়। বাবা বলে, অদিতি বলেছিল নরেশের সঙ্গে তোমার বিয়ের প্রস্তাব আছে। বাবা, আমি এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারছি না। নতুন চাকরি একটু মনোযোগ দিয়ে কাজ করি।

আমার দুই কামরার বাসা, উইকেন্ডে মাঝেমধ্যে বাবাকে নিয়ে আসি এবং কাছে রেখে দিই। বাবার পছন্দের খাবার তৈরি করে খাওয়াই যাতে বাবা একটু তৃপ্তি সহকারে খেতে পারে। আশ্রমে বিভিন্ন দেশীয় লোক একত্রে থাকে এবং ওরা সবার পছন্দের খাবার তৈরি করতে পারে না।

মানস আমাকে বলেছে সে দেশে তার বাবা-মা এবং আত্মীয়দের টেলিফোন করে জানিয়েছে, নিমির সঙ্গে তার অনেক দিনের সম্পর্ক রয়েছে এবং ওর পক্ষের কেউ দেশে যাওয়ার মতো নেই। ওরা গত দুই দশক এই দেশে থাকে। বাবা-মা বলে দেশে গিয়ে সবাইকে নিয়ে বিয়ে করতে, এটা সম্ভব হচ্ছে না এবং শর্ট করে আমাকে এখানেই বিয়ে করে নিতে হবে। বাবা-মা ওর অবস্থা বুঝে বলেছে, তুমি বিয়ে করে নাও এবং পরে দেশে গিয়ে দেখা করে বাকি অনুষ্ঠান এখানে করবে।

মানস নিমিকে বলে, আমি মা-বাবার কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়েছি। কাজেই সামনে এগিয়ে যেতে আর কোনো বাধা নেই। নিমি শুচিতাকে বলে, মানস রাজি হয়েছে তার মা-বাবা এখানে আমাদের বিয়ে হলে অমত করবে না। শুচিতা এ নিয়ে নাহিদের সঙ্গে আলাপ করে বলে, নিমি এখন এগিয়ে গেলে খারাপ কিছু দেখছি না।

নিমি বাবাকে দেখতে গিয়ে বলে, বাবা, মানস রাজি হয়েছে এবং বলেছে এখানে ছোটখাটো করে অনুষ্ঠান করে নেবে। ললিত বলে, আমি তেমন কিছু খারাপ দেখছি না। নিমি অদিতির সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে হোঁচট খায়। অদিতি বলে, নরেশ সব দিক থেকে ভালো এবং তুমি ভালোভাবে চিন্তা করে দেখবে। নিমি বাবাকে বলে, বাবা, অদিতি আমাকে বলে নরেশকে বিয়ে করার জন্য। ললিত বলে, মানস ও নরেশ উভয়ই ভালো। তবে তুমি মানসকে পছন্দ করো, আমি তোমাকে বলছি ওকে আমি দেখছি, ভালো ছেলে, আমি আশীর্বাদ করেছি তা উঠিয়ে নিতে পারব না।

অদিতি বলে, বাবা, মানসের চেয়ে নরেশ বেশি শিক্ষিত এবং কলেজে প্রফেসরি করে। নিজের বাড়ি, গাড়ি সবই আছে এবং ধীরস্থির মানুষ। ললিত বলে, থাকগে, মানস ইয়ং ছেলে এবং তোমাদেরও বাড়ি-গাড়ি হবে। এ দেশে বাড়ি-গাড়ি করতে পয়সা দরকার হয় না, সবাই লোন করে বাড়ি-গাড়ি করে।

এক উইকেন্ডে প্রিয়ব্রত, অদিতি নিমি ও মানসকে মন্দিরে নিয়ে বাবা ললিতের উপস্থিতিতে ঠাকুর দিয়ে ওদের বিয়ের অনুষ্ঠান করিয়ে দিয়ে বলে, তোমরা সুখী হও। বিয়ের পর ওরা নিমির অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ওঠে।

পর্ব: ১০

টরন্টো থেকে শুচিতার অনেক বন্ধু তার ছেলে ধ্রুবকে দেখতে চায়। তার চাকরির ব্যস্ততা, বিবাহ এবং সুমিতের অসুস্থতার কারণে অনেক দিন থেকে ইচ্ছা থাকলেও যাওয়া হয়নি। দাদু রাবেয়া টেলিফোন করলেই বলে, তোমার ছেলেকে একবার দেখিয়ে গেলে না? তোমার এমন কী ব্যস্ততা যে দুই দিনের জন্যও আসতে পারো না?

দাদু, আমি ব্যস্ত, তা ছাড়া সুমিতও অসুস্থ, যে জন্য আসতে দেরি হচ্ছে; তবে আসব একটু সময় নিয়ে। এদিকে সুমিতের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না, ও দুবার স্ট্রোক করেছে, ওপেন হার্ট সার্জারি হলেও অসুস্থ শরীরে পানি নেমেছে, হাঁটা চলাফেরাও খুব একটা করতে পারে না; এ নিয়ে সে অনেক দুশ্চিন্তায় থাকে। প্রতিদিনই কাজ সেরে হাসপাতালে গিয়ে কিছু সময় সুমিতের নিকট বসে অতিবাহিত করে। তার শ্বশুরপক্ষের লোকজন শুচিতাকে পছন্দ করে না, এ নিয়েও ভাবনার অন্ত নেই।

কমল ও আরতি বলে, স্ত্রীর ভাগ্যে স্বামীর সংসারে সুখ আনে। সুমিত যেদিন শুচিতাকে বিয়ে করেছে, তার পরদিন থেকেই এ সংসারে নানা অশান্তি দেখা দিয়েছে। কমল আরও বলে, শুচিতাকে ঘরে রাখলে সুমিতের কোনো দিনও শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা আসবে না। সুমিত গত দুই মাস হাসপাতালে ভর্তি, ওর আজ এই সমস্যা, কাল সেই সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আছে, তার নিজের মা-বাবা, ভাইবোন এ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সে কারও সাহায্য ছাড়া হাঁটাচলা করতে পারে না। হাসপাতাল গেলে দেখা যায় ও ওয়াকার ঠেলে ঠেলে করিডর দিয়ে হাঁটে; তবে বেশির ভাগ সময় বেডে থাকে।

প্রিতম ও আভা ইন্ডিয়া থেকে এযাবৎ ফিরে আসেনি। শুচিতা আজ অফিসের কাজ সেরে হাসপাতাল গিয়ে সুমিতের সঙ্গে আলাপ করে, মা-বাবা ইন্ডিয়া বেড়াতে গিয়েছে; আমি অনেক দিন টরন্টো যাইনি, আগামী লং উইকেন্ডে ধ্রুবকে নিয়ে ঘুরে আসতে চাই। সুমিত বলে, যেতে পারো, আমার দেখাশোনার জন্য লোকজন আছে: তা ছাড়া হাসপাতালে নার্স, ডাক্তার সবই আছে আমার দেখার জন্য।

শুচিতা প্রদীপের সঙ্গে আলাপ করে বলে, আমি টরন্টো যেতে চাই, তুমি যদি যেতে রাজি হও তাহলে একটা গাড়ি রেন্ট নিয়ে আমরা আগামী লং উইকেন্ডে যেতে পারি। আমাদের কিছু বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন আছে যারা সব সময় যেতে বলে। আমার পরিচিত এক দাদা ও দাদু গত তিন বছর থেকে বলে আসছে যাওয়ার জন্য। প্রদীপ বলে, তুমি কি এ নিয়ে সুমিতের সঙ্গে আলাপ করেছ?

