চক্র

মোল্লা রাশিদ কউসার (পুলক)

জামশেদ কানাডায় প্রায় উনিশ বছর। দুই হাজারের সালের মাঝামাঝি এক সকালে মন্ট্রিয়ালের এয়ারপোর্টে ঢাকা থেকে আগমন। তারপরে বছর চারেক থেকে টরেন্টোতে আসা দুই হাজার সাতে। পার্লামেন্ট রোডের একটা এপার্টমেন্টে তখন থেকে এখন পর্যন্ত। মাঝে দশ সালে বিয়ে হলো আর দু’চ্চা হলো তেরো আর ষোলো সালে। বউ আর বাচ্চা নিয়ে মোটামুটি সুখেরই সংসার। মোটামুটি বলবার কারণ জামশেদ একটা স্বপ্ন নিয়ে কানাডায় এসেছিলো, যা তার পূরণ হয়নি। রসায়নে অর্নাস করা জামশেদ ভেবেছিলো আরও পড়াশোনা করবে, বলার মতো কিছু একটা হবে কিন্তু তার কিছুই হলো না ।

পরিবারের বড় ছেলে বলে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব ছিলো, ছিলো আরও নানারকম চাপ। তাইতো, দেশে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে কিছুদিন এক কোম্পানিতে কাজও করেছিলো জামশেদ। কানাডায় থাকা দু’বন্ধু’র পরামর্শেই আসা এই দেশে, ওরা বলেছিলো এখানে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করে ভালোই কামানো যায়। জামশেদ এখন সেইসব দিনের চিন্তা করে হাসে কারণ ওর দু বন্ধুসহ ওর কারোরই পড়াশোনা করা হয়নি। সবাই কোনো না কোনো কারণে জীবন জীবিকায় এমনভাবে আস্টে-পৃষ্ঠে গেছে যে পড়াশোনা নামক জিনিষটা যে কবে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছে তা কেউই খেয়াল করেনি।

সংসার চালাতে দুবেলা কাজ করে জামশেদ। সকালে কাজ করে এক দোকানে আর বিকেলে নিজের গাড়ি নিয়ে খাবার ডেলিভারীর কাজ করে সে। সকাল সাতটায় বের হয় বাসা থেকে, চারটায় বাসায় ফিরে আবার বের হয়; ফিরতে ফিরতে এগারোটা। জামশেদের বউ রাবেয়া ভীষণ ধৈর্য্যশীল মহিলা, চঞ্চল দু’বাচ্চাকে সামলানোই তার দায়িত্ব। মাঝে টুকটাক বাইরে কাজ করতো। কিন্তু দ্বিতীয় বাচ্চা হবার পর তা পুরোপুরি বন্ধ। এখন চিন্তা চলছে দ্বিতীয় বাচ্চাটা স্কুলে গেলে হয়তো রাবেয়া সকালের সময়টা একটু বাইরে কাজ করতে পারবে ।

ছবি: সংগৃহীত

গত তেরোই জুন জামশেদের সাথে ঘটেছে এক অভাবনীয় কান্ড। যেই খাবারের দোকানে ডেলেভারীর কাজ করে জামশেদ, সেই দোকান থেকে এক বাসায় গিয়েছিলো সে খাবার ডেলেভারী করতে। সেদিন আবার ছিলো রেপটার্স এর খেলা, রেপটার্স হলো টরন্টো’র বাস্কেটবল টিম। সেইদিন ওদের মোটামুটি অঘোষিত ফাইনাল, জিতলে শিরোপা আর না জিতলে আরেকটা ম্যাচ হাতে থাকবে জেতার। জামশেদ তেমন আগ্রহী না এই খেলাটার, যাবতীয় আগ্রহ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিয়ে। আর এই রেপটার্স প্রতিবছর কিছুই জিতে না, কিন্তু তাতেই কানাডিয়ানদের সেকি আহা উহু। কিন্তু বিকেলে দোকানে এসে দেখে ত্রাহী দশা, ফোনের পর ফোন আসছে। সবাই অর্ডার করছে খাবার, যেন খেলা দেখতে পারে খেতে খেতে। কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব, এটা জামশেদের ভালো লাগলো। কারণ সেও দেশে থাকতে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখতো মুড়ি চানাচুর কিংবা সিংগারা-সমুচা খেতে খেতে ।

