টরেটক্কা টরন্টো

চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -১৪

কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

‘চীনের জনগণ আজ উঠে দাঁড়িয়েছে’ – মাও সেতুং দৃপ্তকন্ঠে এই কথাটি উচ্চারণ করে নয়াচীন বা পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার গোড়াপত্তন করেন। সেদিনটি ছিল ১৯৪৯ সালের পহেলা অক্টোবর। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শেষে চিয়াং কাইশেক-এর কোয়ামিন্টাং সরকারকে হটিয়ে দিয়ে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা মাও সেতুং বেইজিং-এর থিয়েনআনমেন স্কয়ারের এক বিশাল জন সমাবেশে এই ঘোষণা দেন। সেদিন সেখানে পিপলস লিবারেশন আর্মি-এর সদস্যরা প্রথমবারের মতন প্রকাশ্যে মার্চপাস্ট করে। সেই বছরের ৩রা ডিসেম্বরে কম্যুনিস্ট পার্টির সিনিয়র নেতারা পহেলা অক্টোবরকে নয়াচীনের ‘ন্যাশনাল ডে’ হিসেবে মনোনীত করেন। সেই থেকে প্রতি বছর ‘পহেলা অক্টোবর’ চীন সরকার আড়ম্বরপূর্ণভাবে এই দিনটকে ‘কোয়া ছিং চিয়ে’ বা ন্যাশনাল ডে হিসেবে উৎযাপন করে আসছে। ‘কোয়া ছিং চিয়ে’ গণচীনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের দিন। এই দিনটি যাতে ভালোভাবে পালিত হয় সেই জন্য সরকার শুধুমাত্র এই দিনটিই নয় বরং এই দিন থেকে শুরু করে আরো পাঁচটি দিন ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ফলে জনগণ এই সময় লাগাতার এক সপ্তাহের ছুটি উপভোগ করতে পারে। সপ্তাহব্যাপী এই ছুটিতে চীনের জনগণ বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গাগুলিতে বেরিয়ে আসে। যা কিনা দেশের আভ্যন্তরীণ পর্যটন শিল্পকে চাঙ্গা রাখে। এইজন্য এই সপ্তাহকে বলা হয়ে থাকে ‘হুয়াংচিন ট্রৌ’ বা ‘গোল্ডেন উইক’।

‘কানাডা ডে’ কানাডার একশত পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকী উৎযাপন, অটোয়া ২০১৭ সাল

সরকারীভাবে চীনের ন্যাশনাল ডে উৎযাপিত হয় থিয়েনআনমেন স্কয়ারে। ভোর ছয়টায় জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে শুরু হয় এই উৎযাপন। বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আটত্রিশ মিটার বা দশতলার সমান উঁচু ‘মনুমেন্ট টু দ্য পিপলস হিরোস’ স্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং পিপলস লিবারেশন আর্মি-র প্যারেড প্রদর্শন। দেশ থেকে সামার ভ্যাকেশনের ছুটি কাটিয়ে বেইজিং-এ ফিরে এসেই টের পেলাম যে আসন্ন পহেলা অক্টোবর উৎযাপনের জন্য চারিদিকে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। ১৯৮৯ সাল ছিল চীনের চল্লিশ বছর পূর্তির বছর। কিন্তু সেই বছরে ন্যাশনাল ডে উৎযাপন নিয়ে চীনের কম্যুনিস্ট সরকার বেশ বেকায়দায় পড়ে যায় কারণ মাত্র কিছুদিন আগেই খোদ থিয়েনআনমেন স্কয়ারেই মেশিনগান আর ট্যাংক দিয়ে সেনাবাহিনী নৃশংসভাবে ছাত্র আন্দোলনকে দমন করেছে। ছাত্র এবং জনতার রক্তের সেই দাগ এখনও জনগণের মন থেকে মুছে যায়নি। তবে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতারা সেই বেকায়দা অবস্থা থেকে উত্তরণে বেশ সচেষ্ট ছিলেন। সেই বছর অত্যন্ত কড়া নিরাপত্তার ভেতর পালিত হয় ন্যাশনাল ডে বা ‘কোয়া ছিং চিয়ে’। সাধারণ জনগণ সেদিন থিয়েনআনমেন স্কয়ারের এক মাইলের ভেতর আসার অনুমতি পায়নি অথচ বর্ণাঢ্য নাচের জন্য সরকার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এবং সরকারি অফিস আদালত থেকে এক লক্ষের অধিক ছেলেমেয়েকে সেখানে হাজির করেছিল। পিপলস লিবারেশন আর্মি-র প্যারেড যা কিনা ন্যাশনাল ডে উৎযাপনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংগ, সেটাকে বাদ দেয়া হয়েছিল। হয়ত এই আশঙ্কায় যে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের স্মৃতিকে উস্কিয়ে দিবে। অথচ সেদিন সন্ধ্যার মুহুর্মুহ ফায়ার ওয়ার্কের শব্দ ৪ঠা জুনের সৈন্যদের মেশিনগানের শব্দের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। ১৯৮৯ সালের চীনের ন্যাশনাল ডে-এর অনুষ্ঠান জাপানের রাষ্ট্রদূত সহ বেশ কিছু পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূত বর্জন করেছিলেন। আমেরিকার রাষ্ট্রদূত অনুপস্থিত থাকলেও আমেরিকার প্রাক্তন সেক্রেটারি অব স্টেট আলেক্সজান্ডার হেইগ চাইনিজ নেতাদের আমন্ত্রণে সেই অনুষ্ঠানে অবশ্য যোগ দিয়েছিলেন।