হ্যাঁ। আমি আলাপ করেছি। সে বলেছে, কোনো আপত্তি নেই; কারণ ওকে দেখাশোনার লোকজন রয়েছে এবং মোবাইল ফোনে আলাপ করে খোঁজখবর নেওয়া যাবে। সুমিতের সঙ্গে আলাপ করে থাকলে ভালো করেছ। আমার গাড়িও নিতে পারো, তবে পুরোনো গাড়ি। শুচিতা বলে, দীর্ঘ পথ গাড়ি চালিয়ে যাব, ভালো গাড়ি না হলে নিরাপদ মনে করি না। আমরা বরং ভালো দেখে একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে যাব। শুচিতা বলে, ঠিক আছে।

শুচিতা প্রোগ্রাম ঠিক করে গাড়ির ব্যবস্থা করেছে। শনিবার ওরা ভোর ৮টায় বাসা থেকে সকালের নাশতা করে, কোম্পানি থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে রওনা দেয়। অটোয়া থেকে টরন্টো ৪ ঘণ্টার জার্নি, ওদের কোনো তাড়া নেই, আস্তে-ধীরে গল্প করে ওরা দুজনই শেয়ার করে গাড়ি চালাচ্ছে।

ধ্রুবর পছন্দের রাইম ‘টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার, হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর…’ সিডি বাজাচ্ছে এবং ধ্রুব তার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে। ওর আনন্দ দেখে প্রদীপ ও শুচিতা ওর সঙ্গে গেয়ে আনন্দ দিচ্ছে।

পথে যেতে যেতে ধ্রুবর কত রকম আবদার শুনতে হয়, ধ্রুব কিছুক্ষণ পর বলে মাম্মি, আমি ম্যাকডোনাল্ডে যাব, কাজেই ওকে নিয়ে ম্যাকডোনাল্ডে ওয়াশরুম সেরে দুজনে কফি ও ওর জন্য চকলেট মিল্ক, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ এবং মাফিন কিনে খেয়ে পুনরায় জার্নি শুরু করে। ওরা আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে পথে কিংস্টন থেমে দুটার দিকে রেস্টুরেন্টে খেয়েদেয়ে ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার দিকে দাদা মজিদের পার্কিং লটে এসে কল দিয়ে বলে, দাদু, আমরা তোমাদের পার্কিং লটে। মজিদ ও রাবেয়া নিচে নেমে এসে বলে, এসো ওপরে। তাদের পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রাম, দাদার বাসায় রাতের খাবার সেরে তার এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে ঘুমাবে। সে আগে থেকে টেলিফোন করে জানিয়েছে যে দাদু, আমি এবং আমার কাজিন প্রদীপ এবং ধ্রুব তোমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য টরন্টো আসব এবং রাতে খাব। রেবেকা বলে, তোমরা এখানে রাতে খাওয়াদাওয়া করবে, কোনো অসুবিধা নেই; তা ছাড়া আমরা সব সময় বাসায় থাকি: তবে আমরা এক বেডরুমের বাসায় থাকি, কাউকে রাতে থাকতে দিতে পারি না।

শুচিতা মজিদ ও রেবেকার জন্য এটা-সেটা কেনাকাটা করে এনেছে। মজিদ ও রেবেকা বলে, তুমি আমাদের মনে রেখেছ, এটাই যথেষ্ট; তা ছাড়া তোমার ছেলে ধ্রুবকে দেখিয়েছ, আমরা এতে অনেক আনন্দিত। খাবার টেবিলে অনেক ধরনের খাবার দেখে শুচিতা বলে, দাদু, তোমার রান্নার স্বাদ আলাদা। তুমি এত এত রান্না করেছ, আমরা কটা খাব? রেবেকা বলে, কী আর করলাম?

তোমরা খাবে সে জন্য টুকটাক একটু না করে পারি না। তোমার ছেলে এবং প্রদীপ কিছুই খাচ্ছে না। তোমার বাবা-মাকে নিয়ে একবার এসে দেখা করে যেয়ো। নানা কাপড় এবং এটা-সেটা দেখে বলে, এত এত জিনিস কেন আমাদের জন্য এনেছ?

শুচিতা বলে, আমার মন চাইল, তাই আনলাম। তুমি আমাদের কথা মনে করে তোমার ছেলেকে নিয়ে এসেছ, তার চেয়ে আনন্দের আর কী থাকতে পারে!

শুচিতা বলে, দাদু, আমরা কাল তোমাদের নিয়ে ব্লু মাউন্টেন যাব। মজিদ বলে, আমার না গেলে হয় না?

না দাদা, তোমাদের নিয়ে যাব। তোমরা দুজন তৈরি থেকো। মজিদ বলে, দেখি যদি শরীর ভালো থাকে যাব; নতুবা তোমার দাদু যাবে। না দাদা, তোমাকেও যেতে হবে, তুমি ভালো থাকবে কালকের জন্য।

দাদুর বাসা থেকে ফোন দিয়ে বান্ধবী রিতাকে বলে, আমরা দাদুর বাসা থেকে খেয়েদেয়ে তোমার বাসায় আসতেছি। রিতা বলে, তোমার জন্য আমি বিকেল থেকেই রান্না করে বসে আছি। শুচিতা তার বাসায় পৌঁছাতে রাত সাড়ে দশটা বাজে। রিতা ওদের দেখে বলে, তোমরা এখানে এসে খাওয়াদাওয়া করবে সে জন্য রান্না করেছি। সে বলে, আগের প্রোগ্রাম, আমরা দাদুর বাসায় খেয়ে এসেছি এবং তোমার রান্না কাল সকালে খেয়ে বের হব। অনেক রাত পর্যন্ত ওরা গল্প করে বিছানায় যায়। ওদের সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়। ঘুম থেকে উঠেই দেখে টেবিল ভর্তি খাবার। তোমরা কাল রাতে খাওনি, এখন খেয়ে যাও এবং রাত এসেও খাবে আমার বাসায়। শুচিতা বলে, তুমি ও তোমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলো। না, আমরা সব সময় যাই, আজ তোমরা যাও ঘুরে এসো। মনে রেখো রাতে আমাদের এখানে খাবে এবং কাল সকালে নাশতা করে বিদায় নেবে। সে দেখা যাবে। শুচিতা দাদুর বাসায় টেলিফোন করে বলে, দাদু, তোমরা কি তৈরি হয়েছ?

