সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগানোর মিথ্যা অভিযোগ, নিষ্পত্তিতে কানাডার মুসলিম দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ‘দৃষ্টান্তমূলক’ বিজয়

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, ০৯ জুন ২০২৩ : কানাডার অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় দাতব্য প্রতিষ্ঠান তার বিরুদ্ধে বিদেশের সন্ত্রাসবাদী  গোষ্ঠীগুলোকে অর্থ সরবরাহের ‘ফ্রন্ট’ হিসাবে কাজ করার মিথ্যা অভিযোগ সংবলিত বেশ কিছু প্রকাশনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজয়ী হয়েছে। সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে। খবর শানিফা নাসের  –  সিবিসি নিউজ।

ইসলামিক রিলিফ কানাডা চলতি মাসের শুরুর দিকে সমঝোতার মাধ্যমে আদালতের বাইরে এ বিষয়ক মামলার নিষ্পত্তি করে। প্রতিষ্ঠানটি মামলা করেছিলো টমাস কুইগিন নামে এক সাবেক সেনা কর্মকর্তাসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে। কুইগিন পরে স্বঘোষিত গবেষক হিসাবে নিজের পরিচয় দিতেন এবং গত বছরের ট্রাক বহরের প্রতিবাদের সময় অধিকতর খ্যাতিমান ব্যক্তিদের একজন হিসাবে আবির্ভূত হন। ইসলামিক রিলিফ বলেছে, কুইগিন ও অন্য ছয় ব্যক্তি এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করার হীন উদ্দেশ্যে “মিথ্যা, বিদ্বেষমূলক ও মানহানিকর” বিবৃতি দিয়েছেন।

ইসলামিক রিলিফ কানাডার স্বেচ্ছাসেবীরা ২০২১ সালে হ্যালিফ্যাক্স-এর গরীব মানুষের জন্য শীতকালীন ত্রাণসামগ্রী প্রস্তুত করছেন। ছবি : ভিক্টোরিয়া উইল্যান্ড/সিবিসি

ইসলামিক রিলিফ কানাডার সিইও উসামা খান বলেন, “বৈধ ত্রাণ সংস্থাগুলিকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় হরহামেশা কী ধরণের মিথ্যাচারের শিকার হতে হয় এই ঘটনা তারই দৃষ্টান্ত।”

তিনি বলেন, “ইসলামিক রিলিফ কানাডা যে সমঝোতায় পৌঁছেছে তা এই যুদ্ধে এক মাইল ফলক।” জনাব খান বলেন, “এমন কর্মকাণ্ডের জন্য অপপ্রচারকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনার মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে পারি যে, এধরণের আচরণ সহ্য করা হবে না।”

নিষ্পত্তির শর্তগুলো হুবহু জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি, তবে অভিযুক্তরা ব্যাখ্যামূলক এক বিবৃতিতে স্বীকার করেছেন যে, তাদের বক্তব্য-বিবৃতি ছিল “ভিত্তিহীন”।

বিবৃতিতে অভিযুক্তরা বলেন, “অবমাননাকর বক্তব্য-বিবৃতির বিষয়গুলি নিয়ে গবেষণা, খসড়া তৈরি এবং/অথবা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্ট অনুশীলন করিনি।”

ভুল তথ্য ‘মন্দ চরিত্রের’ হাতে সহজেই উচ্চকিত হয়: আইনজীবী

আসামিদের ব্যাখ্যায় বলা হয়, দাতব্য সংস্থাটি “সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে সমর্থন করে,” তার একটি ইসলামিক এজেন্ডা আছে অথবা এটি একটি “ফ্রন্ট বা প্রতারণামূলক” সংগঠন     এমনটা বোঝানোর কোনও “অভিপ্রায় তাদের কখনই” ছিল না। বিবৃতিতে আরও বলা হয়,  আসামিরা তাদের মানহানিকর বক্তব্য-বিবৃতিগুলি সরিয়ে নিয়েছেন অথবা সেগুলো সরিয়ে ফেলার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকাশকদেরকে অনুরোধ করেছেন।

বিবৃতিতে এসব কথা বলা হলেও বাস্তবে সিবিসি নিউজ খুব সহজেই অনলাইনে ১৩২ পৃষ্ঠার তথাকথিত “কুইগিন রিপোর্ট” খুঁজে পেয়েছে যা ডাউনলোড করার জন্য এখনও সুলভ। একটি একাডেমিক ছদ্মবেশে বিন্যস্ত দীর্ঘ এই ঘুরানো-পেঁচানো নথিগুচ্ছে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এটি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে একটি “ইসলামিক ক্যান্সার” এবং এরা একটি “বৈশ্বিক বিশ্বাস” লালন করে।

