কানাডায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি
কানাডায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অনেকদিন ধরেই সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে যেন আগুন জ¦লছে। মাছ মাংস থেকে শুরু করে শাকসবজি, ফলমূল, দুগ্ধজাত খাবার সবকিছুরই মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক হারে। এর সাথে যোগ হয়েছে বাড়ি ভাড়া যা গত কয়েক বছরে দ্বিগুনেরও বেশী হয়ে গেছে। পেট্রোলের মূল্যও দীর্ঘদিন ধরে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে আছে। এ সবকিছু মিলে সাধারণ মানুষের এখন নাভিশ^াস অবস্থা। আর অন্যদিকে কানাডার বৃহৎ গ্রোসারীর মালিকেরা লাগামহীন মুনাফা করে যাচ্ছেন। সুবিশাল এই গ্রোসারীগুলোর মধ্যে আছে Loblaw, Metro, Empire, Walmart এবং Costco.
মহামারী আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ দেখিয়ে নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে কানাডায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, একটি দেশে মূল্যস্ফীতি বা অর্থনীতি খারাপের দিকে গেলে সকলেরই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা। অথচ কানাডার সুবিশাল গ্রোসারীর মালিকেরা লাগামহীন মুনাফা করে যাচ্ছেন! এটি কি করে সম্ভব?
নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সাধারণ আয়ের মানুষের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এই মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে না থাকার পিছনে কেবল করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ দায়ী নয়। এর পিছনে রয়েছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজিও। কানাডার নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি’র প্রধান জাগমিত সিং এর ভাষায় এই ‘লোভী’ ব্যবসায়ীরা মূল্যস্ফীতির দোহাই দিয়ে পন্যসামগ্রীর মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন।
আর্থিক চাপের কারণে কানাডার প্রায় অর্ধেক মানুষের রাতে ভালো ঘুমও হচ্ছে না এখন। কানাডার গবেষণা সংক্রান্ত কোম্পানি এফপি’র নতুন এক সমীক্ষায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সমীক্ষায় দেখা যায়, ৪০ শতাংশ কানাডিয়ানের জন্য অর্থই মানসিক চাপের প্রধান কারণ। প্রায় অর্ধেক (৪৮ শতাংশ) কানাডিয়ান আর্থিক চাপের কারণে ঘুমাতে পারছেন না। এর ফলে প্রতি তিনজনে একজন (৩৬ শতাংশ) কানাডিয়ান উদ্বেগ অথবা বিষণ্নতার মত মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যার মুখে পড়ছেন।
অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে কানাডায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ লোক খাবার কম খাচ্ছেন। গত বছর পরিচালিত এক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছিল। ঐ সমীক্ষায় বলা হয়, পাস্তা, রুটি এবং মাংশের মত নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কানাডার ক্রমবর্ধমান সংখ্যক মানুষ কষ্টেসৃষ্টে চলছেন। ফুড ব্যাংকস কানাডার এই সমীক্ষায় আভাস পাওয়া যায়, দেশজুড়ে ক্ষুধা ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। আর মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্বল্পআয়ের কানাডিয়ানরা।
সম্প্রতি লন্ডন অন্টারিওতে এক সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো-ও বলেছেন, ‘এটার কোন মানে হয় না যে কানাডার মত একটি দেশে সাধারণ মানুষ প্রতিদিন প্রয়োজনীয় খাবার যোগার করতে গিয়ে কঠিন লড়াই করে যাচ্ছে, ফুড ব্যাংকে লম্বা লাইন তৈরী হচ্ছে, আর অন্যদিকে গ্রোসারীগুলো রেকর্ড মুনাফা করে যাচ্ছে।’
কানাডার কম্পিটিশন ব্যুরো গত জুন মাসে তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছে যে, কানাডায় গ্রোসারী ব্যবসায় যথেষ্ট প্রতিযোগিতা নেই। তিনটি বৃহৎ দেশীয় কোম্পানীর আধিপত্য রয়েছে এই খাতে।
এই পরিস্থিতি বদলানো এখন জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর আহ্বানে কানাডার বৃহৎ গ্রোসারীর প্রধান নির্বাহীরা গত ১৮ সেপ্টেম্বর অটোয়ায় ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ও অর্থ মন্ত্রী Chrystia Freeland এবং শিল্প মন্ত্রী François-Philippe Champagne’র সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে শিল্প মন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া-ফিলিপ সাংবাদিকদের বলেন, কানাডার পাঁচটি বৃহত্তম গ্রোসারি চেইনের প্রধানরা খাদ্যের মূল্য স্থিতিশীল করতে ফেডারেল সরকারের সাথে ‘কাজ করতে সম্মত হয়েছেন’।
সাধারণ মানুষ এখন দেখতে চায় ব্যবসায়ীরা সত্যিকার অর্থে কতটা আন্তরিক দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে। আর সরকারই বা কতটা আন্তরিক সেটাও দেখতে চায় সাধারণ মানুষ। কারণ খেটে খাওয়া এই সাধারণ মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।