আপন পরের খেলা
জসিম মল্লিক
পুরুষদের জন্য ষাটোর্ধ বয়সটা সার্কাসের তারের উপর দিয়ে হাঁটার মতো বিপদ্জনক। এই বয়সটা খুবই নির্জনতার, একাকীত্বের এবং অভিমানের। কি যেনো একটা থাকার কথা এই বয়সে কিন্তু নেই। থাকলে ভাল হতো। সংসারের মধ্যে থেকেও মনে হয় কোথাও নেই। মনে হয় অতিথি, যেনো বেড়াতে এসেছে, আবার চলে যাবে। নিজের মধ্যে নিজে গুটিয়ে থাকার বয়স, গুটিয়ে যাওয়ার বয়স। একাকী হয়ে যাওয়ার বয়স। চারিদিকে সবই আছে, সন্তান আছে, স্ত্রী আছে, বন্ধু আছে, আত্মীয় আছে কিন্তু মনে হয় আসলে তারা নেই। যেনো কাছে থেকেও দূরে। সন্তানেরা নিজের জগত, নিজের সংসার, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জীবন নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা থাকে তাঁদের। বাবা মায়ের সাথে সম্পর্কটা হয়ে পড়ে লৌকিক। স্ত্রীর সাথে এক ধরণের জীবন যাপন থাকে শুধু এর বেশি কিছু না। তাদের সহ্য ক্ষমতা কমে যায়। তাদের প্রায়োরিটি তখন সন্তান, নাতি পুতি, নিজের মা-বাবা, ভাই-বোন। স্বামী তখন একটা বাড়তি মানুষ, বিরক্তিকর। এই বয়সে বেশিরভাগ মানুষ টুপ করে চলেও যায়। অনেকেই চলে গেছে। যারা গেছে তারা আর ফিরবে না।
প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে মনে ভাবি আর একটা বাড়তি দিন পাওয়া গেলো। এই বয়সে একাকী থাকা খুবই ঝুঁকির্প্ণূ। যদি ঘুমের মধ্যে চলে যাই কেউ জানবে না। প্রিয়জনের হাতের স্পর্শ পড়বে না। মুখে পানি দেওয়ারও কেউ থাকবে না। কত আপনজন দূরে সরে গেছে। এমন হওয়ার কথা ছিল না। সমস্যাটা কোথায় বুঝতে পারি না। এজন্য কে দায়ী তাও বোধগম্য হয় না। আমি কী একটু অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছি! অবচেতনে কোনো আত্মঅহমিকায় ভুগছি! তা যদি হয় তাহলে নিজেকে নিজে ধিক্কার দেই। ছিঃ জসিম ছিঃ! যদি অন্যের জন্য হয় তাহলে আমার কিছু করার নেই। আমি বারবার তাদের কাছে যেতে রাজী আছি। তখন নিজের আত্মসম্মানের কথা ভাবব না। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য যতটুকু করা দরকার করতে দ্বিধা করব না আমি। ভাঙ্গনকে আমি ভয় পাই। আমার প্রিয়জন যদি দশবারও আমার ডাকে সারা না দেয়, আমার ফোন না উঠায় তাহলেও আমি তাঁকে মুছে ফেলব না। আশায় থাকব একদিন ফিরবে। যদি আমি ভুল করি একদিন আমি আমার ভুল বুঝতে পারব।
সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছি। নিজেকে না ঘরকা না ঘাটকা মনে করতে চাইনা। কিছুই সুচারুরূপে করতে পারিনি। সব কিছুতে নিজেকে এডজাষ্ট করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। অভিমান অনেক তীব্র আমার। স্বপ্নের মতো কিছুতেই উজান ঠেলে সামনের দিকে এগুতে পারি না। সবকিছু মেনে নিতে পারি না। নিতে পারলে ভাল হতো। নিজেকে নিজে অনেক বুঝাই। মনকে প্রবোধ দেই। নিজেকে বলি, জসিম, সবকিছু