আবৃত্তির সাহিত্য-সাহিত্যের আবৃত্তি

রেজা অনিরুদ্ধ

সাহিত্য-

‘সাহিত্য’ শব্দটি এসেছে ‘সহিত’ শব্দ থেকে। অর্থাৎ যোগ, সংযোগ, সঙ্গে, মিলন, সম্মিলন ইত্যাদি।  বলা যায় এই সংযোগ জীবনের সাথে, প্রকৃতির সাথে, জীবন পরিচালনার সার্বিক বিষয়ের সাথে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পরম্পরায় জাগতিক ও মানসিক উৎকর্ষতায় কথ্য ও লেখ্য যে কোনো উদ্যোগই সাহিত্য।

আবৃত্তি-

সাহিত্য বিষয়ে উপরে উল্লেখিত বিষয় যখন কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, তখন তা আবৃত্তি। হাজার হাজার বছরের আবৃত্তি ইতিহাসের সাথে বর্তমান আবৃত্তির নির্দিষ্টতা ভিন্ন বটে। ব্যকরণগত পরিশুদ্ধতার নির্ণেয় নির্দেশনা এখন মেনে নিয়েই আবৃত্তি করতে হয়। আবৃত্তির উদ্দেশ্যই হ’চ্ছে লিখিত কোনো বিষয় নিজের বোধে যথাপোযুক্তভাবে এনে তা এবং তার মর্মার্থ শ্রোতা-দর্শকের মননে গ্রথিত করা। কিন্তু আবৃত্তি সাহিত্যের ইতিহাস, লিখিত সাহিত্যের চেয়ে অনেক প্রাচীন।

একটি উদাহরণ দিয়ে  সংক্ষপে বলা যেতে পারে, প্রাচীনতম গ্রন্থ ‘মহাভারত’ রচনার সূচনায় ব্রম্মা রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বা ব্যসদেবকে মহাভারতের শ্লোকসমষ্টিকে গ্রন্থভুক্ত করার নির্দেশনা দেন। এ কথার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত যে, মহাভারত গ্রন্থিত হবার আগেই মহাভারতের শ্লোক কণ্ঠে কণ্ঠে ছিলো এবং তা চর্চিত ও আবৃত্ত হয়ে আসছিলো অসংখ্য বছর যাবত। আজকে যে গ্রন্থিত ধর্মগ্রন্থ ‘গীতা’ পঠিত বা আবৃত্ত হ’য়ে আসছে তা অবশ্যম্ভাবীভাবে পূর্বে বহুল আবৃত্ত মহাভারতের অংশ। একইভাবে আরো প্রাচীন গ্রন্থ ‘বেদ’ এর ক্ষেত্রেও উপরোক্ত কথা সমভাবে প্রযোজ্য। এমন উদাহরণ অনেক অনেক ক্ষেত্রেই দেয়ার সুযোগ আছে। যেমন পবিত্র কোরানের বর্তমান লিখিত রূপও কণ্ঠে কণ্ঠে পঠিত হ’তো। এমন অনেক কথাই যৌক্তিকভাবে বলা যায়। এমনকি লালন সাহিত্যও অবধারিতভাবে সমরূপ। এখনো কুষ্টিয়া অঞ্চলে লালনের অসংখ্য গান আছে, যা লালনভক্তগণ বিচ্ছিন্নভাবে গেয়ে বেড়ান এবং অদ্যাবধি গ্রন্থভূক্ত হয়নি। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা থেকে বিরত থাকাই বাঞ্চনীয়।

সমাজ সংস্কৃতি সভ্যতা ও প্রজন্মের শৈল্পিক উত্থানের সাথে সাহিত্যের অপরিহার্য সংযুক্ততা রয়েছে। যাপিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাহিত্য জড়িয়ে রয়েছে। মানবপ্রেমের কথা, প্রাণ ও প্রকৃতির কথা বলতেই সাহিত্য চলে আসে।  যে কোনো কথার শৈল্পিক প্রকাশই সাহিত্য। সাহিত্যকথার শৈল্পিক উচ্চারণ এবং তা শ্রোতা, বিশেষ ক্ষেত্রে দর্শকের মনে মননে বিশ্বাসে ও চিন্তায় বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে আবৃত্তি। বর্তমান সময়ে আবৃত্তির নানামুখি কথা, আলোচনা, পর্যালোচনার পরিসর সৃষ্টি হয়েছে এবং তা স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবে মূল্যায়িত হয়েছে। আবৃত্তির সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক অভিন্ন। ইতিহাসের আলোকে বলাই যায় যে, কণ্ঠে উচ্চারিত যৌক্তিক অর্থপূর্ণ বাক্যই ক্রমে ক্রমে সাহিত্যে রূপায়িত হয়েছে। আমরা যদি চর্চাপদ অথবা ময়মনসিংহ গীতিকার দিকে তাকাই এ কথা স্পষ্ট হয়ে আসে যে, কণ্ঠে কণ্ঠে অনির্দিষ্টকালের কাল ধরে এই ছত্র সমূহ উচ্চারিত হ’য়ে আসছিলো। নিশ্চয়ই অনেক পরে তা গ্রন্থিত হয়েছে, একত্রীভূত হয়েছে। এ কথার মাধ্যমে যৌক্তিকভাবে বলা যায় যে, যুগ যুগ ধরে উচ্চারিত এই সাহিত্য খণ্ড খণ্ড ভাবে প্রচলিত ছিলো। মানুষ এই সাহিত্যের রসবোধ জীবনবোধ ও সামগ্রিক শিল্পবোধে সমৃদ্ধ ছিলো। আবৃত্তি করতে করতেই মানুষের কাছে পৌঁছেছে এবং তা সাহিত্য বলেই পরে তা গ্রন্থিত সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।

