আসাদ চৌধুরী কানাডায় নিজেকে কখনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ বলে মনে করতেন না
কবি আসাদ চৌধুরী আর নেই। গত অক্টোবর ৫, ২০২৩ টরন্টোর নিকটবর্তী অশোয়া শহরের লে’ক রিজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নাল ইল্লা হি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজেউন।
তাঁর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি জানাচ্ছি আমাদের আন্তরিক সমবেদনা।
আসাদ চৌধুরী ২০১৫ সালে কানাডায় আসেন ইমিগ্রেন্ট হয়ে। কানাডায় আসার পর তিনি নিজেকে কখনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ বলে মনে করেননি। টরন্টো থেকে প্রকাশিত প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে কবি নিজেই বলেছিলেন, ‘আমি পৃথিবীর অনেক দেশেই গিয়েছি। আমি চাকরীর সুবাদে জার্মানীতে থেকেছি তিন বছর। আমি নিউয়র্কে গিয়েছি। লন্ডনেও গিয়েছি বেশ কয়েকবার। অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে গিয়েছি, গিয়েছি প্যারিসেও। কিন্তু আমি অত্যন্ত জোর দিয়ে বলতে পারি, কানাডায় এখন পর্যন্ত একবারের জন্যও মনে হয়নি আমি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ যেটি মনে হয়েছিল পৃথিবীর অন্যান্য দেশে গিয়ে বা থেকে।’
আসাদ চৌধুরী বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান কবি ও সাহিত্যিক। তিনি কবিতা লিখছেন গত অর্ধ শতাব্দীরও বেশী সময় ধরে। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই জনপ্রিয় কবি কবিতা ছাড়াও বেশ কিছু শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া ও জীবনী গ্রন্থ রচনা করেছেন। অনুবাদ সাহিত্যেও রয়েছে তার কিছু কাজ। ১৯৮৩ সালে তাঁর রচিত “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ” শীর্ষক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমী পুরষ্কারও পেয়েছেন।
সাহিত্যের জগত ছাড়াও মনোগ্রাহী টেলিভিশন উপস্থাপনায় ছিল তার অপরিসীম দক্ষতা ও জনপ্রিয়তা। চমৎকার আবৃত্তির জন্যও তিনি ছিলেন জনপ্রিয়।
তাঁর কবিতা গীতিময় এবং ছন্দোদ্ভাসিত। তাঁর ব্যঙ্গার্থক কবিতা ‘কোথায় পালালো সত্য’ একটি জনপ্রিয় পদ্য। সভ্যতার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি গত কয়েক দশকে মানবিক মূল্যবোধের যে করুণ অধোগতি, তারই প্রেক্ষাপটে এই কবিতায় তিনি আক্ষেপ করেছেন।
আসাদ চৌধুরী ছিলেন কথারও যাদুকর। কথা বলতেন গুছিয়ে। শ্রোতা-ভক্তরা অধীর আগ্রহ নিয়ে শুনতেন তাঁর কথা।
২০১৫ সালে প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের সম্পাদক খুরশিদ আলম আসাদ চৌধুরীর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
প্রশ্ন : আপনি একজন রাজনীতি সচেতন কবি। কানাডায় ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় আপনি এখানে উপস্থিত ছিলেন। এখানকার রাজনীতি সম্পর্কে আপনার কি অভিজ্ঞতা হলো?
উত্তর : গত ১৯ অক্টোবর কানাডার জাতীয় নির্বাচনের দিনটি আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর আরো আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম পরাজিত প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার কি বলেন এবং বিজয়ী নেতা জাস্টিন ট্রুডো কি বলেন। আমরা জানি, বাংলাদেশের নির্বাচন মানেই কিছু লোক মারা যাবে, কিছু ঘর-বাড়ী পুড়বে। নির্বাচনের পরে দাঙ্গা হাঙ্গামা হবে এবং যথারীতি সুক্ষ্ম কারচুপী আর বিজয় ছিনতাই হয়েছে এ ধরনের কাথাবার্তা হবে। নির্বাচন কমিশন নিয়েও কথাবার্তা হবে। কিন্তু এগুলো কিছুই দেখলাম না কানাডার জাতীয় নির্বাচনে। উল্টো দেখলাম জাস্টিন ট্রুডো অসম্ভব প্রশংসা করলেন স্টিফেন হারপারের। তিনি এমনো বলছেন যে, হারপার দেশটাকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অন্যদিকে স্টিফেন হারপারও বললেন, জাস্টিন ট্রুুডো যে কোন ভাল উদ্যোগ নিলে তিনি তার সাধ্যমত চেষ্টা করবেন সহযোগিতা করার জন্য। আমি দুজনের বক্তব্যই শুনেছি খুব মনোযোগ দিয়ে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে আমি খুবই মুগ্ধ হয়েছি দুজনের বক্তব্য শুনে।
প্রশ্ন : প্রবাসী বাঙ্গালীদের বেশ কয়েকটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আপনার ইতিমধ্যেই। কি অভিজ্ঞতা হলো সেখানে গিয়ে?
