টরেটক্কা টরন্টো – চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -২৫

                                                                             কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মং ওয়ানট্রো এবং দুই মাইকেলের মুক্তি নিয়ে চীন এবং কানাডার কূটনৈতিকদের মধ্যে দর কষাকষি যখন চরমে ঠিক সেই সময় চীনের উহান শহরে রহস্যজনক এক নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ‘সেন্ট্রাল হসপিটাল অব উহান’-এ কর্মরত চৌত্রিশ বছর বয়স্ক তরুণ অপথালমোলজিস্ট ডঃ লি ওয়েনলিয়াং হসপিটালের আভ্যন্তরীণ ডায়াগনোসিস রিপোর্টে যখন দেখতে পান যে বেশ কিছু নিউমোনিয়া রোগীকে সন্দেহ করা হচ্ছে যে তারা ‘সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরাটরি সিনড্রোম’ বা ‘সার্স’ দ্বারা আক্রান্ত তখন তিনি সেই তথ্য তার ডাক্তার বন্ধুদের সাথে ‘উই চ্যাট’-এর মাধ্যমে শেয়ার করেন। দিনটি ছিল ৩০শে ডিসেম্বর, ২০১৯। মুহুর্তেই চীনের সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকটা গুজব আকারে ছড়িয়ে পড়ে যে সার্স আবার ফিরে এসেছে। এই গুজবের সোর্স হিসেবে চিহ্নিত হন ডঃ লি। ৩রা জানুয়ারী পুলিশ ডঃ লি-এর বাড়ীতে এসে তার কাছ থেকে এই মর্মে একটি মুচলেকা আদায় করে নেয় যে তিনি যেটা প্রচার করেছেন সেটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কিন্তু ততদিনে ব্যাপারটা আর গুজবের পর্যায়ে নেই, উহান শহরে এই রহস্যজনক ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই রহস্যজনক ভাইরাসকে করোনা ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যা কিনা কোভিড-১৯ নামে অধিক পরিচিত লাভ করে। ভাগ্যের এক নির্মম পরিহাসে জানুয়ারীর মাঝামাঝি সময়ে ডঃ লি তার এক গ্লুকোমা রোগীর মাধ্যমে নিজেই এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন এবং তিন সপ্তাহ পর ২০২০ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি তিনি এই রোগে মৃত্যু বরণ করেন। ডঃ লি-এর মৃত্যুর পর চীনা কর্তৃপক্ষ অবশ্য এই মর্মে দুঃখ প্রকাশ করে যে তিনি বিনা কারণে পুলিশি হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। পরবর্তীতে করোনা রোগের আভির্ভাব সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করে দেয়ার জন্য তাকে ‘ন্যাশনাল হিরো’-এর মর্যদা দেয়া হয়। করোনা ভাইরাসের দ্রুত বিস্তারকে রোধ করার জন্য চীনা সরকার এক সময় উহান শহরে ‘লক-ডাউন’ আইন চালু করতে বাধ্য হয়। তারপরও উহান ছাড়িয়ে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে চীনের অন্যান্য শহরে এবং সেই সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ফলে ২০২০ সালের ১১ই মার্চ তারিখে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএইচও) করোনা বা কোভিড-১৯ ভাইরাসের এই ভয়াবহ বিস্তারকে প্যানডেমিক বা অতিমারী হিসেবে ঘোষণা দেয়।

রিড্যু হলে গভর্নর জেনারেল জুলি পেজেট-এর কাছ থেকে ডঃ ছিও শিয়াংকোয়ো-এর গভর্নর জেনারেলের ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ, ২০১৮ সাল (ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

