টরেটক্কা টরন্টো

চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -২৪

কাজী সাব্বির আহমেদ

হুয়াওয়েই টেলিকমের সিএফও মং ওয়ানট্রৌ-র গ্রেফতারের ঠিক সাত দিনের মাথায় অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৭ই ডিসেম্বরে হোয়াইট হাউজের এক ক্রিসমাস ডিনার পার্টিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার জন বোল্টনের টেবিলে এসে বলেন, ‘ইভাঙ্কা ট্রাম্প অব চায়না’-কে আমরা অ্যারেস্ট করতে পেরেছি। ফলে চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধে তাকে আমরা দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারব। মং ওয়ানট্রৌ-এর গুরুত্ব বোঝাতে নিজ কন্যা ইভাঙ্কা ট্রাম্পের সাথে তাকে তুলনা করাতে বোল্টনের ঠোঁটের ডগায় প্রায় চলে এসেছিল, ইভাঙ্কা ট্রাম্প যে একজন স্পাই এবং প্রতারক সেটা আমার জানা ছিল না। কারণ মং ওয়ানট্রৌ-এর বিরুদ্ধে জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের প্রতারণার মামলা রয়েছে। আর হুয়াওয়েই-এর বিরুদ্ধে আছে আমেরিকার তথ্য ও প্রযুক্তির জন্য নিরাপত্তার হুমকির অভিযোগ। কিন্তু জন বোল্টন অবশ্য শেষ মুহুর্তে এই অপ্রিয় মন্তব্য করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘দ্য রুম হোয়্যার ইট হ্যাপেনডঃ এ হোয়াইট হাউজ মেমোর’ বইতে জন বোল্টন এই তথ্যসহ ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেন। বইটিতে তিনি বিশদভাবে উল্লেখ করেন যে মং ওয়ানট্রৌ এবং হুয়াওয়েই-কে চীনের সাথে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধে ‘বারগেইনিং চিপ’ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে ভেবে ট্রাম্পকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল সেই ক্রিসমাস ডিনারের পার্টিতে। কিন্তু মং ওয়ানট্রৌ-এর বিরুদ্ধে যে প্রতারণার অভিযোগ এবং হুয়াওয়েই টেলিকমের বিরুদ্ধে যে তারচেয়েও গুরুতর আমেরিকার তথ্য প্রযুক্তির নিরাপত্তার জন্য হুমকির অভিযোগ রয়েছে সেই ব্যাপারে ট্রাম্পের কোন মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয়নি জন বোল্টনের কাছে। সেই কারণেই ট্রাম্প ১১ই ডিসেম্বরে অর্থাৎ চীন যেদিন মং ওয়ানট্রৌ-এর গ্রেফতারের প্রতিশোধ হিসেবে কানাডার দুই মাইকেলকে গ্রেফতার করে তার ঠিক পরদিনই রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অনেকটা বালখিল্যতার সাথে মন্তব্য করেন যে তিনি অবশ্যই মং-এর বিরুদ্ধে জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের দায়েরকৃত মামলাতে হস্তক্ষেপ করবেন যদি সেটা চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধে আমেরিকার পক্ষে কাজ করে। তার এই দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যে বিপাকে পড়ে যায় কানাডা। কারণ তারা যে আমেরিকারই নির্দেশনায় মং ওয়ানট্রৌ-কে গ্রেফতার করেছে। মং ওয়ানট্রৌ-কে ঘিরে ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু করে চীন এবং কানাডাকে নিয়ে এক অভিনব কূটনৈতিক খেলা।