নয়টার সময় একটা অর্ডার আসলো আর অনুরোধ আসলো যেন সাড়ে নয়টার মধ্যে খাবার বাসায় পৌছে দেওয়া হয়। খাবারটা নিয়েই জামশেদ গাড়ি নিয়ে এক ঝলকে চলে গেলো সেই গন্তব্যে। মাত্র-ই বেল দিয়েছে আর অমনি শুনলো বাসার ভিতরে সম্মিলিত চিৎকার। কিছুটা ভয়ই পেয়ে গেলো জামশেদ, ভাবলো কি না কি হলো। হটাৎ করেই হাসিমুখে এক মহিলা দরজা খুললো আর জামশেদকে বললো,”তুমি তো খুব লাকি?”

থতমত খেয়ে গেলো জামশেদ, বলে কি মহিলা!

মহিলার পিছনে প্রায় গোটা বিশেক মানুষ; বিভিন্ন বয়সের! আর সবার চোখ টিভি’র দিকে। আবার শুরু হলো হৈ হৈ চিৎকার। জামশেদের হাত থেকে মহিলা খাবার নিতে যাবে তখনই স্বাস্থ্যবান এক লোক এগিয়ে এলো, দেখে মনে হলো মহিলার স্বামী। উনি সকল দন্তকুল বের করে জামশেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি জান মাত্র খেলা শুরু হয়েছে আর তুমি বেল টেপা মত্রই আমরা তিন পয়েন্ট পেয়েছি। “

পাগল হয়ে গেলো নাকি সব, মনে মনে ভাবলো জামশেদ।

পাগলামীর যে আরও বাকি আছে বুঝেনি সে।

সেই ভদ্রলোক এইবার বললেন, ” দেখো আমি দরজা লাগিয়ে দিচ্ছি, আবার তুমি বেল দাও। মন বলছে আবার আমরা তিন পয়েন্ট পাব”

বাংলাদেশের লোক জামশেদ, বিনয়ের চূড়ান্ত। ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলো সে রাজী আছে ।

সত্যি সত্যি দরজা বন্ধ হলো ।

আবার বেল দিলো জামশেদ। এইবার দ্বিগুণ জোরে হৈ হৈ করে উঠলো ভিতরের মানুষগুলো। আশেপাশেও কিছু চিৎকার শুনলো সে।

এইবার ভদ্রলোক অট্টহাসি দিয়ে দরজা খুললেন আর বললেন,”আসলেই তুমি লাকি! আবারও আমরা তিন পয়েন্ট পেয়েছি!”

মুচকি হাসি দিলো জামশেদ। ভদ্রলোক আর তার বউয়ের কান্ডে ঘরের বাচ্চাগুলোও মজা পেয়ে গেছে যেন। এইবার ওরাও আবদার নিয়ে এসেছে যে ওরাও দরজা বন্ধ করবে আর জামশেদ বেল দিবে যেন রেপটার্স আবারও তিন পয়েন্ট পায়।

এইবার মহিলা কিছুটা বিব্রত হলেন আর বাচ্চাদের মানা করতে লাগলেল যে বিষয়টা ঠিক হচ্ছে না। বাচ্চারা সব নাছোড়বান্দা, অসহায় মহিলা তাকালেন জামশেদের দিকে,আর বললেন, “তুমি কি আজকের দিনে শেষবারের মতো করতে পার এই জিনিষটা?”

দোকানের ম্যানেজারের আদেশ; কাস্টমার যাই বলুক না কেন, তা মানতে হবে।

হ্যা-সূচক মাথা নারলো জামশেদ।

তৃতীয়বারের মতো বেল দিলো জামশেদ !

