টরেটক্কা টরন্টো

চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -১৮

কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কিশোর মাহবুবানি, সিঙ্গাপুরের অবসরপ্রাপ্ত ক্যারিয়ার ডিপ্লোমেট, ২০২০ সালে প্রকাশিত তার সাড়া জাগানো বই ‘হ্যাজ চায়না ওন? দ্য চাইনিজ চ্যালেঞ্জ টু অ্যামেরিকান প্রাইমেসি’-তে প্রশ্ন তুলেছেন চীন কি বিশ্বজুড়ে আমেরিকার যে কর্তৃত্ব বা হেজিমনি রয়েছে সেটা খর্ব করার দিকে এগুচ্ছে কিনা। এই প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দেয়ার চেষ্টা করেছেন তার কূটনৈতিক প্রজ্ঞার আলোকে। তার নিজস্ব বিশ্লেষণে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে চীন অবশ্যই আমেরিকার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে আমেরিকা যে বর্তমানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে শক্তিশালী সেটাকে বুঝাতে তিনি ‘প্রাইমেসি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন -সচেতনভাবেই ‘সুপ্রেমেসি’ কিংবা ‘হেজিমনি’ শব্দকে পরিহার করে তিনি তার পেশাগত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তার মতে চীন আজ আমেরিকার এই ‘প্রাইমেসি’-এর জন্য একটি প্রকাশ্য হুমকি। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন যে ‘কোল্ড ওয়ার’-এর পর থেকে আমেরিকার সামরিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক যেখানে অনেকটাই স্থির রয়েছে সেখানে এইসব খাতে চীনের সূচকগুলি ক্রমবর্ধমানভাবে হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী। কূটনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রেও এই দুই দেশের মধ্যে তুলনা করলে একই রকম ফলাফল দেখা যায়। ফলে সেই দিন আর দেরী নেই যেদিন চীন এই ‘প্রাইমেসি’-র প্রতিযোগিতায় আমেরিকাকে পিছনে ফেলে দিবে। কিশোর মাহবুবানি বিশ্লেষণের খাতিরে পাঠককে নিয়ে গেছেন সেই ‘কোল্ড ওয়ার’-এর যুগে। সেই সময়ে প্রতিপক্ষ রাশিয়া কিংবা কম্যুনিস্ট বিশ্বকে ঘায়েল করার জন্য সামরিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমেরিকা ছিল বাস্তবতার সাথে তালে মিলিয়ে নমনীয়। অপরদিকে যে কোন পরিস্থিতিকে কম্যুনিস্ট মতবাদের আলোকে বিচার করার কারণে তখন রাশিয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়ার অপশন ছিল অপ্রতুল। ফলে অনেকক্ষেত্রেই তাদেরকে বেছে নিতে হত বাস্তবতা বহির্ভূত সিদ্ধান্ত যার পরিনামে কম্যুনিস্ট ব্লকের পতন হয়ে দাঁড়ায় অনিবার্য। কিশোর মাহবুবানি কোল্ড ওয়ারের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন যে আজ আমেরিকার অবস্থান কোল্ড ওয়ারের সময়কার রাশিয়ার মতন ‘ইনফ্লেক্সিবল’ আর চীনের অবস্থান সেই সময়কার আমেরিকার মতন ‘ফ্লেক্সিবল’। কারণ চীন আজ তাদের সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাহসী এবং বাস্তবমুখী কিন্তু আমেরিকা নয়। এই কারণেই চীন আজ আমেরিকার জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ।

আজকের চীনের ফরেন পলিসিতে ন্যাশনালিজমের ভিত রচনা করতে ‘চায়না দ্যাট ক্যান সে নো’ বইটির অবদান অনস্বীকার্য (ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

