পলাতকা রাত্রির পিছনে
জসিম মল্লিক
আমি অপেক্ষা করছি হকারের জন্য। ঢাকার পত্রিকা বরিশাল পৌঁছায় পরদিন সকালে। আমি ততদিনে সাপ্তাহিক বিচিত্রার নিয়মিত পাঠক হয়ে গেছি। বিচিত্রার ডেটলাইন হচ্ছে শুক্রবার। কিন্তু বাজারে ছাড়া হতো একদিন আগেই বৃহষ্পতিবার। মঙ্গলবার হতো পেষ্টিং। বুধবার হতো বাঁধাই। এসব আমি অনেক পরে জেনেছি। শুক্রবারের জন্য থাকে আমার অধীর অপেক্ষা। সে সময় প্রতি সংখ্যা বিচিত্রার দাম দুই টাকা। এই দুই টাকা জোগাড় করা আমার জন্য ছিল অতি কঠিন। আমার মা যে পয়সা দিত সেটাই আমি জমিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা কিনতাম। স্কুল জীবন থেকেই। মফস্বলের এক ছায়াঘেরা শান্ত স্নিগ্ধ বাড়িতে বসে এক তরুণ তখন বিচিত্রা পড়ে, লাইব্রেরী থেকে গাদা গাদা বই আনে। নীহাররঞ্জন গুপ্ত, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, নিমাই ভট্টাচার্য, তারাশঙ্কর, আশাপূর্ণা, বিমল মিত্র, বিমল কর, আশুতোষ, রমাপদ’র লেখা গিলে খায়। দস্যুবনহুর, কুয়াশা, মাসুদ রানা পড়ে মুখস্থ হয়ে যায়। আমার মা এসব দেখে ভয় পেয়ে যায়। আমি রাত জেগে পাঠ্য বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ি। কী ভয়াবহ কথা! মা ভাবলেন এ ছেলের কপালে দুঃখ আছে। বাপ মারা ছেলে! লেখাপড়া না করলে খাবে কি! রাত দশটা হলেই মা লাইট অফ করে দেন।
শৈশবে আমার অনেক ইচ্ছাই আমার অপূর্ণ থেকে যেতো। এজন্য আমি স্বপ্ন দেখতে ভয় পেতাম। আমার জীবনের কোনো লক্ষ্য ছিলনা। আজও নেই। কবি আবুল হাসানের ভাষায় বলতে হয়, ’আমি বুঝে গেছি আমার হবে না’। এজন্য আমার কোনো বেদনাও নাই। আমি যে তেমন কিছু হতে পারিনি এটাকে আমি বেশ উপভোগ করি! সবাই কিছু না কিছুু হতে চায়। বড় হতে চায়। আমি চাই না। সুনীলের কবিতার মতো বলতে হয়..আমি আর কত বড় হবো..! আমার বাবা ছিল না বলে মা-ই ছিল আমার কাছে সব। আজ বুঝতে পারি মা আমার জন্য কত কষ্ট সহ্য করেছেন। আমি ছিলাম খুউব দুরন্ত প্রকৃতির। আমার দুরন্তপনায় পাড়াপরশীরা অতিষ্ঠ ছিল। এজন্য মাকে অনেক অপ্রিয় কথা শুনতে হয়েছে। আমাদের পরিবারটা ছিল দানবের মতো বিশাল। অনেক আত্মীয় পরিজন নিয়ে আমাদের বসবাস। আমার বয়স যখন ঠিক পনেরো তখনই আমি আচমকা বদলে গেলাম। বিস্ময়করভাবে। কাউকে দেখে নয়, কেউ আমাকে কিছু বলেও নি। আমি হঠাৎ নির্জন হয়ে গেলাম। একাকী। বই হলো আমার সঙ্গী। আমার খেলার সঙ্গীরা হতবাক হলো। মা ভয় পেয়ে গেলেন! লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে পর্যবেক্ষন করেন!