উত্তর : আমার কাছে মনে হয়েছে, এখানে এই প্রবাসে বাঙ্গালীর একটি চরিত্র খুব সন্দরভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। সেটি হলো বাঙ্গালীর উৎসব প্রিয়তা। বাঙ্গালী যে সত্যিকার অর্থেই উৎসব প্রিয় সেটা কানাডায় এসে আবার নতুন করে যেন উপলব্দি হলো আমার। দেশে নানা কারণে বিভিন্ন উৎসব উদযাপনে বাধা আসতো। তার মধ্যে ধর্মীয় বাধা একটি। আরো নানান বাধার বিষয় ছিল। বাধা এখনো আছে। তবে আগের তুলনায় কম সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানে দেখেছি এই ডিসেম্বরের তীব্র শীতের মাঝেও বাঙ্গালীরা বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করছেন।
প্রবাসে আরেকটি জিনিষ আমার খুব ভাল লেগেছে। প্রবাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সজ্জন ব্যক্তি যারা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে যারা অনেক বড় বড় ভূমিকা নিচ্ছেন, যারা মর্টগেজ বা রিয়েল এস্টেট ব্যবসা করেন, যারা আইন ব্যবসা করেন এরা কিন্তু বাঙ্গালীদের প্রতিটি অনুষ্ঠানে আসেন নিয়মিত। শুধু যে আসেন তাই নয়, তারা বাঙ্গালীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতাও করেন। এটি সত্যিই আমার কাছে খুব ভাল লেগেছে।
এখানে বাংলা চর্চাটাও যথেষ্ট আছে। প্রবাসে তরুনদের নিয়ে কিছু একটা করা দরকার। বাংলাদেশ সেন্টারে আমি একটা বিষয় দেখলাম তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটা আমার কাছে খুব ভাল লেগেছে। আমি অস্ট্রেলিয়াতেও দেখেছি সেখানে তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে নানামুখী কাজ হচ্ছে। সেখানে বাংলা একাডেমী নামে একটি প্রতিষ্ঠানও আছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে মেয়েদেরকে বাঙ্গালী কায়দার রান্না-বান্নাও শেখানো হয় অস্ট্রোলিয়াতে।
কানাডায় দেখেছি প্রথম সন্তান বাবা মায়ের সঙ্গে খুব ভাল বাংলা বলছে। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয় সন্তান জন্মাবার পর তারা তখন নিজেদের মধ্যে ইংরেজীতে কথা বলছে। কার্টুন দেখে হোক বা অন্যকোনভাবে হোক তারা খুব দ্রুত এই ভাষাটি আয়ত্ব করে নিচ্ছে বা নিতে পারছে। এটি একটি ভাল দিক। কিন্তু আমার আশংকা হচ্ছে, এরা না আবার বাংলাটা খুব দ্রুত ভুলে যায়।
প্রশ্ন : যদি বাংলাদেশের সঙ্গে কানাডার তুলনা করতে বলি তবে আপনি কি বলবেন?