সিঙ্গাপুর সরকারের ‘চায়না নীতি’-এর সাথে সুর মিলিয়ে কিশোর মাহবুবানি এই বইতে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির গুণকীর্তন করেই শুধু ক্ষান্ত হননি, বরং এক ধাপ এগিয়ে তিনি চীনের সমাজ ব্যবস্থার জন্য কম্যুনিজমের উপযোগিতাকে অকুন্ঠভাবে জাস্টিফাই করেছেন। তারপর সিঙ্গাপুরের ফরেন পলিসির সাথে সঙ্গতি রেখেই প্রস্তাব করেছেন যে চীন এবং আমেরিকার উভয়ের উচিৎ হবে তাদের নিজেদের স্বার্থের কারণেই এই ‘প্রাইমেসি’-র প্রতিযোগিতা থেকে সরে এসে একে অপরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। যাই হোক, কিশোর মাহবুবানি-র চীন এবং আমেরিকার পাস্পরিক সহযোগিতার প্রস্তাব আর বাস্তবতার মধ্যে এখনও অনেক ফারাক রয়েছে। তাই চীন এবং আমেরিকা বা পশ্চিমা বলয়ের মধ্যে চলছে আজ শক্তির লড়াই। অথচ কিছুদিন আগ পর্যন্তও চীনের হেজিমনিকে রুখতে পশ্চিমা দেশগুলিকে যে গাঁটছড়া বাঁধতে হবে সেটা তাদের ধর্তব্যের মধ্যেই ছিল না। কারণ চীন যে তলে তলে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে এতটা শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে সে ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলি হয় গাফেল ছিল কিংবা চীন তাদেরকে বোকা বানিয়ে রেখেছিল। তাদের প্রথম টনক নড়ে চীনের টেলিকম কোম্পানী হুয়াওয়েই-এর উত্থানকে যখন আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। হুয়াওয়েই ‘ফাইভ জি’ টেকনোলজিতে পশ্চিমা বিশ্বের কোম্পানীগুলিকে পেছনে ফেলে আমেরিকা, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতন দেশগুলিতে ‘ফাইভ জি’ নেটওয়ার্ক ইনস্টলেশনের কন্ট্রাক্টগুলি কব্জা করে নিয়েছিল। অবশ্য ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালের জানুয়ারীতে চীনা পণ্যের উপর ট্যারিফ জারী করেন। সেই থেকেই শুরু হয়ে যায় চীনের সাথে আমেরিকার ‘ট্রেড ওয়ার’, যার রেশ ধরে এসপিওনাজের অভিযোগে ২০১৯ সালের ১৫ই মার্চ প্রেসিডেন্ট  ট্রাম্প একটি ‘এক্সিকিউটিভ অর্ডার’-এর মাধ্যমে আমেরিকাতে ‘হুয়া ওয়েই’-এর সমস্ত কার্যকলাপ বন্ধ করে দেন। এর আগে অবশ্য ২০১৬ সালের অগাস্টে ‘হুয়া ওয়েই’-এর চিফ ফিন্যানসিয়াল অফিসার এবং ভাইস-চেয়ারওম্যান মেং ওয়ানট্রৌ-এর বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্কের একটি কোর্ট থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী করা হয় ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্যাংশন ভঙ্গের অভিযোগে। সেই বছরের পহেলা ডিসেম্বরে মেং ওয়ানট্রৌ হংকং থেকে মেক্সিকো সিটিতে যাওয়ার পথে তার বিমান ভ্যানকুভার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে স্টপ ওভারের জন্য অবতরণ করে। কানাডা এবং আমেরিকার মধ্যকার এক্সট্র্যাডিশন বা প্রত্যর্পণ চুক্তির বলে কানাডার পুলিশ মেং ওয়ানট্রৌ-কে গ্রেফতার করে। কিন্তু আমেরিকা মেং ওয়ানট্রৌ-কে নিজেদের কাস্টোডিতে না নিয়ে কানাডার আদালতে বিচারের জন্য ঝুলিয়ে রাখে। ফলে কানাডা পড়ে বিপাকে। কারণ চীনের ফরেন মিনিস্ট্রি কানাডাকে এই বলে সতর্ক করে দেয় যে মেং ওয়ানট্রৌ-কে যদি মুক্তি না দেওয়া হয় তবে কানাডাকে এর প্রতিফল ভোগ করতে হবে। চীন এই সময় কানাডাকে আমেরিকার ‘রানিং ডগ’ বলে উল্লেখ করে যা কিনা কোল্ড ওয়ারের সময় চীন কানাডাকে এই তকমা দিয়েছিল। অতীতের নমনীয় এবং বিনয়ী কম্যুনিস্ট চায়নার এই যুদ্ধংদেহী রূপই বলে দিচ্ছিল যে চীনের কূটনৈতিক নীতিতে এসেছে অনেক পরিবর্তন।