আমি অপেক্ষা করছি। অবশেষে হকার বিচিত্রা নিয়ে এসেছে। আমি দ্রুত পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছি। এক জায়গায় এসে আমার চোখ আটকে গেলো! মুহুর্তে আমার শরীরের প্রতিটা শিড়া, উপশিড়া কেঁপে উঠল! আমি বই, পত্রিকা পড়তাম আর ভাবতাম মানুষ কিভাবে লেখে! আমি কী কখনও লিখব! আমার লেখা কী ছাপা হবে! মনে মনে উত্তর পাই, না ছাপা হবে না। তারপরও আমি একদিন সাহস করে বিচিত্রার চিঠিপত্র বিভাগে একটা চিঠি লিখে পাঠালাম। বিচিত্রা আসলে আমি আকুল হয়ে খুঁজতে থাকি আমার নাম। না কোথাও আমার নাম নেই। আমি আরো কয়েকটা চিঠি পাঠাই। অতপর একদিন আমাকে চমকে দিয়ে আমার চিঠি ছাপা হয়! আজও ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখলে খুশী লাগে।
আমার একটা ’ফ্লাইং পিজিয়ন’ নামে বাইসাইকেল ছিল। চাইনীজ। সেটা চালিয়ে শহর দাবড়ে বেড়াতাম। লেখা ছাপা হয়েছে কিন্তু কাউকে বলি না। কাকে বলব! আমাদের পরিবারে কোনো লেখালেখির লোক নেই। আমার এই আকুলতা তারা কী বুঝবে! আমার মনে হয়েছিল, আমার লেখা ছাপা হয়েছে, পুরো শহর বোধহয় আমার দিকে তাকিয়ে দেখছে! আমি বিভোর হয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে গিয়ে পড়লাম বাড়ির পাশের খালের মধ্যে! কী অবস্থা! সত্যি বলতে কী এই লেখাটার কথা যখন আমি ভাবছি তখনও আমি টরন্টোর রাস্তায় দু’বার ভুল পথে গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম। বরিশালের গন্ডিবদ্ধ জীবন থেকে আমি মুক্তির উপায় খুঁজতাম। সে এক অসম্ভব চিন্তা! বরিশাল বিএম কলেজে ভর্তি হয়ে আমি এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। ততদিনে আমার লেখা চিঠিপত্র বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হতে শুরু করেছে। আমি আসল পড়া বাদ দিয়ে গল্পের বই পড়ি, সিনেমা দেখি, পত্রবন্ধুদের চিঠির উত্তর লিখি। এতো চিঠি লিখতাম যে ডাক টিকেট কেনার মতো পয়সা ছিল না। আমি করলাম কি যারা আমাকে চিঠি পাঠাত তাদের চিঠি থেকে ডাকটিকেট খুলে কায়দা করে সেগুলোই আবার আমার চিঠিতে লাগিয়ে নিজেই পোষ্ট অফিসে ঢুকে সিল মেরে দিতাম। গ্রীনবাগ পোষ্ট অফিসের মানুষটি ছিলেন অতিশয় ভালো। বৃদ্ধ মানুষ। আমাকে স্নেহ করতেন খুউব।
শৈশবের সাদামাটা জীবনের কথা ভাবলে এখনও কেমন করে উঠে বুকের মধ্যে। কত সহজ সরল ছিল সেই জীবন। একটু বোকাও কি ছিলাম না তখন! ছিলাম। সামান্যতেই খুশী হতাম, আবার সামান্য কারণে কষ্টে বুক ভেঙ্গে যেতো। একবার একটা গাছ মরে যাওয়ায় আমি কেঁদেছিলাম। সামান্য একটা কলা গাছের জন্য আমার কত খারাপ লেগেছিল। গাছটা আমি লাগিয়েছিলাম। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে আামি গাছটার বেড়ে উঠা দেখতাম। একবার আমার ঘুড়ি কেটে দিয়েছিল আর একটা ঘুড়ি। ঘুড়িটা আমি চার আনা দিয়ে কিনেছিলাম। আমি অনেক দুরন্ত ছিলাম শৈশবে। অন্য পাড়া থেকে এসে দস্যুর মতো সাঁই করে আমার সুঁতোর উপর হামলে পরেছিল রাক্ষুসে ঘুড়িটা, একটু পর আমি টের পেলাম আমার নাটাইর সুতো আলগা হয়ে গেছে। আমার ঘুড়িটা আমাকে ছেড়ে মনের কষ্টে পাক খেতে খেতে দূরের আলখেতে লুটিয়ে পরছে। সে রাতে আমার ঘুম হয়নি কষ্টে। শৈশবের সারল্য মাখা দিনগুলো আর ফিরবে না। এখন কত জটিল জীবন যাপন করি আমরা। প্রতিটা পদে পদে কত কৌশল করি, কত হিসাব নিকাশ করে চলতে হয়। মুখে যা বলি তা মনের কথা না। কথা দিয়ে কথা রাখি না। বন্ধু না তাও বন্ধুত্বের ভান করি। প্রেম না তাও প্রেমের ভান করি। এইভাবে আমরা প্রতিদিন নিঃস্ব হই। আমাদের আবেগ ক্ষয় পেতে থাকে। প্রতিদিন আমরা টুকরো টুকরো হয়ে যাই। প্রতিদিন একটু একটু করে একা হতে থাকি। শৈশবের খেলার সাথীরা আর আজকের বন্ধুদের মধ্যে যোজন যোজন তফাত। তখন ঝগড়া হতো আবার একটু পরই মিলে মিশে যেতাম। রাগ চলে যেতো।
তখনতো আর স্যোশাল মিডিয়া ছিল না যে পাল্টা আক্রমন করব! কত খেলাধুলা করতাম। সহজ সরল খেলা। মার্বেল খেলেছি। দুই আঙ্গুলের মাথায় মার্বেল নিয়ে অন্য মার্বেলকে ঠুকে দেওয়ায় আমার জুড়ি ছিল না। সিগারেটের কাগজ দিয়ে চারা খেলতাম। আমার সাথে কেউই প্রায় পেরে উঠত না। সাইকেলের রিং চালাতাম। একবার আমার রিংটা চুরি হয়ে গেছিল। সেজন্য কত মন খারাপ হয়েছিল। চাইলেইতো আর একটা রিং যোগাড় করতে পারব না। সাইকেলের বেয়ারিং দিয়ে চার চাকার গাড়ি বানিয়ে চালাতাম। একজন ধাক্কা দিত আর আমি গড় গড় করে চলতাম। একবার পরে গিয়ে হাত পা ছড়ে গেছিল। যে ধাক্কা দিচ্ছিল তাকে একটা চর মেরেছিলাম। সেজন্য অনেক খারাপ লেগেছিল। আজকাল সেই সরলতাটা হারিয়ে গেছে। এখন আর সামান্যতে খুশী হইনা বা সামান্য কারণে কষ্টও পাই না। চারিদিকে এতো কষ্টের মতো ঘটনা ঘটছে, বিনে কারনেও কত মানুষ কষ্ট দেয়। এইসব কষ্ট এক সময় খুউব কষ্ট দিত এখন তার ধারটাই কমে গেছে। চারিদিকের এতো সব ঘটনাবলী আমাদেরকে আবেগশূন্য করে দিয়েছে। কষ্ট আর স্পর্শ করে না তেমন।
শৈশবের আমার বেশ কিছু সময় কেটেছে ঢাপর কাঠি, মামা বাড়িতে। বছরান্তে মায়ের সাথে যেতাম। এখনও মামা বাড়ির সেই সব স্মৃতি মনের মনি কোঠায় জ্বল জ্বল করে। কত ঘটানাইতো আমরা ভুলে যাই। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাও মনে রাখি না। আবার কত সামান্য ছিল তাও সহজে ভুলতে পারি না। একবার ভরা বর্ষার সময় হঠাৎ আমার বাড়ির জন্য মন খারাপ হলো। এদিকে স্কুল খুলে গেছে। স্কুলের বন্ধুদের জন্য মন খারাপ লাগে। মাকে বলি মা গা করে না। যেনো দু’একমাস স্কুল না করলে কিছু যায় আসে না। একদিন করলাম কি মাকে না বলেই বাড়িতে রওয়ানা হলাম। তিন ঘন্টার লঞ্চ জার্নি। আমার কাছে কোনো পয়সা নাই, একটা কলাপাতা মাথায় দিয়ে অনেক ধূর পথ হেঁটে হেঁটে লঞ্চঘাট এলাম। ভিজে একসা হয়ে গেছি। এসে দেখি জন মনুষ্যহীন লঞ্চঘাট। এই রকম দুর্দিনে কে আর ঘর থেকে বের হবে! হঠাৎ দেখি দূরে নদীর বাঁক ঘুরে লঞ্চটা উঁকি দিয়েছে। যেনো একটা দেবদূত আসছে। খুশীতে আমার বুকের মধ্যে ব্যাং লাফ দিল। আবার ভয় হচ্ছিল মাকেতো বলে আসিনি। মা কেঁদে কেঁদে মারাই যাবে। বর্ষার পানিতে ফুলে ফেঁপে উঠা সন্ধ্যা নদী দিয়ে লঞ্চটা যতই কাছে আসছিল ততই আমার ভয় বাড়ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লঞ্চটা ঘাটে ভিড়ল না। আমি কত হাত তুলে ডাকলাম শুনল না।
সব মানুষেরই কিছু না কিছু একটা বৈশিষ্ট থাকে। যাকে দিয়ে মানুষটাকে চেনা যায়। সবাই বলে ওই মানুষটা কত বড় পন্ডিত, কত বড় লেখক, কত বড় সম্পাদক, কত বড় সাংবাদিক, আর্টিষ্ট, পরোপকারী, ধার্মিক, মানুষটা কত বড় শিল্পী, দানবীর, শিল্পপতি, বড় রাজনীতিবিদ, ভাল প্রেমিক, মানুষটা সৎ বা মানুষটা অনেক বড় মাপের কবি। এভাবেই সবাই পরিচিতি পায়। স্মরনীয় বরনীয় হয়। এভাবেই আমরা যুগে যুগে একজনকে স্মরণ করি। জন্ম দিবস, মৃত্যুদিবস পালন করি। আমি যখন একটু একটু বুঝতে শিখছি তখন আমি মনে মনে ভাবতাম এইসব মানুষরা কেমন! এইসব মানুষদের কাছ থেকে দেখতে কেমন লাগবে! বরিশালের শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনে মাঝে মাঝে আমার বুকের মধ্যে ঢেউ উঠত। স্বপ্নের ভেলা ভাসাতাম। আমার কোনো সঙ্গী ছিল না। যখন আমি শৈশব অতিক্রম করছি তখন আমি আকিস্মক নির্জন হয়ে গেলাম। তখন অদ্ভুত সব চিন্তা আমার মাথায় জট পাকাতে লাগল। বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরী থেকে বই এনে পড়তাম আর আমার ছ্ট্টে জগতটা ক্রমশঃ স্বপ্ন আর কল্পনায় ভরে যেতে থাকল। আমি যদি লাইব্রেরীতে না যেতাম তাহলে আমি যে একটা বাড়তি মানুষ সেই বোধটা আমার জন্মাত না।
আমি তখন প্রায়ই আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম প্লেনটা কিভাবে আকাশে ভেসে থাকে! আমি কি কোনোদিন পে¬নে চরব! উত্তর পেতাম কখনো চরব না। মানুষ কিভাবে এতো বড় বড় বই লেখে! এতোসব ঘটনাবলী মাথায় কিভাবে ধারন করে! কিভাবে মানুষ কবিতা লেখে! কিভাবে এতো সুমধুর কন্ঠে গান করে! সঙ্গীত জিনিসটা কে আবিষ্কার করল! অভিনয়ই বা কিভাবে করে! সেলুলয়েডের ফিতায় ভেসে ওঠে নানা রঙের মানুষ। সিনেমার রঙিন পর্দায় সুন্দর নারীদের দেখে আমি অভিভূত হই। নিজেকে হারিয়ে ফেলি।
