টরেটক্কা টরন্টো

চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -১৯

কাজী সাব্বির আহমেদ

সম্প্রতি রয়্যাল কানাডিয়ান এয়ারফোর্সের একটি লকহিড সিপি-১৪০ অরোরা সিরিজের মেরিটাইম প্যাট্রল বিমান চীনের কোস্টাল এরিয়ার কাছাকাছি আন্তর্জাতিক জলসীমার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় দুইটি চীনা ফাইটার জেট প্যাট্রল বিমানটির পথরোধ করার জন্য দ্রুত এগিয়ে আসে। তার মধ্যে একটি ফাইটার জেট বিপদজনকভাবে কানাডার প্যাট্রোল বিমানের পাঁচ মিটার দূরত্বে চলে আসে। যদিও কোন সংঘর্ষ হয়নি তবে চীনা ফাইটার জেটের এই ম্যানুভার ছিল অত্যন্ত বিপদজনক। রয়্যাল কানাডিয়ান এয়ারফোর্সের এই প্যাট্রল বিমানটি উত্তর কোরিয়ার উপর আরোপিত স্যাংকশন সঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে কিনা সেটা নজরদারি করার কাজে ইউএন-এর পক্ষ থেকে নিয়োজিত ছিল। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ ই অক্টোবর (২০২৩ সাল) তারিখে কানাডার ডিফেন্স মিনিস্টার বিল ব্লেয়ার তীব্র ভাষায় চাইনিজ এয়ারফোর্সের এই বিপদজনক এবং বেপরোয়া কর্মকান্ডের জন্য চীনকে অভিযুক্ত করেন। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকাসহ অন্যান্য পশ্চিমা ঘরানার পত্রিকাগুলি শুধুমাত্র বিল ব্লেয়ারের বক্তব্যকে তুলে ধরে। কিন্তু সিঙ্গাপুর ভিত্তিক ‘দ্য স্ট্রেইটস টাইমস’ পত্রিকাতে উঠে আসে এই একই ঘটনার ব্যাপারে চীনের বক্তব্য। সেখানে চাইনিজ ফরেন মিনিস্ট্রির মুখপাত্র মিস মাউ নিং-এর বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয় যে কানাডার মিলিটারি প্লেনটি বেআইনিভাবে চীনের ‘চিওয়েই ইউ’ দ্বীপের আকাশ সীমায় ঢুকে পড়াতে চীন তার সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার খাতিরে বাধ্য হয় প্লেনটিকে তাড়া করার জন্য। চীন মনে করে কানাডার এই কর্মকান্ডটি ছিল ইচ্ছাকৃত এবং উস্কানীমূলক। নিকট অতীতেও কানাডা একই রকম উস্কানীমূলক আচরণ করেছে। উল্লেখ্য যে, কানাডার পাশাপাশি আমেরিকার সার্ভেলান্স প্লেনও যখন চীনের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তখন চীনা এয়ারফোর্সের ফাইটার জেট একইভাবে তাদের পথরোধ করে দাঁড়ায়। এই বছরের মে মাসে আমেরিকার পেন্টাগনের মুখপাত্র কানাডার ডিফেন্স মিনিস্টার বিল ব্লেয়ারের মতন একই অভিযোগ করেছিলেন। সাউথ চায়না সী-র আন্তর্জাতিক জলসীমার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় আমেরিকার আরসি-১৩৫ সিরিজের একটি সার্ভেলান্স প্লেনকে চাইনিজ এয়ারফোর্সের একটি জে-১৬ ফাইটার জেট পথরোধ করে। ফলে আমেরিকার প্লেনটি ঝুঁকিপূর্ণ কোর্স ধরে উড়তে বাধ্য হয়। পেন্টাগনের সেই মুখপাত্রটি বলেন যে চাইনিজ এয়ারফোর্সের এই অহেতুক আক্রমণাত্মক ম্যানুভার অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু ওয়াশিংটনস্থ চীনা দূতাবাসের মুখপাত্র লিউ পেংইউ বলেন যে সাউথ চায়না সী-তে আমেরিকার জাহাজ এবং সার্ভেলান্স প্লেনের অনাবশ্যক আধিক্য চীনের সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন যে, চীন তার সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই নিবে এবং একই সাথে