চীনের এই পরিবর্তনের শুরুটা হয়েছিল ঠিক থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের পর যখন প্যারামাউন্ট লীডার দেং শিয়াওপিং  ১৯৯২ সালে ঐতিহাসিক ‘সাউদার্ন ট্যুর’-এর মাধ্যমে চীনের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক গতিপথ নির্ধারণের ক্ষেত্রে তার প্রস্তাবিত ‘রিফর্ম এন্ড ওপেনিং আপ’ পলিসির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেন। এই পলিসির কারণে চীনের অর্থনীতিতে আসে উন্নয়নের জোয়ার। সেই জোয়ারের সাথে যোগ হয় চীনের ‘পাই নিয়েন কোয়া-ঠ্রি’ বা শতাব্দীব্যাপী লাঞ্ছনার প্রতিশোধ স্পৃহা। চীনের এই ‘সেঞ্চুরি অব ন্যাশনাল হিউমিলিয়েশন’ শুরু ১৮৩৯ সালে ছিং ডাইন্যাস্টির আমলে চীন যখন প্রথম অপিয়াম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হংকং-কে বৃটিশদের কাছে হস্তান্তর করতে হয়। এরপর দীর্ঘ এক শত বছরের একটু বেশী সময় ধরে চীনকে বিদেশী শক্তির কাছে নতজানু হয়ে থাকতে হয়। ১৯৪৯ সালে কম্যুনিস্ট পার্টি চীনের ক্ষমতা গ্রহণের পরই এই লাঞ্ছনার অবসান ঘটে। থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের ধাক্কা সামলিয়ে উঠার পর ক্রমশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠা চীন নজর দেয় তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে। একই সাথে চীনের লক্ষ্য থাকে টেকনোলজীতে নিজেদেরকে স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং অন্যান্য দেশ থেকে এগিয়ে থাকার ব্যাপারে। নিজ দেশের ইনফ্রাস্টাকচার তৈরির ব্যাপারে কম্যুনিস্ট নেতারা এই সময় নজর দেন এবং ১৯৯২ সালে ‘রিফর্ম এন্ড ওপেনিং আপ’-এর পলিসির অধীনে গৃহীত ‘থ্রী গর্জেস ড্যাম’ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। ১৯১৯ সালে চীনের কিংবদন্তি রাজনৈতিক দার্শনিক সান ইয়েতসেন সর্বপ্রথম চীনের ইয়াংয নদীর উপর এই ড্যাম নির্মাণের প্রস্তাব করেন। ১৯৩২ সালে রিপাবলিক অব চায়নার ন্যাশনালিস্ট সরকারের নেতা চিয়াং কাইসেক এই ড্যামের প্রাথমিক সার্ভে শুরু করেন। কিন্তু চীনের সিভিল ওয়ারের জন্য কাজ স্থগিত থাকে। ১৯৪৯ সালে মাও সেতুং-এর নেতৃত্বে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি যখন ক্ষমতায় আসে তখন আবার এই ড্যাম নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় কিন্তু ‘দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ এবং ‘কালচারাল রেভ্যুলেশন’-এর কারণে তা চাপা পড়ে যায়। মাও-এর পরে দেং শিয়াওপিং ক্ষমতায় এসে ১৯৮০ সালে আবার এই ড্যাম নির্মাণের প্রকল্পটিকে সামনে নিয়ে আসেন। কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টির