২০১৬ সালের ২৮শে জুন তারিখে আমেরিকার ‘রাস্ট বেল্ট স্টেট’ নামে পরিচিত পিটসবার্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণার জন্য আসেন। ‘রাস্ট বেল্ট স্টেট’ বলতে বুঝায় আমেরিকার যেসব স্টেটে ডিইন্ডাস্ট্রিলাইজেশন বা শিল্প-কারখানা অবলুপ্তির কারণে অর্থনৈতিক মন্দা গ্রাস করেছে। ট্রাম্প তাদের এই দুরাবস্থার জন্য সরাসরি কানাডা, আমেরিকা এবং মেক্সিকো এই তিন দেশের মধ্যে বিদ্যমান ট্রেড এগ্রিমেন্ট যা কিনা ‘নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট’ বা নাফটা চুক্তিকে দায়ী করেন। তিনি এই চুক্তিটিকে সর্বকালের সবচেয়ে জঘন্য চুক্তি হিসেবে অভিহিত করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এই চুক্তিটিকে ঢেলে সাজাবেন যাতে আমেরিকার শ্রমিকদের জন্য কাজের সৃষ্টি হয়। কানাডা এবং মেক্সিকো যদি তার প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে আলোচনার টেবিলে না আসে তবে তিনি এই সিকি শতাব্দি পুরানো এই চুক্তিটিকে বাতিল করে দিবেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৭ সালের ১৬ই অগাস্ট ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এই নাফটা চুক্তির বিষয়টি আলোচনাতে নিয়ে আসে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ট্রেড রিপ্রেজেন্টিটিভ রবার্ট লাইথাইজার ঘোষণা দেন যে, আমরা মনে করি আমেরিকান শ্রমিকদের আর্থিক দুরাবস্থার কারণ হচ্ছে এই নাফটা চুক্তি এবং আমরা এটার আশু পরিবর্তন চাই।

২০১৮ সালের ৩০শে নভেম্বর, জি-২০ সামিট বুয়েনোস আইরেস, আর্জেন্টিনা। ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ক্রমাগত প্রচেষ্টার ফলে সিকি শতাব্দীর পুরানো নাফটা চুক্তিটির কিছু পরিবর্তন এনে সেটাকে ‘ইউএস, মেক্সিকো, কানাডা এগ্রিমেন্ট’ বা ‘ইউএস,এম, সি, এ’ নামে অভিহিত করে তিন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তাতে স্বাক্ষর করেন (ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

এই পরিবর্তনের সূত্র ধরেই ২০১৮ সালের ৩১শে মার্চ আমেরিকা হঠাৎ করেই ঘোষণা দেয় যে তারা কানাডা থেকে আমদানীকৃত স্টিলের উপর ২৫% এবং অ্যালুমিনিয়ামের উপর ১০% ট্যারিফ আরোপ করবে। এই ঘোষণার পাল্টা জবাব হিসেবে কানাডা ঘোষণা দেয় যে তারা চিন্তা করছে আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত স্টিলজাত, অ্যালুমিনিয়ামজাত সামগ্রী সহ অন্যান্য পণ্যের উপর মোট ১৬.৬ বিলিয়ন ডলারের ট্যাক্স আরোপ করার। এই পাল্টাপাল্টি ঘোষণার ফলে দুই দেশের মধ্যে একটি উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সেই উত্তেজনা আরও প্রকট হয়ে উঠে সেই বছরের জুন মাসে কানাডার কুইবেক প্রভিন্সের শারলুভয় শহরে জি-৭ সামিট চলাকালীন সময়ে। সেই সামিটের সময় এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রাইম মিনিস্টার ট্রুডো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সরাসরি বলে বসেন যে, আমেরিকার এই ট্যারিফ আরোপ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কানাডার অবদানকে অস্বীকারের নামান্তর বৈ অন্য কিছু নয়। সেই যুদ্ধকালীন সময়ে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান মিলিটারি হার্ডওয়্যার উৎপাদনের চাহিদা পূরণ করেছিল কানাডার সরবরাহকৃত স্টিল আর অ্যালুমিনিয়াম। অথচ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আজ আমেরিকার ট্রেড আইনের এমন একটি অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে কানাডার জন্য অপমানজনক এই ট্যারিফ আরোপ করেছেন যা কিনা অতীতে কখনই ব্যবহার করা হয়নি। জি-৭ সামিট শেষে এক প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এই ট্যারিফের ব্যাপারে ‘পুশড অ্যারাউন্ড’ শব্দটি ব্যবহার করে বলেন যে তিনি চান না যে আমেরিকা জোর পূর্বক কানাডাকে এই ট্যারিফ চাপিয়ে দিক। সামিট শেষে ট্রাম্প তখন তার ‘এয়ারফোর্স ওয়ান’ বিমানে করে নর্থ কোরিয়ার কিম জংউন-এর সাথে নিউক্লিয়ার সামিটে যোগ দেয়ার জন্য সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। সেই বিমানে বসেই তিনি ট্রুডোকে তার এই মন্তব্যের জন্য ‘ভেরি ডিসঅনেস্ট এন্ড উইক’ অভিহিত করে তার টুইটার বোমা ছুঁড়ে দেন। পরদিন ‘আমেরিকান সানডে’-এর মর্নিং পলিটিক্যাল নিউজ চ্যানেলে ট্রাম্পের ট্রেড অ্যাডভাইজার পিটার নাভারো প্রাইম মিনিস্টার ট্রুডোর উপর আরেক প্রস্থ ঝাল ঝাড়েন। তিনি বলেন যে, প্রেস কনফারেন্সে প্রাইম মিনিস্টারের এই ‘স্টান্টবাজী’ বক্তব্যের কারণে তাকে ‘স্পেশাল প্লেস ইন হেল’-এ যেতে হবে। ট্রূডোর পক্ষে বক্তব্য দেন কানাডিয়ান সিনেটর পিটার বোয়েম যিনি কিনা সেই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন যে, ট্রাম্পের দাবী সম্পূর্ণ অমূলক কারণ প্রাইম মিনিস্টার প্রেস কনফারেন্সে এমন কিছু বলেননি যা কিনা সেই বৈঠকে তিনি ট্রাম্পের সাথে আলোচনা করেননি। যদিও পিটার বোয়েমের এই স্টেটমেন্ট ট্রাম্প এবং ট্রুডোর মধ্যেকার সম্পর্কের মাঝে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে সেটাকে বিন্দুমাত্র প্রশমিত করতে পারেনি।

