প্যালেস্টাইনের পক্ষে মত প্রকাশকারীদের চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভের সময় আনন্দ প্রকাশ করায় রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা চাকরি হারাচ্ছেন। #ফ্রিপ্যালেস্টাইন আহবান জানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেয়ার কারণে একজন ফিলিস্তিনী কানাডীয় সাংবাদিককে বরখাস্ত করা হয়েছে। খবর বৃষ্টি বসু – সিবিসি নিউজ।
এগুলি গোটা কানাডাজুড়ে ঘটে চলা অসংখ্য ঘটনার দুয়েকটিমাত্র। সমস্ত কানাডায় ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে প্রকাশ্য রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদেরকে বরখাস্ত, বহিষ্কার করা হচ্ছে এবং তাদেরকে চাকরি না দেয়ার জন্য সবার প্রতি আহবান জানানো হচ্ছে। এই প্রবণতা কেবল কানাডায় নয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপেও এধরণের ঘটনার খবর প্রকাশ পেয়েছে। সবখানেই গণমাধ্যম, আইনসম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য এবং পরিষেবা খাতসহ নানা ধরণের শিল্পে একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
সিবিসি নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন অন্টারিওর এমন তিনজন আইনজীবীর তথ্য অনুযায়ী, কিছু নিয়োগদাতা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যেন অন্য সবাই সন্ত্রস্ত থাকে যে, যুদ্ধের এই সময়ে এক পক্ষে Ñ অর্থাৎ ফিলিস্তিনের পক্ষে রাজনৈতিক অবস্থান প্রকাশ করলে তাদেরকে চাকরি হারাতে হবে অথবা শিক্ষাক্ষেত্রে বিরূপ পরিণতির শিকার হতে হবে।
টরন্টোর প্রতিষ্ঠান ক্যাভালুজ্জো ল-এর শ্রম বিষয়ক আইনজীবী জ্যাকি এসমন্ডে বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, গত দেড় মাসে আমি এই বিষয়ে প্রতিদিন অন্তত একজন ভুক্তভোগীর ফোন পেয়েছি। আমরা যে ধরণের মামলা নিই, ভুক্তভোগীদের সবার ঘটনা হয়তো তেমন ছিলো না, তবে এই মুহূর্তে আমরা এ বিষয়ে ৮ থেকে ১০টি মামলা নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছি।”
সিবিসি নিউজের সঙ্গে কথা বলা তিন আইনজীবীর কেউই ইসরাইলের পক্ষ সমর্থনের কারণে একই ধরণের কোন ঘটনা ঘটেছে বলে জানতে পারেননি।
প্রতিটি কথা যাচাই করা হচ্ছে
কোন কথা বা কাজ চাকরিদাতা বা ইউনিভার্সিটির কাছে আপত্তিকর হতে পারে তা সব সময় স্পষ্ট নয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে, কোন কোন শব্দগুলি সমস্যার কারণ, সিবিসি নিউজের দেখা কিছু নথিপত্র থেকে তা স্পষ্ট হয়েছে।
গত মাসে অটোয়া ইউনিভার্সিটি তাদের মেডিক্যালের আবাসিক ডাক্তার ইপেং জি-কে বরখাস্ত করে। তিনি তার ব্যক্তিগত সামাজিক মাধ্যমে ফিলিস্তিনের পক্ষে মন্তব্য লিখেছিলেন। ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে ইপেং জির আইনজীবীর কাছে পাঠানো ই-মেলের বক্তব্য অনুযায়ী, ওই মন্তব্যের জন্যই তার বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ অভিযোগ ওঠে। সিবিসি নিউজ সে মেইলটি দেখেছে।
ই-মেলে ডা. জির পোস্টে উল্লেখিত স্লোগান “ফ্রম রিভার টু দ্য সি, প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি”-কে তার বরখাস্তের একটি কারণ বলে জানানো হয়। ই-মেলে বলা হয়, ইউনিভার্সিটি ওই বাগধারাটিকে “ইসরাইল থেকে ইহুদি জনগোষ্ঠীর জাতিগত নির্মূলের” আহবান হিসাবে বিবেচনা করে।
বাগধারাটির জন্মের ইতিহাস বিষয়ে অবগত কিছু বিশেষজ্ঞ সিবিসিকে বলেন, এটির অর্থ ও ব্যবহার অধিকতর জটিল।
গত অক্টোবরে অন্টারিওর রিচমন্ড হিলের ম্যাকেনজি রিচমন্ড হিল হাসপাতালের একজন নেফ্রোলজিস্টকে (কিডনি রোগের বিশেষজ্ঞ) সামাজিক মাধ্যমে ফিলিস্তিনের পক্ষে মতামত পোস্ট করার কারণে বরখাস্ত করা হয়। পরে তাকে আবার পুনর্বহাল করা হয় এই বলে যে, তারা মনে করেছেন, চাকরিতে ফিরে আসাটাই তার জন্য নিরাপদ হবে।
গত মাসে টরন্টোর জর্জ ব্রাউন কলেজ একজন রন্ধন বিশেষজ্ঞ বশির মুনিয়েকে সবেতন ছুটি দিয়ে দেয়। ওই সময় বশিরের বিরুদ্ধে ইন্সটাগ্রামে দেয়া একটি পোস্টের ব্যাপারে ওঠা অভিযোগের তদন্ত চলছিল। এ সম্পর্কিত কলেজের ই-মেল সিবিসি দেখেছে।
ওই কলেজে সাত বছর ধরে কর্মরত বশির সিবিসিকে বলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে নির্দিষ্ট করে বলেনি কোন পোস্টটি সরিয়ে নিতে হবে। তার অ্যাকাউন্টে যুদ্ধের প্রসঙ্গে দেয়া সর্বশেষ পোস্টটি দিয়েছেন তাকে সবেতন ছুটিতে পাঠানোর আগে, যেটিতে “ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি” বাগধারাটি এবং ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে ইসরাইল সরকারের গৃহীত ব্যবস্থার বর্ণনায় “গণহত্যা” এবং “বর্ণবিদ্বেষ” শব্দগুলি ছিল।
বশির বলেন, “একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে সংশোধন হবার, তার কাজের ব্যাখ্যা দেবার অথবা নিজের অনুভূতি প্রকাশের কোনওরকম সুযোগ না দিয়েই কীভাবে শাস্তি দিতে পারে সেটি দেখে তিনি মর্মাহত, হতবাক ও ভীত হয়েছেন।”
সিবিসিকে পাঠানো এক বিবৃতিতে জর্জ ব্রাউন কলেজের মুখপাত্র বলেন: “অভিযোগ পাবার পর আমাদের মানসম্মত প্রক্রিয়ার আলোকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে, (রশিদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে) কলেজের নীতিমালা লংঘিত হয়নি।”
রশিদ মুনিয়ে, মি. জি এবং অন্য যারা একইভাবে ভুক্তভোগী হয়েছেন তারা সবাই তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে আইনী পরামর্শক নিয়োগ করেছেন।
ব্যাপক প্রতিক্রিয়া
ফিলিস্তিনীদের পক্ষে একাত্মতা প্রকাশকারী ব্যক্তিদের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ছিল বহু বিচিত্র, কিন্তু মুষ্ঠিমেয় কিছু চরম ঘটনার ক্ষেত্রেই তাদের চাকরিচ্যুতির মত ঘটনা ঘটেছে।
অক্টোবরে গ্লোবাল নিউজের ফিলিস্তিনী কানাডীয় সাংবাদিক জাহরা আল-আখরাস যখন ম্যাটারনিটি লিভে রয়েছেন তখন তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। কারণ তিনি সামাজিক মাধ্যম থেকে তার পোস্ট সরিয়ে ফেলতে তার প্রতিষ্ঠানের নির্দেশ মেনে নেননি। গ্লোবাল নিউজ জাহরার পোস্টকে বলেছে, এটি “সহিংসতার পক্ষে ওকালতি” এবং সাংবাদিকতায় “গুরুতর পক্ষপাতিত্বের” ধারণা দেয়।
এ বিষয়ে সিবিসির দেখা চিঠিতে দেখা যায়, একজন ম্যানেজার একজন সরকারী কর্মকর্তাকে লক্ষ করে দেয়া যে কোনও পোস্ট এবং #ফ্রিপ্রালেস্টাইন, #গাজাআন্ডারঅ্যাটাক এবং #গাজা জেনোসাইড হ্যাশট্যাগসহ পোস্টগুলি সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন।
সামাজিক মিডিয়ায় আল-আখরাসের তৎপরতার মধ্যে এক্স-এ ফিলিস্তিনীদের প্রতি সমর্থনদানের জন্য জলবায়ু ইস্যুতে আন্দোলনকারী গ্রেটা থুনবার্গকে ধন্যবাদ জানানো থেকে শুরু করে ইন্সটাগ্রামের একটি
স্টোরিতে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াওভ গ্যালান্টের বক্তব্য উদ্ধৃত করা, যেখানে গ্যালান্ট ফিলিস্তিনীদেরকে “নরপশু” বলে সম্বোধন করেছেনÑ এই পোস্টটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছেÑ এবং গাজা উপত্যকায় “কোনও নিরীহ মানুষ নেই” বলে ইসরাইলী প্রেসিডেন্ট ইসসাক হারজগের মন্তব্যের সমালোচনার মত বিষয় রয়েছে।
২৮ বছর বয়সী আল-আখরাস বলেন, গ্লোবাল এর আগে কখনই, এমনকি, উদাহরণস্বরূপ, ইউক্রন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় ইউক্রেনের পক্ষে সমর্থন জানানোর ক্ষেত্রেও তার সামাজিক মাধ্যমের কোনও পোস্ট চিহ্নিত করেনি।
তিনি বলেন, “আমি সব সময়ই, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ঘটনাসহ বিশ্বজুড়ে চলমান রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে আমার মতামত শেয়ার করেছি।”
“কখনই গ্লোবাল থেকে কেউ আমাকে এসব পোস্ট ভারসাম্যহীন বলে তা সরিয়ে নেবার নির্দেশ দেয়নি।”
আল-আখরাস ই-মেলে বারবার গ্লোবালের কাছে জানতে চেয়েছে, তারা তার কোন কোন পোস্ট সরিয়ে নিতে বলছে তার পূর্ণ তালিকা দেয়ার জন্য। কিন্তু সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
গ্লোবাল নিউজ কর্মচারীদের বিষয়ে গোপনীয়তার কারণ দেখিয়ে আল-আখরাসের চাকরিচ্যুতির বিষয়ে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।
তবে ই-মেলে দেয়া এক বিবৃতিতে গ্লোবাল নিউজের এক মুখপাত্র বলেন : “আমাদের কর্মচারীদের কেউ কোনও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বিস্তার বা বৈষম্যমূলক মন্তব্য করলে তা ক্ষমা করা হয় না এবং তা আমাদের কোম্পানির নীতির লংঘন।”
সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের সীমা
আইনজীবী ক্যারিমা সা’দ বলেন, টরন্টোর ম্যক্সিস রেস্তোরাঁর বাইরে একটি ঘটনায় নিয়োগকর্তার আচরণের পেছনেও ছিল প্রতিক্রিয়া।
সা’দ ২১ অক্টোবর টরন্টোর কেন্দ্রীয় এলাকায় ফিলিস্তিনের পক্ষে একটি বিক্ষোভের ভিডিও করছিলেন। তিনি এক্স-এ একটি ভিডিও আপলোড দেন যাতে দেখা যায়, মক্সিস-এর কয়েকজন ইউনিফর্ম পরা কর্মচারী এবং কিছু কাস্টমার বেরিয়ে এসে ফিলিস্তিন-পন্থী বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে উল্লাস প্রকাশ করছেন।
সা’দ বলেন, মক্সিস-এর কর্মচারীরা উল্লাস করছিলেন, হাত নাড়ছিলেন এবং জনতার সঙ্গে “ফ্রি প্যালেস্টাইন” স্লোগান দিচ্ছিলেন।
এ ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোম্পানিটিকে বয়কট করা এবং ওই কর্মচারীদের বরখাস্ত করার দাবি জানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অসংখ্য মন্তব্য আসতে থাকলে মক্সিস তার করপোরেট এক্স অ্যাকাউন্টে একটি বিবৃতি পোস্ট করে।
বিবৃতিতে বলা হয়, “এই ঘটনায় কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকলে আমরা তাদের কাছে আন্তরিক ক্ষমা প্রার্থনা করছি।” এতে উল্লেখ করা হয় যে, “ঘটনায় জড়িত সবার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ওই কর্মচারীদের কেউ আর সেই রেস্তোরাঁয় কাজ করেন না
সিবিসি নিউজের পক্ষ থেকে ওই ঘটনার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কোম্পানি জানায়, ভিডিওতে যেসব কর্মচারীকে দেখা গিয়েছিল তাদের কেউ আর মক্সিস-এ কাজ করেন না। তবে তারা কেন কাজ করেন না সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু জানায়নি কর্মচারী ও অতিথিদের “গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার” কারণ দেখিয়ে।
ই-মেলে কোম্পানিটি বলেছে, “মক্সিস একটি অতিথিসেবার প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংগঠন নয়।” “আমাদের টিমের সদস্যদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থাই আমরা নিয়ে থাকি না কেন, সেটি সম্পূর্ণরূপে ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় কর্মক্ষেত্রে কর্মচারী আচরণবিধির সঙ্গে সম্পর্কিত।”
কিন্তু সা’দ সন্দেহ করেন, কোম্পানির প্রতিক্রিয়ার পেছনে কোনও “লবিং গ্রুপের” চাপের ভূমিকা ছিল।