সাহিত্যের প্রধান একটি অংশ কবিতা বা পদ্য। সাহিত্যমান সমৃদ্ধ যেকোনো কবিতাই আবৃত্তিযোগ্য এবং আবৃত্ত হয় প্রাচীনকাল থেকেই। স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, কবিতা শোনার বা শোনানোর জন্য। তিনি উপন্যাসও নিজে পড়ে শোনাতেন। তবে আবৃত্তি শুধুই পড়া বা পাঠ নয় এখন আর। সাম্প্রতিক সময়ে আবৃত্তির সর্বজন স্বীকৃত সংজ্ঞা দেয়া না গেলেও এ কথা অনেক বিজ্ঞজন স্বীকার করবেন যে, আবৃত্তি হলো- অধিকতর মান্য, গ্রহনযোগ্য ব্যকরণের পদ্ধতি মেনে, উচ্চারণ পদ্ধতির সঠিক নিয়ম মেনে প্রক্ষেপণ করা। সাথে সাথে লিখিত বিষয়ে লেখকের বা কবির অভিপ্রায় বুঝে নেয়া। কবিতার বাক্যস্থিত সুর বুঝে নেয়া, বাক্যস্থিত অন্তঃনিহিত অব্যাক্ত অর্থ বুঝে নেয়া। কবিতার শৈল্পিক শরীর বুঝে নিয়ে তার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছত্র আত্মস্থ করা। কবিতার ছত্রে ছত্রে বর্ণিত ও বোধিত ভাবরস ও ভাবরসের যৌক্তিক বিভাজন এবং তারতম্য বুঝে নেয়া। এমন অসংখ্য বোধের বোধ মস্তিষ্কে গ্রথিত করা। সম্মিলিত বোধের প্রেক্ষিতে অধিকতর অকৃত্রিম, বোধগম্য,  ভাবরসের পর্যাক্রমিক সুরের রঙ, চুড়ান্ত অর্থে কবিতার মর্মকথা স্বরপ্রক্ষেপণের বিশেষ ভারসাম্য রক্ষা ক’রে প্রকাশ করাই আবৃত্তি। এখানে অনিবার্য বিষয় হ’লো আবৃত্তি শিল্পীর দায়িত্বই থাকছে উল্লেখিত বোধের বিষয়সমূহ বিশেষত স্বরপ্রক্ষেণের মাধ্যমে শ্রোতাদর্শককের মনেকে প্রভাবিত করা। যাতে ক’রে শ্রোতাদর্শক কবিতার সামগ্রিক মর্মকথার সাথে নিজ নিজ বোধ তারতম্যে যুক্ত করতে পারে। কবিতার শিল্পবোধের প্রেক্ষিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে এবং শিল্পের অগ্রযাত্রার সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পারে। আবৃত্তি হ’চ্ছে, বলা যায় বাড়তি দায়িত্ব।

একটু চিন্তা করলে বুঝতে কষ্টকর হবে না যে, লালন সাহিত্যও ছুটছুট অংশের সমষ্টি। লালন ফকির বা তাঁর গুরু সিরাজ সাঁই তাঁদের কণ্ঠে প্রক্ষেপিত গান বা কবিতা যা আবৃত্তি মূলতঃ আবৃত্তিই। অনেক পরে আমরা তাঁদের সংকলিত গানের ভাণ্ডার পেয়েছি। অর্থাৎ অতি প্রাচীনকালই শুধু নয়, নিকট অতীতের উদাহরণও রয়েছে এমন যে, আবৃত্তিই সাহিত্যের অংশ হয়েছে।

সাহিত্যের আবৃত্তি বলতে এই পর্যায়ে সাম্প্রতিক আধুনিক আবৃত্তির কথাই বলতে চাই। বর্তমান সময়ে আবৃত্তির নানাবিধ বাধ্যবাধকতা মেনে নিতে হয়। সঠিক বা শুদ্ধ উচ্চারণ, বিরাম রীতি, ব্যকরণের পদ্ধতিগত প্রকরণের সকল অনুসঙ্গ মেনে নিয়েই স্বরপ্রক্ষেপণের সুর রঙ গতি মাত্রা তাল লয় নির্ধারণ করতে হয়।

প্রাণ, প্রকৃতি ও প্রজন্মের উন্নততর চলমান প্রক্রিয়ার পথকে সহজ ও মসৃণ করাই প্রধানত শিল্পের ধর্ম। সেই হিসেব মেনে নিয়ে কবিতা, প্রবন্ধ বা যে কোনো লিখিত অধ্যায়ই সাহিত্যের অংশ, এই সকল খণ্ড খণ্ড অংশ সাহিত্যকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সমৃদ্ধ করে চলেছে। আমরা আবৃত্তি করে চলেছি এইসব সাহিত্য শৈল্পিকতায়, নান্দনিকতায়। আজকের আবৃত্তির ব্যাপকতা সাহিত্যকে জনপ্রিয় করে চলেছে দ্রুতবেগে।

উপসংহারে এ কথা বলা যায় যে, আবৃত্তি ও সাহিত্য প্রায়োগিক বিবেচনায় একে অপরের পরিপূরক অথবা এটাও বলা যায় আবৃত্তি ও সাহিত্য অভিন্ন। আবৃত্তি যখন লিখিত হয়েছে তখনই কেবল সাহিত্য হ’য়ে ওঠে নাই, কথ্য, পাঠ্য বা আবৃত্ত অবস্থাতেও তা সাহিত্য ছিলো।

রেজা অনিরুদ্ধ

টরন্টো