ট্রাম্প এবং ট্রুডো এই দুই নেতার মাঝে সৃষ্ট সম্পর্কের এই তিক্ততা নিয়েই এগিয়ে চলে আমেরিকা, কানাডা এবং মেক্সিকোর মধ্যকার ‘নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট’ বা নাফটা চুক্তির নবায়নের কার্যক্রম। কারণ এতে চিন দেশেরই স্বার্থ জড়িত। এক সময় (২০১৮ সালের ৩০শে নভেম্বর) ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ক্রমাগত প্রচেষ্টার ফলে সিকি শতাব্দীর পুরানো নাফটা চুক্তিটির কিছু পরিবর্তন এনে সেটাকে ‘ইউএস, মেক্সিকো, কানাডা এগ্রিমেন্ট’ বা ‘ইউএস,এম, সি, এ’ নামে অভিহিত করে তিন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তাতে স্বাক্ষর করেন। ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য পরবর্তী ধাপ হচ্ছে কংগ্রেসের অনুমোদন লাভ। উইসকনসিন স্টেটের রিপাবলিকান দুই সদস্য টুমি এবং রন জনসন স্টিল এবং অ্যালুমিনিয়ামের উপর থেকে আরোপিত ট্যারিফ বাতিল করার জন্য হোয়াইট হাউসকে পরামর্শ দিল। কারণ তারা মনে করে এতে করে কংগ্রেসের অনুমোদন লাভের সম্ভবনা বৃদ্ধি পাবে। রিপাবলিকান স্ট্রাটেজিস্ট বা কৌশলবিদ আন্তোনিয়া ফেরিয়ের-এর মতে ট্রাম্পের সামনে দুটি বিকল্প রয়েছে – ‘হানি’ অথবা ‘হ্যামার’। ডেমোক্রাট পেলোসি-এর সাথে ‘দর কষাকষি’ কিংবা নাফটা থেকে সরে আসা। কোনটাই অবশ্য ট্রাম্পের জন্য ভালো অপশন নয়। ডেমোক্রাট পেলোসি-এর সাথে ‘দর কষাকষি’ করতে হবে কারণ ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন যে তার পার্টি ডেমোক্রাট এই ট্রেড ডিলটিকে অনুমোদন করবে না যদি তারা দেখে যে পুরানো নাফটা চুক্তির উপর শুধু ‘সুগার’ যোগ করা হয়েছে। এই সংকটময় সময়ে ট্রাম্প অনুভব করলেন তার দরকার ট্রুডোর সহযোগিতার। অন্যদিকে কানাডার বিজনেস লিডারেরাও চাচ্ছিলেন এই অচলাবস্থার অবসান। তাই তারাও চাচ্ছিলেন ট্রুডো যেন ট্রাম্পের পলিটিক্যাল অপোনেন্ট ন্যান্সি পেলোসিকে ‘ইউএস,এম, সি, এ’-এর ব্যাপারে নমনীয় করে তুলে। ফলে ট্রুডো ২০১৯ সালের ২০শে জুন রওয়ানা হলেন ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে। প্রথমে দেখা করলেন ট্রাম্পের সাথে তার ওভাল অফিসে। তাদের মধ্যকার এই বাইলেটারাল মিটিং-এর এজেন্ডার ভিতর ‘ইউএস,এম, সি, এ’ চুক্তির পাশাপাশি মং ওয়ানট্রৌ-এর গ্রেফতারের প্রসঙ্গও অন্তর্ভূক্ত ছিল। মিটিং শুরুর আগে ট্রাম্প ঘরভর্তি সাংবাদিকদের সামনে ট্রুডোর ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি ট্রুডোর সাথে তার ব্যক্তিগত বিবাদের কথা বেমালুম ভুলে তাকে তার বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেন এবং ‘ইউএস,এম, সি, এ’ চুক্তিকে বাস্তবায়িত করার ব্যাপারে ট্রুডোর অবদানের কথা স্বীকার করেন। সাংবাদিকেরা স্বভাবতই চীনের সাথে কানাডার কূটনৈতিক টানাপোড়েন প্রসঙ্গে বিশেষ করে দুই মাইকেলের ব্যাপারে ট্রাম্পের কাছে জানতে চান। কারণ জাপানের ওসাকাতে অনুষ্ঠিতব্য আসন্ন জি-২০ সামিটে ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে এক বাইলেটারাল মিটিং-এ মিলিত হতে যাচ্ছেন। ট্রাম্প সাংবাদিকদের সামনে কথা দেন যে তিনি প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং-এর সাথে কানাডার দুই মাইকেলের মুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করবেন। সেই সাথে জি-২০ সামিটে ট্রুডোর সাথে শি চিনপিং-এর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার চেষ্টা নিবেন। এটা সহজেই অনুমেয় যে ট্রাম্প কেন ট্রুডো তথা কানাডার জন্য এই দুটি কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কারণ কয়েক ঘণ্টা পরেই ট্রুডো হাউজ অব রিপ্রেজেন্টিটিভস-এর স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি যাকে ট্রাম্প আড়ালে ‘ক্রেজি ন্যান্সি’ বলে সম্বোধন করে মনের ঝাল মিটাতে ভালোবাসেন, তার সাথে মিলিত হতে যাচ্ছেন। সেখানে ট্রুডো ‘ইউএস,এম, সি, এ’ চুক্তিটি যেন ডেমোক্রাটের অনুমোদন পায় সেই ব্যাপারে তদ্বির করবেন। ট্রুডো ট্রাম্পের কাছে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি রেখেছেন ‘ইউএস,এম, সি, এ’ চুক্তি নিয়ে ন্যান্সির সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা করার মাধ্যমে। কিন্তু ট্রাম্প তার কথা রাখেননি। ওসাকা সামিটের পর সাংবাদিকদের তিনি উৎফুল্ল কন্ঠে শি চিনপিং-এর সাথে তার আলোচনা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে বলে জানান। তিনি এও বলেন যে অচিরেই হুয়াওয়েই-এর উপর থেকে কিছু কিছু রেস্ট্রিকশন তুলে নেয়া হবে। যখন তাকে মং ওয়ানট্রৌ-এর এক্সট্রাডিশনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলো তখন ট্রাম্প জানালেন যে তিনি শি চিনপিং-এর সাথে হুয়াওয়েই নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু মং ওয়ানট্রৌ প্রসঙ্গে কোন কথা বলেননি। অর্থাৎ তিনি পরিস্কার করে দিলেন যে, সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও কানাডার দুই মাইকেলের মুক্তির ব্যাপারে তিনিত কোন আলোচনা করেননি শি চিনপিং-এর সাথে যার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন ট্রুডোকে। 