কানাডাতে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায় ২০২০ সালের ২৫শে জানুয়ারীতে। চীনের উহান থেকে টরন্টোতে ফেরত আসার পর টেস্টে আক্রান্ত ব্যক্তিটির রক্তে করোনা ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যায়। আর কম্যুনিটির ভেতর সংক্রামকের কারণে আক্রান্ত প্রথম কেসটি ধরা পড়ে ৫ই মার্চ ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে। এর পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে ‘জরুরী অবস্থা’-এর ঘোষণা আসে। যেহেতু করোনা একটি বায়ু-বাহিত সংক্রামক ব্যাধি তাই সরকার থেকে নানারকম সাবধানতা অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়া শুরু হয়। সেই নির্দেশনাগুলির ভেতর দুইটি ছিল অবশ্য-পালনীয় নির্দেশনা। এক, দুই মিটার দূরত্ব বজায় রেখে পাবলিক প্লেসে চলাচল করা। দুই, নিয়মিত সাবান পানি দিয়ে হাত ধৌত করা অর্থাৎ বেসিক হাইজিন পালন করা। আয়তনের দিক থেকে কানাডা হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। প্রায় দশ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের দেশ কানাডা যেখানে রয়েছে এগারোটি প্রভিন্স এবং তিনটি টেরিটরি। কানাডার মোট জনসংখ্যা আটত্রিশ মিলিয়ন কিন্তু সেই জনসংখ্যার শতকরা পচাশি ভাগের বেশি বাস করে মাত্র চারটি প্রভিন্সে। সেই প্রভিন্সগুলি হচ্ছে অন্টারিও, কুবেক, ব্রিটিশ কলম্বিয়া এবং আলবার্টা। শতকরা হিসেবে অন্টারিও-তে বাস করে মোট জনসংখ্যার শতকরা আটত্রিশ দশমিক ছয় ভাগ। কুবেক-এ শতকরা বাইশ দশমিক ছয়, ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে শতকরা তেরো দশমিক পাঁচ এবং আলবার্টা-তে শতকরা এগারো দশমিক ছয়। এখানে উল্লেখ্য যে কানাডার মোট জনসংখ্যার শতকরা পাঁচ ভাগ হচ্ছে ইনডেজেনাস, যাদের অধিকাংশই বাস করে প্রভিন্সগুলোর মাঝে অবস্থিত রিজার্ভগুলিতে এবং তিনটি টেরিটরিতে।

কানাডার বিভিন্ন প্রভিন্স এবং টেরিটরির ডেমোগ্রাফিক সিচুয়েশন অনুযায়ী ফেডারেল গভর্মেন্ট করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের কর্মসূচী হাতে নেয়। প্রথমেই নজর দেয়া হয় অবশ্য-পালনীয় নির্দেশনা দুটিকে কিভাবে কার্যকর করা যায়। জনগণের ভেতর সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে চালানো হয় প্রচারণা যাতে করে সবাই এই অবশ্য-পালনীয় নির্দেশনা দুটি মেনে চলে। কিন্তু ইনডেজেনাস অধ্যুষিত টেরিটরি এবং রিজার্ভগুলিতে নিয়মিত সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া অর্থাৎ বেসিক হাইজিন মেনে চলাটা বেশ কষ্টসাধ্য। কারণ সেখানে রয়েছে পানযোগ্য কিংবা পরিস্কার পানির তীব্র সংকট। এই সংকটের কারণে সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে জারী করা আছে ‘বয়েল ওয়াটার অ্যাডভাইসরি’ বা জনগণকে পানি ফুটিয়ে খাওয়ার পরামর্শ। যেখানে পানযোগ্য পানিরই রয়েছে প্রবল সংকট সেখানে স্বাভাবিকভাবেই রয়েছে স্যানিটেশন এবং হাইজিনের চ্যালেঞ্জ। ফলে সেখানে যদি একবার করোনা ভাইরাস ঢুকে পড়ে তবে সহজেই তা কম্যুনিটির ভেতর দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে করোনার বিস্তার প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হচ্ছে এর প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিনের প্রয়োগ। কিন্তু করোনা একটি নতুন ভাইরাস হওয়ার কারণে মানুষের কাছে এর কোন ভ্যাকসিন নেই। মানবজাতিকে