যানবাহন থেকে বায়ুদূষণ, টরন্টোতে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচয়ে বেশি ভুগছে স্বল্প-আয়ের মানুষ

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, জুলাই ১৫, ২০২৩ : এবারের জুন মাসে টরন্টোতে শ্বাস নেয়া সহজ ছিল না, কারণ বায়ুর মান নিয়ে একাধিক সতর্কবার্তা গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার পেয়েছে, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু সম্পর্কিত স্বাস্থ্যঝুঁকি বিশেষভাবে স্বল্প পরিষেবা পাওয়া সম্প্রদায়ের জন্য তীব্র হয়ে উঠতে পারে। খবর অলিভিয়া বাওডেন – সিবিসি নিউজ।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা সিবিসি নিউজকে বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, স্বল্প-আয়ের অভিবাসীরা বসবাস করে এবং অপেক্ষাকৃত পুরনো ও দুর্বলভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা ভবন দিয়ে গড়ে ওঠা কমিউনিটিগুলি দূষিত বায়ু এবং প্রচণ্ড গরমের মত স্বাস্থঝুঁকিতে পড়ে সবচেয়ে বেশি।

টরন্টোর উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত সামাজিক সংস্থা জেন অ্যান্ড ফিঞ্চ সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক কমিউনিটির উন্নয়নের প্রবক্তা মিশেল ড্যাগনিনো বলেন, “নিম্ন আয়ের লোকেরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের শিকার হবার ক্ষেত্রে অনেক বেশি উন্মুক্ত।”

গবেষণায় দেখা গেছে, স্বল্প-আয়ের অভিবাসীরা অপেক্ষাকৃত পুরনো ও দুর্বলভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা কমিউনিটি হাউজিং এ বাস করেন যেখানে দূষিত বায়ু এবং প্রচণ্ড গরমের মত স্বাস্থঝুঁকি বিদ্যমান। ছবি : ইভান মিৎসুই-সিবিসি

সিবিসি টরন্টোর রিপোর্টে দেখা যায়, মেয়র পদের শীর্ষ প্রার্থীদের প্রচারণায় জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুটি ব্যাপকভাবে জোরালো নয়। প্রার্থীরা ইলেক্ট্রিক বাস নামানো থেকে শুরু করে বহুতল ভবনের দূষণ কমানোর উদ্যোগ নেয়ার প্রস্তাব করছেন। কিন্তু তাদের পরিকল্পনায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার বিষয়ে সামান্যই বলা হচ্ছে।

পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সাময়িকীতে প্রকাশিত টরন্টো বিশ^বিদ্যালয়ের ২০২২ সালের  সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, টরন্টোর উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত এবং স্কারবরোর কিছু অংশের মহল্লাগুলি গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়ের পাশে, এসব হাইওয়েতে দূরপাল্লার ট্রাক চলাচল করে যার ফলে এখানে বাতাসের গুণগত মান অন্য মহল্লার চেয়ে খারাপ।

সাসটেনেবল সিটিজ অ্যান্ড সোসাইটি শীর্ষক সাময়িকীতে প্রকাশিত একই বিশ^বিদ্যালয়ের বায়ুর মান সম্পর্কিত ২০২২ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, ওইসব এলাকার পুরনো অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলি সব সময় দূষণমুক্ত থাকতে পারে নাÑ সে দূষণ যানবাহন বা দাবানল যে উৎস থেকেই সৃষ্ট হোক।

ড্যাগনিনো বলেন, জনগণকে সুরক্ষা দেওয়ার মৌলিক উপকরণ কারও কাছেই নেই, বিশেষত স্বল্প আয়ের কমিউনিটিগুলিতে। তার সংস্থা সেবা দেয় এমন এলাকার অনেক বাসিন্দা এয়ারকন্ডিশনের ব্যবস্থা নেই, শুধু এয়ার ফিল্টার আছে এমন কারখানায় কাজ করেন। তিনি বলেন, আবাসনের উচ্চমূল্যের কারণে ওইসব বাসিন্দাদের অনেকেই অন্যদের সঙ্গে অ্যাপার্টমেন্টের এমন আবদ্ধ অংশে থাকেন যেখানে ঘরে বাতাস ঢোকে না।

তিনি বলেন, “এসব ভবনের অনেকগুলি, বিশেষ করে টরন্টো কমিউনিটি হাউজিং-এর ভবনগুলি যথাযথভাবে রক্ষাণাবেক্ষণ করা হয়নি। এগুলিতে হাওয়া চলাচলের এবং কাঠামোর সমস্যা আছে।”