শত শত ফুটনোট এবং অগণিত গ্রাফিকস ও চার্ট ইত্যাদি দিয়ে রিপোর্টে দাতব্য সংস্থাটির মূল সংগঠন ইসলামিক রিলিফ ওয়ার্ল্ডওয়াইড-এর মাধ্যমে এটিকে দাতব্য থেকে ফিলিস্তিনের হামাসের মত জঙ্গীবাদী গোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালানো হয়েছে।

ইসলামিক রিলিফ কানাডার আইনজীবী নাদের হাসান বলেন, তার প্রতিষ্ঠান চায় আসামীরা তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে। কিন্তু ইন্টারনেটের নানা কোণে সেগুলো থেকে যেতে পারে, যা প্রমাণ করে যে, ভুল তথ্য কত সহজে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

তিনি বলেন, “এটি মূলত ইন্টারনেটে মানহানির ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্যের কথাই তুলে ধরে, যেখানে মন্দ চরিত্রের লোকেদের হাতে অসত্য বক্তব্যগুলি পুনরাবৃত্ত হতে এবং ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেটি যে কোনও পক্ষেরই নিয়ন্ত্রণের বাইরে হতে পারে।”

আসামিরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিল

এর আগে খোদ ইসলামিক রিলিফ ওয়ার্ল্ডওয়াইডও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযুক্তি থাকার অভিযোগের মুখে পড়েছিল। ২০১৪ সালে ইসরায়েল সরকার এই সংস্থাটিকে নিষিদ্ধ করে। সরকার দাবি করে, সংস্থাটি হামাসকে অর্থের জোগান দেয়। হাসান বলেন, ওই ঘটনার পর আইআরডব্লিউ অধিকৃত ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে তাদের কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য একটি  “সমন্বিত, স্বাধীন” সংস্থা নিয়োগ করে, যেটি আইআরডব্লিউর পশ্চিম তীরে অবস্থিত দফতরের কোনওরকম অবৈধ বা অযথার্থ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পায়নি। 

হাসান আরও যোগ করেন, ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন এবং কানাডা সব দেশের সরকার আইআরডব্লিউর কার্যক্রম পরিচালনায় অর্থ দিয়ে যাচ্ছে।

মামলার তথ্যমতে, আসামিদের “মানহানিকর প্রচারণা” শুরু হয় ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর যখন কুইগিন, গোরা, ডিকটার, রাজা ও তার স্বামী

আরসিএমপির (কানাডীয় পুলিশ) কমিশনার ব্রেন্ডা লুসির কাছে চিঠি লিখেন। চিঠিতে কুইগিনের একটি প্রকাশনা যুক্ত করে দেয়া হয়, যাতে দাবি করা হয় যে, ইসলামিক রিলিফ কানাডাকে অনুদান দেয়ার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার জনগণের অর্থ দিয়ে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন করছে।

ওই দাবির বিবৃতিতে বলা হয়, এই অনুদানের অর্থের মধ্যে ইরাকে যৌন নিপীড়ন থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা; নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং ইয়েমেনের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম; ইথিওপিয়ায় বন্যা ত্রাণ সহায়তা এবং মিয়ানমার সঙ্কটে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দেয় তহবিল অন্তর্ভুক্ত ছিল।

আরসিএমপির কাছে পেশ করা অভিযোগ তখন প্রত্যাহার করা হয়।

সিবিসি নিউজকে হাসান বলেন, যেহেতু সংস্থাটি সারা বিশে^র উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে কার্যক্রম চালায়, আর যেহেতু মুসলিম দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে সচরাচর বাড়তি যাচাই-বাছাইয়ের মুখে পড়তে হয় সেজন্যে ইসলামিক রিলিফ হলো “বিশে^র সবচেয়ে বেশি অডিট হওয়া, যাচাই-বাছাই হওয়া এবং পর্যবেক্ষণকৃত দাতব্য সংস্থাগুলোর একটি।”

তিনি বলেন, “তারা প্রতিটি ডলার ব্যয় করে বৈধ কাজে। সেজন্যেই প্রাথমিকভাবে অভিযোগগুলি ছিল খুবই হতাশাজনক এবং ক্রোধ উদ্রেককারী।”

আসামিদের আইনজীবী লোরনি হোনিকম্যান সিবিসি নিউজকে বলেন, তার মক্কেলরা এই “সমঝোতামূলক নিষ্পত্তি এবং একটি দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া এড়ানো সম্ভব হওয়ায় অত্যন্ত খুশি।