অ্যাডভাইসরি বোর্ড ‘পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেন্সি কনফারেন্স’ এই নির্মাণ কাজকে দেরীতে শুরু করার জন্য পরামর্শ দেয়। অতঃপর ১৯৯২ সালে ‘ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস’-এর অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই ড্যাম নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৯৯৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর। সাড়ে বাইশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা সম্পন্ন এই ‘থ্রী গর্জেস ড্যাম’ হচ্ছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের পর ১৯৯৪ সালে চীন ‘থ্রী গর্জেস ড্যাম’ নির্মাণের কাজে হাত দিয়ে পুরো পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করে যে তারা নিজস্ব মেধা, উপকরণ এবং শ্রমের দ্বারা যে কোন বড় ধরনের প্রকল্পের কাজ করতে সক্ষম যা চীনের জনগণের মধ্যে একটি আত্মপ্রত্যয় তৈরি করতে সমর্থ হয়।

চীনের জনগণের এই আত্মপ্রত্যয়কে আরো মজবুত করার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে পাঁচজন প্রসিদ্ধ চিন্তাবিদ যারা দেং শিয়াওপিং-এর রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী নন তারা চীনের ন্যাশনালিজম-এর উপর একটি ম্যানিফেস্টো ঘরানার গ্রন্থ রচনা করেন যা কিনা রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে পড়ে। এই বইটির শিরোনাম ‘ট্রোং কোয়া খ-ই শোয়া পু’ যা ইংরেজীতে অনুবাদ করলে হয় ‘চায়না দ্যাট ক্যান সে নো’। এই শিরোনামটি নেয়া হয়েছে ১৯৮৯ সালে জাপান থেকে প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলন ‘জাপান দ্যাট ক্যান সে নো’-এর অনুকরণে। জাপানী প্রবন্ধকারেরা ‘জাপান দ্যাট ক্যান সে নো’ বইটিতে আমেরিকার বিজনেস প্র্যাকটিসের সমালোচনা করে জাপান সরকারকে আহ্বান জানান যে জাপানের উচিৎ হবে নিজস্বতা বজায় রেখে তার বিজনেস এবং ফরেন পলিসি তৈরি করা। ঠিক একই আদলে ‘চায়না দ্যাট ক্যান সে নো’-এর লেখকেরা ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন’-এ চীনের সদস্যপদ পাওয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকার অবস্থানকে সমালোচনা করে বলেন যে চীন সরকারের উচিৎ হবে যে কোন গ্লে­াবাল এফেয়্যারে আমেরিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার। জাপান আমেরিকার আজ্ঞাবহ হওয়ার কারণে এই বইটিতে জাপানেরও সমালোচনা করা হয়। চীনের জনগণের ভেতর যে মার্কিন এবং জাপান বিরোধী সুপ্ত মনোভাব রয়েছে তা এই বইটি নতুন করে উজ্জীবিত করে দেয়। থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের পর পরই চীনের জনগণের মধ্যে যে কোন উপায়েই হোক না কেন উন্নত জীবনের খোঁজে আমেরিকাতে পাড়ি দেয়ার প্রবণতা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। এই সময়টায় লক্ষ্য করেছিলাম যে বাংলাদেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণেরা ইটালিতে যাওয়া শুরু করে। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার বেইজিং-এ এসে মস্কোর ভিসা জোগাড় করে ‘বেইজিং টু মস্কো’-এর ট্রেনে চেপে বসত। তারপর মস্কো থেকে ইটালি। আমি তখন ‘বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্ট এন্ড টেলিকম্যুনিকেশনস’-এর আন্ডারগ্রেডের থার্ড ইয়ারের ছাত্র। সেই সময় ইটালিগামী অনেক বাংলাদেশী আমাদের ইউনিভার্সিটির ডরমেটরীতে রুম ভাড়া করে থাকতেন। তাদের কাছ থেকে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনা হত তখন। এই সময়টায় আমি আমার চাইনিজ ক্লাসমেটদেরকে দেখতাম তারা তাদের সিলেবাসের পড়ার বাইরে জিআরই আর টোফেল নিয়েই বেশী ব্যস্ত। আমেরিকাতে যেতে হবে মাস্টার্স করার জন্য। পুরো দেশটাই যেন পারলে আমেরিকাতে পাড়ি দিতে চায়। কে যেন তাদের ভেতর বপন করে দিয়েছে ‘আমেরিকান ড্রিম’-এর বীজ। এই আমেরিকান ড্রিম-কে উপজীব্য করে ১৯৯১ সালে নিউ ইয়র্ক প্রবাসী চাইনিজ নাগরিক ছাও কুইলিন তার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ‘পেইচিং রেন চাই নিউ ইউয়ে’ বা ‘বেইজিংয়ার ইন নিউ ইয়র্ক’ নামে একটি উপন্যাস লিখেন। বইটি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং সেই বছরে চীনের ‘নাম্বার ওয়ান বেস্ট সেলার’ হিসেবে জায়গা করে নেয়। গল্পে দেখানো হয় যে এক চাইনিজ দম্পতি তাদের ‘আমেরিকান ড্রিম’ বাস্তবায়ন করার জন্য নিউ ইয়র্কে এসে কঠিন সংগ্রামময় জীবনের মুখোমুখি হয় তারা। এক সময় তারা তাদের স্বপ্নের দেখা পেলেও বিচ্ছেদ ঘটে তাদের মধ্যে। আমেরিকার বাস্তবতা তাদের দুজনের জীবন থেকেই অনেক কিছু কেড়ে নেয়, তারা পরিণত হন দুইজন ভিন্ন মানুষে। বইটির কাহিনী চীনের জনগণকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। উপন্যাসটির প্রবল জনপ্রিয়তার কারণে এর কাহিনী অবলম্বনে ২৫ পর্বের একটি টেলিফিল্মও তৈরি করা হয় এবং সেটিও ব্যাপক সাড়া ফেলে। আমেরিকার জীবনের অন্ধকার দিক সম্পর্কে চীনের জনগণের ভেতর খানিকটা হলেও সচেতনতা জন্মায়। ফলে ১৯৯৬ সালে যখন আমেরিকা এবং জাপান বিরোধী প্রচারণা নিয়ে লিখিত ‘চায়না দ্যাট ক্যান সে নো’ বাজারে আসে তখন চীনের জনগণ সেটাকেও তুমুলভাবে স্বাগত জানায়। বলা চলে যে এই বই চীনের ন্যাশনাল সাইকিতে বিরাট একটি পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। ফলে সরকারও এই বইটিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে। তবে পরবর্তীতে আমেরিকা এবং জাপানের বিরোধিতার কারণে কম্যুনিস্ট সরকার বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও চীনের ফরেন পলিসিতে ন্যাশনালিজমের ভিত তৈরিতে এই বইয়ের অবদান অনস্বীকার্য। তাই আজ চীন কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আমেরিকা কিংবা কানাডাকে সতর্ক করে দিতে পিছপা হয় না।