এই ভাইরাসের কবল থেকে বাঁচানোর জন্য প্রথম যে জিনিষটি করতে হবে সেটি হচ্ছে এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে হবে। কিন্তু যে কোন নতুন ভ্যাকসিন বা ড্রাগ আবিষ্কার করা একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। যতদিন না পর্যন্ত কোন নিরাপদ এবং কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিস্কার হচ্ছে ততদিন মানুষ সত্যিই অসহায়। তবে যে কোন ক্রাইসিসের উল্টোপিঠে থাকে অপরচুনিটি। করোনার এই ক্রান্তি কালে প্রধান ‘অপরচুনিটি’-টি ছিল বাণিজ্যিক। অর্থাৎ প্রথমে যে ড্রাগ কোম্পানী কার্যকরী ভ্যাকসিন বাজারজাত করতে পারবে তারা আর্থিকভাবে বিপুল লাভের মুখ দেখবে। ফলে পৃথিবীর সব বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা এবং ড্রাগ ডিসকভারি কোম্পানীগুলি উঠে পড়ে লেগে যায় করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিনের আবিষ্কারে। নতুন নতুন ভ্যাকসিনের খবর আসা শুরু হলেও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সেগুলি তেমন সফল হতে পারেনি। উল্লেখ্য যে, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের এই প্রতিযোগীতা কালে ‘গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড’ নামক বাংলাদেশি একটি কোম্পানীও ঘোষণা দিয়েছিল যে তারা করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজে হাত দিয়েছে। পরে অবশ্য আরেকটি ঘোষণার মাধ্যমে তারা এই কাজে তাদের ইস্তফা দেয়ার কথা জানিয়ে দেয়।

করোনা বা কোভিড-১৯-এর দ্রুত সংক্রমণকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে চীন সরকার রেডক্রস-এর মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছ থেকে সাহায্যের আহ্বান জানায়। এই সাহয্যের আবেদন মেঘের কিনারে যেমন একটা ‘সিলভার লাইনিং’ থাকে ঠিক তেমনি করে একটি সুযোগ হিসেবে দেখা দেয় কানাডার কাছে। কারণ এই সময়টায় মং ওয়ানট্রো এবং দুই মাইকেলের গ্রেফতারের কারণে চীনের সাথে কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্কে চলছিল ভীষণ টানাপোড়েন। চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ককে চাঙ্গা করার এই সুযোগকে লুফে নিয়ে কানাডা সরকার রেডক্রসের মাধ্যমে চীন সরকারকে বিপুল পরিমাণে পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) সরবরাহ করে। কানাডার সময়োপযোগী এই সাহায্য চীন সরকারের নজর এড়ায়নি। তাই ২০২০ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে জার্মানির মিউনিক শহরে অনুষ্ঠিত ‘মিউনিক সিকিউরিটি কনফারেন্স’-এ চাইনিজ ফরেন মিনিস্টার ওয়াং ই যখন কানাডার ফরেন মিনিস্টার ফিলিপ শ্যামপেইনের সাথে মিলিত হন তখন তিনি চীনের জনগণের পক্ষ থেকে কানাডার সরকারকে বিশেষ ধন্যবাদ জানান। কিন্তু চীনের এই প্রশস্তি বেশি দিনের জন্য কার্যকরী হয়নি। কারণ অচিরেই কানাডা জড়িয়ে পড়ে চীনের ‘ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসি’-এর জালে এবং চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কে আবারো লেজেগোবরে করে ফেলে।  