আচ্ছা সারেং কেমন করে লঞ্চ চালায়! প্রবল স্রোতের মধ্যে মাঝি কিভাবে নৌকার হাল ধরে থাকে তাও এক আশ্চর্যের ব্যাপার। আমি কি এরকম নৌকা চালাতে পারব! একজন স্ট্র্ইাকার যখন ড্রিবলিং করে নিপূণভাবে গোলপেষ্টে বল ফেলে তাও অবাক কান্ড। বাই সাইকেল জিনিসটাও কত ভাল! স্বাধীনভাবে ঘোরা যায়। একটা বাইসাইকেল থাকা কম বড় ব্যপার না। লাইব্রেরীতে পত্রিকা পড়তাম আর ভাবতাম সাংবাদিকরা রিপোর্ট লেখে কিভাবে! এতো সোর্স কোথায় পায়! ছাত্ররা এতো পড়াই বা মনে রাখে কিভাবে! পরীক্ষায় ফার্ষ্ট হওয়া কি চাট্টিখানি কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভার্তি হওয়ার আগে আমি জানতামই না ’অনার্স’ কি! ভর্তি পরীক্ষায় আমি কোনোদিন পাশ করবো না।
ছোটবেলায় মাঝে মাঝে আমার মেঝ ভাইয়ের সাথে বাজারে যেতাম। বাংলাবাজার নাম ছিল বাজারটির। যেনো আমি বাজার করাটা শিখি তাই আমাকে নিয়ে যেতো। মা আমাকে কখনো একলা বাজারে পাঠাত না। তার ধারণা ছিল আমি এসব কিছ্ইু পারব না। ভুলভাল কিনে নিয়ে আসব। দু’একবার এমন হয়েছেও। আজও আমি বাজারের কথা শুনলে আঁতকে উঠি। এখনও বাজারে গেলে জেসমিনের পিছন পিছন ট্রলি নিয়ে ঘুরি। আমি কিছু পছন্দ করলে জেসিমন বলবে তোমার চয়েস জঘন্য! আমি আমার নিজের কাপর চোপরও ঠিকঠাক মতো কিনতে পারি না। এমনকি কাপড় নির্বাচনেও আমার পরামর্শ দরকার হয়। বাজার করার মতো তুচ্ছ কাজও যে পারে না।
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মহসিন হলের ছয় তালায় থাকি। ৬৫৫ নম্বর রুম। সিঙ্গল রুম। নির্জন দুপুরে এই রুম থেকে প্রায়ই বাবুপুরা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। গাড়ি চলাচল দেখতাম। তখন ঢাকার রাস্তায় এতো দামী দামী গাড়ি চলত না। জাপানী গাড়ির পাশাপাশি কিছু কোরিয়ান এবং মালয়েশিয়ান গাড়ি চলতো। প্রোটন সাগা নামে একটা মালয়েশিয়ান গাড়ি চলতো তখন। কেনো যেনো নামটা আমার খুউব পছন্দ হলো। তখন থেকেই আমি ভাবতাম আচ্ছা আমি কী কোনোদিন গাড়ি চালাবো? ওই রকম গাড়ি হবে কখনো আমার? গাড়ি ড্রাইভ করবো আর আমার পাশে বসে থাকবে রূপসী কোনো মেয়ে, আমার প্রেমিক। সে গুন গুন করে নজরুলের গান গাইবে আর আমি চলে যাবো বহুদূর তাকে নিয়ে। তার হাত ধরব, চুলের ঘ্রান নেবো বা গালে হাত ছুয়ে দেবো। চলে যাব পাখী ডাকা কোনো নির্জন জায়গায় অথবা সমুদ্রের কাছে। সুমুদ্রের ফেনিল উচ্ছাস দেখব আর বাতাসে তার লম্বা চুল উড়ে লুটিয়ে পরবে চোখে মুখে। আমি মুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য দেখব।