তোমার চাওয়ার মতো ঘটবে না। সবকিছু তোমার হাতে নেই। নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিয়মিত প্রে করি, গান শুনি, মুভি দেখি, বই পড়ি, লিখি, ভ্রমণ করি। কোনটার সাথে কোনোটার বিরোধ হয় না। এর বাইরে আর কিছু করার ক্ষমতা আমার নাই। মানুষের মন জয় করা অনেক কঠিন কাজ। নিরবচ্ছিন্নভাবে কারো প্রিয় হয়ে উঠতে পারা সহজ কাজ না। যাদের আপন মনে করতাম তারা পর হয়ে যায়। আবার যারা দূরের তারা আপন হয়ে উঠে। এই পৃথিবী অনেক রহস্যময় জায়গা। আপন পরের এই জট কিছুতেই খোলে না। একটা গোলক ধাঁধা যেনো। ষাটোর্ধ বয়সটা এমনই বোধকরি। এই বয়সে দরকার নিরবচ্ছিন্ন ভালবাসা, কেয়ার আর আপনজনের সান্নিধ্য। – ঢাকা ৪ জানুয়ারি ২০২৩
একজন কামাল ভাই
প্লেন যাত্রায় সবসময় আমি আইল সীট প্রেফার করি। লম্বা হোক, মাঝারি হোক আর শর্ট জার্নি হোক এটা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। তবে আইল সীটের অনেক হ্যাপাও আছে। সারাক্ষণ যাত্রী এবং কেবিনক্রদের ঘষ্টানি সহ্য করতে হয়। মাঝে মাঝে ওভারহেড আইটেমের সাথে মৃদু ঘসাঘসিও লাগে। আমি নীরবে সেসব সহ্য করি। আইল সীট নেওয়ার কারণ আমার নী পেইন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নী পেইন আর তেমন ভোগাচ্ছে না তবুও আমার আইল সীট চাই। এর আরও একটা সুবিধা হচ্ছে যখন তখন উঠে পায়চারি করা যায়, ওয়াশরুমে যাওয়া যায়। মাঝের আসনে বা জানালার পাশে বসলে অন্যদের জ্বালাতন করতে হয়। আমি আইল সীট নেই বলে আমাকেও এই অত্যাচার সহ্য করতে হয়। বার বার উঠতে হয়। দ্বিমুখী অত্যাচার। তাই আইল সীটের সুবিধা যেমন আছে অসুবিধাও আছে। ট্রাভেল এজেন্ট বা অনলাইনে টিকিট করলেও আইল সীট নেই, নিজে চেক ইন করলেও তাই। বোর্ডিং এর সময়ও অনুরোধ করি। আমার টিকিট বা চেক ইন প্রায়শই অরিত্রি করে দেয় আর অরিত্রি ভালকরেই জানে আমি আইল সীট প্রেফার করি। কিছু এয়ার লাইন্সে আগে ভাগে সীট সিলেক্ট করলে পঞ্চাশ ডলার পে করতে হয়। যাত্রার ২৪ ঘন্টা আগে ফ্রি করে দেয় চেক ইন।
গত বছর এমিরেটসে টরন্টো ফিরছি। ঢাকা থেকে দুবাই পর্যন্ত আইল সীট পেলেও দুবাই থেকে টরন্টো আইল সীট পেলাম না। ২৪ ঘন্টা আগেই ট্রাই শুরু করেছিলাম কিন্তু আইল সীট পাইনি। এয়ারপোর্টে চেক ইন করার সময় রিকোয়েষ্ট করে অনেক সময় পাওয়া যায়। কিন্তু ঢাকা থেকে অনেক রিকোয়েষ্ট করার পরও কাজ হলো না। কিছুতেই সুন্দরী নারীর মন গলাতে পারলাম না। সাধারণতঃ নারীদের ফেবার পাই আমি কিন্তু এবার সম্ভব হয়নি। সত্যি হয়ত আইল সীট এভেলেবল ছিল না। বিজনেস ক্লাসে এই সমস্যা নাই। গরীবের নানা সমস্যা। দুবাই থেকে ফ্লাইটে উঠেছি। আমি মাঝখানে বসেছি। উইন্ডো সীটে একজন ইন্ডিয়ান মেয়ে। আইল সীটে একজন ইন্ডিয়ান ছেলে। আমি ছেলেটার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। ছেলেটি