রেবেকা বলে, আমরা সেই সকাল থেকে উঠে নাশতা করে বসে আছি। দাদু, আমরা কাল রাত দেরি করে ঘুমিয়েছি সে জন্য উঠতে দেরি হলো।

ঠিক আছে তাড়া কিসের? তোমরা নাশতা করবে না?

না, দাদু, আমরা এখানে নাশতা করছি।

ঠিক আছে, আস্তে আস্তে আসো, নিচে এসে কল দিলে আমরা নেমে যাব। আমরা আসতেছি আধ ঘণ্টার মধ্যে। ঠিক আছে।

মজিদ ও রেবেকাকে সিনিয়র হোম থেকে উঠিয়ে নিয়ে হাইওয়েতে না গিয়ে ছোট রাস্তা ধরে আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে এবং মাঝেমধ্যে টিম হর্টন দেখলে ধ্রুব চিৎকার করে বলে, মাম্মি, এখানে রাখো আমি আইসক্রিম খাব। শুচিতা বলে, টিম হর্টনে ভালো আইসক্রিম পাওয়া যায় না। ওরা কপি এবং মাফিন, চকলেট মিল্ক কিনে খেয়ে ওয়াশরুম সেরে আস্তে আস্তে দুই দিক দেখে এগোচ্ছে। দুই দিকে বিরাট বিরাট কৃষি ফার্ম, গম, আলু চাষ দেখে এগোচ্ছে। তা ছাড়া বিরাট বিরাট বাড়ি চারদিকে প্রশস্ত মাঠ এবং অনেক ফার্মে গরু আর ঘোড়া। বেলা দুইটার দিকে ওরা ব্লু মাউন্টেন পৌঁছে। টরন্টো থেকে ব্লু মাউন্টেন প্রায় ২০০ কিলোমিটার। ওরা ক্লান্ত হয়ে রেস্টুরেন্টে ও ডেইরি কুইনে সবাই মিলে দুপুরের খাবার ও আইসক্রিম খেয়ে রাইডিংয়ে যায়। ব্লু মাউন্টেন অতিচমৎকার পাহাড়ি এলাকা এবং সুন্দর করে বিভিন্ন গেম দিয়ে সাজানো। পাশেই চার্লেস্টোন লেক অতিচমৎকার এবং চারদিকের মনোরম দৃশ্য দেখলে মন ভরে যায়।

ব্লু মাউন্টেন ট্যুরিস্টদের থাকার জন্য হোটেল, মোটেল ও ভাড়া বাসা, সিঙ্গল, ডাবল বেডরুমের ব্যবস্থা রয়েছে। যে কেউ গ্রীষ্মের উইকেন্ড বা ছুটি নিয়ে থাকতে পারে। ওরা বিভিন্ন রাইডিংয়ে ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার দিকে ফিরতি যাত্রা শুরু করে রাত ১০টার দিকে টরন্টো পৌঁছে। রেবেকা বিকেলের জন্য রান্না করে রেখে গিয়েছে এবং বলে, তোমরা ওপরে এসো, খেয়ে যাও। শুচিতা বলে, দাদু, খাবার মতো ইচ্ছা নেই; রিতাও আমাদের জন্য রান্না করেছে। মজিদ বলে, ওপরে ওঠো এবং খাওয়া শেষ করে তবে যাও এবং সকালে তোমার বান্ধবী রিতার বাসায় নাশতা করে যেও। শুচিতা এবং প্রদীপ ধ্রুবকে নিয়ে ওদের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে খেয়ে বলে, দাদু, আমরা কাল সকালে অটোয়া চলে যাব। আমাদের জন্য আশীর্বাদ করো। রেবেকা বলে, কাল সকালে যাওয়ার আগে একবার কয়েক মিনিটের জন্য ওপরে আসবে।

মজিদ ও রেবেকা আগেই ধ্রুব এবং শুচিতার জন্য এটা-সেটা কিনে রেখেছে। সকালে রিতার বাসায় নাশতা করে, এ বাসায় আসলে, হালকা খাবার পর রেবেকা বলে, এগুলো তোমাদের জন্য। শুচিতা খুশিতে আপ্লুত হয়ে বলে, দাদু, তোমরা আমাদের অনেক আপনজন, কিছু না দিলেও আমরা খুশি থাকি। মা-বাবা এলে তোমাদের একবার অটোয়া নিয়ে যাব। রেবেকা বলে, সে দেখা যাবে। ওদের পার্কিং পর্য্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বিদায় দেয়।

শুচিতা প্রদীপকে বলে, টরন্টোর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। এখানে আমার বহু বন্ধু যাদের সঙ্গে রয়েছে শিশু, কিশোর ও যৌবনের নানা কাহিনি ও স্মৃতি। টরন্টো থেকে বিদায় নেওয়ার আগে সে সিএন টাওয়ার, পার্লামেন্ট এরিয়া, টরন্টো ইউনিভার্সিটি গাড়ি নিয়ে ঘুরে ধ্রুব ও প্রদীপকে দেখিয়ে বিকেলের দিকে অটোয়া রওনা দেয়। যাওয়ার আগে জার্রার্ড স্ট্রিট নেমে কিছু কেনাকাটা করে। শুচিতা বলে, বাবা-মা মাসে দু-একবার এই স্থানে আমাকে নিয়ে আসত। এখানে রেস্টুরেন্টে বসে কিছু না কিছু খেয়ে ঘোরাঘুরি করতাম।

যাওয়ার পথে ওরা থেমে থেমে রেস্টুরেন্টে বসে খেয়েদেয়ে আস্তে আস্তে রাতের দিকে অটোয়া পৌঁছে। প্রদীপ শুচিতা ও ধ্রুবকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে কোম্পানিতে জমা দিয়ে নিজের গাড়ি গ্যারেজ থেকে নিয়ে বাসায় গেলে মারিয়া বাসার দরজা খুলে বলে, লম্বা জার্নি করে এসেছ। প্রদীপ হেসে বলে, মারিয়া, তুমি ঠিকই বলেছ। সকাল ৯টা বাজে গাড়ি চালান শুরু করেছি, এখন রাত ৯টা বাজে ঘরে ঢুকেছি। মারিয়া বলে, টরন্টো থেকে অটোয়া ৪ ঘণ্টার জার্নি, তোমাদের ১২ ঘণ্টা লাগার কারণ কী?

প্রদীপ বলে, আমরা বিভিন্ন স্থানে রেস্ট নিয়ে আস্তে আস্তে নানা দৃশ্য দেখতে দেখতে এসেছি। মারিয়া বলে, তুমি কি রাতের খাবার খেয়েছ?