১৯৯৯ সালের মার্চ মাস থেকে ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ বা সংক্ষেপে ‘ন্যাটো’ কসোভো যুদ্ধে ‘ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়া’-কে রুখতে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে লাগাতার বোমাবর্ষণ শুরু করে। এই বোমাবর্ষণের ধারাবাহিকতায় ৭ই মে তারিখে ন্যাটো বেলগ্রেডে অবস্থিত চীনের এ্যাম্বাসীতে বোমা নিক্ষেপ করে। এতে তিনজন চীনা স্টেট মিডিয়ার জার্নালিস্ট  নিহত হয়। সেই সাথে এ্যাম্বাসীতে কর্মরত আরোও কুড়িজন চাইনিজ নাগরিক আহত হয়। ন্যাটোর পক্ষ থেকে বলা হয় এই বোমাবর্ষণ ছিল অনিচ্ছাকৃত একটি ভুলের কারণে। কিন্তু এই বোমাবর্ষণের ঘটনায় চীনের নাগরিকেরা ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা আমেরিকা সহ ন্যাটো-র সদস্যদেশগুলির এ্যাম্বাসী এবং কাউনসুলার অফিস ঘেরাও করে এই বোমাবর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ করে। এই সময় হাজার হাজার জনতা বেইজিংস্থ আমেরিকার এ্যাম্বাসীতে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে এবং এ্যাম্বাসীকে ঘেরাও করে রাখে ফলে অ্যাম্বাসেডার জেমস স্যাসর এবং অন্যান্য স্টাফদেরকে অনেকটা গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হু চিনথাও ৯ই মে তারিখে টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার সময় ন্যাটো কর্তৃক এই বোমাবর্ষণের ঘটনাকে ‘বারবারিক’ এবং ‘ক্রিমিন্যাল অফেন্স’ বলে উল্লেখ করেন। এরপর ১২ই মে তারিখে চীনের প্রিমিয়ার ট্রু রোংচি ন্যাটো-কে ‘হিপোক্র্যাট’ বলে অভিহিত করেন এবং আমেরিকা ও ন্যাটো-কে আহ্বান জানান চীনের সরকার এবং জনগণের কাছে ‘ওপেন এন্ড অফিসিয়াল এপোলজি’ চাওয়ার জন্য। এই সময় চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি চিয়াং জ-মিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের ফোন কল রিসিভ করতে অস্বীকৃতি জানান, অর্থাৎ প্রকারান্তে বুঝিয়ে দেন যে চীন এখন না বলতে সক্ষম। তিনি তখনই শুধুমাত্র ফোন রিসিভ করতে সম্মত হন যখন নিশ্চিত হন যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এপোলজি চাইবেন। এই ঘটনায় বিল ক্লিন্টন শুধু মুখে এপোলজি চেয়েই পার পাননি অর্থাৎ শুধু মুখের কথায় চিড়ে ভিজেনি। আমেরিকাকে ন্যাটো-র বোমাবর্ষণে চীন সরকারকে ক্ষতিগ্রস্থ দূতাবাসের জন্য এবং নিহত ও আহতদের পরিবারকে বেশ মোটা অংকের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। এছাড়াও আমেরিকাকে চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার জন্য ২০০০ সালের মে মাসে চীন-আমেরিকার মধ্যে একটি মেজর ট্রেড বিল পাশ করতে হয়। যারই ফলশ্রুতিতে ২০০১ সালে চীন ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন’ সদস্যপদ হস্তগত করতে সমর্থ হয়। অতীতে আমেরিকা চীনের এই সদস্যপদের বিরুদ্ধে ছিল সোচ্চার কারণ তাদের ভয় ছিল যে চীন এই সদস্যপদ পেলে আমেরিকার একদিন বাজার চীনা পণ্যে ভরে যাবে। তাদের সেই ভয় অবশ্য অমূলক ছিল না। তাই বর্তমানে চীন এবং আমেরিকার মধ্যে দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণই হচ্ছে এই দুই দেশের মধ্যে ট্রেড ডেফিসিট।