তিনি আমেরিকাকে সাউথ চায়না সী এলাকায় উস্কানীমূলক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেন। এখানে উল্লেখ্য যে সাউথ চায়না সী-র জলসীমার ভাগবন্টন নিয়ে মালেয়শিয়া, ভিয়েতনাম এবং চীনের ভেতর মতবিরোধ দীর্ঘদিনের। এরই সূত্র ধরে অতি সম্প্রতি সাউথ চায়না সীতে অবস্থিত ‘স্কারবোরো শোল’-এর আধিপত্য নিয়ে চীন এবং ফিলিপিন্সের ভেতর এক টান টান উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। চীন কেন সাউথ চায়না সী-র এই বিতর্কিত জলসীমাতে তার আধিপত্যের ব্যাপারে আপোষহীন সেটা বুঝতে হলে আমাদেরকে প্রথমে জানতে হবে কেন এই সমুদ্র অঞ্চল চীন কিংবা অন্যান্য দেশের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ।

চীনের দাবীকৃত নাইন ড্যাশড লাইন দ্বারা চিহ্নিত সাউথ চায়না সী-র সমুদ্র অঞ্চল (ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

হিন্দু পুরাণে বর্ণিত আছে যে দুর্বাসা মুনির কোপানলে পড়ে দেবতারা এক সময় ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। দেবতাদের এই দুরাবস্থার সুযোগ নিয়ে অসুরেরা তাদেরকে যুদ্ধে আহ্বান করে। সেই যুদ্ধে ক্ষমতাহীন দেবতাদেরকে সহজেই পরাজিত করে অসুরেরা সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রণ হস্তগত করে ফেলে। অসহায় দেবতাকূল তখন তাদের নেতা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলে তিনি তাদেরকে পরামর্শ দেন যে অসুরদের সাথে আঁতাত করে সমুদ্রমন্থনে নামতে হবে। অসুরদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দিতে হবে যে এই সমুদ্রমন্থনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অমৃত দেবতাকূল এবং অসুরেরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিবে। কিন্তু বিষ্ণু দেবতাদেরকে নিশ্চয়তা দেন যে, তিনি ষড়যন্ত্র করে এমন ব্যবস্থা করবেন যাতে সেই অমৃত শুধু যেন দেবতাদের ভাগেই পড়ে। তারপর শুরু হয় সমুদ্রমন্থনের বিরাট কার্যক্রম। ক্ষীরসাগরে সংঘঠিত এই সমুদ্রমন্থন প্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল। এই প্রক্রিয়ায় মন্দার নামক একটি পর্বতকে মন্থনদন্ড হিসেবে এবং শিবের সঙ্গী বাসুকী নাগরাজকে মন্থনরজ্জু হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সমুদ্রমন্থনের ফলে বিভিন্ন অমূল্য রত্নাদি সহ অমৃত উঠে আসলেও বাসুকী নাগের বিষোদগারে বেরিয়ে আসে মরণঘাতী বিষ হলাহল যা কিনা সমস্ত সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। অর্থাৎ সমুদ্রে নিমজ্জিত অগাধ সম্পদ আহরণ যাকে আমরা ‘ব্লু ইকোনমি’-র উৎস বলে থাকি তা কখনই সহজলভ্য, নিস্কন্টক কিংবা নিরাপদ ছিল না। এর সাথে জড়িয়ে আছে কূটনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষতা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এর প্রমাণ মেলে। দক্ষিণ তালপট্টি বা পূর্বাশা দ্বীপের মালিকানা নিয়ে এক সময় বাংলাদেশ ভারতের সাথে কূটনৈতিক এবং সামরিক বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়ে। ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের পর বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনার দুই কিলোমিটার দূরত্বে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ জেগে উঠে। বাংলাদেশের শ্যামনগর উপজেলার তালপট্টির দক্ষিণে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশ এই দ্বীপের নাম দেয় ‘দক্ষিণ তালপট্টি’, অপরদিকে ভারত এর নাম দেয় ‘দ্য নিউ মুর আইল্যান্ড’ বা ‘পূর্বাশা দ্বীপ’। ১৯৭৪ সালে আড়াই হাজার বর্গমিটার আয়তনের এই দ্বীপটির অস্তিত্ব ধরা পড়ে আমেরিকান এক স্যাটেলাইটের ছবিতে। পরে রিমোট সেন্সিং সার্ভের মাধ্যমে দেখা যায় যে দ্বীপটির আয়তন ক্রমশই বাড়ছে এবং এক পর্যায়ে এর আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার বর্গমিটার। দ্বীপটির মালিকানা বাংলাদেশ দাবী করলেও ১৯৮১ সালে ভারত সেখানে সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে তাদের পতাকা ওড়ায়। ভারতের যুক্তি ১৯৮১ সালের আন্তর্জাতিক জরীপ অনুযায়ী দক্ষিণ তালপট্টির পূর্ব অংশটির অবস্থান ভারতের দিকে যা ১৯৯০ সালের ব্রিটিশ অ্যাডমিরালটি চার্টেও স্বীকৃত। ১৯৮৫ সালে উড়িরচরের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের পর দ্বীপটি আস্তে আস্তে আবার সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যেতে শুরু করে। ২০০৮ সালে ভারতের করা এক গবেষণাতে বলা হয় ‘দ্য নিউ মুর ইজ নো মোর’ (নিউ মুর দ্বীপের অস্তিত্ব আর নেই)। দ্বীপটি বর্তমানে দুই মিটার সমুদ্রতলে নিমজ্জিত। ২০১৪ সালে ৭ই জুলাই আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায় অনুযায়ী দ্বীপটি ভারতের সমুদ্রসীমাতে পড়েছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কখনও যদি দ্বীপটি জেগে উঠে তবে সেটি হবে ভারতের। দক্ষিণ তালপট্টি নিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে মীমাংসা আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের মাধ্যমে হলেও বর্তমান সময়ে চলমান সাউথ চায়না সী নিয়ে বিরোধে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত তেমন কোন ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বরং সেখানে বিশ্বের বড় বড় শক্তিগুলি বিশেষ করে চীন এবং আমেরিকা যেভাবে তাদের আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা করা জন্য কূটনৈতিক, সামরিক এবং টেকনোলজির বিরামহীন প্রতিযোগিতাতে লিপ্ত হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে যে হিন্দু পুরাণের সেই সমুদ্রমন্থনের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। চীনের সীমান্ত নিকটবর্তী সাউথ চায়না সী, ইস্ট চায়না সী এবং ইয়েলো সী অঞ্চলে অর্থাৎ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য বিস্তার আমেরিকা এবং তার দোসরদের শিরপীড়ার একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

সাউথ চায়না সী-র যে সমুদ্র অঞ্চল নিয়ে বিরোধ রয়েছে তার আয়তন হচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন স্কোয়ার কিলোমিটার। এই অঞ্চলে রয়েছে বেশ কিছু দ্বীপপুঞ্জ এবং অসংখ্য শোল (সমুদ্রের মাঝে জেগে উঠা চর যা অগভীর পানিতে নিমজ্জিত)। এর মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে স্প্রাটলি এবং পারাসেল দ্বীপপুঞ্জ। মূলত গত ষাট বছর ধরে এই সব দ্বীপপুঞ্জ এবং শোলগুলির মালিকানা নিয়ে চীন, ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়া, মালেয়শিয়া, ফিলিপাইন্স, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনামের মধ্যে রয়েছে বিরোধ। এই সমুদ্র অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এই অঞ্চলটি একদিকে যেমন পৃথিবীর ব্যস্ততম শিপিং রুট আবার অপরদিকে এখানে রয়েছে অগাধ খনিজ ও মৎস্য সম্পদ। জাতিসংঘের দেয়া তথ্য অনুসারে ২০১৬ সালে সমগ্র বিশ্বের মোট  বাণিজ্যিক পরিবহনের শতকরা একুশভাগ পরিবহনই এই রুটের মাধ্যমে হয়েছে। প্রতি বছর আনুমানিক ৩.৩৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের গ্লে­াবাল ট্রেড সম্পন্ন হয় এই শিপিং রুটের মাধ্যমে। ১৯৬৮ সালে প্রথম এই সমুদ্র অঞ্চলে খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ে করা সার্ভের মাধ্যমে জানা যায় যে এই অঞ্চলের ভেতর মজুদ রয়েছে আনুমানিক এগারো বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল এবং ১৯০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস। ফলে এই বিপুল পরিমান খনিজ জ্বালানিকে করায়ত্ত করার জন্য সত্তুর দশক থেকে বিভিন্ন দেশ এই সমুদ্র অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন দ্বীপের মালিকানা দাবী করা শুরু করে। ১৯৭০ সালে ফিলিপাইন্স এই সমুদ্র অঞ্চলের তিনটি দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা শুরু করে। ফিলিপাইন্সের দেখাদেখি ১৯৭৩ সালে ভিয়েতনাম অন্য পাঁচটি দ্বীপের দখল নিতে সেখানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। ১৯৭৬ সালে স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের কাছে ফিলিপাইন্সের পালায়ান কোস্টে প্রথম তেল পাওয়া যায় যেখান থেকে আহরিত তেল থেকে বর্তমানে ফিলিপাইন্সের মোট জ্বালানি চাহিদার শতকরা ১৫ ভাগ মিটানো হয়। স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের আশেপাশে তেলের মজুদ সবচেয়ে বেশী এই ধারণা থেকে শুরু হয় এই দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপের মালিকানা নিয়ে বিরোধ। এছাড়াও পারাসেল দ্বীপপুঞ্জ এবং স্কারবোরো শোল-এর মালিকানা নিয়েও বিরোধ চরমে উঠে কারণ এই দ্বীপগুলির চারিদিকে রয়েছে খনিজ জ্বালানি এবং মৎস্য সম্পদের বিপুল ভাণ্ডার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে স্প্রাটলি এবং পারাসেল দ্বীপপুঞ্জ জাপানের দখলে ছিল। সেই সময় স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জকে “সিন-নান ছুনতাও” বা নিউ সাউদার্ন দ্বীপপুঞ্জ নামে অভিহিত করা হত। পারাসেল দ্বীপপুঞ্জ এবং নিউ সাউদার্ন দ্বীপপুঞ্জ উভয়েই তখন জাপানের কলোনী তাইওয়ানের অধিকারে ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পনের ঠিক পরপরই ১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাসে এই দুইটি দ্বীপপুঞ্জের দখল পুনরুদ্ধার করার জন্য ‘রিপাবলিক অব চায়না’ সেখানে তার নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠায়। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জকে চাইনিজে “নান-শা ছুনতাও” বা দক্ষিণের বালুকাময় দ্বীপপুঞ্জ  এবং পারাসেল দ্বীপপুঞ্জকে “শি-শা ছুনতাও” বা পশ্চিমের বালুকাময় দ্বীপপুঞ্জ বলা হয়। ‘রিপাবলিক অব চায়না’-এর নৌবাহিনী স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় দ্বীপ ‘ইতু আবা’-কে তাদের জাহাজের নামানুসারে ‘তাইপিং দ্বীপ’ নাম দেয় এবং সেখানে তাদের ঘাঁটি তৈরি করে। বলা যেতে পারে সেটাই ছিল এই বিতর্কিত সাউথ চায়না সী অঞ্চলে চায়নার প্রতিষ্ঠিত প্রথম সামরিক ঘাঁটি। তাদের এই ঘাঁটি স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই দুইটি দ্বীপপুঞ্জকে যাতে ফরাসীরা দখল করে না নিতে পারে। এই সময় রিপাবলিক অব চায়না ‘নাইন-ড্যাশড’ অথবা ‘ইলেভেন-ড্যাশড’ লাইন টেনে সাউথ চায়না সী থেকে একটি ইউ আকৃতির অঞ্চলকে চিহ্নিত করে সেটা তাদের অধিকারভুক্ত বলে ঘোষণা করে। ইউ আকৃতির এই অঞ্চলের ভেতর রয়েছে স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জ, পারাসেল দ্বীপপুঞ্জ এবং স্কারবোরো শোল। ১৯৪৯ সালে যখন মেইনল্যান্ড চায়না কম্যুনিস্ট পার্টির শাসনের অধীনে আসে তখন দেশটির নাম ‘রিপাবলিক অব চায়না’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’ বা ‘পিআরসি’ হয়। সেই সময় চীন সরকারের ফরেন মিনিস্টার ট্রৌ এনলাই ‘রিপাবলিক অব চায়না’-এর দাবীকৃত নাইন অথবা ইলেভেন ড্যাশড লাইন দ্বারা চিহ্নিত এলাকাকেই বর্তমান চীনের দাবীকৃত এলাকা বলে অনুমোদন করেন। এই অঞ্চলের দ্বীপগুলির অপর দাবীদার জাপান ১৯৫১ সালে ‘সানফ্রানসিসকো শান্তি চুক্তি’-এর কারণে তাদের দাবী প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু ‘রিপাবলিক অব চায়না’ কিংবা তাইওয়ান তাদের দাবী অব্যাহত রাখে যদিও তারা ১৯৫০ সালে তাইপিং দ্বীপ থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়। কিন্তু ১৯৫৬ সালে যখন টমাস ক্লোমা নামক ফিলিপাইনের একজন নাগরিক স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জ এলাকাতে ‘ফ্রিডমল্যান্ড’-এর ঘোষণা দেন তখন তাইওয়ান আবার তাইপিং দ্বীপে সৈন্য মোতায়েন করে। সেই থেকে আজ অবধি তাইপিং দ্বীপের দাবীদার তাইওয়ান। ১৯৭১ সালে তাইওয়ানের নৌবাহিনী ফিলিপাইন্সের এক ফিশিং বোটকে আক্রমণ করে ফলে একজন জেলে মারা যায়। তখন ফিলিপাইন্স এবং তাইওয়ানের মধ্যে শুরু কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়ন। ঘটনাক্রমে ১৯৭৪ সালে টমাস ক্লোমা বাধ্য হয়ে ‘ফ্রিডমল্যান্ড’-এর দাবী ছেড়ে দেয় ফিলিপাইন্সের সরকারের কাছে এক পেসোর বিনিময়ে। সেই সূত্র ধরে ১৯৭৮ সালে তদানীন্তন ফিলিপাইন্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মার্কোস দাবী করা শুরু করেন যে স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের সিংহভাগ দ্বীপই হচ্ছে ফিলিপাইন্সের অধিকারভুক্ত।

এদিকে ১৯৫৪ সালে তাইওয়ানের ন্যাশনালিস্ট সরকার তাদের প্রতিরক্ষা অবকাঠামোকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে কিনমান এবং মাতসু দ্বীপে সৈন্য মোতায়েন শুরু করলে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি সেখানে লাগাতার বোমাবর্ষণ শুরু করে। তাদের লক্ষ্য ছিল তাইওয়ানকে যুদ্ধে হারিয়ে আত্তীকরণ অর্থাৎ চীনের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলা। তাইওয়ানের এই দুঃসময়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে আমেরিকা। ‘কোল্ড ওয়ার’ চলাকালীন সময়ে আমেরিকার একটি বৈদেশিক নীতি ছিল কম্যুনিস্ট দেশগুলি যাতে তাদের প্রাধান্য বিস্তার করতে না পারে সেদিকে নজর রাখা। এই নীতিটি ‘পলিসি অব কন্টেইনমেন্ট’ নামে পরিচিত ছিল। এই নীতি অনুযায়ী চীন কর্তৃক আক্রান্ত তাইওয়ানের এই নাজুক পরিস্থিতিতে তাইওয়ানকে সাহায্য করা আমেরিকার জন্য জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। এই সময় আমেরিকার ‘জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ’ চীনের বিরুদ্ধে আনবিক অস্ত্র ব্যবহারের সুপারিশ করে। কিন্তু আমেরিকার তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আইসেনহোয়ার আনবিক অস্ত্র ব্যবহার কিংবা সৈন্য পাঠানো কোনটিতেই রাজী হননি। বরং তিনি তাইওয়ানকে চীনের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্য তাইওয়ানের সাথে ১৯৫৫ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত কার্যকরী একটি ডিফেন্স চুক্তি করেন যা ‘সাইনো-আমেরিকান মিউচুয়াল ডিফেন্স ট্রিটি’ নামে পরিচিত। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারীতে চীনের পিপলস লিবারেল আর্মি যখন চীনের ইস্ট কোস্টের কাছাকাছি তাইওয়ানের ইচিয়াংশান দ্বীপের দখল নিয়ে নেয় তখন এই ট্রিটি মোতাবেক আমেরিকা তাইওয়ানকে সাহায্য করার জন্য তার সৈন্য পাঠাতে তৎপর হয়। তবে প্রয়োজন হয় কংগ্রেসের অনুমতি। আমেরিকার কংগ্রেসের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টিটিভ এবং সিনেট উভয়েই যৌথভাবে সৈন্য পাঠানোর জন্য একটি রেজুলেশন পাশ করে যা ‘ফরমোসা রেজুলেশন’ নামে অভিহিত। এই ভাবেই শুরু হয় তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রথম সামরিক কার্যক্রম। আমেরিকার হস্তক্ষেপের মুখে চীন তখন তাইওয়ানের ইচিয়াংশান দ্বীপের দখল ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালের এপ্রিলে ইন্দোনেশিয়ার বানডোং শহরে অনুষ্ঠিত প্রথম ‘আফ্রো-এশিয়ান কনফারেন্স’-এ চীন তার ‘ফাইভ প্রিন্সিপলস অব পিসফুল কো-এক্সিস্টেনস’-এ উল্লেখ করে যে, আমেরিকার সাথে যুদ্ধে জড়াতে চীনের কোন অভিপ্রায় নেই এবং আলোচনার মাধ্যমে চীন ফার-ইস্ট অঞ্চলের তথা তাইওয়ানের আশে পাশের অঞ্চলের উত্তেজনা নিরসনে আগ্রহী। উল্লেখ্য যে, কালের বিবর্তনে এই ‘সাইনো-আমেরিকান মিউচুয়াল ডিফেন্স ট্রিটি’-এর মাধ্যমে আমেরিকা দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানকেও কম্যুনিস্ট চায়নার সামরিক হুমকি কিংবা আগ্রাসন থেকে রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়।

১৯৫৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরুর আগে স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের একটি অংশ ছিল চীনের নৌবাহিনীর দখলে আর বাকী অংশ ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের দখলে। যুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে ১৯৭৪ সালে যখন উত্তর ভিয়েতনামের জয় প্রায় অবধারিত তখন দক্ষিণ ভিয়েতনামের নৌবাহিনী স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত চাইনিজ নৌবাহিনীকে আক্রমণ করে বসে। সেই যুদ্ধে দক্ষিণ ভিয়েতনামের নৌবাহিনী হেরে যায়। ফলে গোটা স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জ চলে আসে চাইনিজদের দখলে। সেই সাথে দক্ষিণ ভিয়েতনামের ইয়াকোং দ্বীপ এবং ক্রিসেন্ট রীফও চীন দখল করে নেয়। এছাড়াও ১৯৮৮ সালে চীন ভিয়েতনামের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে জনসন রীফের দখল নেয়ার জন্য। একই বছরে অর্থাৎ ১৯৮৮ সালে চীন ইউনেস্কোর ইন্টারগভর্নমেন্টাল ওশোনওগ্রাফিক কমিশন থেকে সাউথ চায়না সী অঞ্চলে পাঁচটি অবজারভেশন পোস্ট বসানোর অনুমতি পায় যার একটি ছিল স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি অবস্থানে।  ১৯৯৪ সালে ফিলিপাইন্সের নিকটবর্তী মিসচিফ রীফও চীন দখল করে নেয়। অর্থাৎ সাউথ চায়না সী-র বিতর্কিত অঞ্চলের দখলদারিত্বের ব্যাপারে চীনের শক্তি প্রদর্শনের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই চলে। চীনের এই আগ্রাসী মূর্তিতে স্বভাবতই অন্যান্য দেশগুলি একই সাথে উদ্বিগ্ন এবং শংকিত হয়ে পড়ে। চীনকে প্রতিহত করার জন্য আসিয়ান দেশগুলি একজোট হয় এবং ২০০২ সালে তারা অর্থাৎ ব্রনাই, মালেয়শিয়া, ফিলিপাইন্স, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনাম ‘ডিক্লারেশন অব কনডাক্টস অব পার্টিস ইন সাউথ চায়না সী’ শিরোনামে চীনের সাথে একটি চুক্তি করে। ২০১১ সালের ২০শে জুলাই সেই চুক্তিটিকে নতুন করে রিভিউ করা হয় এই অঞ্চলের দখলদারিত্বের বিরোধিতা নিরসনের জন্য। যদিও তাতে তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানের ব্যাপারে চলমান বিরোধের কোন মীমাংসার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। বরং অবস্থা আরও জটিল আকার ধারণ করে যখন চীনের প্রতিপক্ষ ইন্ডিয়া এই বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। ‘ডিক্লারেশন অব কনডাক্টস অব পার্টিস ইন সাউথ চায়না সী’ চুক্তি নবায়নের ঠিক দুইদিন পর অর্থাৎ ২২শে জুলাই সাউথ চায়না সী-র এই বিরোধপূর্ণ এলাকাতে প্রবেশ করে ইন্ডিয়ান নেভীর একটি উভচর অ্যাসল্ট ভেসেল। ভেসেলটির গন্তব্য ছিল ভিয়েতনাম, কিন্তু তারা চাইনিজ নেভীর নজরদারিতে পড়ে যায়। তখন চাইনিজ নেভী ইন্ডিয়ান অ্যাসল্ট ভেসেলটিকে শুধু এই বলে সতর্ক করে দেয় যে তারা চীনের জলসীমায় প্রবেশ করেছে। কিন্তু এই ঘটনার দুই মাস পর অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে ইন্ডিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত অয়েল এন্ড ন্যাচরাল গ্যাস কর্পোরেশনের বিদেশ বিভাগ ঘোষণা করে যে ভিয়েতনামের সাথে তাদের একটি তিন বছর তিন বছর মেয়াদী চুক্তি হয়েছে যে তারা সাউথ চায়না সী অঞ্চলে ভিয়েতনামের সাথে যৌথভাবে তেল এবং গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রমে অংশ নিবে। অর্থাৎ দৃশ্যপটে প্রবেশ ঘটে ইন্ডিয়ার যা স্বাভাবিকভাবেই চীন সহজভাবে নিতে পারেনি। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

কলাম লেখক । টরন্টো