প্রদীপ বলে, আমরা পথে অনেক কিছু খেয়েছি। মারিয়া বলে, আমি পাস্তা, মিটবল ও ভেজিটেবল তৈরি করেছি, তুমি কাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে নাও আমি খাবার নিয়ে আসছি, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে তোমার কাজ আছে, লম্বা জার্নির পর রেস্টের দরকার আছে। প্রদীপ বলে, মারিয়া, তুমি ঠিকই বলছ। আমি ক্লান্ত, রাতে ভালো ঘুমের দরকার।

রাতে শুচিতা কল দিয়ে বলে, প্রদীপ, তুমি কি গাড়ি জমা দিয়েছ?

প্রদীপ বলে, হ্যাঁ! কোনো অসুবিধা হয়নি তো?

না, কোনো অসুবিধা হয়নি।

কিছু কি খেয়েছ?

হ্যাঁ! মারিয়া খাবার দিয়েছে, আমি খেয়ে শুয়ে পড়েছি। তুমি একটা ভালো বাড়িওয়ালা পেয়েছ যে তোমার অনেক যত্ন নিয়ে থাকে। তুমি ঠিকই বলেছ, ঠিক আছে কাল কথা হবে।

পরদিন শুচিতা অফিসের কাজ থেকে বের হয়ে হাসপাতালে সুমিতকে দেখতে যায়। সুমিত বলে, তোমার জার্নি কেমন হয়েছে?

শুচিতা বলে খারাপ না, মোটামুটি উপভোগ করেছি; তবে তোমাকে মিস করেছি। তুমি সুস্থ হলে একবার নিয়ে যাব। সুমিত কিছু না বলে ওর দিকে চেয়ে থাকে।

আরতি বলে, তুমি আমার ছেলেকে এ অবস্থায় রেখে কীভাবে প্রদীপকে নিয়ে টরন্টো বেড়াতে গেলে?

শুচিতা বলে, মা, এখানে থেকে থেকে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি; তা ছাড়া প্রদীপ আমার কাজিন, ও গাড়ি ড্রাইভ করে গিয়েছে। এ নিয়ে তুমি রং ছড়াছড়ি করবে না অনুগ্রহপূর্বক। আমি সুমিতকে ভালোবাসি, সে আমার স্বামী এবং আমি আশাকরি সে ভালো হয়ে উঠুক এবং আমরা ঘর সংসার শুরু করব। আরতি বলে, তুমি ডাবল অ্যাকটিং করো, প্রদীপকে তুমি ভালো না বাসলে ওকে নিয়ে ওঠাবসা করবে কেন?

মা, আমি তোমার সঙ্গে এসব নোংরা কথার জবাব দিতে চাই না; এই বলে সে হনহন করে হাসপাতালের রুম থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে ধ্রুবকে ডে কেয়ার থেকে নিতে যায়। নাহিদ ওকে দেখে বলে, তোমার টরন্টো জার্নি কেমন হয়েছে?

ভালো হয়েছে, আমরা টরন্টো এবং ব্লু মাউন্টেন গিয়েছিলাম। দুই দিনে আমি ধ্রুবকে নিয়ে অনেক উপভোগ করেছি। আমি একা লম্বা ড্রাইভ করতে পারি না। সে জন্য আমার কাজিন প্রদীপকে নিয়ে গিয়েছি। অধিকাংশ সময় সে ড্রাইভ করেছে, আমি ধ্রুবকে সামলিয়েছি। কিন্তু এ নিয়ে আমার শাশুড়ি আরতি আমাকে অনেক কথা শুনিয়েছে, আমি সুমিতকে একা হাসপাতালে রেখে প্রদীপকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করি। আমি রাগ করে হাসপাতাল থেকে চলে এসেছি। নাহিদ বলে, এসব বাদ দিয়ে তুমি তোমার কর্তব্য করো। কে কী বলল এতে তোমার কিচ্ছু যায়-আসে না। তুমি ভালো হলে একদিন তোমাকে কেউ না কেউ ভালো বলবে। টরন্টো এবং ব্লু মাউন্টেন তোমার কেমন কেটেছে?

অপূর্ব! লোকজন অনেক দিন পর দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরেছে; তা ছাড়া ধ্রুবকে দেখে সবাই খুশি। ধ্রুব চটপটে সবার সঙ্গে কথা বলে এবং কোনো জড়তা নেই, সবার কাছে যায়।

রাতে শুচিতা মা আভাকে টেলিফোন করেছে। আভা টেলিফোন উঠিয়ে বলে, শুচিতা, তুমি কেমন আছ?

মা, আমি ধ্রুব ও প্রদীপকে নিয়ে টরন্টো এবং ব্লু মাউন্টেন ঘুরে এসেছি। দাদু রাবেয়া,মজিদ এবং বন্ধুরা আমাদের দেখে অনেক খুশি হয়েছে। ওরা ধ্রুবকে খেলনা,প্যান্ট, শার্ট এবং আমাকে অনেক কাপড়চোপড় দিয়েছে। দাদুদের নিয়ে আমরা ব্লু মাউন্টেন অনেক মজা করেছি। তা ছাড়া প্রদীপ নতুন মানুষ, দেখে খুব খুশি হয়েছে। আমরা দুদিন ঘোরাঘুরি করে অটোয়া এসেছি ; তবে আমার শাশুড়ি আমার ওপর অনেক রাগ করেছে এবং বলে, সুমিত এত অসুস্থ, তুমি টরন্টো বেড়াতে গিয়েছ। আমাকে অনেক খারাপ বলেছে আমি কেন প্রদীপকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করি।

আভা বলে, আরতির কথা তুমি শুনবে না। সুমিত কী কিছু বলেছে?

না, ও কিছুই বলেনি; তা ছাড়া সে অনেক অসুস্থ।

তুমি কী সারা দিন রোগীর কাছে বসে থাকবে?

মা, এদের কথামতো সারা দিন সুমিতের কাছে বসে থাকতে হবে এবং তার মা-বাবার বকুনি শুনতে হবে; আর চোখের পানি ফেলতে হবে। আমি এখানে বসে থাকলে আমার কাজ কে করবে এবং ধ্রুবকে কে দেখবে?

আরতি আর কমল আমাকে দেখলেই বলে, আমি ওর ছেলেকে অসুস্থ করেছি। আমার ওপর দোষ চাপাতে পারলেই খুশি। শুচিতা, ওদের খুশি হতে দাও।

মা, তোমরা এখন কোথায় আছ?

আমরা এখন দিল্লি প্রদীপদের বাবা-মায়ের বাসায় আছি, এখানে এক সপ্তাহ থেকে আমরা বোম্বে তোমার এক আংকেলের বাসায় যাব এবং কয়েক দিন থেকে কলকাতা ফিরে যাব। দিল্লিতে কী কী দেখলে?

এখানে মুঘল আমলের অনেক স্মৃতি ও আগ্রার তাজমহল দেখেছি। এত এত স্মৃতি, দেখে শেষ করা যায় না।

তুমি কী প্রদীপের বাবার সঙ্গে কথা বলবে?

দাও। হ্যালো শুচিতা, তুমি কেমন আছ?

ভালো। আংকেল, আপনারা কেমন আছেন?

আমরা ভালো আছি, প্রদীপ কেমন আছে?