কোয়া ছিং চিয়ে’ চীনের সত্তুরতম জন্মবার্ষিকী উৎযাপন, বেইজিং ২০১৯ সাল (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

কালের পরিক্রমায় বিশ্বমঞ্চে চীনের অবস্থান পাল্টে গেছে এখন। ২০১৯ সালে চীন মহা আড়ম্বরের সাথে তাদের ৭০ বছর পূর্তির ন্যাশনাল ডে বা কোয়া ছিং চিয়ে পালন করে। ঠিক সত্তুর বছর আগে এই দিনটিতে মাও সেতুং যেখানে দাঁড়িয়ে নয়াচীনের ঘোষণা দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে, ‘চীনের জনগণ আজ উঠে দাঁড়িয়েছে’, ঠিক সেইখানে দাঁড়িয়ে চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং বলেছেন, ‘পৃথিবীর কোন শক্তিই আজ চীনের অবস্থানকে টলাতে পারবে না’। এ কথা অবশ্যই ঠিক যে বিগত সত্তুর বছরে চীনকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক চড়াই উতরাই পথ এবং সফলতার সাথে সেই পথ পাড়ি দিতে পেরেছে বলেই চীন আজকে এই দম্ভোক্তি করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। অতীতে চীনের নেতারা তাদের বক্তব্য দিতেন বিনয় এবং নম্রতার সাথে কিন্তু শি চিনপিং-এর নেতৃত্বে চীন এখন অনেকখানিই বদলে গেছে। কূটনৈতিক আচার আচরণে এখন চীন বেপরোয়া এবং উদ্ধত – সিঙ্গাপুরের প্রাক্তন ডিপ্লোমেট কিশোর মাহবুবানি তার ‘হ্যাজ চায়না ও’ন? -দ্য চাইনিজ চ্যালেঞ্জ টু অ্যামেরিকান প্রাইমেসি’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়েই সেটা উল্লেখ করেছেন। চীনের এই উদ্ধত কূটনৈতিক আচরণের উপুর্যপরি শিকার কানাডা। ২০২১ সালের মে মাসের ২৯ তারিখে চীনের একজন শীর্ষ কূটনৈতিক লি ইয়াং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে ‘বালক’ বলে সম্বোধন করেন এবং তাকে কানাডাকে আমেরিকার ‘রানিং ডগ’-এ পরিণত করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। চীনা কূটনৈতিকের এই ধরনের উদ্ধতপূর্ণ মন্তব্য কানাডার জন্য ছিল অবমাননাকর।