এইবার তো গগণবিদারী চিৎকার, আওয়াজ যেন বাড়ির ছাদ তুলে নিয়ে যাবে এমনই অবস্থা। বাচ্চারা হইহই করে দরজা খুললো, জামশেদ বুঝলো এইবারও তিন পয়েন্ট পেয়েছে রেপটার্সরা।ভদ্রলোক এগিয়ে এসে করমর্দন করলো জামশেদের সাথে আর হাতে বিশ ডলারের একটা নোট দিয়ে বললো, ম্যান তুমি খুব লাকি, তাই তোমার জন্য এই বখশিশ ।

ঘটনাগুলো এতো দ্রুত ঘটে গেলো যে জামশেদ পুরো হচকিত হয়ে গেলো। গাড়ি নিয়ে খুব একটা সুখানুভূতি নিয়ে সেই বাসা থেকে দোকানে ফিরে আসলো। পরে আরও অর্ডার আসলো আর ঝটপট ও সেইগুলো ডেলেভারী করতে লাগলো। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ জানতে পারলো যে রেপটার্স জিতে গেছে। পুরো শহর যেন জেগে উঠলো, হৈচৈ যেনো এক বাধ ভাঙ্গা উল্লাস। রাস্তায় সবাই হর্ণ দিচ্ছে, পতাকা নিয়ে উল্লাস করছে। হটাৎ করেই কেন জানি জামশেদ এর মস্তিস্ক তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো সাতানব্বই সালে, মনে করিয়ে দিলো রেপটার্সের এই উৎসবটা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের আইসিসি কাপ বিজয়ের উৎসবের মতোই। উৎসবের কথা মনে হতেই তার মনে পড়লো বন্ধুদের সাথে সেইদিনের আনন্দ মিছিলের কথা, আর জিসান ভাইয়ের কথা। জিসান ভাই, কে এই জিসান ভাই ?

জিসান ভাই ক্যারাম খেলায় ভালো, ভালো বললে অবশ্য ভুল হবে। বলা উচিত বেশ ভালো। নিখুঁত এংগেল আর দূর্দান্ত টেকনিকে খেলে সে। জামশেদদের কেমেস্ট্রি ল্যাবে কাজ করতো। স্যাররা প্র্যাকটিকাল ক্লাস নেন আর তারপরে জিসান ভাই মাইক্রোস্কোপ বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে প্র্যাকটিকাল দেখাতেন। অনেকেই ভাবতো, জিসান ভাইও বুঝি শিক্ষক। সেইরকম ভাব নিয়ে চলাফেরা করতো আর গম্ভীর করে কথা বলতো বলে সবারই সেই ভুল ধারণা হতো বলে বিশ্বাস।

জামশেদের অবশ্য এইসব মানুষদের সাথে সহজেই ভাব হয়ে যায়। প্রথম দিনই বুঝে গেছিলো জিসানের যে গম্ভীরতা তা উপরের একটা মুখোশ, ভেতরে ভেতরে এক চরম রসিক মানুষ জিসান ভাই। মাঝে মাঝে প্র্যাকটিকাল করার সময় কথার খোঁচা দিতো জামশেদ কিংবা তাদের বন্ধুদের, ছেড়ে দিতো না কেউ কাউকেই। সেভাবেই আস্তে আস্তে কথায় কথায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে।

ক্লাসের ফাঁকে আড্ডায় কিংবা টং দোকানের সামনে চা খেতে খেতে অর্থপূর্ণ কিংবা অর্থহীন কতো কতো কথা হতো। ক্যারাম খেলার কথা ভাবছিল জামসেদ। কলেজের কমন রুমে ছিলো ক্যারাম বোর্ড। সেই রুমেই আবার ছিলো কলেজের একমাত্র টিভি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবগুলো ম্যাচ চার বছরে মনে হয় ঐখানেই দেখেছে জামশেদ। অনেক আনন্দ বেদনার স্মৃতি আছে ঐ রুমে। তখনকার সময়ে জিম্বাবুয়ে এর সাথে ফাইট করা ছিলো জেতার মতো বিরাট ব্যাপার। ছোটখাটো মিছিলের মতো হয়ে যেতো আর শ্লোগান দেওয়া হতো গগণবিদারী।