ড্যাগনিনো বলেন, আর ওইসব কমিউনিটিতে সবুজ আচ্ছাদনও কম। যেমন, জেন অ্যান্ড ফিঞ্চ-এ সবুজ জায়গা আছে কিন্তু জনগণের ব্যবহারের উপযোগী করে সেগুলির উন্নয়ন হয়নি, সেখানে বসার ব্যবস্থা এবং ওয়াকওয়ের স্বল্পতা আছে।

বৃক্ষ আচ্ছাদন কম, বেড়েছে জনসংখ্যা

ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর ডালা লানা পাবলিক হেলথ স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক জেফরি ব্রুক বলেন, জনসংখ্যার কারণে হাইওয়ের কাছে আবাসন সুবিধা অপেক্ষাকৃত সস্তা, কিন্তু হাইওয়ে নাকি আবাসনÑ কোনটি বেশি জরুরী তা নির্ধারণ করা শক্ত।

ব্রুক নগরের বায়ুর মান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। তিনি সহকর্মীদের নিয়ে হেলদিডিজাইন.সিটি নামে একটি প্রকল্প তৈরি করেছেন যা কানাডার অনেকগুলি শহরের বায়ুর মান সম্পর্কিত মানচিত্র বানিয়েছে। এতে অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীসহ জনসংখ্যার উপাত্তের সঙ্গে বৃক্ষ আচ্ছাদনের মত বিষয়গুলির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়।

তিনি বলেন, স্বল্প পরিষেবা পাওয়া মহল্লাগুলির জলবায়ু সম্পর্কিত ঝুঁকি আরও বেড়ে যায় এই ঘটনায় যে, নবাগত ও স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠী নিয়ে গড়ে ওঠা কমিউনিটির লোকেরা ইংরেজিতে কথা বলতে সক্ষম না-ও হতে পারে এবং তাদের জন্য ক্ষতিকর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লড়াই করার মত সংগঠনও সেখানে কমই থাকে।

তিনি বলেন, সচ্ছল কমিউনিটির লোকেরা “ব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকেবহাল, সাধারণত তাদের ক্ষমতাও বেশি থাকে।”

টরন্টো ইউনিভার্সিটির পিএইচডি পরীক্ষার্থী জাড জালজাল, যিনি নগরের বায়ুর মান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে যাচ্ছেন, গত বছর যৌথভাবে এক গবেষণাকর্ম প্রণয়ন করেন, যাতে উঠে আসে যে, কঠোর নীতির কারণে যানবাহনের নিঃসরণ থেকে সৃষ্ট দূষণ ২০০৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে এলেও যানবাহনের নিঃসরণের ঝুঁকিতে থাকা লোকদের মধ্যে বৈষম্য আছে। তিনি বলেন, বায়ুর মান খারাপ হওয়ার সঙ্গে অকাল মৃত্যুর সম্পর্ক আছে।

অলাভজনক অ্যাডভোকেসি সংগঠন টরন্টো এনভায়রনমেন্টাল অ্যালায়েন্সের প্রচার বিষয়ক পরিচালক সারাহ বুকানন বলেন, নগর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব আছে টরন্টো কমিউনিটি হাউজিং করপোরেশনের (ঞঈঐঈ) ভবনগুলিতে রেট্রোফিটিং বাধ্যতামূলক করার মত পদক্ষেপ নিয়ে বৈষম্য নিরসন করার।

তিনি বলেন, বায়ুর মান খারাপের দিন নিয়ে যতটা উদ্বেগ ঠিক সেরকম গুরুত্ব দিয়েই বড় সড়কের পাশে বসবাসের ধারাবাহিক দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পরীক্ষা করা দরকার। “এটি সময়ের সাথে সাথে মানুষের ওপর অনেক বেশি ক্ষতিকর প্রভাব রাখতে পারে। ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে পারে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে নগর কর্তৃপক্ষ।”

টরন্টোর যেসব কমিউনিটি নাজুক অবস্থায় রয়েছে সেগুলিকে সাহায্য করার জন্য টরন্টো নগর কর্তৃপক্ষ কী পরিকল্পনা নিয়েছে জানতে চাওয়া হলে নগর কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা বিল্ডিং অপারেটরদেরকে পুরনো ভবনগুলির নবায়নে সাহায্য করছে, সেই সাথে ভবন নির্মাতাদের জন্য একটি হাইরাইজ উন্নয়ন কর্মসূচি এবং বাড়ির মালিক ও ব্যবস্থাপকদের জন্য ভবনের পরিবেশ দক্ষতা বাড়ানোর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।

