কানাডায় পারিবারিক সহিংসতা
খুরশিদ আলম
ভয়াবহ এক পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে গেল গত ২৩ অক্টোবর সোমবার রাতে অন্টারিওর Sault Ste. Marie শহরে। মর্মান্তিক এই ঘটনায় প্রাণ হারান ৫ জন। নিহতদের মধ্যে একজন খুনি নিজেই। তিনি একে একে চারজনকে হত্যা করার পর নিজেই নিজেকে গুলি করেন। তার বয়স ছিল ৪৪।
নিহত বাকি চারজনের মধ্যে একজন মহিলা এবং তিনজন শিশু। মহিলার বয়স ৪১ এবং শিশু তিনজনের বয়স ৬, ৭ এবং ১২।
খুনের ঘটনাটি ঘটে শহরের কাছাকাছি পৃথক দুটি বাড়িতে। স্থানীয় পুলিশ খবর পেয়ে প্রথমে মহিলার লাশ উদ্ধার করে একটি বাড়ি থেকে। এর কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় আরেকটি বাড়ি থেকে শিশুদের লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ খুনী ব্যক্তির সন্ধান পায় দ্বিতীয় বাড়িটিতেই। মারাত্মক আহত আবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু ঘটে।
তিন শিশুসহ এক মহিলার এই মর্মান্তিক মৃত্যু প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায় কানাডার প্রতিটি মানুষের মনে। স্তম্ভিত হয়ে যান সবাই এই ঘটনায়। পুলিশ সূত্রে জানা যায় পারিবারিক সহিংসতার দায়ে খুনী এই ব্যক্তিটি আগেও কয়েকবার অভিযুক্ত হয়েছিলেন।
এদিকে তিন দিন পার হয়ে গেলেও ঘটনার বিস্তারিত কিছুই জানা যায়নি এখনো। পুলিশও খুনি এবং খুনের শিকার ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করেনি এখন পর্যন্ত। গোয়েন্দা পুলিশ ঘটনার তদন্ত করেছে।
ভাবতে অবাক লাগে, কানাডার মতো একটি উন্নত সমাজ ব্যবস্থায়ও পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতি বছর অনেক মানুষ মারা যান। ‘কানাডিয়ানওম্যান.অরগ’ এর হিসাব মতে ২০২২ সালে কানাডায় ১৮৪ জন মহিলা ও মেয়ে মারা যান পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে। অবাক করার মতই তথ্য এটি। অথচ আমরা জানি নারীর অধিকার এদেশটিতে জোড়ালোভাবে সুরক্ষিত। নারী স্বাধীনতা এখানে গ্যারান্টিড। সমঅধিকারও সাংবিধানিকভাবেই নিশ্চিত করা আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীসভায় প্রায় অর্ধেকই নারী। ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার একজন নারী। অন্যান্য আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও নারী। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু পরিবারে নারী নির্যাতনের মত জঘন্য অপরাধ ঘটছে এ দেশটিতে। নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না কিছু ইমিগ্রেন্ট পরিবারের নারীরাও।
এইতো গত ১৭ অক্টোবর গ্লোবাল নিউজের এক খবরে বলা হয়, সাবেক স্ত্রীকে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার দায়ে টরন্টোর এক ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। নৃশংস এই হত্যাকান্ডটি ঘটেছে প্রকাশ্য দিবালোকে।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, প্রায় চার বছর আগে থার্শিকা জেগানাথন নামের এক ইমিগ্রেন্ট মহিলা বাস স্টপেজ থেকে হেটে বাসায় ফেরার পথে তার সাবেক স্বামী শশিকরণ থানাপালসিংহমের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে নিহত হন। জেগানাথন যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সেই বাসার মাত্র দুই শ গজ দূরেই নির্মম এই ঘটনাটি ঘটে। জেগানাথন বাস থেকে নেমে তার পরিচিত এক মহিলার সঙ্গে সেলফোনে কথা বলতে বলতে বাসায় ফিরছিলেন। আর তখনই আগে থেকে উৎ পেতে থাকা শশিকরণ অচমকা তার উপর ছুরি নিয়ে হামলা চালায়।