ভালো আছে। আমরা এই সপ্তাহে টরন্টো ও ব্লু মাউন্টেন বেড়াতে গিয়েছিলাম এবং অনেক উপভোগ করেছি। আমরা তোমাকে সেই ছোট বয়সে দেখেছি। অনেক দিন তুমি ইন্ডিয়া আসোনি। তুমি একবার তোমার ছেলে ধ্রুবকে নিয়ে এসে দেখা করে যাবে। ঠিক আছে আংকেল; আমার জন্য আশীর্বাদ করবে। তোমার আন্টির সঙ্গে কথা বলবে কী?

দাও।

হায় শুচিতা! তোমাকে সেই ছোট বয়সে দেখেছি, আর দেখিনি।

প্রদীপ কেমন আছে?

ভালো আছে। তুমি ধ্রুবকে নিয়ে বেড়াতে আসবে। ঠিক আছে ভালো থেকো।

শুচিতা টেলিফোন রেখে দিয়ে ধ্রুবকে বলে, তুমি টেবিলে এসে খাওয়া শেষ করে তোমার ড্রয়িং নিয়ে বসো।

মাম্মি, আমি এখন ড্রয়িং করব না। আমি একটু টেলিভিশন দেখব, আচ্ছা খেয়ে টেলিভিশন দেখে ঘুমাতে যাবে। মাম্মি, আংকেল কি আজ আসবে না?

কেন?

না, আংকেল আসলে টিম হর্টন থেকে একটা কিছু আনতে পারত আমার জন্য। তুমি কি সব সময় আংকেলের খাবারের আশা করে বসে থাকো?

ধ্রুব কিছু না বলে হাসি দিয়ে রয়েছে। শুচিতা জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি আমার লক্ষ্মী সোনা।

প্রিতম ও আভা দিল্লি এবং বোম্বে ঘুরে কলকাতা গিয়ে কয়েক দিন রেস্ট নিয়ে বাংলাদেশে ফরিদপুর ওদের আদি বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রিতম বলে, বাংলাদেশে ফরিদপুর একটু না গেলে ওখানকার লোকজন অসন্তুষ্ট হবে।

ছুটির মাত্র আর দুই সপ্তাহ আছে। প্রদীপ বলে, চলো কাল বাংলাদেশের ভিসার জন্য গিয়ে দাঁড়াই; যদি ভিসা পেয়ে যাই, শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে বেনাপোল বর্ডার গিয়ে যশোর হয়ে ফরিদপুর তিন-চার দিন থেকে চলে আসি। আর কোনো দিন যেতে পারব কি না, বলতে পারি না।

ওরা সকালে বাংলাদেশ দূতাবাস, কলকাতা গিয়ে ভিসার জন্য লাইনে দাঁড়ায়। ভিসা নিয়ে বের হতে দিনের তিনটা বাজে।

পরদিনই সকালে নাশতা করে প্রিতম ও আভা শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে পেট্রাপোল স্টেশনে নেমে বেবিট্যাক্সি করে বেনাপোল বর্ডার ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশ চেকপোস্ট শেষ করে বাসে যশোর শহরে চলে যায় এবং ওখানে রেস্ট ও খাওয়াদাওয়া সেরে পুনরায় বাস ও ট্যাক্সি করে ফরিদপুর নিজেদের আদি ভিটাবাড়ি গিয়ে উঠলে সবাই এসে প্রিতম ও আভাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরে। ওরা এ বাড়ি-সে বাড়ি ঘোরাঘুরি করে প্রিতমের পুরোনো স্মৃতি, তার দাদা ও দাদির সমাধির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। গাছ থেকে সদ্য প্রস্ফুটিত জবা ফুল সমাধিতে দিয়ে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে পুরোনো দিনের পূজার ঘর সেরে পুকুরে শানবাঁধানো ঘাটে বসে পুরোনো স্মৃতি স্মরণ করে। প্রিতম বলে, এই পুকুর থেকেই আমাদের পুরোনো লোকজন সে যুগে স্নান সেরে পানি নিয়ে রান্না করত এবং একদিকে পুরুষ এবং অপর দিকে মেয়েরা পুকুরে আসত, কাপড় ধোয়া, স্নান সেরে রান্না ও খাবার পানি নিয়ে মহিলারা ঘরে যেত। পুকুরে মহিলাদের আলাদা ঘাটে কোনো পুরুষ যেত না। পুরুষদের দেখলে মহিলারা মাথার কাপড় টেনে নিজেকে আড়াল করত, সেসব স্মৃতি আজও মনে জাগে।

প্রিতম ও আভা একদিন রেস্ট নেওয়ার পর সারা গ্রাম বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছে। ওরা নিজেদের আত্মীয়স্বজন খুঁজে খুঁজে বের করে দেখা করে। তাদের পরিচিত অনেকেই পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। তাদের স্মৃতি ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলাপ করে খোঁজখবর নেয়।

সবাই বলে তোমরা আরও কয়েক দিন থাকো এবং আমাদের সঙ্গে একটু বসে কানাডার জীবন কীভাবে কাটছে জানাও। প্রিতম বলে, আমরা অবসর জীবনে দুজনে একমাত্র ধ্রুবকে নিয়ে আনন্দ করি।

ওরা গাড়ি ঠিক করে ঢাকা শহর ঘোরাতে নিয়ে যায়। ঢাকা ওয়ারী প্রিতমের দাদা একটা বাড়ি করেছিল এবং সে বাড়ি দেখার জন্য গেলে ওখানে তাদের আত্মীয়রা বলে, তোমরা এখানে কয়েক দিন থেকে যাও। আভা বলে, আমাদের এক সপ্তাহ মাত্র আছে। এর মধ্যে কানাডা চলে যেতে হবে। আভার লোকজনের অনেকেই বাংলাদেশ থেকে কলকাতা চলে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছে। তারা তিন দিনের জন্য গেলেও লোকজনের অনুরোধে দুদিন বেশি থেকে ঢাকা থেকে বাস নিয়ে কলকাতা চলে আসে।

কলকাতা এসে ৪-৫ দিন থেকে লাগেজ গুছিয়ে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে লন্ডন এসে ৮ ঘণ্টা ট্রানজিট নিয়ে অটোয়া এসে নিজের বাসায় ওঠে। প্রদীপ, শুচিতা ও ধ্রুব এয়ারপোর্টে গিয়ে ওদের পেয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, তোমাদের অনেক দিন মিস করছি।

পর্ব: ১১

প্রিতম ও আভা লম্বা জার্নি করে অটোয়া এয়ারপোর্ট এসে ইমিগ্রেশন শেষ করে কাস্টম ক্লিয়ার করতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখে আভার সব লাগেজ এসেছে, কিন্তু ওর নিজের লাগেজ আসেনি। সে অনেক সময় নিয়ে প্রতিটি লাগেজে চেক করে শেষ পর্য্যন্ত লাগেজ মিসিং রিপোর্ট করে। কাস্টম জানায় যে ওর লাগেজ হয়তো লন্ডন হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে ভুলবশত পাঠায়নি। পরবর্তী প্লেনে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। বাইরে এসে শুচিতা, ধ্রুব ও প্রদীপকে পেয়ে ওরা লাগেজের কথা ভুলে যায়। ধ্রুব ওদের জড়িয়ে ধরে বলে, আমি তোমাদের অনেক মিস করেছি। ওরা বলে, আমরাও তোমাকে অনেক মিস করেছি। ওরা লম্বা জার্নির পর ক্লান্ত অবস্থায় বাসায় গিয়ে বলে, তোমরা কেমন আছ বা ছিলে?

প্রদীপ বলে, ভালো, দেশে আমার মা-বাবা এবং আত্মীয়স্বজন কেমন দেখলে?

প্রিতম বলে, সবাই ভালো আছে এবং তোমার কথা সবাই জিজ্ঞেস করছে। আমরা বলছি, তুমি পড়াশোনা করে কাজে যোগদান করেছ। তোমার মা-বাবা শুনে খুশি হয়েছেন। তোমাকে কিছু মিষ্টি এবং গিফট পাঠিয়েছেন, মিষ্টি আমরা হাতে করে এনেছি এবং বাকি কাপড় ও এটা-সেটা লাগেজ এলে পাবে। রাতে এয়ারপোর্ট কাস্টম থেকে কল দিয়ে বলে, তোমার লাগেজ এসেছে, আমরা পাঠিয়ে দেব। পরদিন কাস্টম লোক বাসায় এসে লাগেজ বুঝিয়ে দিয়ে যায়। প্রদীপ এসে তার মা-বাবার দেওয়া শার্ট ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে যায়।

ধ্রুবকে আজ আর ডে কেয়ারে পাঠাতে হয়নি। সে গত দুই মাস ডে কেয়ারে অনেক বন্ধু বানিয়েছে। এখন বাসায় থাকতে ভালো লাগে না; বলে, আমি ডে কেয়ারে যাব। শুচিতা বলে, ঠিক আছে তোমাকে ডে কেয়ারে দিলে অন্যদের সঙ্গে কিছু শিখতে পারবে, তাই সকালে প্রিতম এবং আভা নিয়ে দিয়ে কিছু সময় দেখে বাসায় ফিরে এসেছে। ওদের জার্নি অসুস্থতা এখনো কাটেনি, শুচিতা অফিস থেকে গিয়ে ধ্রুবকে নিয়ে বাসায় এসে বলে, মা, তোমরা কি সুমিতকে দেখতে যাবে?

আভা বলে, আমরা দেশ থেকে সুমিত ও ওর মা-বাবা, ভাইবোনদের জন্য কিছু জিনিসপত্র এনেছি; এখনো লাগেজ খোলা হয়নি। আজ না গিয়ে কাল সবাই মিলে গিয়ে দেখে টুকিটাকি জিনিসগুলো দিয়ে আসব।

শুচিতা হাসপাতালে সুমিতকে টেলিফোন করে বলে, তুমি কেমন আছ?

সুমিত বলে, আগের মতোই, আমি আজ আসব না। মা-বাবা দেশ থেকে ঘুরে এসেছে এবং ওরা জার্নি সিক, আজ রেস্টে আছে এবং কাল সবাই মিলে তোমাকে দেখতে আসব। সুমিত কিছু না বলে টেলিফোন রেখে দিয়ে তার মা আরতিকে বলে, শুচিতা আজ আসবে না, কাল তার মা-বাবাকে নিয়ে আসবে বলে জানিয়েছে। আরতি রেগে গিয়ে বলে, ওরা আসলে বা না আসলে কী?

কমল বলে, ওদের সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক আছে?

আরতি বলে, শুচিতা ৫-১০ মিনিটের জন্য এসে উপস্থিতি দিয়ে যায় যাতে বলতে পারে যে সে প্রতিদিন আসে। আমাদের এ ধরনের উপস্থিতি দেওয়ার দরকার নেই। সে আসলেই কি তোমার রোগ ভালো হয়ে যাবে?

সুমিত কিছু না বলে চুপটি মেরে থাকে।

কিছুক্ষণের মধ্যে সুনীল ও অধরা রেস্টুরেন্ট থেকে কাজ শেষ করে কিছু খাবার নিয়ে হাসপাতালে আসে এবং দেখে কমল ও আরতি কী নিয়ে জোরে জোরে কথা-কাটাকাটি করতেছে। ওদের দেখে সবাই চুপটি মেরে যায় এবং বলে, তোমরা কেমন আছ?

অধরা বলে, আমরা ভালো। সুমিতের অবস্থার কি কিছু পরিবর্তন হয়েছে?

আরতি বলে, না, কোনো পরিবর্তন দেখছি না।

সুনীল কমলকে বলে, দাদা, জিজ্ঞেস করতে ভুলে যাই, তোমাদের ইমিগ্রেশন কেস কি মীমাংসা হয়েছে?

না। কোথায়?

মীমাংসা তো হয়নি; বরং জটিলতা দেখা দিয়েছে।

কমল বলে, আমাদের ইমিগ্রেশন কেস এই পর্যন্ত দুবার প্রত্যাখ্যান হয়েছে। আমাদের বলেছে এ দেশ ছেড়ে নিজের দেশে চলে যেতে। আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি, কিন্তু টেকেনি। ইমিগ্রেশন বলেছে, যদি ইচ্ছা করি, আপিল করে দেখতে পারি। তাই করেছি, কিন্তু তাও টেকেনি। এখন আর আমাদের সামনে কোনো পথ নেই ; মানবতার খাতিরে দরখাস্ত করেছি।

সুনীল বলে, কাকে উকিল ধরেছ? হয়তো উকিল পরিবর্তন করতে হবে। কমল বলে, আমাদের দেশীয় এক উকিল নিয়েছি। লোকজন বলেছিল কোনো অসুবিধা হবে না, ওর অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং ভরসা দিয়েছিল। কিন্তু এখন দেখি সবই গুড়ে বালি। সুনীল বলে, আমার জনমতে ইমিগ্রেশনসংক্রান্ত কোনো ভালো উকিল নেই; তবে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি যদি কোনো খবর পাই জানাব। কিছু সময় সুমিতকে দেখে বলে, ঠিক আছে তোমরা থাকো, আবার আসব।

হাসপাতাল থেকে বের হতেই গেটে সুনীলের পূর্বপরিচিত অনিতার সঙ্গে দেখা। অনিতা কিছুদিন তার সঙ্গে এক কোম্পানিতে কাজ করত। সুনীল বলে, অনিতা, তুমি হাসপাতালে!

অনিতা বলে, তার স্বামী শর্মাকে নিয়ে এসেছে। শর্মা রোড অ্যাকসিডেন্ট করেছে। সুশীল জানতে চায় ওর অবস্থা কী?