সেই স্বপ্ন আমার পূরন হয়নি। ওই রকম আর্থ সামাজিক অবস্থায় ওসব স্বপ্নই থেকে যায়। সেসময় সকালে খেলাম তো দুপুরে খাওয়া জুটবে কিনা তা নিয়েই ছিল শঙ্কা। তার পর অনেক বছর পার হয়েছে। ১৯৯৪ সাল। একবার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড-এ দাঁড়িয়ে আছি। সময়টা সকাল। অফিসে যাবো। আগের রাত থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল। তখনও ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে। হাতে একটা ছাতা। রাস্তায় পানি জমে গেছে। পরনে সদ্য স্ত্রি করা জামা প্যান্ট। বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ একটা প্রাইভেট কার হুস করে আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেলো। পিছনের সীটে বসা এক তরুনী মাথা বের করে আমার করুন অবস্থা দেখে ফিক করে হেসে ফেললো। ধনীর রপসী কন্যার কেমন রসিকতা এটা! সেই ঘটনাটা আমি খুব মনে রেখেছি..।
পরের বছর একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন অফিসে যেতে দেরী হয়েছিল বলে বসকে কৈফিয়ত দিতে হয়েছিল। এর কয়েক মাস পর একদিন বসের পাশে বসে গাড়িতে যেতে যেতে তিনি বললেন, জসিম তুমি ড্রাইভিং জান? আমি বললাম না স্যার। তিনি বললেন ড্রাইভিংটা জানা দরকার। ভাল ড্রাইভিং জানলে কখনো না খেয়ে থাকবা না। এ কথার মানে কি! আমি কী ড্রাইভার হবো নাকি! তবে আমি সত্যি সত্যি ড্রাইভিংটা শিখলাম। মহাখালীর বাবুল নামের একজন লক্করমার্কা একটা টয়োটা গাড়ি দিয়ে অতি তাচ্ছিল্যের সাথে আমাকে গাড়ি চালানো শিখালো। সে বলল, আফনে গাড়ি চালানো শেখেন ক্যান! আমি বললাম এমনি। তার ধারনা হয়েছিল আমি হয়ত রেন্ট-এ কার চালাব। বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স পেলাম। অরিজিনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স। ড্রাইভিং টেষ্টে পাশ করা সত্বেও ইন্সপেক্টরকে দুশ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছিল। এরপর একদিন গাড়ি চালানো বা লাইসেন্সের কথা ভুলে গেলাম।
১৯৯৫ সাল। সম্ভবতঃ সেটা ছিল এপ্রিল মাস। একদিন আমার বস আমাকে একটা কার্ড দিয়ে বললেন, যাও এর সাথে দেখা করো। সেটা ছিল ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডে একটি গাড়ির শো রুম। আমি সেখানে গেলাম। শোরুমের মালিক আমাকে দেখে হাসলেন। চা খেতে দিলেন। তারপর আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে একটা চাবি দিয়ে বললেন এই গাড়িটা নিয়ে যান। আমি বললাম মানে কি! তিনি বললেন এটা আপনার গাড়ি। সেটা ছিল একটা সাদা রঙের ঝক ঝকে টয়োটা স্টারলেট গাড়ি। চার দরজার গাড়ি। আমার জীবনের প্রথম গাড়ি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বস কেনো সেদিন বলেছিলেন ভাল ড্রাইভিং জানলে না খেয়ে থাকতে হবে না! এর উত্তর অনেক পরে জেনেছি। তখন বস কিভাবে বুঝেছিলেন যে আমি একদিন বিদেশে চলে যাব! আমি কানাডা এসেছি ২০০৩ সালে। আর তিনি কথাটা বলেছিলেন ১৯৯৪ সালে। কানাডা এসে চাকরির জন্যে হন্যে ঘুরছি। সারভাইভতো করতে হবে। থাকি অটোয়া। এসেই প্রথম যেটা করলাম এখানকার