জেগানাথন আর শশিকরণের মধ্যে বিয়ে হয়েছিল ভরতে। পারিবারিক আয়োজনে এই বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালে। জেগানাথন এর জন্ম শ্রীলংকায় আর শশিকরণের জন্ম ভারতে। এর প্রায় বছরখানেক পরে ইমিগ্রেশনের যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে জেগানাথন কানাডায় আসেন ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। চোখে তার তখন নতুন স্বপ্ন। নতুন দেশে নতুন জীবন শুরু করবেন। নতুন সংসারে নতুন মানুষও আসবে একদিন। আরো কত কি স্বপ্ন। কিন্তু দুর্ভাগ্য জেগানাথনের। কানাডায় আসার তিন সপ্তাহের মাথায় স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়ে তার সব স্বপ্ন উলটপালট হয়ে যায়। নির্যাতনের খবর পেয়ে পুলিশ এসে শশিকরণকে গ্রেফতার করে। অপরদিকে জেগানাথন স্বামীর গৃহ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
পরবর্তীতে শশিকরণ জামিনে বেড়িয়ে আসেন। তবে শর্ত ছিল তিনি জেগানাথনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না এবং তার ধারে কাছেও ভিড়তে পারবেন না। কিন্তু শশিকরণ সে শর্ত ভঙ্গ করে একাধিকবার। ফলে ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্য তিনি তিনবার গ্রেফতার হন পুলিশের হাতে।
এ ভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর শশিকরণ ক্রমেই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেন। পরিকল্পনা করতে থাকেন জেগানাথনের উপর কি ভাবে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। অবশেষে ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দিনটিকে বেছে নেন শশিকরণ জেগানাথনের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। সেদিন জেগানাথনের বাসার কাছে (Ellesmere Road and Morrish Road) অবস্থিত বাস স্টপেজের নিকটে শশিকরণ অপেক্ষায় ছিল ছুরি নিয়ে। জেগানাথন কখন বাসায় ফিরে সেটি হয়তো সে আগে থেকেই পর্যবেক্ষণ করে আসছিল। সেভাবেই সে প্রস্তুুতি নেয় এবং সুযোগ বুঝে হামলা করে যা স্থানীয় একটি বাড়ির সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড হয়।
জেগানাথন সম্ভবত ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি যে শশিকরণ এভাবে ছুরি নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। ভাবলে হয়তো আরো সতর্ক থাকতেন এবং পুলিশকেও বিষয়টি জানাতেন।
বিচারের রায় প্রকাশের দিন বিচারক শশিকরণকে আদালতের সামনে কিছু বলার সুযোগ দিয়েছিলেন। এই সময় শশিকরণ বলেন জেগানাথনের আসল উদ্দেশ্য ছিল বিয়ের মাধ্যমে কানাডার সিটিজেনশীপ পাওয়া। আর এর জন্য সে আমাকে ব্যবহার করে। জেগানাথন আমাকে পছন্দ করতো না কারণ আমি গ্রাম থেকে এসেছি আর সে শহরের মেয়ে। শশিকরণ আরো জানান, জেগানাথন চলে যাওয়ার পর সে ডিপ্রেশনে ভুগে এবং অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়ে।