চীন অবশ্য আমেরিকাকে আরো একবার কোণঠাসা করেছিল ২০০১ সালের জুলাইতে যখন ইউএস নেভীর ইপি-৩ মডেলের একটি সার্ভেলিয়েন্স বা স্পাই প্লেনের সাথে চীনের বিমানবাহিনীর ফাইটার জেটের সংঘর্ষে একজন চীনা পাইলট নিহত হন। ইউএস নেভীর এই স্পাই প্লেনটি তখন চীনের হাইনান দ্বীপের প্রায় সত্তুর মাইল এবং সাউথ চায়না সাগরের ‘প্যারাসেল’ দ্বীপের প্রায় একশ’ মাইল দূর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। উল্লেখ্য যে এই ‘প্যারাসেল’ আর্কিপেলাগো দ্বীপটি একটি বিতর্কিত দ্বীপ যেখানে চীনের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ফলে চীন সেখানে সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখে যাতে কেউ অনধিকার প্রবেশ করতে না পারে। সেই কারণে ইপি-৩ স্পাই প্লেনের উপস্থিতি শনাক্ত করার সাথে সাথে চীনের দুটি জে-৮ ফাইটার জেট স্পাই প্লেনটিকে ধাওয়া করা শুরু করে। তখন পুরাতন মডেলের স্পাই প্লেনটি অটো পাইলটে থাকার কারণে তাড়াতাড়ি তার গতিপথ পরিবর্তন করতে না পারায় একটি জেটের সাথে ইপি-৩-এর সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের ফলে সেই ফাইটার জেটটি পাইলটসহ সাগরে নিখোঁজ হয় এবং স্পাই প্লেনটি হাইনান দ্বীপে জরুরী অবতরণ করতে বাধ্য হয়। স্পাই প্লেনের আরোহীরা তাড়াহুড়া করে প্লেনের ভিতরে থাকা গোপনীয় যন্ত্রপাতি এবং নথিপত্রগুলি ধ্বংস করার চেষ্টা করলেও সময়ের অভাবে তারা পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। স্পাই প্লেনের আরোহী চব্বিশজন ক্রু-কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চীনের সামরিক বাহিনী তাদের কাস্টোডিতে নেয়। প্রায় বারো দিন পর আমেরিকার কূটনৈতিক তৎপরতা এবং ‘লেটার অব টু সরিস’-এর পর তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। এই ‘লেটার অব টু সরিস’ পত্রটি আমেরিকার অ্যাম্বাসেডর চীনের ফরেন মিনিস্টারকে পাঠান যেখানে আমেরিকা দুইটি বিষয়ে দুঃখ (‘ভেরি সরি’) প্রকাশ করে – প্রথমত চাইনিজ পাইলটের মৃত্যুর জন্য, দ্বিতীয়ত তাদের প্লেনটির চীনের আকাশসীমায় প্রবেশ এবং হাইনান দ্বীপে অনুমতি ব্যতীত অবতরণের কারণে। চীন অবশ্য আমেরিকাকে বাধ্য করে সেই স্পাই প্লেনটিকে ডিসম্যান্টল করে অন্য একটি কার্গো প্লেনে করে নিয়ে যেতে। তবে সেই প্লেনটি থেকে চীন সমস্ত গোয়েন্দা তথ্য হস্তগত করে এমনকি প্লেনটির যাবতীয় এ্যারোনটিক্যাল গঠনও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে নেয়। চীন অবশ্য আরো একবার আমেরিকাকে তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে অভিযুক্ত করে। ২০০২ সালের জানুয়ারীতে চীন অভিযোগ করে যে বোয়িং কোম্পানীর কাছ থেকে কেনা প্রেসিডেন্ট চিয়াং জ-মিন-এর অফিসিয়াল এয়ারক্র্যাফটের ভিতর তারা প্রায় ৩০টির মতন ‘সফিস্টিকেটেড লিসেনিং ডিভাইস’ শনাক্ত করে। কিন্তু বর্তমানে দাবার ছক যেন উল্টে গেছে, আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বের অভিযোগ চীন আজ সারা বিশ্বে তার গোয়েন্দা জাল বিস্তার করে আছে। চীনকে কোণঠাসা করার জন্য এখন আমেরিকা মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে চীনের টেলিকম কোম্পানী ‘হুয়া ওয়েই’-কে অভিযুক্ত করা হয়। সেই সাথে কানাডাকে দিয়ে ‘হুয়া ওয়েই’-এর ভাইস-চেয়ারওম্যান মেং ওয়ানট্রৌ-কে গ্রেফতার করায়। কানাডা জড়িয়ে যায় চীনের সাথে এক সুদূর প্রসারী কূটনৈতিক যুদ্ধে।  (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

কলাম লেখক । টরন্টো