বেশ লম্বা। ছয় ফুটের বেশি হবে। প্রথমবার কানাডা যাচ্ছে। স্ত্রী পড়াশুনা করে। হাজবেন্ডকে স্পন্সর করেছে। প্রায় দশ ঘন্টা গাড়িতে করে দিল্লী এসে ফ্লাইট নিয়েছে। আমি মজা করে বললাম, তোমরা দু’জনই ইন্ডিয়ান, পাশাপাশি বসো। তাছাড়া আমার একটু পায়ে সমস্যাও আছে। ছেলেটি তৎক্ষনাত রাজী হয়ে গেলো। আমাকে আইল সীট ছেড়ে দিল। মাঝখানে বসে ছেলেটির পা রাখতে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম। যেনো দুই পা খুলে গুটিয়ে রাখতে পারলে ভাল হয়। আমার মায়া হলো। বললাম, তুমি তাহলে আইল সীটেই আসো। সে রাজী হলো না।
এ বছর বিমান বাংলাদেশে আমি ঢাকা আসি। টিকিট করার সময়ই ফ্রি সীট সিলেক্ট করতে দেয় বিমান। বিমানের ভাড়াও অপেক্ষাকৃত কম অন্য এয়ারলাইন্সের তুলনায়। ঢাকা-টরন্টো ফ্লাইট ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিমান যদি তাদের চিরাচরিত ’টিকিট নাই অথচ সীট খালি’ এই থিউরিতে ফিরে না যায় তাহলে বিমান এই রুটে ভাল ব্যবসা করবে। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরন হবে। যাত্রীদের ভোগান্তি কমবে। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ড্রীমলাইনার দিয়ে ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে ভাবতেও ভাল লাগে। আমি এবার বাঁ দিকে আইল সীট নিয়েছিলাম। আমার বাঁ নীতে যেহেতু সমস্যা হয় তাই বাঁ পা স্ট্রেস করা যায় প্যাসেজে। আঠারো ঘন্টার ননস্টপ জার্নি কম নাতো! বিমানের ইকোনমি ক্লাসের লেগ স্পেস অপেক্ষাকৃত কম তাই ফেরার টিকিট অলরেডি আপগ্রেড করে নিয়েছি। আসার সময় আমার পাশে বাংলাদেশের এক তরুণ দম্পতি বসেছিল। তরুণটি মাশাল্লাহ গায় গতরে ভাল। সাইজে আমার তিন জনের সমান। তার হাসি খুশী স্ত্রীও কম যায় না। তাহলে বুঝতেই পারছেন পাশে বসে আমার কেমন ত্রাহি অবস্থা হয়েছিল! তার উপর কিছুক্ষণ পর পর দুজনেই প্রতিযোগিতা করে ওয়াশরুমে যাচ্ছিল!
আসল গল্প বলতে গিয়ে একটু শীবের গীত গাওয়া হয়ে গেলো। আমার বন্ধু কামাল ভাইর কথা বলি। কামাল ভাইও আমার চেয়ে সাইজে ভাল। সেটা গত বছরের কথা। ফেব্রুয়ারী মাস। আমি বরিশাল থেকে ঢাকা ফিরছি। বলে রাখি আমি ডোমেস্টিক রুটে বিমানের ফ্লাইট প্রেফার করি। বিমান যদিও প্রায়শঃই লেট লতিফ তাও বিমান পছন্দ। এবারও কক্সবাজার বিমানেই ট্রাভেল করেছি। পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় ঢাকা বরিশাল রুটে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে প্লেন এবং লঞ্চ সার্ভিস দুটোই। আমি যথারীতি আইল সীটে বসেছি। বিমানের ড্যাশ এইট এয়ারক্রাফট। ছোট্ট কিন্তু বেশ ভাল এয়ারক্রাফট। রেকর্ড ভাল। কানাডার বোম্বারডিয়ার তৈরী। মাত্র আধা ঘন্টার যাত্রা। উঠা আর নামা। আমার পাশের যাত্রী জানালা নিয়ে আকাশ দেখছে। মুখটা ভাল মতো দেখতে পাচ্ছি না। একটু কী গাম্ভীর