এরপর বিচারক শশিকরণকে উদ্দেশ্য করে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বলেন, ‘আপনি আপনার পরিবারের উপর যে দুর্দশা ডেকে নিয়ে এসেছেন তার জন্য আপনি একমাত্র দায়ী। আপনার স্ত্রী এর জন্য দায়ী নন। আমি হত্যাকান্ডের ভিডিওটি দেখেছি। এটি এমন এক বর্বরতার কাজ ছিল যা আমি কখনও প্রত্যক্ষ করিনি। আমি আপনাকে ফার্স্ট-ডিগ্রি মার্ডার এর জন্য দোষী বলে সাব্যস্ত করছি। এটি একটি ঠান্ডা মাথায় খুনের ঘটনা ছিল।
বিচারক শশিকরণকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করেন এবং ২৫ বছরের আগে প্যারলের জন্য যোগ্য হবেন না বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়।
জেগানাথন এর পরিবারের সদস্যরা বিচার কার্যের ভিডিও দৃশ্যটি শ্রীলংকায় বসে দেখেছেন ‘Zoom’ এর মাধ্যমে।
উল্লেখ্য যে কানাডায় পারিবারিক সহিংসতা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েই চলেছে। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা এ বিষয়ে ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ২০২১ সালে পুলিশে রিপোর্ট করা হয়েছে এমন পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন এক লাখ ২৭ হাজার ৮২ জন কানাডিয়ান। এসব সহিংসতার ঘটনায় জড়িত স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা, সন্তান, ভাইবোন অথবা বর্ধিত পরিবারের সদস্যরা। অর্থাৎ প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ৩৩৬ জন সহিংসতার শিকার হন।
রিপোর্টে বলা হয়, “পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাবার এটি হলো উপর্যুপরি পঞ্চম বছর।” সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের দুই-তৃতীয়াংশই নারী ও মেয়েরা (৬৯ শতাংশ)। স্ট্যাটক্যান আরও উল্লেখ করে, “পুরুষ ও বালকদের তুলনায় নারী ও মেয়েদের ক্ষেত্রে সহিংসতার ঘটনা দ্বিগুণেরও বেশি।”
লিউকস প্লেস সাপোর্ট অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টার ফর উইমেন-এর আইন বিষয়ক পরিচালক পামেলা ক্রস গ্লোবাল নিউজকে বলেন, সহিংসতা বেড়ে যাবার সবচেয়ে বড় কারণ কোভিড-১৯ মহামারি ও এর সাথে আরোপিত লকডাউন।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে পুলিশে রিপোর্ট হওয়া অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতার (বর্তমান ও প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রী, কমন ল পার্টনার বা সঙ্গী, ডেটিংয়ের সঙ্গী এবং অন্যান্য অন্তরঙ্গ অংশীদারের হাতে) শিকার হন ১২ বছর বা তার বেশি বয়সের এক লাখ ১৪ হাজার ১৩২ জন নারী ও মেয়ে (প্রতি লাখে ৩৪৪ জন)। এটি ছিল এধরণের সহিংসতা বেড়ে যাবার উপর্যুপরি সপ্তম বছর। এ ধরণের সহিংসতার প্রতি ১০টির মধ্যে আটটিতেই (৭৯%) শিকার হন নারী বা মেয়ে সঙ্গীটি। আর নারী ও মেয়েদের শিকার হবার ঘটনা পুরুষ ও বালকদের (৫৩৭ বনাম ১৪৭) তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি।
অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতার ঘটনা ২০২০ এর তুলনায় ২০২১ সালে ২% বাড়ে। অন্যদিকে অন্তরঙ্গ নয় এমন সঙ্গীদের মধ্যে সহিংসতা বাড়ে ৬%। অবশ্য মহামারির আগে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২১ সালে অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতা ৪% বেশি হলেও অন্তরঙ্গ নয় এমন সঙ্গীদের সহিংসতা ছিল ২% বেশি।