কোভিড সংকটের কারণে সারা বিশ্বে অতি দ্রুত এক নজিরবিহীন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় যার জন্য কোন দেশই প্রস্তুত ছিল না। না কানাডা, না আমেরিকা, না ইউরোপ, না চীন। কারও কাছেই কার্যকরী কোন ভ্যাকসিন নেই। ফলে ভ্যাকসিন সমস্যাটি সবার জন্য সমান প্রযোজ্য হয়ে উঠে। গোটা পৃথিবীতে অনাবিষ্কৃত এই ভ্যাকসিনের রয়েছে বিপুল চাহিদা। চীন ইতিমধ্যেই বেশ কিছু প্রকারের ভ্যাকসিন তৈরি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য পাকিস্তান এবং সৌদি আরবে পাঠানোর ঘোষণা দিয়ে ফেলে। সেই সময় অর্থাৎ ২০২০ সালের মে মাসে চীনের থিয়েনচিন শহরে অবস্থিত ‘ক্যান-সাইনো বায়োলজিকস’ চীনের তৈরি ভ্যাকসিন কানাডাতে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রস্তাব নিয়ে কানাডা সরকারের সাথে যোগাযোগ করে। কানাডা সরকার এই প্রস্তাবকে চীনের সাথে তার প্রায় ভেঙে পড়া কূটনৈতিক সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার আরেকটি সুযোগ হিসেবে মনে করে। ফলে ‘ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল অব কানাডা’ (এনআরসি) খুব উৎসাহ নিয়ে ‘ক্যান-সাইনো বায়োলজিকস’-এর প্রস্তাবে সাড়া দেয় এবং তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। এই চুক্তি অনুসারে ‘ক্যান-সাইনো বায়োলজিকস’ যা কিনা চীনের মিলিটারির একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান, চীনের তৈরি ভ্যাকসিন মে মাসেই কানাডাতে হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য পাঠাবে। কানাডাতে কিভাবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা যেতে পারে সেই লক্ষ্যে এনআরসি হ্যালিফ্যাক্সে অবস্থিত কানাডিয়ান সেন্টার ফর ভ্যাকসিনোলজি-এর ডাইরেক্টর ডঃ স্কট হালপেরিন-কে পরামর্শক হিসেবে নিযুক্ত করে। চুক্তির অংশ হিসেবে যদি  ট্রায়াল সফল হয় তবে মন্ট্রিয়ালের একটি ল্যাবে সেই ভ্যাকসিনের ব্যাপক উৎপন্ন শুরু হবে। অর্থাৎ চীনের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন কানাডাতে ব্যবহার করা হবে। অনেকটা ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’-এর মতন করে এনআরসি মন্ট্রিয়ালের সেই ল্যাবটির উন্নতি সাধনের জন্য বেশ মোটা অংকের টাকা খরচ করে ফেলে। ২০২০ সালের ১৬ই মে তারিখে প্রাইম মিনিস্টার জাস্টিন ট্রুডো কানাডার গণমাধ্যমে চীনের ক্যান-সাইনো-এর সাথে কানাডার ভ্যাকসিন চুক্তির ঘোষণা দেন। কিন্তু ১৯শে মে জানা গেলো যে ক্যান-সাইনো কানাডাতে রফতানির জন্য প্রস্তুত প্রথম লটের ভ্যাকসিনের কাস্টমস-ছাড়পত্র যোগাড় করতে পারেনি। তারা বেইজিংস্থ কানাডার এম্ব্যাসিকে এই মর্মে আশ্বস্ত করে যে ২৭শে মে ভ্যাকসিনের প্রথম লটটি বিমানে করে কানাডার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাবে। কিন্তু সেই বিমান আর কখনই বেইজিং ত্যাগ করেনি। অর্থাৎ চীনের সাথে কানাডার এই ভ্যাকসিন চুক্তিটি মুখ থুবড়ে পড়ে। কেন এমনটা ঘটলো সেই তদন্তে বেরিয়ে এসেছিল যে ২৭শে মে চীনের টেলিকম জায়ান্ট হুয়া ওয়েই-এর চীফ ফিনান্সিয়াল অফিসার মং ওয়ানট্রো ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সুপ্রীম কোর্টে তার গ্রেফতারের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আপীল মামলায় হেরে যান। সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে চীন সরকারের কাস্টমস বিভাগ কানাডাতে রফতানির জন্য অপেক্ষারত ভ্যাকসিনের লটটির ছাড়পত্র