অনিতা বলে, গাড়ি ভেঙে গেছে, ইমার্জেন্সিতে ওর ইনজুরি ডাক্তার চেক করছে। দুর্ঘটনায় কার ত্রুটি ছিল?

অনিতা বলে, এক মহিলা গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পেছন থেকে আমাদের গাড়িতে ধাক্কা দিয়েছে এবং আমরা অন্য গাড়ি ধাক্কা দিয়েছি। তিনটা গাড়ি নষ্ট হয়েছে এবং ৪-৫ জন আহত অবস্থায় হাসপাতালে পাঠিয়েছে। গাড়িতে আর কে ছিল?

আমি এবং আমার ছোট্ট ছেলে ছিল; তবে শর্মা ব্যতীত আমাদের বেশি ক্ষতি হয়নি। চলো দেখে আসি। সে বলে, শর্মা মাথায় আঘাত নিয়ে ছটফট করছে।

সুনীল ও অধরা শর্মাকে ইমার্জেন্সিতে দেখতে পায়নি। ওকে এক্স-রে করানোর জন্য নিয়ে গিয়েছে। অনিতা বলে, ওকে এক্স-রে করিয়ে ফিরিয়ে আনতে অনেক সময় লাগতে পারে। তোমরা অপেক্ষা না করে চলে যাও। ঠিক আছে আমরা পরে খবর নেব এবং তোমাদের জন্য আশীর্বাদ করি। সুশীল ও অধরা সারা দিনের কাজের পর বাসায় এসে পরে রাতে কল দিয়ে জানে যে শর্মাকে হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে; ডাক্তার দুই দিন পর রিপোর্ট দেবে। অধরা বলে, তোমার স্বামী দ্রুত ভালো হয়ে উঠুক এই আশা করি; আমরা পরে এসে দেখে যাব। পরদিন সুশীল ও অধরা কাজ থেকে ফেরার পথে পুনরায় হাসপাতালে গিয়ে শর্মাকে দেখে। শর্মার মাথা ও মুখ ফুলে গেছে এবং শরীরে ব্যথার জন্য চিৎকার করছে, নড়াচড়া করতে পারে না। ডাক্তার বলে ঠিক হতে সময় লাগবে। অনিতা বলে, দাদা, আমি পরে তোমার সাহায্য দরকার পড়লে স্মরণ করব। অধরা ও সুশীল বলে, তোমার যেকোনো দরকার হলে আমাদের ডাকবে এবং আমরা চেষ্টা করব।

শুচিতা পরদিন তার বাবা প্রিতম ও আভাকে নিয়ে হাসপাতালে এসে সুমিতকে না পেয়ে ডিপার্টমেন্টে খোঁজ নিয়ে জানে যে ওকে আজ সকালে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে। শুচিতা হাসপাতাল থেকে সুমিতের সেল নম্বরে কল দিয়ে বলে, আমি মা-বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে তোমাকে দেখতে এসে শুনি তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে।

সুমিত বলে, হ্যাঁ।

শুচিতা বলে, মা-বাবা হাসপাতালে এসেছিল তোমাকে দেখার জন্য। সুমিত বলে, আমি চাই না তোমার মা-বাবাকে নিয়ে এখানে আমার মা-বাবার সঙ্গে কোনো বাদানুবাদ হোক। তুমি বরং বাসায় চলে যাও। শুচিতা বলে, তাহলে তোমার সঙ্গে আমার কীভাবে দেখা হবে?

সুমিত বলে, দেখি আমি যদি ভালো হয়ে উঠি তবে কোথাও দেখা হবে। আমি এখনো নার্সের কেয়ারে আছি, সপ্তাহে দুইবার নার্স এসে আমাকে গোসল, হাঁটানো থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন্য শারীরিক ব্যায়াম করিয়ে যায়। আমি বাইরে যেতে পারি না এবং বাসার সবাই আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে।

আরতি সুমিতকে বলে, কে তোমাকে টেলিফোন করেছে?

মা, শুচিতা হাসপাতালে ওর মা-বাবাকে নিয়ে আমাকে দেখতে গিয়েছিল, না পেয়ে হাসপাতাল থেকে টেলিফোন করেছে। আরতি কিছু না বলে রান্নাঘরে গিয়ে রাতের খাবার তৈরি করতে শুরু করে এবং কিছু না বললেও মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে সে শুচিতার টেলিফোন পছন্দ করেনি।

শুচিতা সুশীলের কাছে শুনেছে শর্মা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। শুচিতা বলে, মা, অনিতার হাসব্যান্ড অ্যাকসিডেন্ট করে হাসপাতালে আছ। চলো ওকে একটু দেখে যাই। প্রিতম ও আভা বলে, তুমি ওদের কীভাবে চেন?

মা, সুশীল আংকেলের স্ত্রী অধরা আমাকে বলেছে। ওরা ওর রুমে গিয়ে কিছু সময় রোগী দেখে কথা বলতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে অনিতা বলে, সুমিত হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে গেছে। শুচিতা বলে, আমরা শুনি নাই, দেখতে এসে জেনেছি যে সে বাসায় গিয়েছে। অনিতা বলে, ও দুর্বল এবং হাঁটাচলা করতে পারে না। হ্যাঁ, ঠিকই বলছ, আমরা বাসায় গিয়ে দেখে আসব। ওরা শর্মাকে দেখে বাসায় চলে যায়।

প্রিতম ও আভা বলে, আমরা ইন্ডিয়া থেকে কিছু জিনিসপত্র ওদের জন্য এনেছি। চলো গিয়ে দেখে আসি। আজ না, মা, আমরা উইকেন্ডে দেখি যেতে পারি কি না।

রাতে প্রদীপ এসে বাসার কলিং বেল টিপতেই ধ্রুব দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে চিৎকার করে বলে, আংকেল এসেছে। আভা বলে, ধ্রুব প্রদীপের খুবই ভক্ত। দেখো কীভাবে দৌড়ে গিয়ে চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরে। শুচিতা বলে, ওসব কিছু না। ও ধ্রুবর পছন্দের পিৎজা নিয়ে আসে, সে জন্য দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে, তাই না ধ্রুব?

ধ্রুব হাসে এবং পিৎজা নিয়ে কাউকে না বলে খাওয়া শুরু করেছে। দেখো মা, কাউকে কিছু না বলে সবার আগে খাওয়া শুরু করেছে। প্রদীপ বলে, থাক ও ছোট্ট ছেলে, ও খাইলেই আমরা খুশি। তোমরা কি সুমিতকে দেখতে গিয়েছ?