ছিল! গম্ভীর মানুষদের আমি সমঝে চলি। একটু ভয়ও পাই। কি না কি আবার ভুল হয়ে যায়। মানুষটা ঘুরতেই আমার গায়ে গা লেগে যায়। কারণ তার সাইজ। দেখলাম মানুষটা গম্ভীর না একদমই, বেশ হাসিখুশী মুখ। আমি সাহস পেয়ে হেসে বললাম, হ্যালো। তারপর পরিচয় হওয়ার পর জানলাম আমরা পরষ্পরকে ভালমতো চিনতাম। একসাথে গল্প, আড্ডা, সাহিত্য নিয়ে মেতে ছিলাম। বিয়াল্লিশ বছর আগের কথা।
আমি যাব চামেলিবাগ আর কামাল ভাইর বাসা ইস্কাটন। কাছাকাছিই বলা যায়। কামাল ভাই বললেন, আপনাকে ড্রপ দিচ্ছি। গাড়িতে উঠে দেখি টরন্টোতে আমি যে গাড়ি চালাই কামাল ভাইর সেই গাড়ি। নিসান রোগ, এসইউভি। এখানে অবশ্য ভিন্ন নাম। নিসান এক্সট্রেইল। কাকতলীয় বটে। গাড়িতে যেতে যেতে গল্প হচ্ছে, স্মৃতিচারন করছি আমরা। এমন সময়ে বরিশাল থেকে আনসারি নামে একজন ফোন দিল কামাল ভাইকে। হঠাৎ কিভাবে যেনো আমার কথা উঠল। সেদিনই আমি বরিশাল নিয়ে একটা লেখা ফেসবুকে পোষ্ট করেছিলাম। আনসারি আমার ফেসবুকে না থাকলেও লেখাটা সে পড়েছে। সেটা নিয়েই কথা বলছিল। কামাল ভাই মজা করে তাঁকে বলল, নে কথা বল। আমাকে ফোনটা ধরিয়ে দিল। আমি তার সাথে কথা বলছি। পুরো বিষয়টাই ছিল ইন্টারেষ্টিং। আমি কামাল ভাইর গাড়িতে, বহু বছর পর দেখা আর তখনই একজন অচেনা মানুষ ফোন করে আমার কথাই বলছে! আজবই বটে। গত বছর আমরা একসাথে পদ্মা সেতু দেখতে গিয়েছিলাম। হিলসায় খিচুরি খেলাম। তখনও পদ্মা সেতু চালু হয়নি। লঞ্চে পদ্মা পারি দিয়ে আমরা বরিশাল গিয়েছিলাম দু’জনে। এবার কামাল ভাইর সাথেই পদ্মাসেতু দিয়ে প্রথমবার বরিশাল গেলাম এবং ফিরলামও একসাথে। বরিশালের আশে পাশের জায়গাগুলো আমরা ঘুরেছি গত বছর।
কত পুরনো বন্ধু হারিয়ে যায় জীবন থেকে। আবার নতুন করে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। পুরনো বন্ধুত্ব নতুন করে জোড়াও লাগে। জীবন আসলেই অদ্ভুত। এবার অনেক পুরনো বন্ধুর সাথেই দেখা হয়নি। সবার ব্যস্ততা, জীবনযুদ্ধ। আমি এসব মেনে নিয়েছি। আমার খারাপ লাগছে না। অনেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। অনেক আত্মীয়তায় পলি পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। জীবন এমনই। দু’হাত ভরে যেমন দেয় আবার কেড়েও নেয়। কোনো কিছুই স্থায়ী না। কামাল ভাই মানুষটাকে আমার ভাল লেগেছে। সহজ এবং স্বাভাবিক মানুষ। জীবন সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার। কোনো জটিলতা নাই। হামবরা ভাব নাই। অন্যদের মতো গাড়ি বাড়ির গল্প করেন না। প্যাশোনেট এবং দ্বায়িত্বশীল। এক ছেলে এবং এক মেয়ে। আমার মতোই। ছেলে ফিনল্যান্ডে পড়াশুনা করে। মেয়ে ঢাকায় বড় চাকরি করে। সম্প্রতি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে শশুড় হয়েছেন। কামাল ভাইর স্ত্রী জিনিয়া ভাবি অসাধারণ একজন মানুষ। তারমধ্যে