নবাগতরা খাবারের জন্য ক্রমবর্ধমান হারে ফুড ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছে
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : আলবার্টা ইউনিভার্সিটির পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মারিয়ানা ফেইজু বলেন, খাদ্যমূল্যের চাপ তিনি প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করছেন। তিনি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী হিসাবে ২০১৭ সালে মেক্সিকো থেকে কানাডায় আসেন।
তিন বছর আগে থেকে তিনি ইউনিভার্সিটির ফুড ব্যাংক উইক্যান (WECAN) এর ঝুড়ি কর্মসূচির ওপর নির্ভর করেন, যেখানে তিনি হ্রাসকৃত দামে মাংস ও অন্যান্য পণ্য কিনতে পারতেন। বর্ধিত বাজেটের চাপের মুখে ছয় মাস আগে তিনি ফুড ব্যাংকের গ্রোসারির ওপর নির্ভর করতে শুরু করেন।
নতুন এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ফেইজু হলেন হাজার হাজার নবাগত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর মধ্যে একজনমাত্র, যারা আজ খাবারের জোগানের জন্য ফুডব্যাংকের ওপর নির্ভর করছে। প্রকৃতপক্ষে, ফুড ব্যাংকের ব্যবহারকারীদের এক-চতুর্থাংশই কানাডায় সম্প্রতি আসা নবাগত।
ফুড ব্যাংকস কানাডার বার্ষিক হাঙ্গার কাউন্টস রিপোর্টে দেখা গেছে, ফুড ব্যাংকগুলোর সব গ্রাহকের মধ্যে ২৬.৬ শতাংশ নবাগত, যারা ১০ বছরের কম সময় ধরে কানাডায় বসবাস করছেন। সংখ্যাটি গত বছরের চেয়ে বেশি। সেসময় সব গ্রাহকের মধ্যে ১৭.২ শতাংশ ছিল নবাগতরা। আর ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সংখ্যাটি বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৬ সালে ফুড ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে নবাগতদের হার ছিলো ১২.৫ শতাংশ।
নিউ কানাডিয়ান মিডিয়া যেসব ফুড ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছে তারা জানায়, তাদের গ্রাহকদের মধ্যে যারা নবাগত তাদের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে সঙ্কটের মধ্যে অভিবাসীরা ফুড ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছে কারণ, অন্যান্য কানাডীয়র মত তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক লাইফলাইন বা উপকরণ নেই, যেজন্যে তারা খাদ্য নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে। এটি ঘটছে রেকর্ড মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে যা খাদ্যমূল্য দ্রুত বাড়িয়ে দিয়েছে।
ভেঙে পড়া নিরাপত্তা জাল
ফুড ব্যাংকস কানাডার সিইও কার্সটিন বিয়ার্ডসলি বলেন, ফুড ব্যাংকের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ভাঙন দেখিয়ে দিচ্ছে। “এই রিপোর্ট প্রকাশ করে দিচ্ছে যে, আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা জাল কতটা গভীরভাবে ভেঙে পড়েছে যে, লোকেরা যখন কানাডায় আসছে তখন তাদেরকে ফুড ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এটি তাদেরকে সহায়তার জন্য সরকারের বর্ধিত বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলছে।”
যদিও স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, খাদ্যমূল্যের মাসিক বৃদ্ধির হার কমছে, তবু মনোহারি পণ্যের দাম এখনও বেশি।
হাঙ্গার কাউন্টস রিপোর্টে দেখা গেছে, সম্প্রতি আসা নবাগতদের অনিশ্চিত চাকরি এবং ওষুধ ও দন্তচিকিৎসার মত সুবিধার স্বল্পতার কারণে অধিকতর লড়াই করতে হয়। তাদের ভাড়াটে হবার সম্ভাবনাও বেশি এবং তাতে স্পষ্ট যে, তারা মাঝারি মানের আবাসনের জন্য উচ্চমূল্য দিয়ে থাকে। যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে
পালিয়ে আসা এসব নবাগত সাশ্রয়ী আবাসন ও তাদের স্ট্যাটাসের ভিত্তিতে প্রাপ্য বিভিন্ন স্তরের আর্থিক সুবিধা খুঁজে পেতেও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারেন।
স্বাবলম্বী নবাগত?
কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষ অভিবাসীরা যখন কানাডায় আসে তখন সক্ষমতার প্রমাণ হিসাবে হাতে তাদের মাথাপিছু ১৩,৭৫৭ ডলার করে থাকতে হবে। অঙ্কটা প্রতি বছর হালনাগাদ করা হয় (২০২২ সালে ছিল ১৩,০০০ ডলার) এবং তা পরিবারের সদস্য সংখ্যার ভিত্তিতে বাড়ে। এদিকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদেরকে প্রথম বছরের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের জন্য অবশ্যই ১০,০০০ ডলারের তহবিল থাকার প্রমাণ দেখাতে হয়। এই শর্ত ২০১৫ সালের পর আর হালনাগাদ করা হয়নি। (তবে চলতি ডিসেম্বর মাসে তা হালনাগাদ করে দ্বিগুণ করা হয়েছে যা ২০২৪ সালের জানুয়ারী থেকে কার্যকর হবে।)
সারের কিংডম অ্যাক্টস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক গডউইন উদে বলেন, তার সংস্থার ফুড ব্যাংক ব্যবহারকারীর সংখ্যা হাঙ্গার কাউন্টস রিপোর্টে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে বেশি হতে পারে, এতে মনে হয়, তার গ্রাহকদের মধ্যে নবাগতদের অনুপাত এমনকি ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। তার গ্রাহকরা ভারত, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকাসহ বহু জায়গা থেকে আসা।
“এসব লোকের মধ্যে কেবল উদ্বাস্তুরাই নেই, তাদের কিছু আছে যারা নিজের দেশে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল পটভূমি থেকে আসা, কিন্তু এখানে আসার পর তারা উপলব্ধি করেন যে, যখন খাবার কেনার কথা আসে তখন কিছুটা সমন্বয় করতেই হবে।”
উদে বলেন, নবাগতরা যখন কানাডায় আসে তখন তারা মনোহারি পণ্যের জন্য বাজেট রাখে না। “তারা আবাসন, যাতায়াত ইত্যাদি নিয়ে পরিকল্পনা করে, কিন্তু অনেক সময় তারা খাদ্যের জন্যও বাজেট রাখে না।”
আলবার্টা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের ফুড ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এরিন ও’নিল বলেন, এডমন্টে তার ফুড ব্যাংকের গ্রাহকদের ৭০ শতাংশই ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী। এই ফুড ব্যাংক হলো কোনও ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের প্রাচীনতম।
ফুড ব্যাংকগুলি জরুরী প্রয়োজন মেটাতে পারলেও কিংডম অ্যাক্টস ফাউন্ডেশনের মি. উদে বলেন, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার পাওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান পদ্ধতিগত বাধার নিরসনের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো দরকার।
নিজের প্রসঙ্গে ফেউজু বলেন, কিছু খরচ সাশ্রয়ের জন্য তিনি টিউশন ফি বৃদ্ধিতে খানিক বিরতি পেতে চান। যদিও এডমন্টনে তার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট, তবু তিনি বলেন, অভিবাসী-বান্ধব গন্তব্য হিসাবে কানাডার খুব বেশি আত্মতুষ্ট হওয়া উচিৎ নয়।
“সামগ্রিকভাবে, কানাডার একটি সুনাম আছে, কিন্তু এই অবস্থা যদি চলতেই থাকে তাহলে সে সুনাম একইরকম থাকবে না… এখানে বসবাস কতটা ব্যয়বহুল সে খবর ছড়িয়ে পড়া নিছক সময়ের ব্যাপার। এখানে কতটা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে সেটা জানলে আমি হয়তো ভিন্ন উপায় বেছে নিতাম- আর আমি নিশ্চিত এমন চিন্তা কেবল আমার একারই নয়।”
– সূত্র : ক্যাট্রিয়া বলগার / নিউ কানাডিয়ান মিডিয়া