২০১৯ সালের ২৮শে এবং ২৯শে জুন তারিখে জাপানের ওসাকা শহরে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং-এর সাথে কানাডার প্রাইম মিনিস্টার জাস্টিন ট্রুডোর ‘বাইলেটারাল মিটিং’ নানা কারণে জরুরী হয়ে পড়ে। প্রথমত, কানাডার দুই নাগরিক মাইকেল কভরিগ এবং মাইকেল স্পাভর-এর মুক্তির ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং-এর হস্তক্ষেপ কামনা। মং ওয়ানট্রৌ-এর গ্রেফতারের ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে চীন কানাডার উপর চাপ প্রয়োগের জন্য যে এই দুই মাইকেলকে আটক করেছে সেটা অনেকটা স্বচ্ছ পানির মতন পরিস্কার। সেটা নিয়ে দেন-দরবার করা ছাড়াও চীন যে কানাডা থেকে আমদানী পণ্যের উপর নানা রকম বিধি নিষেধ আরোপ করে প্রচ্ছন্নভাবে কানাডার উপর চাপ প্রয়োগ করা শুরু করেছে সেটা নিয়েও প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং-এর সাথে আলোচনা করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। রফতানি পণ্যের তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ক্যানোলা ওয়েল যা কিনা কানাডার প্রধান রফতানি পণ্য। ২০১৯ সালের পহেলা মার্চ তারিখে চীন হঠাৎ করেই কানাডার প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান রিচার্ডসন ইন্টারন্যাশনাল-এর ক্যানোলা ওয়েলের রফতানি রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেয়। চীনের অভিযোগ যে রিচার্ডসন ইন্টারন্যাশনাল-এর রফতানিকৃত ক্যনোলা অয়েল গ্রহণযোগ্য মানের নয়। অথচ এই কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে একই মানের ক্যানোলা অয়েল চীনে রফতানি করে আসছে। তাই রিচার্ডসন ইন্টারন্যাশনাল-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট কানাডার সংবাদ সংস্থা সিবিসি-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন যে, এই রফতানি রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার আসল কারণ হচ্ছে চীনের সাথে কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি। মং ওয়ানট্রো-এর গ্রেফতারের কারণে চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতিতে কানাডার বিখ্যাত ‘কানাডা গুজ’ ব্র্যান্ডও বিপাকে পড়েছিল। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের শেষে ‘কানাডা গুজ’ বেইজিং-এ যখন তাদের প্রথম আঊটলেট খোলে তখন চাইনিজ স্যোসাল মিডিয়াতে এই ব্র্যান্ডের ‘উইনটার কোট’ বয়কটের ডাক দিয়ে জোর প্রচার শুরু হয়। ফলে স্টক মার্কেটে ‘কানাডা গুজ’-এর শেয়ারের পতন হলো প্রায় শতকরা ৯.৬ ভাগ। তবে অবশ্য এতসব নেগেটিভ প্রচারণার পরও বেইজিং-এর অভিজাত শপিং এরিয়া ‘সানলিথুন’-এ অবস্থিত ‘কানাডা গুজ’ আউটলেটে উইন্টার কোট কেনার জন্য চাইনিজ ক্রেতারা লম্বা লাইন দিয়েছিল। চীনের জনগণ কানাডার পণ্যকে বয়কটের ব্যাপারে কতখানি আগ্রহী ছিল সেটা জানা না গেলেও চীন সরকার অবশ্য কানাডাকে শায়েস্তা করার ব্যাপারে ছিল বদ্ধ পরিকর। ফলে তারা রিচার্ডসন ইন্টারন্যাশনাল-এর পর মার্চের ২৬ তারিখে আরেক কানাডিয়ান কোম্পানি ভিটেরা ইনক-এর ক্যানোলা অয়েলের রফতানি রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেয়। রফতানির পরিমাণের দিক থেকে ভিটেরা ইনক-এর অবস্থান ছিল রিচার্ডসন ইন্টারন্যাশনাল-এর ঠিক পরেই অর্থাৎ দ্বিতীয় বৃহত্তম। পরপর দুই কানাডিয়ান কোম্পানির ক্যানোলা অয়েলের রফতানি রেজিস্ট্রেশন বাতিলের ঘটনার পর গাই সেন্ট-জ্যাকুয়েস যিনি একসময় চীনে কানাডার রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন, মন্তব্য করেন যে, চীন স্পষ্টত কানাডাকে শাস্তি দেয়ার জন্য এই কাজ করছে। কারণ প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার মূল্যের রফতানি আয় কিংবা চীনে কানাডার মোট রফতানির শতকরা ১৭ ভাগ এই দুই কোম্পানির রফতানি রেজিস্ট্রেশন বাতিলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্যানোলা অয়েল ছাড়াও ২০১৯ সালের মে মাসে দুটি কানাডিয়ান পর্ক রফতানিকারক কোম্পানির রফতানি স্থগিত করে দেয় চীন ‘লেবেলিং’-এর সমস্যার অজুহাতে। তবে কানাডার এগ্রিকালচারাল মিনিস্টার ম্যারি-ক্লডি বিবিউ এই সাসপেনসনকে স্রেফ ‘অ্যান অ্যাডমিনিস্ট্রিটিভ ইস্যু’ বলে অভিহিত করেন। জি-২০ সামিটের ঠিক চারদিন আগে চীন যখন কানাডিয়ান বিফ এবং পর্ক-এর রফতানির উপর ঢালাওভাবে সাসপেনশন জারী করে তখনও এগ্রিকালচারাল মিনিস্টার এটাকে ‘টেকনিক্যাল, নট আ পলিটিক্যাল ইস্যু’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি অস্বীকার করলেও এটা স্পষ্টতই ছিল একটা পলিটিক্যাল ইস্যু। এইসব ইস্যু কিভাবে রিসলভ করা যায় তা নিয়ে আলোচনার জন্য আসন্ন জি-২০ সামিটে শি চিনপিং-এর সাথে ট্রুডোর একটি ‘বাইলেটারাল মিটিং’ জরুরী হয়ে পড়ে।