এতো কিছুর মধ্যেও  জিসান ক্যারাম খেলতো। জামসেদরা হইচই করতো। জিসান মুখ কুচকে একটুখানি মাথা উচিয়ে টেলিভিশনের দিকে তাকাতো। এক পলকেই আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে ক্যারাম খেলায় ডুবে যেতো। মাঝে মাঝে জামসেদরা ক্ষ্যাপাতো তাকে এই বলে যে খেলা নিশ্চয়ই সে বুঝে না তাই খেলা দেখে না, ইত্যাদি ইত্যাদি বলে। পুরোটাই টিটকারী ছিলো বলে জিসান ভাইও বাকা জবাব দিতো এই বলে, “আরে ভাই এই খেলায় এতো নিয়মকানুন যে আগ্রহই হয় না দেখবার। খেলা হচ্ছে ফুটবল, গোল হবে, স্কিল দেখা যাবে আর নব্বই মিনিটের মধ্যে খেলা শেষ।”

জামসেদরা আরও বেশি বেশি ক্ষ্যাপাতো তাকে এই বলে যে, আরে জিসান ভাই তো এল.বি.ডাব্লিও-ই বুঝে না, খেলা দেখে লাভ কি? পাল্টা উত্তরও যেন তৈরী থাকতো , ” আরে ছোটবেলায় খেলেছি ফুটবল; পেলে, রসি, ম্যারাডোনা আরও কতো কতো প্লেয়ার আমাদের আনন্দ দিয়েছে। পাঁচদিন খেলেও যে খেলার ফল আসে না, সেটা কোনো খেলা হলো” এক নিশ্বাসে অভিযোগের সুরে বলে জিসান ভাই। এই রকম খোঁচাখুচি প্রায়শই চলতো, ঠাট্টাচ্ছলে অনেক তীর্যক কথা হলেও সবাই তা ভুলেও যেত আবার । কেউই গায়ে মাখাতো না এগুলো।

একদিন টং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিংগাড়া খাচ্ছিলো জামশেদ, সেইসময়ই জিসান ভাই হাজির। বললো, জামশেদ ভাই ফ্রী আছেন?

জামশেদ

বললো, হ্যাঁ ভাই! কেন? কথা আছে কোনো কি?

– হ ভাই, কথা আছে।

– বলেন কি বলবেন!!

– না মানে! জামশেদ ভাই, আপনাকে যে খেলা নিয়ে বাকা বাকা কথা বলি, রাগ করেন নাতো?

– আরে জিসান ভাই, আপনি এতো ফরমাল হলে চলে? আমরা তো দুষ্টামী করি, আপনি কি বোঝেন না!!

– না জামশেদ ভাই, তবুও। আসলে জীবন আর জীবিকা নিয়ে এতোটাই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকি যে এইসব সাড়ে সাত ঘন্টা খেলা দেখে সময় নষ্ট করতে চাই না। খেলার পোকা ছিলাম একসময় রে ভাই। কিন্তু পেটের তাগিদে এইসব বাদ দিয়ে দিয়েছি!! লোভ লাগে আর দেখতেও ইচ্ছে হয়। কিন্তু কি আর করা!!

অবাক হয়ে শুনে গেলো জামশেদ কথাগুলো। কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু সেই সুযোগ জিসান ভাই দিলো না। মুচকি হেসে বিদায় সংকেত দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলো। মনটা খারাপ হয়ে গেলো জামশেদের, এমন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলেছে যে যেখানে সান্ত্বনাও পরিহাসের মত শোনাবে। অসহায় লাগলো কিছুক্ষণ, তারপরে চলে গেলো সে ক্লাসে।

হটাৎ করেই জিসান ভাইয়ের সাথে নিজের জীবনটা মেলানো শুরু করে জামশেদ। জিসান ভাই বলেছিলো আসলে জীবন আর জীবিকা নিয়ে এতোটাই দুঃচিন্তাগ্রস্ত থাকতো যে সাড়ে সাত ঘন্টা খেলা দেখে সময় নষ্ট করার সময় নাই, জামশেদের যেন একই অবস্থা। খেলার পোকার ভূত নেমে গেছে জামশেদের ।

জীবন যেন একটা চক্র, ঘুরে ঘুরে যেন আসে সবার কাছেই। যতই বদলাতে চাও না কেন, চক্র হয়ে ঘুরে ঘুরে আসবে জীবনের কোনো এক সময়ে ॥

মোল্লা রাশিদ কাউসার (পুলক)

{গল্পের লেখক কানাডা প্রবাসী মোল্লা রাশিদ কাউসার (পুলক)}