অন্য এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কানাডায় গড়ে প্রতি আড়াই দিনে একজন নারী বা মেয়ে নিহত হয়। ইতিপূর্বে নারীহত্যা সম্পর্কিত এক রিপোর্টে এ কথা বলা হয়েছে। ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি বিষয়ক কানাডার নারীহত্যা পর্যবেক্ষণ সংস্থার (Canadian Femicide Observatory for Justice and Accountability) ২০২০ সালের রিপোর্টে বলা হয়, ওই বছর কানাডায় মোট ১৬০ জন নারী ও মেয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন। ওই বছরের এপ্রিল মাস ছিলো নারী ও মেয়েদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ মাস। ওই মাসে মোট ২৬ জন নিহত হয় বলে রিপোর্টে জানানো হয়। সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল সিটিভি নিউজে।
রিপোর্ট সংকলনকারী দলের একজন সদস্য অনুরাধা ডুগাল সিটিভি নিউজ চ্যানেলকে বলেন, “কানাডায় প্রতিবছর সার্বিকভাবে যত নারী বা মেয়ে হত্যার শিকার হয় সেই সংখ্যা গত কয়েক বছরে তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেনি।” তিনি বলেন, “এটি একটি অনঢ় সংখ্যা যাতে আজকের দিনে কানাডাজুড়ে শুধু লিঙ্গের কারণে কীভাবে নারীরা হত্যার শিকার হচ্ছে তারই প্রতিফলন ঘটে।”
#কলইটফেমিসাইড, শিরোনামের ওই রিপোর্টে বলা হয়, হত্যাকারী চিহ্নিত হয়েছে এমন ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে হত্যাকারী ছিলো পুরুষ। হত্যার শিকার নারীদের বয়স বিভিন্ন। তবে নিহতদের অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যকের বয়স ২৫ থেকে ৬৪ বছর।
ডুগাল বলেন, “নারী ও মেয়েরা তাদের খুনীদের চেনে। তারা হলো তাদেরই পরিবারের সদস্য, জীবনসঙ্গী, তাদের প্রাক্তন জীবনসঙ্গী।”
এই নির্যাতনকারী বা খুনীদের মধ্যে আছেন কানাডায় বাংলাদেশী পরিবারের কিছু সদস্যও। আমরা দেখেছি ইতিপূর্বে গ্রেটার টরন্টোতে তিনজন বাংলাদেশী মহিলা খুন হয়েছেন তাদের স্বামীদের হাতে। অন্যদিকে স্ত্রী নির্যাতনের সংখ্যা কম নয় বাংলাদেশী কমিউনিটিতে। বেশ কয়েক বছর আগে ড্যানফোর্থের এক বাংলাদেশী কানাডিয়ান ব্যারিস্টার কথাপ্রসঙ্গে বলছিলেন, টরন্টোর বাঙ্গালী পাড়া (ড্যানফোর্থ ও ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায়) থেকে প্রতি একদিন পর পর গড়ে একজন বাংলাদেশী পুরুষকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে স্ত্রী নির্যাতনের অপরাধে। এ কথার প্রমাণ মিলে হাজত খেটে আসা এক বাংলাদেশী কানাডিয়ান ব্যক্তির বক্তব্যে। তিনি কথা প্রসঙ্গে একদিন বলছিলেন, ‘হাজতখানায় গিয়ে দেখি আমি একা নই, আরো অনেক বাঙ্গালীই আছেন সেখানে।’
উপরে উল্লেখিত এই ব্যক্তিটির স্ত্রী ছিলেন সুন্দরী। সম্ভবত সেটিই তার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বামী সারাক্ষণই সন্দেহ করতেন তার স্ত্রীর উপর অন্য কারোর নজর পড়ে কি না বা তার স্ত্রী নিজেই অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পরেন কি না। ভদ্রমহিলা টরন্টোর একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে সেলস ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন। আর সন্দেহপ্রবণ স্বামী ব্যক্তিটি প্রায়ই সেখানে যেতেন এবং গোপনে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করতেন স্ত্রীর চালচলন। মাঝে মধ্যে বাড়িতে স্ত্রীকে মারধরও করতেন তিনি। কিন্তু স্ত্রী লোক লজ্জার ভয়ে বিষয়টি পরিচিত কাউকে বলতে না। অবশেষে একদিন সহ্যের সীমা পার হয়ে গেলে তিনি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হন। ঐ মহিলার দুই মেয়ে ছিল। তারাও মাকে পরামর্শ দেন পুলিশ ডাকার জন্য। শেষ পর্যন্ত এই সংসারটি আর টিকেনি।
