কানাডা দক্ষ অভিবাসীদেরকে আনতে চায়, কিন্তু আবাসন সঙ্কট কি তাদেরকে দুর্লভ করে তুলছে?
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : অঙ্কিতা গোয়েল ২০১৯ সালে যখন মুম্বাইয়ে ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্টের চাকরি ছেড়ে প্রযুক্তি খাতে চাকরি পাওয়া তার স্বামীর সঙ্গে ভ্যাঙ্কুভারে আসার সিদ্ধান্ত নেন তখন তিনি আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু চার বছর পর ভ্যাঙ্কুভারে জীবনযাত্রার ব্যয় তার সিদ্ধান্তের জন্য আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিবিসি রেডিওর ক্রসকান্ট্রি চেকআপ অনুষ্ঠানে গত সেপ্টেম্বরে গোয়েল বলেন, “আবাসন সাধ্যের বাইরে, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, ভাড়াও একইভাবে বাড়ছে, এসব কারণে আমাকে ভ্যাঙ্কুভার ছেড়ে যাবার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হচ্ছে।
“আমার মনে হয়, নতুন অভিবাসীদের জন্য এটি অন্যায্য, যারা তাদের সমাজ পেছনে ফেলে আসে, যারা নিজের দেশে চাকরি ছেড়ে আসে, যারা নতুন জায়গায় আসার জন্য তাদের সবকিছু ছেড়েছে, আর পরে দেখতে পাচ্ছে, তাদের জন্য সবকিছুই ভীষণ কঠিন।”
গোয়েল বলেন, এই পরিস্থিতিতে নিশ্চিতভাবেই তিনি একা নন, ভারত থেকে আসা তার পরিচিত অনেক নবাগতই একইরকম মনোভাব পোষণ করেন।
কানাডায় মূল্যস্ফীতি কমে আসার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, আর ভাড়া ও মর্টগেজের হার অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে- যার ফলে দেশজুড়ে সাশ্রয়ী আবাসনের সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার অভিবাসনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে এবং ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর পাঁচ লাখ পারমানেন্ট রেসিডেন্ট গ্রহণের লক্ষ্য নিয়েছে। এর মধ্যে সেইসব অভিবাসী শ্রমিক ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ধরা নাও হতে পারে যাদের সবারই আবাসনের চাহিদা আছে।
মন্ট্রিলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির পাবলিক পলিসি বিষয়ক ম্যাক্স বেল স্কুলের পরিচালক ক্রিস্টোফার রেগান ক্রস কান্ট্রি চেকআপ অনুষ্ঠানে বলেন, তিনি মনে করেন, এটি স্পষ্ট যে সরকার অভিবাসনকে কানাডার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাবিকাঠি হিসাবে দেখছে ।
রেগান বলেন, “বছরে অভিবাসী আগমনের হার যদি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো হয়Ñ এই সরকার ঠিক সেই কাজটিই করছে- তাহলে আমার মনে হয় পাজলের অন্য টুকরোগুলো খুঁজে পাওয়া নিশ্চিত করতে আপনাকে ঠিক একই কায়দায় কাজ করে যেতে হবে।”
টরন্টো মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটির টেড রজার্স স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসার ভিক সিং বলেন, আবাসন সঙ্কটের উন্নতি না ঘটলে এটা সম্ভব যে, কানাডায় আসার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছেন এমন দক্ষ অভিবাসীরা দুবার করে ভাবতে শুরু করবে।
তিনি বলেন, “এটা নিশ্চিত, কারণ তাদের আরও ভালো পছন্দ থাকতে পারে। তারা যদি সত্যিই থাকার বিষয়ে চিন্তা করে তাহলে তাদের অন্য কোনও দেশে যাবার সম্ভাবনা তাদের আছে।”
অভিবাসনের লক্ষ্য পূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ: মন্ত্রী
গোয়েল বলেন, তার কানাডায় অবস্থানের আংশিক কারণ হলো কানাডীয় পাসপোর্ট পাওয়া- যা তার জন্য এইচ-১বি ভিসার (H-1B visa) জন্য আবেদন করা সহজ করবে। তাহলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করতে পারবেন।
তিনি বলেন, “আমি জানি সেখানে বন্দুকবাজির মত অপরাধ এবং এমন অনেক কিছু আছে, কিন্তু অনেক জায়গাও আছে যেখানে একটি বাড়ি কেনা সম্ভব, সেগুলি যথেষ্ট সস্তাও।”