দিবস উৎযাপনের ক্ষেত্রে ‘কানাডা ডে’-কে চীনের ‘কোয়া ছিং চিয়ে’-এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কারণ ‘কোয়া ছিং চিয়ে’ বা ‘ন্যাশনাল ডে’ যেমন চীনের জন্য জন্মদিন উৎযাপন তেমনি ‘কানাডা ডে’ হচ্ছে কানাডার জন্য জন্মদিন উৎযাপন। ১৮৬৭ সালের পহেলা জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘ব্রিটিশ নর্থ অ্যামেরিকা এ্যাক্ট, ১৮৬৭’-এর মাধ্যমে নিউ বার্নসউইক, নোভাস্কশিয়া, ওন্টারিও এবং কুইবেক এই চারটি প্রভিন্সের সমন্বয়ে একটি একক ব্রিটিশ ‘ডমিনিয়ন’ কানাডা কনফেডারেশনের জন্ম হয়। ১৮৬৮ সালের ২০শে জুন তখনকার গভর্নর জেনারেল লর্ড মঙ্ক এক পাবলিক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন যেখানে বলা হয় যে এখন থেকে কানাডার সকল জনগণ পহেলা জুলাই দিনটি একটি উৎসবের দিন হিসেবে উৎযাপন করবে। কিন্তু এই দিনটিকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা দিতে আরও প্রায় দশ বছর সময় লেগে গিয়েছিল। ১৮৭৯ সালে একটি ফেডারেল আইনের মাধ্যমে এই দিনটিকে ‘কনফেডারেশন বার্ষিকী’ হিসেবে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয় যা পরবর্তীতে ‘ডমিনিয়ন ডে’ হিসেবে পরিচিত হয়। ১৯৪৬ সালে হাউস অব কমন্স-এর একজন কুইবেকের মেম্বার ‘ডমিনিয়ন ডে’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘কানাডা ডে’ রাখার জন্য একটি বিল আনেন যা কিনা লোয়ার চেম্বারে খুব তাড়াতাড়ি পাশ হয়ে গেলেও সিনেটে গিয়ে আটকে যায়। সিনেট থেকে পরে এই বিলটি আবার ‘হাউস অব কমন্স’-এ ফেরত পাঠায় এই বলে যে, ‘ডমিনিয়ন ডে’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘দ্য ন্যাশনাল হলিডে অব কানাডা’ রাখা যেতে পারে। ফলে ‘কানাডা ডে’ বিলটি মুখ থুবড়ে পড়ে। ১৯৫৮ সালে কানাডার প্রাইম মিনিস্টার জন ডিফেনবেকার প্রথমবারের মতন সারা কানাডাব্যাপী ‘ডমিনিয়ন ডে’ পালনের উদ্যোগ নেন এবং প্রস্তাব করেন যে সেক্রেটারী অব স্টেট এলেন ফেয়ারক্লগ-এর তত্ত্বাবধানে এই দিবস উৎযাপনের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হোক। এর জন্য চৌদ্দ হাজার ডলারের একটি বাজেটও তিনি প্রস্তাব করেন। তখন থেকে এই ‘ডমিনিয়ন ডে’ সরকারীভাবে উৎযাপন শুরু হয়। শুরুতে উৎযাপনের জন্য অটোয়ায় অবস্থিত পার্লামেন্ট হিল-এর চত্বরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য ‘ট্রুপিং দ্য কালার’-এর আদলে কুচকাওয়াজ প্রদর্শনী এবং সন্ধ্যার সময় মিউজিক ব্যান্ড ও ফায়ারওয়ার্ক করা হত। পরবর্তীতে স্টেট সেক্রেটারী এলেন ফেয়ারক্লগ যখন সিটিজেনশীপ এন্ড ইমিগ্রেশন মিনিস্টার হন তখন তিনি বিভিন্ন এথেনিক গ্রুপের কালচারাল ইভেন্টও ‘ডমিনিয়ন ডে’ উৎযাপনে অন্তর্ভূক্ত করেন। এই দিনটির উৎযাপন তখন থেকে জনপ্রিয় হতে শুরু করে এবং আপামর জনসাধারণ এতে অংশ নেয়া শুরু করে। ১৯৬৭ সালে কানাডা কনফেডারেশনের একশত বছর জন্মবার্ষিকীতে এই দিনটিকে বিশেষভাবে উৎযাপন করা হয় ফলে কানাডার জনগণের মধ্যে ন্যাশনালিজমের বন্ধন দৃঢ় হওয়া শুরু করে। ১৯৮০ সালের পর থেকে কানাডা সরকার ‘ডমিনিয়ন ডে’-এর উৎযাপন রাজধানী ‘অটোয়া’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে অন্যান্য শহরেও উৎযাপনের জন্য আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। এই সময় আবার কানাডা ব্রিটেনের কাছ থেকে পুরোপুরি স্বাধীন হওয়ার জন্য প্যাট্রিয়েশন প্রক্রিয়া শুরু করে। ফলে এই প্যাট্রিয়েশনের কার্যক্রম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কানাডিয়ান ‘ডমিনিয়ন ডে’-কে অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘কানাডা ডে’ হিসেবে উল্লেখ করা শুরু করে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে ‘ডমিনিয়ন ডে’-তে একটা কলোনিয়াল লেগাসির গন্ধ রয়েছে যা থেকে এখন কানাডা পুরোপুরি মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে।