আর দেয়নি। ‘কানাডা-চায়না জয়েন্ট কমিটি অন সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি’ নামক কানাডিয়ান সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানে সাত বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মার্গারেট ম্যাকচুয়াইগ-জনসটন অন্তত তাই মনে করেন। তিনি ছাড়াও কানাডিয়ান সেন্টার অব ভ্যাকসিনোলজি-এর ডাইরেক্টর ডঃ স্কট হালপেরিনও মনে করেন যে কাস্টমসের ছাড়পত্র না পাওয়াটা একটি অজুহাত মাত্র কারণ একই ভ্যাকসিন চীন পাকিস্তান এবং রাশিয়াতে পাঠিয়েছে। সঠিকভাবে হোমওয়ার্ক সম্পন্ন না করার  কারণে ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসিতে চীনের কাছে পরাজয় ঘটে কানাডার। পরাজয় এই জন্য যে, চীন নানাভাবে এই ভ্যাকসিন টেকনোলজিতে কানাডা থেকে উপকৃত হলেও বিনিময়ে চীন থেকে কানাকড়ি পরিমাণ উপকার পায়নি কানাডা। বরং চীনের দেয়া মিথ্যা প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করে উল্টো আরও আর্থিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় কানাডা। পিছিয়ে পড়ে ফাইজার কিংবা অন্য কোন ভালো কোম্পানি থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের প্রতিযোগিতায়।

চীন কিভাবে কানাডার কাছ থেকে ফায়দা লুটেছে সেই হিসাব বুঝতে হলে প্রথমেই আমাদেরকে দেখতে হবে কারা এই ‘ক্যান-সাইনো বায়োলজিকস’-এর সাথে জড়িত। চীনের রাজধানী বেইজিং-এর নিকটস্থ শহর থিয়েনচিন-এ অবস্থিত  ‘ক্যান-সাইনো বায়োলজিকস’-এর তিন প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে দুইজনই কানাডার সাথে জড়িত। প্রথম জন, চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ডঃ সুয়েফং ইউ ১৯৮৮ সালে চীনের নানখাই ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রী সম্পন্ন করে ১৯৯১ সালে কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে আসেন। পিএইচডি সম্পন্ন করে ১৯৯৮ সালে তিনি টরন্টো ভিত্তিক ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানি ‘সানোফি পাস্তর’-এ যোগ দেন। চীনের বিখ্যাত ছিংহুয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যাচেলর এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করা অপর কো-ফাউন্ডার ডঃ থাও ট্রু আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন ২০০৩ সালে। এরপর তিনি কার্নেগি-মেলোন ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট-ডক পজিসন নিয়ে কাজ করেন ২০০৬ সালে ‘সানোফি পাস্তর’-এ যোগ দেয়ার আগ পর্যন্ত। ২০০৮ সালে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি ‘থাউজেন্ড ট্যালেন্টস প্ল্যান’ নামক একটি প্রকল্প চালু করে যার উদ্দেশ্য হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চাইনিজ ট্যালেন্টদেরকে লোভনীয় পদ মর্যাদা এবং মোটা অংকের রেমুনারেশন দিয়ে চীনে ফেরত আনা। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২০০৯ সালে ডঃ ইউ এবং ডঃ ট্রু দুজনেই ‘সানোফি পাস্তর’-এর কাজে ইস্তফা দিয়ে ‘ক্যান-সাইনো বায়োলজিকস’-এ কো-ফাউন্ডার হিসেবে যোগ দেন। ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’ এই প্রবাদবাক্যটি যে বিনা কারণে তৈরি হয়নি সেটা প্রমাণ করে দিয়ে কানাডার বিভিন্ন ইন্টিলিজেন্স এজেন্সীর প্রাক্তন সদস্যগণ কানাডার ‘গ্লোবাল নিউজ’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন যে, চীন সরকার পরিচালিত টেকনোলজি এসপিওনাজের সাথে ‘ক্যান-সাইনো বায়োলজিকস’-এর ডঃ ইউ এবং ডঃ ট্রু-এর জড়িত থাকার সম্ভবনা রয়েছে শতভাগ। তাই তাদের সাথে ‘ভ্যাকসিন চুক্তি’ করার আগে এনআরসি-এর উচিৎ ছিল তাদের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্সের ব্যাপারটি কানাডার সিকিউরিটি এজেন্সি-এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা।

‘ক্যান-সাইনো বায়োলজিকস’-এর সাথে অবশ্য এনআরসি এর আগেও জয়েন্ট রিসার্চ প্রজেক্টে কাজ করেছে বিশেষ করে ২০১৮ সালে ‘ইবোলা’-এর এক নতুন কার্যকরী ভ্যাকসিন তৈরির প্রজেক্টে। ২০১৪ সালে ওয়েস্ট আফ্রিকাতে ইবোলার প্রাদুর্ভাবে প্রায় দশ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে। যদিও ইবোলা ভাইরাস আফ্রিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ তবুও চীন এই ভাইরাসের নতুন এক ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। যার ফলশ্রুতিতে ‘ক্যান-সাইনো বায়োলজিকস’ কানাডার এনআরসি-এর সাথে জয়েন্ট রিসার্চ শুরু করে। এই জয়েন্ট রিসার্চের ফলে আবিষ্কৃত ইবোলা ভ্যাকসিনের সফলতায় ২০১৮ সালে এনআরসি-এর প্রেসিডেন্ট ইয়েন স্টুয়ার্ড ‘ক্যান-সাইনো বায়োলজিকস’-এর ভূয়সী প্রসংসা করে বলেন যে এনআরসি তাদেরকে সাহায্য করতে পেরে গর্বিত এবং ধন্য। কিন্তু ‘ক্যান-সাইনো’-এর সাথে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন চুক্তিতে যাওয়ার আগে এনআরসি তথা কানাডা সরকারকে অবশ্যই দুইটি বিষয়কে আমলে নেয়া উচিৎ ছিল। প্রথমটি, ২০১৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল সাইবার পলিসি সেন্টার অব অস্ট্রেলিয়ান স্ট্রাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট তার এক পেপারে উল্লেখ করেছিল যে বিশ্বব্যাপী চীন যে ‘টেকনোলজি এসপিওনাজ’-এর কার্যক্রম চালাচ্ছে সেখানে কানাডা হচ্ছে চীনের তৃতীয় টার্গেট। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের পরেই কানাডার অবস্থান। আর দ্বিতীয়টি ছিল আরো বেশি স্পষ্ট। ২০১৯ সালে ‘টেকনোলজি এসপিওনাজ’-এর অভিযোগে উইনিপেগে অবস্থিত কানাডার সর্বোচ্চ সিকিউরিটি সম্পন্ন লেভেল-ফোর ক্যাটেগরির ল্যাবরেটারি ‘ন্যাশনাল মাইক্রোবায়োলিজি ল্যাব’ বা এনএমএল-এ কর্মরত দুই চীনা ভাইরোলজিস্ট ডঃ ছিও শিয়াংকোয়ো এবং তার কলিগ ও হাজব্যান্ড ডঃ ঠ্রেং খতিং-কে তাদের ল্যাব থেকে বহিষ্কার। এখানে উল্লেখ্য যে, এনএমএল হচ্ছে কানাডার একমাত্র লেভেল-ফোর ক্যাটেগরির ল্যাবরেটরি। কেন কানাডা সরকার চীনের সাথে করোনা ভ্যাকসিন চুক্তির সময় এই স্পর্শকাতর তথ্য দুটিকে আমলে নেয়নি সেই প্রশ্ন কিন্তু কানাডার সকল সচেতন জনগণের। 