নগরীর বায়ুর মান বাড়াতে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কমিউনিটিতে সবুজ আচ্ছাদন বাড়ানোর একটি কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করেছে। নগরীর বিধিমালায় বাড়ির মালিকদের জন্য যথেষ্ট শীতাতপ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা আছে। যানজট নিরসনে কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালের শেষ দিকে একটি কর্মপরিকল্পনা অনুমোদন করে।

সামাজিক আবাসনের ভবনগুলিতে রেট্রোফিট জরুরী

টরন্টো কমিউনিটি হাউজিংয়ের তথ্যমতে, সামাজিক আবাসনের ভবনগুলির মানোন্নয়নে জ¦ালানিদক্ষ সরঞ্জাম সংযোজনসহ বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে চলেছে, যা শুধু গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণই কমায় না বরং বাসিন্দাদের জন্য ঘরের ভেতরের বায়ুর মানের উন্নতি ঘটায়, তাদেরকে বাইরের দূষিত বায়ু ও বাড়তি শীত থেকে রক্ষা করে।

গত বছর আঞ্চলিক জলবায়ু বিষয়ক সংস্থা দ্য অ্যাটমস্ফিয়ারিক ফান্ডের (ঞঅঋ) সাঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে টরন্টো কমিউনিটি হাউজিং সামাজিক আবাসনের সাতটি ভবনে রেট্রোফিট সম্পন্ন করে। আরও পাঁচটি প্রকল্পের কাজ চলমান আছে।

টিএএফের লো কার্বন বিল্ডিং বিভাগের পরিচালক কিথ বারোজ সিবিসি টরন্টোকে বলেন, তার সংস্থা এক দশকের বেশি সময় ধরে রেট্রোফিটের কাজ করছে। এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই সামাজিক আবাসন নিয়ে।

তিনি বলেন, “নিশ্চিতভাবেই মনে হচ্ছে দাবানলের ধোঁয়া আমাদের জন্য নতুন এক ধারা হতে যাচ্ছে। ভবনগুলি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তত করার জন্য রেট্রোফিট একটি সুযোগ।” এটি বাসিন্দাদের বিদ্যুৎ বিলও কমিয়ে দেয়। 

সিবিসি-কে পাঠানো এক বিবৃতিতে টরন্টো কমিউনিটি হাউজিং বলেছে, গ্রীষ্মকালে বাসিন্দারা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হন তার মধ্যে অত্যধিক গরম সবচেয়ে গুরুতর। বর্তমানে নগরীর অর্ধেক বাসিন্দার শীতাতপ ব্যবস্থা আছে। টিসিএইচসির স্মার্ট বিল্ডিং অ্যান্ড এনার্জি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক বয়েড ডায়ার বলেন, আর দাবানলের কারণে বায়ুর মান খারাপ হওয়াটা সেন্ট্রাল কুলিং সিস্টেম না থাকার স্বাভাবিক ফল।

তিনি বলেন, “প্রায় সব” ভবনেই “কোনও না কোনও ধরণের” জ¦ালানিদক্ষ রেট্রোফিট লাগানো হয়েছে, তবে তা হয়েছে বিভিন্ন মাত্রায়। এর মধ্যে এলইডি বাল্ব লাগানো থেকে শুরু করে বারোজের উল্লেখিত পুরো রেট্রোফিট পর্যন্ত নানা পর্যায়ের কাজ হয়েছে।

আবাসন সংস্থাটি আগামী পাঁচ বছর ধরে অব্যাহতভাবে রেট্রোফিটের কাজ চালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করছে। তাদের লক্ষ হলো এই সময়ের মধ্যে জ¦ালানির ব্যবহার ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা। কিন্তু ভবনগুলির রক্ষণাবেক্ষণ এবং বাসিন্দাদের সমস্যাবলি পূরণ না করার বিষয় নিয়ে সম্প্রতি সংস্থাটি সমালোচনার মুখে পড়ে।

বুকানন বলেন, পুরনো ভবনগুলির পুরোপুরি রেট্রোফিট করা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এবং আরও বেশি জরুরী হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, “বিশেষ করে সেই নগরীর জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ যেটি এসব সম্পদের মালিক, আসুন দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করি… এখনই কাজটি করে ফেলি এবং ভবনগুলি আরও টেকসই করে তুলি।”