কলোনিয়ান লেগাসি-র ব্যাপারটা হচ্ছে, যে সব প্রাক্তন ব্রিটিশ কলোনি স্বাধীন হয়েও ব্রিটিশ ডমিনিয়ন-এর অন্তর্ভূক্ত হয় তাদের শাসন ব্যবস্থায় ব্রিটেনের একটা কর্তৃত্ব থেকে যায়। অর্থাৎ তাদের সংবিধান প্রণয়ন কিংবা পরিবর্তনে ব্রিটেনের অনুমতির প্রয়োজন হতো। ১৯৩১ সালের ১১ই ডিসেম্বরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘স্টাটিউট অব ওয়েস্টমিনিস্টার, ১৯৩১’ আইন পাশ হয় যার মাধ্যমে ইউনাইটেট কিংডম-এর অধীনস্থ ডমিনিয়নগুলি অধিকতর স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার অর্জন করে। কিন্তু তারপরেও ইউনাইটেট কিংডম তার অধীনস্থ ডমিনিয়নগুলির আইন প্রণয়ন কিংবা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার অধিকার সংরক্ষণ করত। প্যাট্রিয়েশন কার্যক্রমের আওতায় ১৯৮২ সালে কানাডার অনুরোধে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ‘ব্রিটিশ নর্থ অ্যামেরিকা এ্যাক্ট, ১৮৬৭’ থেকে ‘স্টাটিউট অব ওয়েস্টমিনিস্টার, ১৯৩১’ ক্লজটি তুলে নিয়ে কানাডাকে তার সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করে। ফলে ‘ব্রিটিশ নর্থ অ্যামেরিকা এ্যাক্ট, ১৮৬৭’-টির নতুন নামকরণ হয় ‘কনস্টিটিউশন এ্যাক্ট, ১৮৬৭’। সেই বছরের ১৭ই এপ্রিলে অটোয়ার পার্লামেন্ট হিল-এ ‘কনস্টিটিউশন এ্যাক্ট, ১৯৮২’-এ স্বাক্ষর করেন ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ আর কানাডার পক্ষে থেকে তাতে স্বাক্ষর করেন প্রাইম মিনিস্টার পিয়ারে ট্রুডো এবং জাস্টিস মিনিস্টার জন ক্রিটিয়েন। ‘কনস্টিটিউশন এ্যাক্ট, ১৯৮২’-এর মাধ্যমে কানাডা একটি পূর্ণ স্বায়ত্বশাসিত দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং ‘কানাডিয়ান চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম’-এর মাধ্যমে আদিবাসীসহ সকল কানাডিয়ান নাগরিকদের পলিটিক্যাল এবং সিভিল অধিকার নিশ্চিত করা হয়। ১৯৮২ সালের ২৭শে অক্টোবরে ‘ডমিনিয়ন ডে’-কে অফিসিয়ালি ‘কানাডা ডে’ হিসেবে নামকরণ করা হয়।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে পহেলা জুলাই অর্থাৎ ‘কনফেডারেশন বার্ষিকী’ বা ‘ডমিনিয়ন ডে’ কিংবা ‘কানাডা ডে’-কে মহিমান্বিত করার জন্য কানাডার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট আবর্তিত হয়েছে এই দিনকে কেন্দ্র করে। ১৯২৭ সালের পহেলা জুলাইতে কানাডার ন্যাশনাল রেডিও নেটওয়ার্ক-এর সাথে কানাডা ন্যাশনাল রেলওয়ে-কে যুক্ত করা হয়। ১৯৫৮ সালে গভর্নর জেনারেলের ‘ডমিনিয়ন ডে’-এর ভাষণ পার্লামেন্ট হিল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করার মাধ্যমে কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন বা সিবিসি তার সারা কানাডাব্যাপী ব্রডকাস্টিং-এর কার্যক্রমের সূচনা করে। কানাডার শততম জন্মবার্ষিকীতে অর্থাৎ ১৯৬৭ সালের পহেলা জুলাইতে ‘অর্ডার অব কানাডা’-এর অভিষেক হয়। কানাডার ন্যাশনাল এনথেম বা জাতীয় সঙ্গীত ‘ও কানাডা’-কে ১৯৮০ সালের পহেলা জুলাই থেকে কার্যকরী করা হয়। এসব কারণে পহেলা জুলাই তারিখটি অর্থাৎ ‘কানাডা ডে’ কানাডার জন্য একটি ‘রেড-লেটার ডে’। অনেকটা কাকতালীয়ভাবে আমার জন্যও। কারণ ২০০৬ সালের পহেলা জুলাই-তে আমরা সিঙ্গাপুর থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে কানাডার ইমিগ্রান্ট হিসেবে টরন্টোর পিয়ারসন্স এয়ারপোর্টে এসে ল্যান্ড করি। 