হ্যাঁ, গিয়েছি; তবে ওকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দিয়েছে। বাসায় গিয়ে দেশ থেকে যা যা এনেছ ওদের দিয়ে এবং ওকে দেখে এসো। আভা বলে, সুমিত যাইতে নিষেধ করতেছে, ওরা পছন্দ করে না অযথা রাগারাগি করবে। সুমিত বলছে, শুচিতা, তুমি বরং পরে আমার সঙ্গে দেখা করবে।

প্রদীপ বলে, তোমরা চলো আমিসহ সুমিতকে তাদের বাসায় দেখতে যাই। শুচিতা বলে, এটা মন্দ না, দেখি ওরা কে কী বলে এবং ওদের কী সমস্যা যে জন্য আমাদের দেখতে পারে না।

পরের উইকেন্ডে বাসা থেকে সুমিত ও ওদের পরিবারের জন্য কিছু খাবার তৈরি করে সবাই গিয়ে বাসায় উপস্থিত। প্রিতম বলে, আমরা দুই মাসের অধিক ইন্ডিয়া ছিলাম এবং সুমিতের বাবার বাড়িতেও গিয়ে তাদের লোকজনের সঙ্গে দেখা করেছি। ওর চাচা ও বাড়ির অন্যরা আমাদের সাদরে আপ্যায়ন করেছে এবং ঘুরে ঘুরে আমরা তোমাদের বিল্ডিং ও জমিজমার খোঁজখবর নিয়েছি। আমরা বলেছি, সুমিত সুস্থ হলে কমল এবং আরতি বাড়ি চলে আসবে। ওরা বলছে, তোমরা দেশে চলে গেলে ওরা তোমাদের দেখাশোনা করবে। এ কথা শোনার পর কমল ও আরতি কিছুটা নরম মেজাজে কথা বলা শুরু করছে। কমল বলে, আমরা মানুষের কাছে শুনি ওরা আমাদের সবকিছু দখল করে নিয়েছে। প্রিতম বলে, আমার তা মনে হয়নি। মানুষ না থাকলে যা হয়; তবে তোমার বাবার সম্পত্তি তোমার ভাই পুরা দখল কেন এবং কীভাবে করবে?

কমল বলে, আজকাল সবই সম্ভব ‘জোর যার মুল্লুক তার।’ আমরা কানাডা চলে এসেছি, ওরা মনে করে আমরা আর কোনো দিনও দেশে ফেরত যাব না। সে জন্য বাড়ি ও জমিজমার কাগজপত্র নিয়ে ওরা ভেতরে-ভেতরে কী করতেছে আমরা এখানে থেকে কীভাবে বলব?

প্রিতম বলে, এটা সবার ব্যাপারেই হয়। আমি আজ বহুদিন এ দেশে, আমার দাদার বাড়ি বাংলাদেশে এবং পরে কলকাতা চাকরিস্থলে বাড়ি করেছেন। এখন আমাদের বাংলাদেশ বা ভারতে কিছুই নেই, লোকজন সবকিছু দখল করে নিয়েছে। শুধু গিয়ে মিসকিনের মতো এখানে-সেখানে থাকি। আপন রক্তের ভাই ভাইকে চিনে না, শত্রু ভাবে, জমিজমার ভাগ চাইলে হাঙ্গামা করে এবং মনে করে বাপ-দাদার সম্পত্তির আমি কোনো অংশীদার না।

সুমিত ওয়াকার ঠেলে ঠেলে করিডর দিয়ে হাঁটা হাঁটি করছে। ওকে দুর্বল বলে মনে হয় এবং প্রিতম ও আভা সান্ত্বনা দিয়ে বলে, রোগ দিয়েছে ভগবান এবং আরোগ্য করবেন ভগবান।

চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে ভগবানকে স্মরণ করো, ভগবান তোমাকে মুক্তি দেবে। আরতি চা-নাশতা তৈরি করে ওদের দিয়েছে এবং কাছে বসেছে। ওকে দেখে মনে হয় আজ কিছুটা স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে। সবাই চা খাওয়ার পর আভা ওদের জন্য ইন্ডিয়া থেকে নিয়ে আসা মিষ্টি ও কাপড় হাতে উঠিয়ে দিয়ে বলে, এগুলো তোমাদের জন্য। আরতি ও ছেলেমেয়েরা বলে, এসবের কোনো দরকার ছিল না। প্রদীপ সুমিতকে বলে, কোনো সাহায্য দরকার লাগলে আমাকে টেলিফোন করে বলবে বা কোথাও যেতে চাইলে জানালে আমি ফ্রি থাকলে নিয়ে যাব।

পর্ব: ১২

এবার ললিত আশ্রম থেকে এক মাসেরও অধিক কোথায় চলে গিয়েছে কেউ বলতে পারছে না। নিমি মন্ট্রিয়েলে খোঁজ নিয়েছে, কোথাও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। নিমি তার দাদা প্রিয়ব্রতকে বলেছে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য যদি অটোয়া পুরোনো শেল্টারে এসে থাকে। প্রিয়ব্রত ললিতের পুরোনো ডাক্তার, শেল্টার এবং আত্মীয়স্বজনকে বলেছে খোঁজ নেওয়ার জন্য। কিন্তু কেউ তাকে খুঁজে বের করতে পারছে না। নিমি কেঁদে তার দাদা প্রিয়ব্রতকে বলে, আমি বাবাকে নিজের বাসায় নিয়ে এসে অতিযত্নের সঙ্গে রেখেছি যেন বাবার কোনো অসুবিধা না হয়। প্রতিদিন সকালে বাবার নাশতা এবং দুপুরের খাবার তৈরি করে রেখে কাজে যাই। তা ছাড়া বাবা শেল্টারে থাকলে আমাদের দেশীয় লোকদের সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখার জন্য বলেছি। মাঝেমধ্যে গিয়ে বাবার বেড পাল্টিয়ে কাপড় লন্ড্রি করে দিয়ে আসি। এত যত্নের মধ্যেও বাবা বাইরে চলে গেল, আজ এক মাস কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

মানস অটোয়া কাজ করে এবং প্রতি উইকেন্ডে মন্ট্রিয়েল গিয়ে নিমির সঙ্গ দিয়ে প্রতি সোমবারে ভোরে কাজে চলে আসে। ইন্ডিয়া থেকে মা-বাবা চিঠির পর চিঠি দিয়ে বলে, তুমি নিমিকে নিয়ে আমাদের দেখিয়ে যাও। কিন্তু আজ এ সমস্যা, কাল সে সমস্যা এর জন্য দেশে যাওয়া বিলম্বিত হচ্ছে। মানস কখনো তার শ্বশুর ললিতের ব্যাপার নিয়ে নিমিকে বা তার দাদা প্রিয়ব্রতকে কিছুই বলছে না। সে জানে ললিত মানসিক অসুস্থতার কারণে মাঝেমধ্যে বের হয়ে যায়। সে নিমিকে সব সময় সান্ত্বনা দিয়ে বলে, বাবা একদিন নিশ্চই ফিরে আসবে, চিন্তা করে কোনো কিছু হবে না। পুলিশ মন্ট্রিয়েল ও অটোয়া ললিতকে না পেয়ে বলে, তোমরা নিরুৎসাহ না হয়ে ধৈর্য ধারণ করো, যদি কোনো দুর্ঘটনা না হয় একদিন আমরা ওকে খুঁজে বের করব। (চলবে)