ভিক সিং বলেন, তিনি এই উপলব্ধির পেছনের যুক্তিটা বোঝেন: “আমেরিকায় যাবার প্রক্রিয়াগুলি দেখুন, কানাডার পাসপোর্ট থাকলে এটি অনেক সহজ হয়ে যায়।”
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি এবং মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধি জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলে কানাডার আবাসন সুবিধা সম্পর্কে নবাগতদের সন্তুষ্টির মনোভাব খুঁজে পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়েছে।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার সর্বশেষ আবাসন জরিপ চালানো হয় ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের মার্চের মধ্যে। কিন্তু সেটি এখনও প্রকাশ পায়নি।
বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘লেগার’ গত বছর নবাগত অভিবাসীদের মনোভাব সম্পর্কিত সমীক্ষা চালায়। তাতে দেখা যায়, ৮৭ শতাংশই কানাডার ব্যাপারে সুপারিশ করেন, তবে জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় ছিল সবচেয়ে সর্বজনীন আপত্তির বিষয়।
অভিবাসন মন্ত্রী মাইক মিলার ক্রসকান্ট্রি চেকআপ অনুষ্ঠানে বলেন, “লোকেরা কানাডা ছেড়ে যাবার অপেক্ষায় আছে এরকম গল্পকথা আমি শুনেছি, কিন্তু অভিবাসন, শরণার্থী ও সিটিজেনশিপ কানাডার দপ্তরে আমরা যে মোট সংখ্যা দেখছি সেটি সম্পূর্ণ বিপরীত।”
“আমাদের দেশের মত একটি দেশে আসার জন্য এই মুহূর্তে আমাদের এযাৎকালের সর্বোচ্চ চাহিদা আছে।”
অভিবাসন ও অবকাঠামোর সম্পর্ক স্থাপন
সিং বলেন, তিনি মনে করেন চলতি অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে অভিবাসনের সম্পর্ক স্থাপনে আরও অনেক কাজ করার দরকার আছে।
“সম্ভবত নতুন অভিবাসীদের উৎসাহিত করার কোনও উপায় থাকতে পারে, জানেন তো, বলা হয়ে থাকে, দক্ষ বাণিজ্য সেক্টরে যান, কারণ সেখানে চাকরি সুলভ। আর নিশ্চিতভাবেই কানাডার সর্বত্র চাকরি যথেষ্ট সুলভ।”
কানাডার মর্টগেজ ও হাউজিং করপোরেশন জানিয়েছে, আবাসন সাশ্রয়ী করার জন্য কানাডার এখন দরকার নতুন ৩৫ লাখ আবাসন ইউনিট। এখন পর্যন্ত যত বাড়ি বানানো হয়েছে এ সংখ্যাটি তার অতিরিক্ত। গ্রীষ্মে প্রকাশিত টিডি ইকোনোমিক্স-এর এক রিপোর্টে বলা হয়, বর্তমানে যে পর্যায়ে অভিবাসন হচ্ছে তা আগামী দুই বছরে কানাডার আবাসনের ঘাটতি কেবলই
বাড়াবে।
ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির রেগান বলেন, “আমি যখন মন্ত্রী মার্ক মিলারকে বলতে শুনলাম যে, তাদের দিক থেকে অভিবাসনের সংখ্যা কমিয়ে দেয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই… আমি ভাবলাম, এটি ঠিক আছে, যদি অন্যসব বিষয়গুলির সমাধানে আপনার একটি আন্তরিক পরিকল্পনা থাকে। সেরকম আন্তরিক কোন পরিকল্পনা আছে বলে আমি অবশ্য নিশ্চিত না।”
মিলার বলেন, কানাডার অভিবাসন ব্যবস্থা, বিশেষ করে এটির ডিজিটাইজেশনের প্রক্রিয়া নিয়ে এখনও অনেক কাজ বাকি। তবে তিনি মনে করেন, অভিবাসনের সঙ্গে আবাসন সঙ্কটজনিত ত্রুটির সম্পর্ক সামান্যই।
“পর পর আসা সরকারগুলি, লিবারেল বা কনজারভেটিভ যেটাই হোক, এই জটিল বিষয়ে কমই তহবিল বরাদ্দ করেছে। আর এটার জন্য অভিবাসীদের ওপর দোষারোপ করার কিছু নেই।”
আবাসন পেতে যত বাধা
মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স ফর চেঞ্জ-এর নির্বাহী পরিচালক সাঈদ হুসেন ক্রসকান্ট্রি চেকআপ অনুষ্ঠানে বলেন, “আমি মনে করি, আবাসন নির্মাণ খাতে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মদদ দরকার। গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে যা ঘটেছে সেটি হলো, বিষয়টি ব্যক্তিখাতের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং ব্যক্তিখাত এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।” – সূত্র : পল হান্টিউক – সিবিসি রেডিও