চীন প্রতি বছর ‘কোয়া ছিং চিয়ে’ পালনের পাশাপাশি প্রতি দশ বছর অন্তর অন্তর বিশেষ আড়ম্বরতার সাথে এই দিবসটি পালন করে। কানাডা সে রকমটি করে থাকে প্রতি পঞ্চাশ বছর অন্তর। সেই সুবাদে ২০১৭ সালের পহেলা জুলাইতে কানাডা বিশেষ আড়ম্বরতার সাথে তার একশত পঞ্চাশতম বা সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পালন করে।  এই উপলক্ষ্যে ‘ব্যাংক অব কানাডা’ কমমেমোরাটিভ বা স্মারক দশ ডলার নোট রিলিজ করে। পাশাপাশি ‘রয়্যাল কানাডিয়ান মিন্ট’ সারা কানাডাব্যাপী ‘আমার কানাডা, আমার অনুপ্রেরণা’ শীর্ষক একটি ডিজাইন কনটেস্ট-এর আয়োজন করে। এই কনটেস্ট-এর বিজয়ী ডিজাইনগুলি দিয়ে প্রচলিত পাঁচটি কয়েন যথা টুনি (২ ডলার), লুনি (১ ডলার), কোয়ার্টার (২৫ সেন্ট), ডাইম (১০ সেন্ট) এবং  নিকেল (৫ সেন্ট)-এর স্মারক কয়েন রের করা হয়। বিজয়ীদেরকে দুই হাজার ডলার ক্যাশমানি, অটোয়া ট্রিপ এবং এক সেট স্মারক কয়েন দেয়া হয়। কানাডার সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সাদা এবং লাল মেশানো ‘মেইপল লিফ টিউলিপ’ নামের এক বিশেষ ব্রীডের টিউলিপ ফুল উৎপন্ন করা হয় যা কানাডার পতাকার রঙের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই বিশেষ টিউলিপ ফুলকে ‘কানাডা ১৫০’ বলেও উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও কানাডার মূল্যবোধকে প্রমোট করে সারা দেশব্যাপী বিভিন্ন কালচারাল অনুষ্ঠান, সিনেমা প্রদর্শনী এবং আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মোট কথা কানাডার বিভিন্ন জাতিসত্ত্বাকে একীভূত করে কানাডিয়ান ন্যাশনালিজমকে প্রচার করা হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ইন্ডিজেনাস জনগোষ্ঠীর ইতিহাস এবং তাদের বর্তমান দুর্দশার কথা কানাডার এই সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উৎযাপনে কোথাও যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি।

