সুযোগের সন্ধানে কানাডার অভিবাসীরা ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় অন্যত্র চলে যাচ্ছে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সহায়ক বলে বিবেচিত অভিবাসীদের ধরে রাখা কানাডার অভিবাসন কৌশলের একটি মূল সূচক হওয়া উচিৎ

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অভিবাসনের লক্ষ্যমাত্রা কয়েকবার বাড়ানোর পর কেন্দ্রীয় সরকার গত ০১ নভেম্বর ঘোষণা করেছে যে, ২০২৬ সালের মধ্যে পাঁচ লাখ নতুন পারমানেন্ট রেসিডেন্ট গ্রহণের টারগেট ঠিক রাখা তার লক্ষ্য। 

অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী মার্ক মিলার বলেছেন, এই লক্ষ্যমাত্রার অর্থ হলো আবাসন ও স্বাস্থ্যসেবার ওপর চাপ কমানোর পাশাপাশি শ্রমিক সরবরাহে মদদ দেয়া।

শ্রমশক্তি বাড়ানো এবং বয়স্ক হয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিতে সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অভিবাসনের স্তর ক্রমাগত বাড়িয়েছে।

সরকার ২০২৩ সালে চার লাখ ৬৫ হাজার লোককে পারমানেন্ট রেসিডেন্সি দেয়ার পরিকল্পনা প্রকাশ করে গত বছর। এর ফলে ২০২৫ সালের মধ্যে পারমানেন্ট রেসিডেন্সি পাবে এমন লোকের সংখ্যা বেড়ে পাঁচ লাখে উন্নীত হয়। ২০২৫ সালের মধ্যে অভিবাসী গ্রহণের লক্ষ্য ছিল তিন লাখের কম।

নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, অভিবাসীরা অন্য কোথাও সুযোগ-সুবিধা পাবার জন্য ক্রমবর্ধমান হারে কানাডা ছেড়ে যাচ্ছেন। (সংগৃহীত প্রতীকী ছবি)

২০২২ সালে কানাডার জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি রেকর্ড পরিমাণ ১০ লাখ বেড়েছে। চলতি বছরেই আরও আগের দিকে দেশের জনসংখ্যাও চার কোটির সীমা ছাড়িয়েছে।

জনসংখ্যার এই বৃদ্ধি এমন সময়ে ঘটছে যখন দেশটি আবাসন ঘাটতির মুখে। সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত কানাডার মর্টগেজ ও হাউজিং করপোরেশনের রিপোর্টে বলা হয়, আবাসনের যোগান স্বাভাবিক রাখার জন্য চলতি দশকের শেষ নাগাদ দেশটিতে প্রায় ৫৮ লাখ নতুন আবাসন নির্মাণ করতে হবে। গ্লোবাল নিউজের খবরে এ কথা বলা হয়।

মন্ত্রী মার্ক মিলার অটোয়ায় পরিকল্পনা উপস্থাপনের পর সাংবাদিকদের বলেন, “অভিবাসনের এই স্তর আমাদের জন্য শ্রমিক ঘাটতি পূরণে প্রয়োজনীয় দক্ষ ও মেধাবী শ্রমিক নিয়ে আসার, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার, পরিবারগুলোর পুনরেকত্রীকরণের এবং শরণার্থী পুনর্বাসনে এগিয়ে থাকার সুযোগ করে দেবে।”

নতুন লক্ষ্যমাত্রা এমন সময়ে এসেছে যখন এনভায়রনিকস ইনস্টিটিউটের নতুন এক জরিপের তথ্যমতে, জীবনযাত্রার ব্যয় সঙ্কটে উদ্বেগের কারণে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক কানাডীয় মনে করছেন যে, দেশে অভিবাসনের হার খুব বেশি। গ্লোবাল নিউজের জন্য ইপসোসের করা এক জরিপেও একই তথ্য উঠে এসেছে।

এনভায়রনিকস-এর সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, ৪৪ শতাংশ কানাডীয় এমন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত যে, “সার্বিকভাবে, কানাডায় খুব বেশি অভিবাসন হচ্ছে।” এর বিপরীতে ৫১ শতাংশ কানাডীয় একমত নন।

অভিবাসন নিয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গি গত বছরের ফলাফল থেকে উল্লেখযোগ্য অপসারণ। তখন মাত্র ২৭ শতাংশ বলেছিলেন, অভিবাসন খুব বেশি। আর সর্বোচ্চ ৬৯ শতাংশ সেটি অস্বীকার করেন।   