উত্তর : গুড গভার্নেস বা সুশাসন একটি খুব বড় ব্যাপার। আর আমি আরো মনে করি মানুষের প্রতি প্রশাসনের আস্থা এবং শ্রদ্ধাবোধ থাকলে এই সুশাসনটা বিকশিত হয় এবং আমার কাছে আরো মনে হয়েছে যে মানবিক মূল্যবোধগুলো কার্যকর থাকায় এখানকার সমাজও অনেকটা এগিয়ে আছে। সুশাসনের কথাটা বলছি এই কারণে যে, কতগুলো কাগুজে মূল্যবোধ থাকে গণতন্ত্রের। এখানে কাগজে নয়, খাতা কলমে নয়, আমি সেটার অস্তিত্ব বাস্তব জীবনেই লক্ষ্য করেছি। যেমন চার্চে একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে বাঙ্গালীদের। নাচের অনুষ্ঠান বা গানের অনুষ্ঠান। এটা আমাকে অবাক করেছে। এতটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সামাজ এখানে, এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এরকমটি হচ্ছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে সুশাসনের কারণে।
দুই দেশের তুলনা করতে বললে আমি আরো বলবো, বাংলাদেশের কাগজে – কেতাবে অনেক কিছু আছে, কিন্তু বাস্তব জীবনে কিচ্ছু নেই।
যেমন আমরা এত কষ্ট করে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি, গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছি, স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি কিন্তু প্রত্যেকটা বিষয়ই যেন ছিনতাই হয়ে গেছে বা যাচ্ছে বা যাওয়ার পথে।
আরো দেখেছি এখানকার বিভিন্ন লাইব্রেরীগুলো যেখানে বাংলা বই আছে, আছে গানের সিডি। আছে বাংলা ম্যাগাজিন। তার মনে হচ্ছে, এখানে যে অনেকগুলো ভাষা আছে সেই ভাষাগুলো সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। এই যে প্রয়াসটা এটা খুব বড় ব্যাপার বলে মনে হয়েছে আমার কাছে।
প্রশ্ন : কানাডা প্রবাসী বাঙ্গালীদের সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?
উত্তর : কানাডায় গণতন্ত্রের পরিবেশ আছে বলেই দেখুন এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিষ রয়েছে। তার একটি হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের উদযোগ। বৃটেনে কানাডার চেয়ে অনেক বেশী বাঙ্গালী রয়েছেন। সেখানে এখন বাঙ্গালীদের পঞ্চম প্রজন্মের যুগ চলছে। নিউয়র্কেও রয়েছেন প্রচুর সংখ্যক বাঙ্গালী। সেখানে তৃতীয় এবং চতুর্থ প্রজন্ম রয়েছে বাঙ্গালীদের। শুধু তাই নয়, বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বিত্তবান বাঙ্গালীও রয়েছেন। কিন্তু তারপরও এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের উদ্যোগটি শুরু করেছিলেন কানাডা প্রবাসী বাঙ্গালীরাই।
কানাডায় ইদানিং বাঙ্গালীদের মধ্যে আস্তে আস্তে বিত্তবানদের সংখ্যা বাড়ছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেল-মেয়েরা অনেক ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। তারপর দেখুন লেখালেখিতেও অনেকে ভাল করছেন কানাডা প্রবাসী বাঙ্গালীরা। যেমন অটোয়াপ্রবাসী মুস্তফা চৌধুরী লিখেছেন অসামান্য একটি গবেষণা গ্রন্থ ‘একাত্তরের যুদ্ধ শিশু’। বহু দিন লেগেছে তার এই কাজটি সমাধা করতে। মন্ট্রিয়লে বসে মুক্তিযুদ্ধের উপর অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেছেন তাজুল ইসলাম। কাজেই আমি বলতে চাচ্ছি যে বিষয়টা সেটা হলো, এদেশের রাজনীতি, এদেশের প্রশাসন সমাজে এমন একটা অনুকুল অবস্থার সৃষ্টি করেছে বলেই এখানে একজন বাঙ্গালী বাংলাদেশকে বুকে ধারণ করে বাংলাদেশকে নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। বাংলা ভাষায় বাঙ্গালীরা পত্রিকা প্রকাশ করতে পারছেন। এতগুলো পত্রিকা এখানে – ভাবা যায়? এই যে সবার জন্য ক্ষেত্র তৈরী করা, সুযোগ দেওয়া, এই বিষয়গুলো কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার।
কানাডা একজন বিদেশীকে গ্রহণ করছে, তাকে নাগরিকত্ব দিচেছ। এবং তার জন্য সুযোগ তৈরী করে দিচেছ তার নিজের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশের। আর এটা কোন কাগুজে প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তবিকভাবেই তারা এই কাজগুলো করছে। তাদের এই যে সহমর্মীতা ও সহযোগিতা এবং মানবিক মূল্যবোধ এর কি তুলনা হয়? একটি দেশে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকলে সেখানে এই বিষয়গুলো থাকবেই অবধারিতভাবে। কানাডায় আমরা সে বিষয়গুলোই দেখতে পাচ্ছি।
প্রশ্ন : আমাদের শেষ প্রশ্ন। আপনি কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে ভালবাসেন সবচেয়ে বেশী? কবি হিসেবে না লেখক হিসেবে?
উত্তর : আমাকে আমি মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে সবচেয়ে বেশী ভালবাসি। কবি বা লেখক হিসেবে নয়।