জি-২০ সামিটের ভেন্যু ওসাকাতে পৌঁছেই কানাডার ফরেন অ্যাফেয়ার্স মিনিস্টার ক্রিস্টিয়া ফ্রীল্যান্ড প্রথমেই চীনের ফরেন মিনিস্টারের সাথে একটি মিটিং-এর শিডিউল নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার এই অনুরোধ অনেকটা তিরস্কারের সুরে প্রত্যাখ্যাত হয়। তখনই বোঝা যায় যে কে আপারহ্যান্ডে আছে কিংবা কোন পক্ষের দায় বেশী। কিন্তু দুই পক্ষের সাথে যে সম্পর্ক ভালো নয় সেটাও স্পষ্ট হয়ে যায় ওপেনিং সেরেমনির টেলিভিশন সম্প্রচারে। সেখানে দেখা যায় যে শি চিনপিং টেবিলে তার নির্ধারিত জায়গায় বসে ছিলেন যখন ট্রুডো সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করলেন। যেহেতু অ্যালফাবেটিক অর্ডারে বসার জায়গা নির্ধারিত, তাই চায়নার প্রেসিডেন্টের ঠিক পাশেই কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সিট। ট্রুডো যখন তার সিটে বসছিলেন তখন শি চিনপিং উল্টা দিকে মুখ ঘুরিয়ে তার একজন সাহায্যকারীর সাথে কথা বলছিলেন। ট্রুডোও তার সিটে বসে শি চিনপিং-এর দিকে পিঠ ফিরিয়ে তার একজন সাহায্যকারীর সাথে কথা বলা শুরু করলেন। এর কিছুক্ষণ পর ট্রুডো তার চেয়ার একটু ঘুরিয়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলা শুরু করলেন। অর্থাৎ টেলিভিশনে দেখা গেল যে শি চিনপিং এবং ট্রুডো পাশাপাশি সিটে বসেও কোন রকম সৌজন্যমূলক সম্ভাষণ বিনিময় করলেন না যা কিনা রীতিমত দৃষ্টিকটু। পরে অবশ্য ট্রুডোর দলের পক্ষ থেকে বলা হয় যে কক্ষে প্রবেশের পূর্বেই দুই নেতার মাঝে সম্ভাষণ বিনিময় হয়েছিল। ফলে কক্ষের ভিতর তারা আর দ্বিতীয়বার সম্ভাষণ বিনিময় করেননি। চীনের অনাগ্রহের কারণে এই দুই নেতার ভিতর একান্তে কোন মিটিং না হলেও প্রাইম মিনিস্টারের অফিস থেকে পরে জানানো হয় যে ওয়ার্কিং লাঞ্চের সময় নাকি তাদের মধ্যে ‘সংক্ষিপ্ত কিন্তু গঠনমূলক ভাববিনিময়’ হয়েছে। কিন্তু সেই ‘ভাববিনিময়’ দ্বারা চীনে কানাডার দুই মাইকেলের আটকাবস্থার কিংবা রফতানি স্থগিত হয়ে যাওয়ার সমস্যাগুলির সমাধানের কোন উত্তরণ হয়নি। তবে ওসাকা সম্মেলনের ঠিক পরপরই থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত আসিয়ান সামিটে ক্রিস্টিয়া ফ্রীল্যান্ড চীনের ফরেন মিনিস্টারের সাথে এক মুখোমুখি বৈঠকের সুযোগ পান সেখানে তিনি দুই মাইকেলের গ্রেফতার সহ মং ওয়ানট্রৌ-এর আমেরিকাতে এক্সট্রাডিশনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু সেই আলোচনাও কোন কার্যকরী ফলাফল বয়ে আনতে পারেনি।