একটা নরম মাতৃসুলভ ব্যাপার আছে। সবসময় হাসিমুখ। বাসায় গেলেই এমনভাবে আতিথেয়তা দেন যেনো কত বছর ধরে চেনা। আমার লেখা পছন্দ করেন। কিছু সুন্দর মনের মানুষ আছে বলে পৃথিবী আজও সুন্দর। বেঁচে থাকা আনন্দের। আমরা যতই স্বার্থপরতার কথা বলি, যতই মমতাহীনতার কথা বলি পৃথিবীর ব্যালেন্স তখনই ঠিক থাকে যখন ভালবাসাময় মানুষ পাশে থাকে। আমার ঢাকা তথা বাংলাদেশের নিঃসঙ্গ জীবনের মধ্যে কামাল ভাইর উপস্থিতি বসন্তের বাতাসের মতো হৃদয়গ্রাহী ও স্বতস্ফুর্ত।
– ঢাকা ২৩ জানুয়ারী ২০২৩
পিকুর কথা
আমি যে প্রায় প্রায় ব্যাকপেইনে ভুগি এটা কোনো নতুন কথা না। এ নিয়ে বহুবার লিখেছি। তরুণ বয়স থেকেই এটা আমার সঙ্গী। আমাকে কখনও ছেড়ে যায় না। যাবে বলেও আর মনে করি না। ১৯৯১ সালে আমার লাম্বার ২ এবং ৩ তে সাজারি হয়েছিল। তার আগে কয়েক বছর ভয়ানক ব্যাথায় ভুগছিলাম। সাজারি হওয়ার পর বলতে গেলে নতুন জীবন পাই আমি। তখনকার সময়ে সবচেয়ে বড় নিউরো সাজন প্রফেরসর রশীদ উদ্দীন সাজারি করেছিলেন। এরপর মাঝে মাঝে ব্যথা হয়েছে আবার চলেও গেছে। এভাবেই চলছে, এভাবেই চলবে। ডাক্তার বলেছেন সাবধান মতো থাকতে, নিয়মিত এক্সারসাইজ করতে, বেন্ড না হতে, ভারি জিনিস না তুলতে, নিজের ওজন না বাড়াতে। নিজের ওজন কমানো ছাড়া বাড়েনি। তবে বিদেশে থাকি বলে ভারি জিনিস তুলতেই হয় মাঝে মাঝে। ব্যাকপেইনটা হুট হাট চলে আসে। আমাকে না বলেই আসে। তবে সবসময় সহনীয় পর্যায়ে থাকে না এই যা।
যেমন কাল রাতে হঠাৎ করে ব্যথা শুরু হলো। বিকেলে থেকেই টের পাচ্ছিলাম, তার উপর বন্ধু পিকুর সাথে উত্তরা গিয়েছিলাম ওর বাড়িতে। টৃম্পার সাথে একটা বাড়ির ডিজাইন নিয়ে কথা বলেছি উত্তরার একটা রেষ্টুরেন্টে। ঘরে ফিরলাম রাত দশটায়। রাত বাড়তেই টের পেলাম ডানদিকের হিপ অবশ হয়ে আসতেছে। ব্যাথাটা দুই পায়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল ক্রমশঃ। এক ধরণের নামনেস হচ্ছিল। কোমড় থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত ব্যাথা। সারা রাত যন্ত্রণায় কাতরালাম। গরম শেক, ব্যথা নাশক ওষুধ, ন্যাপ্রোক্সিন খেলাম তাও কাজ হচ্ছিল না। কাউকে বলতেও পারছিলাম না। গভীর রাতে কাকেইবা বলব। বিপদের সময় ডাক্তার বা হাসপাতালের নাম মনে পড়ে না। কাউকে বিরক্ত করতেও ইচ্ছে করে না। ৯১১ কল করার কথা মনে পড়ে না। কষ্টের রাতও একসময় ভোর হয়। সকালে ম্যাসেজ করার পর মাসলের স্টিভনেসটা চলে যায় এবং ব্যথাও কমতে থাকে। কালকে বরিশাল যাওয়ার প্রোগ্রাম আমার কামাল ভাইর মেয়ের বিয়েতে। টিকিট, হোটেল বুকিং সব দেওয়া আছে। যেতে কি পারব! ব্যাথা বাবা যে আবার ফিরে আসবেন না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হে ব্যাথা তুমি আর এসোনা। বুড়ো বয়সে ব্যাথা বেদনা হলে সেবা করবে কে! বুড়োদের জন্য তখন ওল্ডহোমই শেষ আশ্রয়!