কানাডায় বাংলাদেশী পরিবারগুলোতে আসলে কি পরিমান সহিংসতার ঘটনা ঘটছে সে সম্পর্কে কোন জরিপ তথ্য নেই। তবে এ দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত সার্বিক জরিপ তথ্য থেকে একটা ধারণা নেওয়া যেতে পারে যে সহিংসতা বাঙ্গালী পরিবারেও ঘটছে যেমনটা ঘটছে বাংলাদেশেও। ২০২১ সালে ঢাকার প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ‘ বিশ্বের যেসব দেশে স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারী নির্যাতনের হার বেশি, সেসব দেশের তালিকায় এসেছে বাংলাদেশের নাম। দেশের ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৫০ শতাংশই জীবনে কখনো না কখনো সঙ্গীর হাতে শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের উচ্চ হারের জন্য মানসিকতার ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘দেশে পুরুষতন্ত্র এমন পর্যায়ে যে নারীরাও পুরুষ সঙ্গী ছাড়া নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এর ফলে সামাজিকভাবে নারীর চেয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থানে থেকেও ওই পুরুষ নিজেকে শক্তিশালী ভাবতে শুরু করেন।’
কানাডায় বাংলাদেশী পরিবারগুলো এরকম একটি পরিবেশ থেকেই আসা। সুতরাং ধারণা করা যেতেই পারে যে, এখানেও নারী নির্যাতনের হার কম বেশী বাংলাদেশেরই মত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বছর দুই আগে নারী নির্যাতনের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রতিটি দেশ ও সংস্কৃতিতে নারীর প্রতি সহিংসতা ঘটে চলেছে। এতে কোটি কোটি নারী ও তাঁদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
কানাডাও কিন্তু এর বাইরে নয়। আর বাইরে নয় ইমিগ্রেন্টদের কিছু পরিবারও। পিল অঞ্চলে (মিসিসাগা ও ব্র্যাম্পটন) সব পশ্চাদপট, জাতিগত পরিচয় ও আয়ের স্তর নির্বিশেষে সব ধরণের পরিবারেই পারিবারিক সহিংসতা কমবেশি আছে, তবে বিশেষভাবে নবাগতরা এক্ষেত্রে বেশি নাজুক অবস্থায় পড়েন। ওইসব অভিবাসী, উদ্বাস্তু এবং পারমানেন্ট রেসিডেন্টরা বৃহত্তর টরন্টো এলাকার জনসংখ্যারও উল্লেখযোগ্য অংশ এবং বিশেষ করে পিল অঞ্চলের, যেখানে প্রিয়া (ছদ্ম নাম) নামের এক মহিলা কানাডায় এসে প্রথম আশ্রয় নিয়েছিলেন। সময়টা ছিল ২০১৮ সাল, প্রিয়ার বিয়ের দুই বছর পেরিয়েছে তখন। তার বিয়ে হয় ভারতে পারিবারিক পছন্দে। তখন প্রিয়ার বয়স ছিল ২৬। বেশিরভাগ দিন একটি অ্যাপার্টমেন্টে আটকে থাকা প্রিয়া দেখছিলেন কানাডায় তার নতুন জীবনের প্রতিটি বিষয় কীভাবে দ্রুত নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছেন তার স্বামী। সিবিসি নিউজকে তিনি জানান, তার সেল ফোন ও পাসওয়ার্ড, সবই ছিল স্বামীর কব্জায়। ছোটখাটো কাজ করে প্রিয়া যা কিছু অর্থ আয় করতেন তার সবটুকুই চলে যেত স্বামীর পরিবারের কাছে। প্রিয়ার উপর পীড়ন শুরু হয় বিয়ের ক’দিন পরই। তিনি বলেন, এ নিয়ে স্বামীকে কখনও প্রশ্ন করলে বা তাকে ‘না’ বললেই স্বামী তাকে লাথি মারতেন। একবার তিনি প্রিয়াকে রুমের মধ্যে টেনে ছেঁচড়ে নিয়ে যান, তার হাত ভেঙে দেন এবং এক সপ্তাহেরও বেশি সময় তার কোনও রকম চিকিৎসা না করে ফেলে রাখেন ঘরে। মাঝেমধ্যে প্রিয়ার গায়ে ছুঁড়ে দিয়ে কাঁচের জিনিসপত্র ভাংতেন।