কম্যুনিস্ট চীনের সাথে কানাডার ‘একাডেমিক এক্সচেঞ্জ’ শুরুর ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপটি নিয়েছিল চীন। ১৯৭২ সালে চীনা বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান জেন ওয়ং তার এক মাসের ভ্রমণ শেষে যখন বেইজিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ইচ্ছে প্রকাশ করে তখন চীনের তদানীন্তন প্রিমিয়ার ট্রৌ এনলাই সেটাকে অনুমোদন করে। এরপর যখন দুই দেশের মধ্যে একাডেমিক এক্সচেঞ্জ শুরু হয়ে যায় তখন দেখা যায় যে চীনের শিক্ষার্থীরা কানাডার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার জন্য আসছে আর কানাডিয়ান শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে চাইনিজ ভাষা, সংস্কৃতি কিংবা মাওইজম পড়ার জন্য। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু ২০০০ সালের দিকে এসে চীন সরকার কানাডার সাথে ‘একাডেমিক এক্সচেঞ্জ’-এর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ-এর আধুনিকায়ন প্রকল্পকে বেগবান করার দিকে মনোনিবেশ করে। তারা হাতে নেয় ‘পিকিং ফ্লাওয়ারস ইন ফরেন ল্যান্ড টু মেক হানি ইন চায়না’ প্রকল্প। চীন সরকার পিএলএ প্রকৌশলীদেরকে সাধারণ ছাত্রের ছদ্মবেশে কানাডা সহ বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উচ্চ শিক্ষার জন্য যাওয়া শুরু করে। ধারণা করা হয় যে, ‘ন্যাশনাল মাইক্রোবায়োলিজি ল্যাব’ বা এনএমএল-এ কর্মরত ডঃ ছিও এবং ডঃ ঠ্রেন চীন সরকারের এই প্রকল্পে সরাসরি অংশগ্রহণ করে আসছিলেন। ডঃ ছিও ভাইরোলজি নিয়ে তার গবেষণাতে বিশেষ সাফল্য অর্জনের জন্য ২০১৮ সালে কানাডার গভর্নর জেনারেলের ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড পান। কিন্তু ২০১৯ সালের মার্চ মাসে ডঃ ছিও-এর কিছু কর্মকাণ্ড আরসিএমপি-র নজরে আসে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্যটি গোপনে ইবোলা এবং নিপাহ এই দুইটি মারাত্মক ভাইরাসের নমুনা চীনে পাঠানো। খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে তার গবেষণা দলের চীনা ছাত্রদের অনেকের সাথেই চীনের সামরিক বাহিনী পিএলএ-এর ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। ফলে আরসিএমপি ২০১৯ সালের জুলাই মাসে তাকে এবং তার গবেষণা দলকে ‘ন্যাশনাল মাইক্রোবায়োলিজি ল্যাব’ থেকে বহিষ্কার করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি ছিল অতি গুরুতর। প্রথম এবং প্রধান অভিযোগটি হচ্ছে চীন সরকারের কাছে কানাডার স্টেট সিক্রেট পাচার। অন্য অভিযোগগুলি হচ্ছে চীন সরকারকে বিভিন্ন প্রকার বায়ো-উইপেন তৈরিতে সাহায্য করা। কোভিড-১৯ ভাইরাসের সেই ক্রান্তিকালে অনেকেই ধারণা করছিল যে ভাইরাসটি চীন বায়ো-উইপেনের অংশ হিসেবে ল্যাবে তৈরি করেছে এবং সেই ভাইরাস তৈরিতে ডঃ ছিও-এর প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে। কারণ ডঃ ছিও চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্স-এর অধীনে পরিচালিত ‘উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি’-এর সাথে যৌথ গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। জোনাথন ম্যানথর্প ২০১৯ সালে প্রকাশিত তার ‘ক্লওজ অব চায়না’ বইটিতে ‘টেকনোলজি এসপিওনাজ’-এর সাথে ডঃ ছিও-এর সম্পৃক্ততার কথা বিশদভাবে লিখেছেন। যখন সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে চীনের গোয়েন্দা হস্তক্ষেপের ব্যাপারগুলি একে একে প্রকাশিত হতে শুরু করে তখন কানাডার সিকিউরিটি ইন্টিলিজেন্স সার্ভিস (সিসিস) কানাডাতে চীনের গুপ্তচরবৃত্তির শাখা-প্রশাখা কতখানি বিস্তৃত সেটা অনুসন্ধান করতে গিয়ে হতবাক হয়ে যায়। যেন ‘কেঁচো খুড়তে সাপ’ বেরিয়ে আসার অবস্থা।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *