টরেটক্কা টরন্টো
চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -২২
কাজী সাব্বির আহমেদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
২০১৮ সালের ৩০শে নভেম্বর দুপুরবেলায় ভ্যাঙ্কুভারের আরসিএমপি-এর কনস্টেবল উইনস্টন ইয়েপ-এর কাছে একটি মেসেজ আসে তার সুপারভাইজারের কাছ থেকে। তাকে বলা হয়, হংকং থেকে ক্যাথে প্যাসিফিক-এর সিএক্স৮৩৮ ফ্লাইটে একজন মহিলা যাত্রী আগামী চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ভ্যাঙ্কুভার এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছুবে। চীনের নাগরিক সেই যাত্রীর নাম ‘মং ওয়ানট্রৌ’ ওরফে ‘ক্যাথে মং’ ওরফে ‘সাবরিনা মং’। তাকে গ্রেফতারের জন্য একটি প্রভেনশিয়াল অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট তৈরি করতে হবে। কনস্টেবল উইনস্টনের কোন ধারণাই ছিল না কে এই বিশেষ যাত্রী এবং কেনই বা তার বিরুদ্ধে এই অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বের করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ এই অ্যাসাইনমেন্টের কাজে হাত দিয়ে তিনি জানতে পারলেন যে মং ওয়ানট্রৌ হচ্ছেন চীনের বিখ্যাত টেলিকম কোম্পানী যারা নিজেদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় টেলিকম কোম্পানী হিসেবে দাবী করে সেই ‘হুয়া ওয়েই’-এর চীফ ফিনান্সিয়াল অফিসার বা সিএফও। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানীর কিংবদন্তি প্রতিষ্ঠাতা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রাক্তন পিপলস লিবারেশন আর্মির কর্মকর্তা রেন ট্রংফেই সম্পর্কে তার পিতা। ১৯৭২ সালে জন্ম গ্রহণ করা মং ওয়ানট্রৌ ১৯৯৩ সালে চীনের উহান শহরে অবস্থিত বিখ্যাত হুয়াট্রোং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজী থেকে অ্যাকাউন্টিং-এ মাস্টার্স সম্পন্ন করে তার পিতার কোম্পানীতে যোগ দেন। দশ বছর পর ২০০৩ সালে তিনি হুয়া ওয়েই-এর সিনিয়র এক্সিকিউটিভ পদে নিযুক্ত হন। এই পদে যোগ দিয়েই তিনি হুয়া ওয়েই-এর প্রশাসন ব্যবস্থা এবং সেই সাথে বিদেশ শাখাগুলিকে ঢেলে সাজাতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি চীফ ফিনান্সিয়াল অফিসার সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেন। ২০০১ সালে তিনি কানাডার পার্মানেন্ট রেসিডেন্টশীপ লাভ করেন কিন্তু ২০০৯ সালে সেটা এক্সপায়ারড হয়ে যায়। তবে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে তার দুটি প্রাসাদোপম বাড়ী রয়েছে যেখানে তার ছেলেমেয়েরা তার স্বামীর সাথে বসবাস করে। তার ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট স্বামী লিউ সিয়াওজং টেম্পোরারি রেসিডেন্স ভিসায় ভ্যাঙ্কুভারে বাস করেন। মং ওয়ানট্রৌ প্রতি বছর ছুটিতে ভ্যাঙ্কুভারে বেড়াতে আসেন তার পরিবারের সাথে সময় কাটাতে। তবে এখন তিনি হংকং থেকে ভ্যাঙ্কুভারে আসছেন মেক্সিকোতে একটি বিজনেস মিটিং-এ যোগ দেয়ার জন্য। এয়ারপোর্টে পৌঁছা মাত্র কানাডা সরকার তাকে অ্যারেস্ট করতে যাচ্ছে কারণ আমেরিকার জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট আসামী ‘এক্সট্র্যাডিশন ট্রিটি’ বা ‘প্রত্যর্পন চুক্তি’ মোতাবেক কানাডাকে এই অনুরোধ জানিয়েছে। মং ওয়ানটৌ আমেরিকার আইন ভঙ্গকারী একজন আসামী যার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ২২শে অগাস্ট ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক অব নিউ ইয়র্কের ম্যাজিস্ট্রেট জাজ ‘রোয়ান এল. মান’ একটি অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছেন। তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে ব্যাংক জালিয়াতি বা মানি লন্ডারিং-এর অভিযোগ। কারণ হংকং-এ রেজিস্ট্রিকৃত ‘স্কাইকম’ নামক কোম্পানী যা কিনা হুয়া ওয়েই-এর একটি অংগ প্রতিষ্ঠান, মার্কিন স্যাংশন উপেক্ষা করে ইরানের কাছে টেলিকম সামগ্রী বিক্রী করেছে। এই অবৈধ ট্র্যাংজেকশনের কারণেই হুয়া ওয়েই-এর সিএফও মং ওয়ানট্রৌ-এর বিরুদ্ধে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারী করা হয়েছে।
‘ফাইভ-জি’ নেটওয়ার্কের ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরির প্রযুক্তিগত কৌশলের দিক থেকে হুয়া ওয়েই টেলিকম অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী টেলিকম কোম্পানী থেকে অনেক এগিয়ে। ফলে আমেরিকাসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলি ‘ফাইভ-জি’ নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজের জন্য হুয়া ওয়েই-কেই বেছে নিতে হচ্ছিল। কিন্তু হুয়া ওয়েই-এর বিরুদ্ধে রয়েছে তথ্য চুরির অভিযোগ। যে কোন সময় কোন এক অজুহাতে হুয়া ওয়েই-এর বড় কোন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে বলে হুয়া ওয়েই আগে থেকেই সতর্ক ছিল। ফলে মং ওয়ানট্রৌ সহ অন্যান্য বড় কর্মকর্তারা পার্সোনাল কিংবা বিজনেস ভ্রমণের সময় আমেরিকার মাটিকে পরিহার করে আসছিল। কিন্তু ‘এক্সট্র্যাডিশন ট্রিটি’ বা ‘প্রত্যর্পন চুক্তি’-র কারণে কানাডা যে আমেরিকার হয়ে এই গ্রেফতারের কাজটি করতে পারে সেটা তাদের মাথায় খেলেনি। কনস্টেবল উইনস্টন-এর উপর দায়িত্ব এসে পড়ল সুচারুভাবে এই গ্রেফতারের কাজটি সম্পন্ন করার। উইনস্টন নভেম্বরের ৩০ তারিখেই ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সুপ্রিম কোর্টের জাস্টিস মার্গোট ফ্লেমিং-কে দিয়ে মং ওয়ানট্রৌ-এর বিরুদ্ধে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট ইস্যু করিয়ে নেন। ওয়ারেন্টে উল্লেখ করা হয় যে, মং ওয়ানট্রৌ-কে ‘ইমেডিয়েটলি অ্যারেস্ট’ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যেন আদালতে হাজির করা হয়।
পরদিন পহেলা ডিসেম্বর সকালবেলাতেই ওয়ারেন্ট হাতে নিয়ে কনস্টেবল উইনস্টন ভ্যাঙ্কুভার এয়ারপোর্টে এসে হাজির হন। আরসিএমপি-এর আভ্যন্তরীণ মিটিং-এ আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-এর নির্দেশনা অনুসারে তাদের ‘হাই-ভ্যালু টারগেট’-কে প্লেন থেকেই অ্যারেস্ট করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় প্রথমে। কিন্তু সবার সামনে অ্যারেস্ট করার সময় মং ওয়ানট্রৌ যদি বেঁকে বসে তবে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারে সেই আশঙ্কায় প্লেন থেকে অ্যারেস্টের প্ল্যানটি বাতিল করা হয়। ফ্লাইট নামার ঠিক দুই ঘণ্টা আগে ঠিক করা হয় বর্ডার সিকিউরিটির সাহায্যে প্লেনের বাইরে তাকে অ্যারেস্ট করতে হবে। সিডিউল মোতাবেক ঠিক সকাল এগারোটায় ক্যাথে প্যাসিফিকের প্লেনটি ভ্যাঙ্কুভার এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছায়। পরিকল্পনা অনুসারে মং ওয়ানট্রৌ যখন ফ্লাইট পরিবর্তন করার জন্য ইমিগ্রেশন পার হচ্ছিলেন তখন কানাডার বর্ডার সিকিউরিটি এজেন্ট তাকে ‘রুটিন ইমিগ্রেশন চেক’-এর দোহাই দিয়ে ‘সেকেন্ডারি ইন্সপেকশন এরিয়া’-তে নিয়ে যায়। সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে তার লাগেজ তল্লাশি করা হয় এবং তার ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসগুলির পাসওয়ার্ড জেনে নিয়ে এফবিআই-এর দেয়া বিশেষভাবে তৈরি একটি ব্যাগে রাখা হয় যাতে সেখান থেকে কোন প্রকার ইলেক্ট্রনিক সিগন্যাল বের হতে না পারে। বর্ডার সিকিউরিটির তল্লাশি শেষে এবং জেরার শেষ পর্যায়ে তাদের সুপারিন্টেন্ট সঞ্জিত ধীলন আসেন মং ওয়ানট্রৌ-কে শেষ কিছু প্রশ্ন করার জন্য। তার ভিতর একটি প্রশ্ন ছিল ‘হুয়া ওয়েই কি কোন প্রডাক্ট ইরানের কাছে বিক্রী করে?’। উত্তরে মং ওয়ানট্রৌ বলেছিলেন যে তিনি এ ব্যাপারে অবগত নন। তার এই উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে সঞ্জিত বলেন, আমি বিশ্বাস করি না যে হুয়া ওয়েই-এর সিএফও-এর কাছে এর উত্তর জানা নেই। তারপর তাকে জানানো হয় যে তার বিরুদ্ধে আমেরিকার কোর্টে ক্রিমিনাল চার্জ রয়েছে। এরপরই পাশের রুমে অপেক্ষারত কনস্টেবল উইনস্টন একজন দোভাষী সহ এসে মং ওয়ানট্রৌকে জানান যে কানাডা সরকার তাকে এই মুহুর্তে অ্যারেস্ট করছে এবং তাকে শীঘ্রই আমেরিকাতে পাঠানো হবে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার জন্য। বিস্মিত মং ওয়ানট্রৌর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, আমি কিভাবে আমেরিকার আইন ভঙ্গ করলাম! মং ওয়ানট্রৌ যখন কানাডার জেলে প্রথম রাত কাটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে অনুষ্ঠিত জি২০ সামিটের শেষ রাতে এক অন্তরঙ্গ পরিবেশে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কানাডার প্রাইম মিনিস্টার জাস্টিন ট্রুডো একসাথে ডিনারে মিলিত হয়েছেন। এই আন্তরিক সম্পর্ক যে খুব শীঘ্রই তিক্ততায় ভরে উঠবে সেটা সম্পর্কে সেই মুহুর্তে তাদের কোন ধারণাই ছিল না।
গ্রেফতারের ঘটনার পরদিন হুয়া ওয়েই-এর পক্ষ থেকে বলা হয় যে, মং ওয়ানট্রৌ কোন আইন ভঙ্গ করেনি অর্থাৎ সম্পূর্ন বিনা কারণে তাকে আটক করা হয়েছে। ডিসেম্বরের ৬ তারিখে প্রাইম মিনিস্টার জাস্টিন ট্রুডো এই ঘটনার পিছনে কানাডার যে কোন রাজনৈতিক অভিসন্ধি নেই তা পরিস্কার করার জন্য বলেন যে, আমেরিকার সাথে কানাডার ‘এক্সট্র্যাডিশন ট্রিটি’-র নিয়ম অনুযায়ী কানাডার জুডিশিয়াল সিস্টেম তার নিজস্ব উদ্যোগে মং ওয়ানট্রৌকে গ্রেফতার করেছে যেখানে সরকারের করণীয় কিছুই নেই। ট্রুডোর এই বক্তব্যের জবাবে দুইদিন পর চীনের ভাইস ফরেন মিনিস্টার ল ইউঠ্রেং অত্যন্ত কঠিন ভাষায় কানাডাকে সতর্ক করে দেন যে, মং ওয়ানট্রৌকে যদি অবিলম্বে মুক্তি না দেয়া হয় তবে কানাডাকে এর প্রতিফল ভোগ করতে হবে। চীনের কাছ থেকে এই ধরণের কূটনৈতিক আচরণের জন্য কানাডা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কারণ কানাডা এর আগে চীনের এই এই যুদ্ধংদেহী ‘ওলফ ওয়ারিয়র কূটনীতি’ সম্পর্কে পরিচিত ছিল না। অতীতে প্যারামাউন্ট লিডার দেং শিয়াওপিং-এর ফরেন পলিসি অনুসারে চীন তার কূটনৈতিক যোগাযোগে শিষ্ঠাচার বজায় রেখে নরম ভাষা ব্যবহার করত। কিন্তু শি চিনপিং ক্ষমতায় আসার পর চীন তার ভাবমূর্তিতে বিরাট পরিবর্তন আনে এবং সেটা চীনের ফরেন পলিসির স্ট্র্যাটেজিতেও প্রভাব বিস্তার করে। জন্ম হয় ‘ট্রানলাং ওয়াইচিয়াও’ বা ‘ওলফ ওয়ারিয়র কূটনীতি’-এর যার নামকরণ করা হয়েছে ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চীনের এ্যাকশন ফিল্ম ‘ওলফ ওয়ারিয়র টু’ নামক সিনেমার নাম থেকে। দেশাত্মবোধক চেতনাকে উপজীব্য করে তৈরি করা এই সিনেমা অভূতপূর্ব দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘ওলফ ওয়ারিয়র কূটনীতি’-এর মূলমন্ত্র হচ্ছে বিশ্বমঞ্চে চীনকে যখন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, হেয় কিংবা খাটো করা হবে তখন চীনের প্রতিক্রিয়া হবে ‘কনফ্রনটেশনাল’ এবং ‘কমবাটিভ’। মং ওয়ানট্রৌর গ্রেফতারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চীন কানাডার বিরুদ্ধে তাদের এই নতুন আক্রমণাত্মক ফরেন পলিসি ‘ওলফ ওয়ারিয়র কূটনীতি’-কে পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করে।
ভ্যাঙ্কুভারের আদালতে মং ওয়ানট্রৌর আইনজীবী ডেভিড মার্টিন যখন তার জামিনের জন্য আবেদন জানাচ্ছিলেন তখন আমেরিকার জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট কানাডা সরকারকে জানায় যে তারা চায় মং ওয়ানট্রৌ-কে যেন কোন অবস্থাতেই জামিন না দেয়া হয়। তাকে রাখতে হবে ‘বিহাইন্ড দি বারস’ অর্থাৎ জেলে। কারণ সে যদি জামিনে ছাড়া পায় তবে সে তার এবং তার বাবা রেন ট্রংফেই-এর প্রভাব খাটিয়ে সহজেই কানাডা ছেড়ে চিরতরে পালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু মং ওয়ানট্রৌ তার এফিডেভিটে উল্লেখ করেন যে তিনি কানাডা ছেড়ে পালাবেন না কারণ এতে তার বাবার তিলে তিলে গড়া হুয়া ওয়েই-এর যে ‘রেপুটেশনাল ড্যামেজ’ হবে তা তিনি কোনভাবেই হতে দিবেন না। এই সময় (৬ই ডিসেম্বর) ডেভিড মুলরোনি (কানাডার প্রাক্তন ডিপ্লোমেট যিনি অতীতে চীনে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন) আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, চীন এই গ্রেফতারের ঘটনায় চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়েছে, ফলে কানাডাকে শাস্তি দেয়ার জন্য ‘টিট ফর ট্যাট’ নীতি গ্রহণ করার সম্ভাবনা ষোল আনা। তার এই আশঙ্কা অমূলক ছিল না, চীন ৮ই এবং ৯ই ডিসেম্বরে যথাক্রমে কানাডা এবং আমেরিকার রাষ্ট্রদুতকে তলব করে তাদের তীব্র ক্ষোভের কথা জানায়। কানাডা চীনের এই বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে আমলে নিয়ে ১০ই ডিসেম্বরে পূর্ব নির্ধারিত এক ট্রেড ডেলিগেশনের চীন ভ্রমণের কর্মসূচীকে বানচাল করে দেয়। অন্যদিকে ১১ই ডিসেম্বর ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সুপ্রীম কোর্ট জাস্টিস উইলিয়াম এহরকে আমেরিকার জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের সরাসরি নির্দেশনাকে পাশ কাটিয়ে দশ মিলিয়ন ডলারের জামানতের বিনিময়ে মং ওয়ানট্রৌর জামিন মঞ্জুর করেন। সর্বক্ষণের জন্য একটি বিশেষ জিপিএস ডিভাইস পরে থাকার শর্ত সাপেক্ষে মং ওয়ানট্রৌ তার ভ্যাঙ্কুভারের বিলাসবহুল বাড়ীতে তার পরিবারের সাথে থাকার অনুমতি লাভ করেন কোর্ট থেকে। তাছাড়া তার বাড়ীতেও সর্বক্ষণের জন্য সিকিউরিটির লোক থাকবে কোর্টের রুলিং অনুসারে। দীর্ঘদিনের জন্য তিনি যে ভ্যাঙ্কুভারে আটকা পড়ে থাকবেন সেটা অনুমান করে মং ওয়ানট্রৌ খোঁজ নেয়া শুরু করেন এই সময়কে কাজে লাগিয়ে তিনি ‘ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া’ থেকে একটি পিএইচডি ডিগ্রী নিতে পারেন কিনা। মং ওয়ানট্রৌ যেদিন জামিন পেয়ে অনেকটা মুক্ত জীবনে ফিরে যান তার ঠিক আগের দিন অর্থাৎ ১০ই ডিসেম্বরে চাইনিজ সিকিউরিটি পুলিশ কানাডার দুই প্রাক্তন ডিপ্লোমেট ‘মাইকেল কভরিগ’ এবং ‘মাইকেল স্পাভর’ কে এসপিওনাজের অভিযোগে গ্রেফতার করে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যায়। তাদের গ্রেফতার এতটাই গোপনীয়তার সাথে করা হয় তাতে প্রাথমিকভাবে মনে হয় যে এই দুই মাইকেল যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। চীন অবশ্য জোরালোভাবে দাবী করে যে দুই মাইকেলের গ্রেফতারের সাথে মং ওয়ানট্রৌর গ্রেফতারের কোন যোগসূত্র নেই। কিন্তু এটা জলের মত পরিষ্কার যে চীন এই গ্রেফতারের মাধ্যমে শুরু করে তার ‘জিম্মির কূটনীতি’ যা কিনা পূর্বেও তারা করেছে। ফলে মং ওয়ানট্রৌর গ্রেফতারের কাহিনী মোড় নেয় এক নতুন খাতে, যা কিনা মিডিয়াতে ‘দুই মাইকেলের উপাখ্যান’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই নাজুক পরিস্থিতিতে ১১ই ডিসেম্বরে আমেরিকার তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রয়টারের সাথে দেয়া এক ইন্টারভিয়্যুতে মন্তব্য করেন যে তিনি মং ওয়ানট্রৌ-এর গ্রেফতারের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে রাজী যদি সেটা চীনের সাথে আমেরিকার বাণিজ্য চুক্তি কিংবা আমেরিকার নিরাপত্তার জন্য মঙ্গলজনক হয়। তার এহেন মন্তব্যে বিপাকে পড়ে যায় কানাডা। ট্রুডো সরকারের প্রাক্তন ফরেন পলিসি অ্যাডভাইসার রোনাল্ড প্যারিস ট্রাম্পের এই বেফাঁস মন্তব্যে বিরক্ত হয়ে এই মর্মে টুইট করেন যে আমেরিকা যদি কানাডার মতন আইনের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ না থাকে তবে তাদের উচিৎ হবে মং ওয়ানট্রৌ-এর এক্সট্র্যাডিশনের অনুরোধকে তুলে নেয়া। পরের দিন অর্থাৎ ১২ই ডিসেম্বর ‘লস এঞ্জেলেস টাইমস’ একটি প্রতিবেদন ছাপায় যার শিরোনাম ছিল ‘ডিড প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জাস্ট থ্রো কানাডা আন্ডার দি বাস বাই সেইং হি মাইট ইন্টারভিন ইন হুয়া ওয়েই কেস?’। এই প্রতিবেদনের শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় ট্রাম্পের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য কতখানি অস্বস্তিকর ছিল কানাডার জন্য।
কানাডাতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লু শা-ইয়ে ২০১৯ সালের জানুয়ারীর ৯ তারিখে অটোয়া থেকে প্রকাশিত ‘দি হিল টাইমস’ পত্রিকাতে ‘হোয়াই দি ডাবল স্টান্ডার্ড অন জাস্টিস ফর কানাডিয়ানস, চাইনিজ’ শীর্ষক শিরোনামের একটি ‘অপ-এড’ বা উপসম্পাদকীয় লিখেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে চীন তার জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে বাধ্য হয়েছে কানাডার নাগরিক মাইকেল কভরিগ এবং মাইকেল স্পাভরকে গ্রেফতার করতে যা কিনা কানাডার কাছে মনে হয়েছে অন্যায়ভাবে তাদেরকে আটক করা হয়েছে। অথচ নিরাপরাধী মং ওয়ানট্রৌকে যখন কানাডা সম্পূর্ণ বিনা কারণে আটক করে সেটাকে তারা অন্যায় মনে করে না। সে কারণে তিনি কানাডার জাস্টিস সিস্টেম ‘ওয়েস্টার্ন এগোটিজম’ এবং ‘হোয়াইট সুপ্রেমেসি’ দ্বারা প্রভাবিত বলে কটাক্ষ করেন। কানাডা এবং চীনের মধ্যে যখন কূটনৈতিক সংঘাত তুঙ্গে তখন চীনে নিযুক্ত কানাডার রাষ্ট্রদূত জন ম্যাককালাম-এর কিছু মন্তব্যও ট্রুডো সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। ২০১৯ সালের ২১শে জানুয়ারীতে ম্যাককালাম টরন্টোর মারখাম শহরে অনুষ্ঠিত চীনাভাষী সাংবাদিকদের সম্মেলনে মং ওয়ানট্রৌ-এর পক্ষে তিনটি যুক্তি দিয়ে উল্লেখ করেন যে এই কেসে তার জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পার্লামেন্টে যখন ম্যাককালামের এই মন্তব্যের ব্যাপারে প্রাইম মিনিস্টার ট্রূডোকে প্রশ্ন করা হয় তখন তিনি সেটাকে এড়িয়ে যান, কিন্তু বিরোধী দল কনজারভেটিভের তখনকার নেতা অ্যান্ড্রু শিয়ার বলেন তিনি যদি প্রাইম মিনিস্টার হতেন তবে ম্যাককালামকে তার রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করতেন। বড় রকমের ভুল হয়েছে বুঝতে পেরে ম্যাককালাম অবশ্য তার ‘বেফাঁস মন্তব্য’-কে ‘মিসস্পোক’ বলে ক্ষমা চেয়ে নেন। আপাতত তার রাষ্ট্রদূতের পদ রক্ষা হলেও, তা বেশী দিনের জন্য ছিল না। অল্প কয়েকদিন তিনি যখন ভ্যাঙ্কুভারের একটি চ্যারিটি লাঞ্চে যোগ দেন তখন একজন সাংবাদিক তাকে মং ওয়ানট্রৌ-এর কেস প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি কোন প্রকার রাখঢাক না করেই তার মনের কথা বলে ফেলেন যা কিনা কোন কূটনৈতিকের জন্য মানানসই নয়। তিনি বলেন যে, আমেরিকা যদি এক্সট্র্যাডিশন কেসকে তুলে নেয় তবে সেটা হবে কানাডার জন্য সবচেয়ে মঙ্গলজনক। এবং আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যে আমেরিকা যখন তার এক্সট্র্যাডিশন কেস তুলে নিবে তখন যেন চীনকে এই শর্ত দেয় তারা যেন কানাডার জিম্মি দুই মাইকেলকে মুক্তি দেয়। এবং আমেরিকা এই বিষয়ে বেশ ভালোমতোই ওয়াকিবহাল রয়েছে। ম্যাককালামের এই বক্তব্য ছিল লিবারেল সরকারের জন্য অস্বস্তিকর ফলে সেই রাতেই ট্রুডো ফোন করে ম্যাককালামকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন। তার পদত্যাগে ‘টরন্টো স্টার’ পত্রিকার সাংবাদিক সুজান ডেলাকোর্ট মন্তব্য করেন যে, ট্রুডো সরকার যে কথাগুলো সরাসরি বলতে না পেরে রাষ্ট্রদূতকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছিল বলে যে গুঞ্জন তৈরি হয়েছিল, ম্যাককালামের পদত্যাগে সেই গুঞ্জনের অবসান হলো। ট্রুডো এবার চীনের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে নিয়ে আসেন কর্পোরেট দুনিয়ার চৌকশ ব্যক্তিত্ব ডমিনিক বার্টনকে, কূটনৈতিক হিসেবে যার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। বার্টনের জন্ম উগান্ডায় যেখানে তার বাবা-মা ক্রিশ্চান অ্যাঞ্জলিকান মিশনারিতে কাজ করতেন। গত শতাব্দীর ষাট দশকের শেষভাগে ইদি আমিনের অত্যাচারে তারা কানাডাতে পালিয়ে আসেন। ব্রিটিশ কলোম্বিয়াতে বড় হওয়া বার্টন যথাক্রেমে ইউনিভার্সিটি অব কলোম্বিয়া এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ইকনোমিক্সে ডিগ্রী নেন। তার ক্যারিয়ারের একটি দীর্ঘ সময় তিনি ‘ম্যাককিনসি’ কোম্পানীর রিপ্রেসেন্টিটিভ হয়ে চীনে কাজ করেছেন। চীনের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে চাইনিজ ফরেন মিনিস্ট্রির সাথে তার প্রথম মিটিংয়েই তিনি ছিলেন অত্যন্ত আক্রমণাত্মক। ২০২০ সালে তার দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই মিটিং সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, যেহেতু কানাডার নাগরিকদেরকে চীন জিম্মি হিসেবে আটক করেছে তাই আমরা ছিলাম খুবই ক্ষুব্ধ, অনুরূপভাবে চাইনিজরাও ছিল খুবই ক্রুদ্ধ। আমরা উভয়েই ছিলাম খুবই ফিউরিয়াস বা ক্ষিপ্ত। (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ
কলাম লেখক । টরন্টো