শিক্ষিত ও ইংরেজিতে সাবলীলভাবে কথা বলতে সক্ষম প্রিয়া সহজেই ভাষার টেস্টে পাশ করেন এবং তাকে স্বামীসহ কানাডায় আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি আশা করছিলেন, কানাডায় অভিবাসন তার জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। পরিবর্তে অত্যাচার অবাধে চলতে থাকে। পিল অঞ্চলের বাসিন্দা প্রিয়া আরো বলেন, কানাডায় তার পারমানেন্ট রেসিডেন্সি পাবার অল্প কিছুদিন পর এক রাতে স্বামী তাকে আক্রমণ করেন উন্মত্তের মত- তাকে আঘাত করতে থাকেন, চড় চাপর মারতে থাকেন, মাটিতে ফেলে দিয়ে লাথি মারতে থাকেন আর বলতে থাকেন ‘তোকে আমার দরকার নেই, যা, তুই মর।’
প্রিয়া বলেন, রাগের সময় তার স্বামী বলতেন, তিনি শুধু কানাডায় আসার জন্য প্রিয়াকে ব্যবহার করেছেন। এখন তিনি চান সে মরে যাক। সে এমন কথাও বলতো যে, “তোকে দিয়ে আমার আর কোনও কাজ নেই, তুই যদি নিজে মরতে না পারিস, আমার সাহায্য নিতে পারিস।”
পিল এলাকার পুলিশ জানায়, ২০১৯ সাল ছিল পারিবারিক ও ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের প্রতি সহিংসতার দিক থেকে রেকর্ড সৃষ্টির বছর। এর চার বছর আগে থেকে পুলিশ ওই এলাকায় পারিবারিক সহিংসতার বিষয়ে নজরদারি শুরু করে।
এর আগে ২০১৬ সালে এখানে পারিবারিক পর্যায়ে কোনও হত্যার ঘটনা ঘটেনি। পুলিশ জানায়, গত ২০২০ সালে পিল অঞ্চলে সাতটি হত্যাকাণ্ড ঘটে।
উল্লেখ্য যে, গত জুন মাসে ‘রিজিঅন অফ পিল কাউন্সিল’ স্থানীয় পারিবারিক সহিংসতাকে ঐ এলাকার মহামারী হিসাবে ঘোষণা দেয়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, শুধুমাত্র ২০২১ সালে পিল পুলিশ ১৭ হাজার পারিবারিক সহিংসতার ঘটনায় সাড়া দিয়েছিল। গড় হিসাবে প্রতিদিন ৪৫টি পারিবারিক সহিংসতা ঘটনা ঘটেছিল অথবা প্রতি দুই ঘন্টায় একটি করে ঘটনা ঘটেছিল যেখানে পুলিশকে হাজির হতে হয়েছে। আর এসব ঘটনায় ভিক্টিমদের মধ্যে ৭৮% ই ছিলেন মহিলা।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পারিবারিক সহিংসতার শিকার শুধু মহিলারাই হন তা কিন্তু নয়। অনেক পুরুষও নির্যাতনের শিকার হন তাদের স্ত্রীদের হাতে। দেখা গেছে সরকারী হিসাব মতে ২০১৯ সালে কানাডায় ২৩,১৪৬ জন পুরুষ পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এই হিসাব হয়তো আরো বেশী হতে পারে। কারণ, সাধারণত পুুরুষরা স্ত্রী কর্তৃক নির্যাতনের বিষয়টি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করেন না। ২০২১ সালে প্রকাশিত আরেক রিপোর্টে দেখা গেছে প্রায় ৩৬% পুরুষ (৪.৯ মিলিয়ন) তাদের লাইফটাইমে অন্তরঙ্গ সঙ্গীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মহিলাদের মধ্যে এই সংখ্যা ৪৪% (৬.২ মিলিয়ন)। তথ্য সূত্র : justice.gc.ca
‘ফেমিসাইড অবজারভেটরি ফর জাস্টিস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি’র এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কানাডায় পারিবারিক সহিংসতায় নিহত নারীদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই এমন অভিযুক্তের হাতে নিহত হন যার সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হিসাবে সম্পর্ক চলছিল অথবা আগে এ ধরণের সম্পর্ক ছিল। এর পর রয়েছে পরিবারের অন্য কোনও সদস্যের হাতে হত্যার ঘটনা।
ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর হাতে হত্যার শিকার ৫২ নারীর মধ্যে ৪২ জনের সম্পর্কের অবস্থা জানা যায়। নিহত নারীদের মধ্যে ৫২ শতাংশ তাদের খুনের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির বর্তমান অথবা প্রাক্তন বৈধ জীবনসঙ্গী ছিলেন। অন্যদিকে ২৪ শতাংশ ছিলেন বর্তমান অথবা প্রাক্তন কমন-ল পার্টনার এবং আরও ২৪ শতাংশ ছিলেন বর্তমান অথবা প্রাক্তন ডেটিং পার্টনার।
হত্যার শিকার নারীদের ৪৮ শতাংশের ক্ষেত্রে হত্যার পদ্ধতি জানা গেছে। ৫১ শতাংশ ছুরিকাঘাতে, ৩২ শতাংশ গুলিতে এবং ৭ শতাংশ প্রহারে নিহত হন।
তবে লক্ষ্যণীয় একটি পর্যবেক্ষণ হলো, বিশে^র অনেক দেশের তুলনায় পারিবারিক সহিংসতার অভিযোগ কানাডায় সর্বনিম্মে। গত বছর ৩০টির বেশি দেশের ভ্রমণ বিষয়ক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে। খবরটি প্রকাশ করে সিটিভি নিউজ। মালামাল সংরক্ষণ সুবিধা দানকারী প্রতিষ্ঠান ‘বাউন্স’ এই সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় পারিবারিক সহিংসতা সম্পর্কিত আইন, খুনের হার এবং নিজের দেশে রাতের বেলা একা পথে নামার ক্ষেত্রে নারীরা কতটা নিরাপদ বোধ করে এসব বিষয়সহ নারী-পুরুষের সমতা ও নিরাপত্তার দিকগুলি বিবেচনায় নেয়া হয়।
সাতটি বিভিন্ন পরিমাপকের ভিত্তিতে এই সমীক্ষা চালানো হয়। এর মধ্যে ছিল, সংশ্লিষ্ট দেশটিতে নারীদের কত শতাংশ সহিংসতার শিকার হয়েছেন, প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে কতজন খুনের শিকার হন, রাতের বেলা একা চলাচলের ক্ষেত্রে নিরাপদ বোধ করেন কত শতাংশ নারী, কতজন নারী বলেন যে, তার প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে তার স্বামী অন্যায় করেননি এবং দেশটিতে পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন কতটা কঠোর।
সাতটি ক্যাটাগরিতে প্রাপ্ত স্কোর মিলিয়ে সার্বিক নিরাপত্তার স্কোর বের করা হয়। তবে পৃথক ক্যাটাগরিগুলোর মধ্যে একটিতে কানাডা শীর্ষ স্থান লাভ করে। সমীক্ষার প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, পারিবারিক সহিংসতার অভিযোগ কানাডায় সর্বনিম্ন।
কিন্তু এই তথ্য নিয়ে আত্মতুষ্টির কোন সুযোগ আছে কি? না, নেই। পারিবারিক সহিংসতার অভিযোগ সর্বনিম্নে থাকার পরও আমরা দেখলাম অন্টারিওর Sault Ste. Marie শহরে মর্মান্তিক এক হত্যাযজ্ঞ ঘটে গেল যেখানে খুনিসহ প্রাণ হারান ৫ জন। আর এদের মধ্যে তিনজন নিষ্পাপ শিশু! আরো দেখলাম স্কারবরোতে জেগানাথন নামের এক ইমিগ্রেন্ট মহিলাকে তার সাবেক স্বামী শশিকরণ কিভাবে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।
আমাদের কাছে মনে হয়, পারিবারিক সহিংসতা রোধকপ্লে পুলিশসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মহলকে আরো বেশী তৎপর হতে হবে। এর বিরুদ্ধে প্রচারণা আরো জোরদার করতে হবে। পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী পুরুষ যেই হোক না কেন সেটা নিয়ে শিথিল মনোভাবের কোন সুযোগ নেই।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