কালকে পিকুর সাথে এইসব নিয়েই কথা হচ্ছিল। বুড়ো বয়সে কেমন কাটবে সেসব নিয়ে। বরিশালে একটা বাড়ি করতে চাই যেনো হোটেলে না থেকে নিজের বাড়িতে থাকতে পারি সেইসব নিয়ে পিকু ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ চাইছিলাম। পিকুর এক ছেলে এক মেয়ে দুজনই কানাডা থাকে। স্বামী-স্ত্রী মাঝে মাঝে ছেলে মেয়ের কাছে যায় বেড়াতে। ভাবি চমৎকার একজন মানুষ। সাদা সিধে ধরণের একজন মহিয়সী মা। পিকু সরকারি চাকরি থেকে অচিরেই রিটায়ারমেন্টে যাবে। তখন আর বাঁধা থাকবে না বিদেশ যাওয়ার। ইতিমধ্যেই সরকারি পাসপোর্ট সারেন্ডার করে দিয়েছে। ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছে। আমিও ই-পাসপোর্টের নিয়ম কানুনগুলো জেনে নিলাম। দশ বছর মেয়াদী। দশ বছর বাঁচবতো! না বাঁচলে নাই। মরে গেলে সবই পড়ে থাকে। কিছুই সাথে নিয়ে যাওয়া যায় না। পিকু আমার এমন একজন বন্ধু যার সাথে আমি সব শেয়ার করতে পারি। কোনো রাখ গুড় গুড় নেই আমাদের। মন খোলা হতে পারি। আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন সে। আমরা ভাইয়ের মতো। আমি আমার অনেক বন্ধুর কথাই লিখেছি কিন্তু পিকুর কথা খুউব বেশি লেখা হয়নি। সে খুবই একজন ইনট্রোভার্ট টাইপ মানুষ। খুবই প্যাশোনেট। খুবই দ্বায়িত্বশীল। যা বলে তা বিশ্বাস থেকে বলে, যা বলে তা করে।
আমাদের বন্ধুত্ব বহু বছরের। ১৯৮৯ সালে যখন আমি জেসমিনকে বিয়ে করা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দে ভুগছি তখন পিকু আমাকে সাহস জুগিয়েছিল। দ্বিধা দ্বন্দ্ব এই জন্য যে তখনও আমার চাল চুলা বলে কিছু নাই। নিজের থাকা খাওয়ারই সংস্থান নাই। বিয়ে করে কি ফার্মগেট ওভার ব্রীজে থাকব! সুতরাং নো বিয়ে শাদি। গুড বাই জেসমিন। কিন্তু পিকু সাহস জুগিয়েছিল। পাশে থেকেছিল। আজও পিকুর আমার চেয়ে জেসমিনের প্রতি পক্ষপাত বেশি। নব্বই দশকের দিকে একটা দীর্ঘ সময় ধরে পিকুর সাথে আমার বিচ্ছিন্নতা চলে আসে। সেজন্য তার যতটা না দায় তারচেয়ে আমার দায় বেশি ছিল। আমার স্বভাবসুলভ নির্লিপ্তততার কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা চলে আসে। কিছুটা অভিমানও ছিল আমার। পিকু হয়ত তা কখনও টেরও পায়নি। টের পেলেও এটা নিয়ে আমরা কেউ কথা বলিনি। তেমন অভিযোগও করিনি পরস্পরকে।