আজকে আমরা যে অঞ্চল বা ল্যান্ডকে কানাডা বলে থাকি তা একসময় ছিল ইন্ডিজেনাস জনগোষ্ঠির অধিকারে। ১৭০১ সাল থেকে শুরু করে প্রথমে ব্রিটিশ ক্রাউন এবং পরবর্তীতে কানাডিয়ান সরকার বিভিন্ন ট্রিটি বা চুক্তির মাধ্যমে সেই ল্যান্ডের মালিকানা লাভ করে। কিন্তু এর বিনিময়ে ইন্ডিজেনাস জনগোষ্ঠীকে ‘রিজার্ভ’ এবং আনুসাঙ্গিক ‘সুযোগ সুবিধা’ দেয়ার অঙ্গীকার করা হয়। অথচ কানাডা সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে বারংবার। ‘রিজার্ভ’-এর ভেতর দিয়ে চুক্তি ভঙ্গ করে পাইপলাইন তৈরি করেছে যা কিনা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ। এছাড়াও ‘ইন্ডিয়ান এ্যাক্ট, ১৮৭৬’ দ্বারা ইন্ডিজেনাস জনগোষ্ঠীকে কানাডার কালচারের সাথে অ্যাসিমিলেশন করার একটি অমানবিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ‘বোর্ডিং স্কুল’ স্থাপনের মাধ্যমে। সেই উদ্যোগের কারণে যে গণহত্যা বা জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে তা কানাডার জন্য একটি কলঙ্কিত ইতিহাস। ফলে কানাডার সার্ধশত জন্মবার্ষিকী জনগণ বিশেষ আড়ম্বরতার সাথে উৎযাপন করলেও ইন্ডিজেনাস জনগোষ্ঠী সেদিন ‘কমলা’ রঙের পোশাক পরে শোক প্রকাশ করেছে। যা কানাডার জন্য একটি দুঃখজনক অধ্যায়। ইন্ডিজেনাস জনগোষ্ঠীর সাথে অমানবিক আচরণের কারণে অতীতে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে কানাডাকে চরমভাবে অপদস্থ হতে হয়েছে অনেকবার। যখনই কানাডা অন্য দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলেছে তখনই সেই দেশ কানাডাকে চোখে আঙুল দিয়ে তার নিজ দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ২০২১ সালে কানাডা যখন উইঘুর জনগোষ্ঠীর উপর চীনের নিষ্পেষণ নিয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে তখন চীন কড়াভাবে কানাডাকে সতর্ক করে দেয় এই বলে, কানাডা যে তার ইন্ডিজেনাস জনগোষ্ঠীর ল্যান্ড অন্যায়ভাবে হস্তগত করেছে, তাদেরকে যে নির্বিচারে হত্যা করেছে এবং তাদের সংস্কৃতিকে যে ধ্বংস করেছে, সেগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। ২০১৮ সালে কানাডার ফরেন মিনিস্টার ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড সৌদি এক্টিভিস্ট সামিরা বাদাউয়ি-এর গ্রেফতারকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে টুইট করলে সৌদি সরকার কানাডার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। সেই সময় সৌদি ফরেন মিনিস্টার ইন্ডিজেনাস জনগোষ্ঠীর সাথে কানাডা সরকারের আচরণের কথা উল্লেখ করে বলেন যে কানাডা সরকার ক্ষমা না চাইলে তারা এই বিষয় নিয়ে কোন আলোচনায় যাবে না। তবে আশার কথা যে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর কানাডা এবং সৌদি সরকার অতি সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে তারা আবার পূর্ণমাত্রায় কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে আগ্রহী। সৌদি আরবের সাথে কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে সমর্থ হলেও চীনের সাথে কূটনীতির কূটচালে পাল্লা দিয়ে কতখানি সফল হতে পারবে সে বিষয়ে এখনই জোর দিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

কলাম লেখক । টরন্টো