লাইসেন্স নিলাম। জি ২। এইসব দেশে গাড়ির লাইসেন্স অনেক ইম্পরট্যান্ট। সবচেয়ে বড় আইডি। কিছুতেই যখন কাজ খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন একজন বুদ্ধি দিল একটা গাড়ি কিনে পিজা ডেলিভারি করো। আমি হোন্ডা একর্ড নামে একটা ইউজড গাড়ি কিনলাম। এবং তখনই মনে পরল সেই অমোঘ বানী ‘ভাল ড্রাইভং জানলে কখনো না খেয়ে থাকতে হয় না।
আমার বয়স দশ এগার বছর হবে। সে সময় আমি প্রতি বছর মায়ের সাথে ঢাপর কাঠি যেতাম। বরিশাল থেকে লঞ্চে যেতে হতো। আমার বোন সাজু আমি আর মা যেতাম। বরিশাল থেকে দুপুর বারোটায় লঞ্চটা ছাড়ত। ঠিক চারটায় লঞ্চটা ঢাপরকাঠি ঘাটে ভিড়ত। আমি সবসময় লঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। হেল্পার আমাকে বারবার পিছনে চলে যেতে বলত। সেফটির জন্য হয়তবা। যদি আমি নদীতে পড়ে যাই! মাও বারবার বলত জসিম ভিতরে আয়। আমি তাও যেতে চাইতাম না। ছোট ছোট ঢেউ ভেঙ্গে কিভাবে লঞ্চটা যায় সেটা আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। তারপর ঢেউটা বড় হয়ে পাড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ে। ছোটছোট নৌকোগুলো কেমন দোল খেতে থাকে, নদীতে নাইতে নামা ছোটছৈাট বাচ্চারা কেমন উচ্ছসিত হয়, গ্রামের বধুরা তাদের কাঁখের কলসী কিভাবে সামাল দেয় সেসব চোখভরে দেখি আমি।
সারেং লঞ্চটাকে কেমন নিখুঁতভাবে কন্ট্রোল করে অবাক লাগে। লঞ্চের ককপিঠ থেকে দড়িতে টান দিলে নিচে ইঞ্জিনরুমে ঘন্টি বেজে ওঠে। কোন ঘন্টায় কি সংকেত তা ইঞ্জিনরুমের মাষ্টার বুঝতে পারে। কখন স্পীড দিতে হবে, কখন ব্যাকে যেতে হবে সব বোঝা যায়। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম বড় হয়ে আমি সারেং হবো। সাধারণতঃ শীতের সময় যেতাম আমরা। আমাদের অনেক ধানপান হতো। সেগুলো তদারকির জন্যই মাকে যেতে হতো। নানা নানীকে আমি দেখিনি। আমি আমার দাদা দাদীকেও দেখিনি। আমি কি একটু ভাগ্যাহত! কে জানে তখন এসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি। লঞ্চটা যখন ঘাটে ভিড়ত তখন প্রায় বিকেল। লঞ্চের সুকানি সিঁড়ি ফেলত এবং একটা লগি দিত ধরে ধরে নামার জন্য। লঞ্চ থেকে নেমে এমন ভাল লাগত। চার ঘন্টার জার্নি হলেও মনে হতো কতদূর দেশে এসে পরেছি। সামনেই সবুজ ক্ষেত। কলাই আর শর্ষেফুল। কয়েকদিন আগেই আমন ধান উঠে গেছে। সেখানে শর্ষে বোনা হয়েছে।