আবার আমাদের যোগাযোগ ঘটে যায়। গতবছর টরন্টোতে অনেক বছর পর আমাদের দেখা হয়েছিল। আমরা এসকাথে কফি খেয়েছিলাম। কফির কাপে চুমুক দিয়ে পুরনো অভিমান ভুলেছিলাম। পিকু অনেকখানি বদলে গেছে ফিজিক্যালি। আমিও। সময় সবকিছু বদলে দেয়। শুধু মনটাই বদলায় না। পুরনো দিনগুলো ফিরে পেয়ে আমি যারপরনাই আনন্দিত। জীবন থেকে সবকিছু হারিয়ে যায় না। কিছু হারায় কিছু থেকে যায়। আর যা কখনোই হারায় না তা হলো স্মৃতি। আমাদের অনেক মধুর স্মৃতি আছে। সেগুলো রোমন্থন করেও বাকি জীবন পার করে দেয়া যায়। জীবনে ভাল হোক আর মন্দ হোক ডিসিশন নিতে পারাটাও একটা বড় ব্যাপার যেটা আমার নাই। কিন্তু পিকুর আছে। আমি কুইক ডিসিশন নিতে পারি না। ডিসিশন নিতে গিয়ে প্রায়ই ভুল করি। হেরে যাই। এবং হারতে হারতে জিতে যাই। প্রকৃতি আমাকে জিতিয়ে দেয়। পিকুর সাথে নতুন দেখা হওয়াটাও প্রকৃতির খেলা। আমরা আসলে কখনও হারাইনি বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম।
– ঢাকা ২৬ জানুয়ারি ২০২৩
কাল রাতে চোখে জল এসেছিল!
বেশ কিছুদিন হয় দেশে এসেছি। সাধারণত আমি বইমেলাকে উপলক্ষ করে দেশে আসি। কিন্তু এবার কিছু বৈষয়িক কাজে আগে ভাগে আসতে হয়েছে আমাকে। যদিও আমি মোটেও বৈষয়িক নই। গাড়ি, বাড়ি, সম্পদের পিছনে কখনও দৌঁড়াইনাই। ওসব ছাড়াও জীবন দিব্যি চলে যাচ্ছে। লেখালেখির জন্য আমি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। অনন্ত ত্যাগ। বইয়ের প্রতি ভালবাসা আমার কখনও যাবে না। কালকে বইমেলার উদ্বোধন হবে। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার দাওয়াত পত্র পেয়েছি। আমি খুবই উদ্বেলিত। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি নতুন বই, লেখক, পাঠক আর প্রকাশকদের মিলন মেলার।
জীবনে সবাই সব পাবে না। ধন সম্পদ না হলেও জীবন বৃথা হয়ে যাবে না। জীবনে যা পেয়েছি তাওতো কম না। এতো কিছু পাওয়ার কথা ছিল না। সবচেয়ে বেশি পেয়েছি মানুষের ভালবাসা। এরচেয়ে বেশি কিছু লাগে না। আর পেয়েছি একটি পরিবার। সন্তান। আমার সন্তানদের মতো আর কেউ আমাকে এতো ভাল বোঝে না। অর্ক, অরিত্রি এমন মানুষ যারা কখনও কোনো অভিযোগ করেনি, ভুল ধরেনি আমার, কোনো কিছুর জন্য বায় নাক্কা করেনি। আমি যা বলি, যা করি তাতেই ওদের সম্মতি থাকে। ওদের সাব কথা বাবাকে বাবার মতো থাকতে দাও। অর্ক সবসময় বলবে, বাবা তুমি তোমার লাইফ এনজয় করো। যা মন চায় করো। যেখানে যেতে ইচ্ছে করে যাও। কারো জন্য বসে থেকোনা।
অক অরিত্রিকে খুউব মিস করছি। কাল রাতে ঘুমের মধ্যে চোখ ভিজে উঠেছিল ওদের কথা মনে করে। কতদিন দেখি না। সকালেই হোয়াটসএপে ফোন অর্ক-র। আজব কান্ড! তখন টরন্টোতে রাত সাড়ে এগারোটা।
বাবা কি করো।
এইতো চা খাই। তুমি কি করো।
একটু পড়ছি।
ঘুমানোর আগে বই পড়া অর্ক-র চিরাচরিত অভ্যাস। বালিশের পাশে একটা দুটো বই সবসময় থাকে। বই ছাড়া ঘুমাতে পারে না।
আমার বইয়ের কভার পাঠিয়েছি দেখেছো!