মিলার বলেন, অভিবাসন স্তর স্থিতিশীল রাখা হলে সরকারের পক্ষে বিশেষ করে নির্মাণ শিল্পে শ্রমিক ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে।

মিলার ৩০ অক্টোবর অটোয়ায় কৌশলগত অভিবাসন পর্যালোচনা রিপোার্ট প্রকাশ করেন, যাতে বলা হয়, কানাডার আগামী কয়েক বছরের অভিবাসন কৌশল হবে দেশের শ্রমিক চাহিদার ওপর গুরুত্ব দিয়ে অভিবাসন নীতি গ্রহণ করা। 

কৌশলগত পর্যালোচনায় বলা হয়, বিভিন্ন খাতে শ্রমিক ঘাটতি পূরণের জন্য বিশ্বের মেধা টেনে আনার দারকার আছে কানাডার। এই পর্যালোচনায় অভিবাসনের একটি পথরেখা দেয়া হয়েছে। এতে “দেশের দক্ষতা ও শ্রম কৌশল সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের সঙ্গে কানাডার অভিবাসন নীতির সমন্বয়ের জন্য চিফ ইন্টারন্যাশনাল ট্যালেন্ট অফিসার (CITO) নামে একটি নতুন পদের ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা” তুলে ধরা হয়।

এই পদাধিকারী মূল্যায়ন করবেন, ভবিষ্যতে কানাডার অর্থনীতিতে কোন ধরণের মেধার প্রয়োজন হবে। তিনি ওইসব ক্ষেত্রের চাহিদা পূরণের সঙ্গে অভিবাসন কৌশলের সমন্বয় নিশ্চিত করবেন।

নিজ নিজ পেশায় চাকরী না পেয়ে অনেক দক্ষ অভিবাসীকে স্বল্প আয়ের চাকরী বেছে নিতে হয় কানাডায়। ছবি : গেটিইমেজ

এতে বলা হয়, কানাডাকে অবশ্যই “আবাসন ও স্বাস্থ্যসেবার মত গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিদ্যমান সামাজিক চাপ দূরীকরণে সহায়তা করতে পারবে এমন কর্মীদের” নিয়ে আসার ওপর মনোযোগ দিতে হবে।”

কিন্তু, নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, কানাডায় আসা অভিবাসীরা অন্য কোথাও সুযোগ-সুবিধা পাবার জন্য ক্রমবর্ধমান হারে দেশটি ছেড়ে যাচ্ছেন।

ইন্সটিটিউট ফর কানাডিয়ান সিটিজেনশিপ এবং কনফারেন্স বোর্ড অব কানাডার পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী, অভিবাসীদের কানাডা ছেড়ে যাওয়ার জোয়ার সৃষ্টি হয় ২০১৭ ও ২০১৯ সালে। ওই দুই সময়ে ঐতিহাসিক গড়ের চেয়ে ৩১ শতাংশ বেশি অভিবাসী কানাডা ছাড়েন।

কনফারেন্স বোর্ড অব কানাডার আগের সমীক্ষার উল্লেখ করে নতুন সমীক্ষায় বলা হয়, “কানাডার ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি অভিবাসনের ওপর নির্ভরশীল।” আগের সমীক্ষায় বলা হয়, অভিবাসনের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ায়, শ্রমিক ও অবসর গ্রহণকারীর অনুপাত উন্নত করে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়া শ্রমিক ঘাটতি সহজ করে। নবাগতরা কানাডার মানবিক লক্ষ্য অর্জনেও সহায়ক।

“অভিবাসনের উপকারিতার বিষয়টি বোঝা যায় যখন দেখা যায়Ñ যত দীর্ঘদিন তারা অবস্থান করে, তত বেশি তারা উপকৃত হয় এবং অবদান রাখে। যেসব অভিবাসী উন্নতি করে তাদের এদেশে অবস্থানের সম্ভাবনা তত বেশি।”

সমীক্ষার লেখকরা কেন্দ্রীয় সরকারকে নতুনদের ধরে রাখার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার পরামর্শ দেন।

সমীক্ষায় লেখা হয়েছে, “কানাডাকে অভিবাসনের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে কেবল নবাগতদের আকৃষ্ট করলেই হবে না, ধরেও রাখতে হবে। এখন পর্যন্ত কানাডার অভিবাসীদের থেকে যাবার হার মূল্যায়নের চেষ্টা কমই হয়েছে।

“জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সহায়ক বলে বিবেচিত হওয়ায় অভিবাসীদের ধরে রাখা কানাডার অভিবাসন কৌশলের কর্মক্ষমতার একটি মূল সূচক হওয়া উচিৎ।”

সমীক্ষার লেখকরা বলেছেন, নীতি নির্ধারকদেরকে অভিবাসনের প্রভাবক কারণগুলি বুঝতে হবে। 

কারণগুলির মধ্যে থাকতে পারে, অর্থনৈতিকভাবে একীভূতকরণ;  একাত্মতা বোধ; বর্ণবাদ; বাড়ির মালিকানা, বা তার অভাব এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসনের ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা। সমীক্ষায় আরও উল্লেখ করা হয় যে, কানাডায় অভিবাসী হয়ে আসা অনেকে তাদের যোগ্যতা ও পেশাগত দক্ষতার সাথে মেলে এমন কাজ খুঁজে না পেলে তাদের ক্যারিয়ারে গুরুতর বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এসব বিপত্তি কাটিয়ে উঠতে তাদের কয়েক বছর লেগে যেতে পারে যদি তারা আদৌ কখনও সেটি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়।

কানাডার অভিবাসীদের জীবনমান ও সম্ভাবনা উন্নয়নের জন্য সমীক্ষার লেখকরা সরকারের পক্ষ থেকে একই সঙ্গে কয়েক স্তরের পদক্ষেপের সুপারিশ করেন, যেমন, অভিবাসীদের মধ্যে অভিবাসনের হার পর্যবেক্ষণ, কানাডায় অভিবাসন সহজতর করে এমন সেটেলমেন্ট পরিষেবা ও অন্যান্য কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করা, নিয়োগকারীদেরকে অভিবাসী কর্মীদের নিয়োগ দেয়া ও ধরে রাখার ক্ষেত্রে সহায়তা দেয়া এবং অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করা যা সাধারণভাবে কমিউনিটিগুলিকেও উন্নীত করে।

“অভিবাসী ও তাদের পরিবারের জন্য ব্যক্তিগত ও ক্যারিয়ার গড়ে তোলার সুযোগ নিশ্চিত করবে এমন নীতির পাশাপাশি কানাডার সঙ্গে সংযোগ ও একাত্মতা বোধ বৃদ্ধির বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলে তা আরও বেশি সংখ্যক অভিবাসীকে কানাডায় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করতে পারে।”

অভিবাসী কর্মী নিয়োগ, কাজ দেয়া ও ধরে রাখতে নিয়োগকর্তাদের সহায়তা দান

চাকরির সুযোগ অভিবাসীদের বসতিযাত্রা এবং জীবনমান প্রভাবিত করে।

ইকোনোমিক ইমিগ্রেশনের প্রধান খাতগুলিতে আবেদনকারীদেকে কানাডায় অভিবাসনের শর্ত হিসাবে তাদের শিক্ষাগত ও পেশাগত পশ্চাদপটের প্রমাণ দিতে হয়। কিন্তু তাদের অনেকেই এখনও তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী চাকরি খুঁজে পেতে সংগ্রাম করেই যাচ্ছে।

পারিবারিক পুনরেকত্রীকরণ ও মানবিক বিবেচনার সূত্রে আসা অভিবাসীরা অনেক মূল্যবান দক্ষতা নিয়ে কানাডায় এলেও উপযুক্ত চাকরি পেতে তাদেরকে হয়তো আরও অনেক বড় বাধার মুখোমুখি হতে হয়।

অভিবাসীদের মেধা পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে নিয়োগকর্তাদেরও কিছু জ্ঞান ও সম্পদ থাকার প্রয়োজন হতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়োগকর্তাদের বাস্তব কর্মকাণ্ডের উন্নয়ন ঘটাতে সরকারের তিনটি স্তরের সব কটাই তাদেরকে কিছু উপকরণ ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দিতে পারে।

অভিবাসী ও চাকরি খালির পদের দক্ষতা চমৎকারভাবে মিলে গেলে তা অভিবাসী ও নিয়োগদাতা উভয়ের জন্য ভালো এবং শেষ পর্যন্ত তা অভিবাসীদের ধরে রাখার কাজে সহায়ক হতে পারে।

তথ্য সূত্র: সিটিভি, সিবিসি, গ্লোবাল নিউজ, ইন্সটিটিউট অব কানাডা সিটিজেনশিপ, দি কনফারেন্স বোর্ড অব কানাডা।