আমরা এক মাইল দেড় মাইল ধানি জমির ভিতর দিয়ে আইল ধরে হেঁটে মামাবাড়ি চলে যেতাম। আমার তিন মামা ছিল। মামারা তালুকদার বংশ বলে একটু দাপুটে ছিল তল¬াটে। আমরা শহর থেকে এসেছি আমাদের অন্যরকম খাতির ছিল। তিন মামার অগুনিত ছেলে মেয়ে। বিশাল বাড়ির মধ্যে আমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকি। সববয়সী মামাত ভাইদের সাথে খেলা করি। কারো কারো সাথে মারামরি লাগে ছোটখাটে ব্যাপার নিয়ে। কেউ কেউ আমাকে ঈর্ষা করে। তার কারণ সবমবয়সী মামাত বোনরা আমাকে ঘিরে থাকে। একটু বড়রা আমার গাল টেনে দেয় অকারনে। আমি দেখতে নাদুস নুদুস ছিলাম বলে এই অত্যাচার সহ্য করি। শীতের রাতে খেজুর গাছের হাড়ি থেকে রস পেরে খাই। ফ্রেস কাচা রস। তালগাছে এক ধরণের পাতা হতো তা দিয়ে ঘুড়ি উড়াই। আর শীতের রাতে সেদ্ধ ধানের যে পালা করা হতো তার মধ্যে টং বানিয়ে ওম ওম গরমে ঘুমাই। আহা ওরকম সুন্দর বিছানায় আর কোনোদিন ঘুমাইনি।
ছোটবেলায় আমি খুব ঘুড়ি পাগল ছিলাম। যখন ঘুড়িগুলো আকাশে ছোটাছুটি করত তখন আমার মধ্যে অদ্ভুৎ একটা শিহরন হতো। ওই মুক্ত নীলাকাশে ঘুড়ি উড়ছে! আহা মানুষের জীবন যদি ওরকম হতো! শুধু উড়তো! একবার একটা ঘুড়ি ছিল আমার, ঘুড়িটা আমি কিনিনি। কোথা থেকে ঘুড়িটা বোকাট্টা হয়ে বাঁক খেতে খেতে আমাদের ঘরের চালের উপর আছড়ে পড়ল। আমি সবসময় নজর রাখতাম কখন কোথা থেকে কেটে যাওয়া ঘুড়ি আসবে। ঘুড়িটাকে আমি লুফে নিলাম, সাথে পেলাম মাঞ্জা দেওয়া সুতো। এরপর আমি ওই ঘুড়িটা নিয়ে মেতে উঠলাম। স্কুল থেকে এসেই ছুটে যাই মাঠে ঘুড়ি নিয়ে। মার বকা খাই, বাড়ির মুরুব্বিরা বলে বখে গেছি কিন্তু কে শোনে কার কথা! একবার কি হলো আমি ঘুড়িটার সুঁতো ছিড়ে দিলাম, মুক্তি দিয়ে দিলাম। দেখলাম ঘুড়িটা মুক্তির আনন্দে আকাশে কয়েকটা ডিগবাজি খেলো, তারপর হেলেদুলে রাজকীয় ভঙ্গিতে আরো দুর আকাশে হারিয়ে যেতে থাকল। একসময় ওটা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো। ঘুড়িটার জন্য এখনও আমার মন খারাপ লাগে!
আমি নিজেও একটা ঘুড়ি। একদিন আমি বাড়িতে গেছি। মা তখন অসুস্থ্য। খুব অসুস্থ্য। আমি মায়ের পাশে বসে থাকি। কখন মা কিছু বলবে সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করি। মাঝে মাঝে মা আমাকে চিনতে পারে না। একটা চেতন ও অবচেতনের মধ্যে মা। একদিন বলল, তুমি জসিম না! আমি হ্যাঁ বলি। মা শিশুর মতো আমার হাত শক্ত করে ধরে থাকে। আমি জল ভরা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। মা একদিন বলল, তুমি হইলা একটা পাখী এই দেখি, এই দেখি না। আমার পাখী উড়াল দিয়া চইলা যায়.. এই বলে মা কাঁদে। পাখীরা স্বাধীন, যেখানে মন চায় সেখানে চলে যায়। কিন্তু ঘুড়ি তা পারে না। ঘুড়িকে আপাতঃ স্বাধীন মনে হলেও সে স্বাধীন না। ঘুড়ি যতই উড়ে বেড়াক, ঘুড়ে বেড়াক নাটাই থাকে অন্যের হাতে। আমার নাটাইটাও তাই। যতই উড়ে বেড়াই, যতই প্রতিপক্ষের রাক্ষুশে ঘুড়িরা আমার উপর হামলে পড়ে ছিঁড়ে খুঁড়ে দিতে চাক আমাকে, সে শক্ত হাতে ধরে রাখে নাটাই।
জসিম মল্লিক, লেখক ও সাংবাদিক
টরন্টো