হ্যাঁ কভার সুন্দর হয়েছে। বইয়ের নামও সুন্দর।
খাতিজা কেমন আছে! অফিসে যেতে হয়!
হ্যাঁ দুই দিন যেতে হয়।
ঠান্ডা কেমন তোমাদের !
অর্ক থাকে বোমেনভিল নামে সুন্দর ছিম ছাম ছোট্ট এক শহরে। ওখানে টরন্টোর চেয়ে একটু বেশি ঠান্ডা।
কালকে মাইনাস দশ ছিল। বাবা ঠান্ডায় তোমার গাড়ির ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছিল। সিএএ কল দিয়ে নতুন ব্যিাটারি লাগিয়েছি।
আমি আসার সময় আমার গাড়ি অর্ক-র ড্রাইওয়েতে রেখে এসেছি কারণ জেসমিন ড্রাইভিং জানে না।
ভাল করছো। মাঝে মাঝে একটু ড্রাইভ কইরো।
আর বাবা নিসান থেকে চিঠি এসেছে। তোমার মডেলের সব গাড়ি রিকল করেছে। কোথায় যেনো ক্রটি ধরা পড়েছে। আমাদের এখানে নিসানের একটা শোরুমে আছে। কালকে যোগাযোগ করব।
অর্ক আমাকে না জিজ্ঞেস করে কিছুই করবে না।
আচ্ছা যেটা ভাল হয় করো আব্বু।
অরিত্রি ফোন দিয়েছিল তিন চার দিন আগে। মাঝে মাঝে লিঙ্ক পাঠায় আমাকে। যেমন আর্জেন্টিনা ফুটবল দল বাংলাদেশে আসতেছে বা আর্জেন্টিনা এম্বাসী খুলতেছে ঢাকায় এসব পাঠায়। মেসির কোনো খবর থাকলেও পাঠায়। তখন আমি বরিশাল যাচ্ছি। গ্রীন লাইনের কাউন্টারে বসে আছি তখনই অরিত্রির ফোন। প্রায় এক সপ্তাহ পর অরিত্রির ফোন পেলাম। মনে হচ্ছিল কতদিন অরিত্রির কন্ঠটা শুনিনা!
বাবা কি করো।
এতোদিন পর ফোন করলা!
আমার কন্ঠে গোপন অভিমান টের পাই।
অরিত্রি হেসে বলল, তুমি বিজি থাক তাই ডিস্টার্ব করিনি।
বরিশাল যাইতেছি এখন!
আবার! কয়দিন আগে না গেলা!
এমনি যাচ্ছি। ঢাকায় ডিপ্রেস্ড লাগছে।
কিভাবে যাচ্ছ প্লেনে!
না বাসে। পদ্মা সেতু দিয়ে। সুন্দর বাস। বিজনেস ক্লাস, সময়ও কম লাগে। সাড়ে তিন ঘন্টা মাত্র।
তারপর অরিত্রিকে গ্রীন লাইনের বাসের ছবি পাঠাই।
ওয়াও নাইস।
সাদের খবর কি!
ও অফিসের কাজে লাসভেগাস। কালকে টরন্টো আসবে। দু’দিন থেকে আটলান্টা যাবে।
তোমার যাওয়ার কতদূর!
এখনও কিছু ফাইনাল হয় নাই।
অরিত্রি কম কথার মানুষ। আগে ভাগে কিছুই বলবে না। যখন সব ফাইনাল হবে তখন বলবে, বাবা আমি চলে যাচ্ছি। আমিও বেশি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাই না। মনে মনে বলি যত দেরিতে যায় ততই ভাল। অরিত্রি আমেরিকা চলে গেলে আমার জগতটা আরো শূন্য হয়ে যাবে!
জসিম মল্লিক, লেখক ও সাংবাদিক, টরন্টো, কানাডা।