চীনের ব্যাপারে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ট্রুডো সরকারকে তাদের প্রধান বিরোধী দল কনজারভেটিভের নেতা অ্যান্ড্রু শিয়ার-এর অনেক কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। আমেরিকার অনুরোধে মং ওয়ানট্রৌ-কে গ্রেফাতার করার কারণে কানাডাকে আজ চীনের ‘উলফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোম্যাসি’-এর মোকাবেলা করতে হচ্ছে অথচ যেখানে কানাডার নিজস্ব কোন স্বার্থ জড়িত নয়। এটা যে এক ধরণের বোকামী বা কানাডার কূটনৈতিক প্রজ্ঞার সীমাবদ্ধতা সেটাকে ইঙ্গিত করে প্রাক্তন ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার জন ম্যানলে চীনে কানাডার দুই মাইকেলের আটকের পরপরই বলেছিলেন যে কানাডার উচিৎ ছিল ‘ক্রিয়েটিভ ইনকম্পিটেন্স’-এর আশ্রয় নিয়ে মং ওয়ানট্রৌ-কে ভ্যাঙ্কুভার এয়ারপোর্ট থেকে গ্রেফতার না করে তাকে বরং মেক্সিকোতে চলে যাওয়ায় বাঁধা না দেওয়া। জন ম্যানলে একজন বিজ্ঞ স্টেটম্যান যিনি কিনা জঁ ক্রটেন-এর আমলে ফরেন মিনিস্টার এবং ফাইন্যান্স মিনিস্টারের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে যা বলেছিলেন সেটা করলে কানাডার জন্য হত মঙ্গলজনক। চীনের সাথে বিবাদে জড়িয়ে কানাডাকে অহেতুক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হতে হয়েছে অপদস্থ। বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে ‘শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ’। যার অর্থ হচ্ছে যে শঠ তার সাথে শঠতার আশ্রয় নেয়াটাই সমীচীন। জাস্টিন ট্রুডোর উচিৎ ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে এই মন্ত্র প্রয়োগ করার। (চলবে)

তথ্যসূত্রঃ

‘দ্য টু মাইকেলসঃ ইননোসেন্ট কানাডিয়ান ক্যাপটিভস এন্ড হাই স্টেকস এসপিওনাজ ইন ইউএস-চায়না সাইবার ওয়ার, ফেন হ্যাম্পসন, মাইক ব্লাঞ্চফিল্ড -সুদারল্যান্ড হাউজ, টরন্টো, ২০২১

কাজী সাব্বির আহমেদ

কলাম লেখক । টরন্টো