লেখক কখনও গরীব নয়!
জসিম মল্লিক
‘গরীব লেখক’ এই কথাটা শুনতে বা ভাবতে আমার অনেক বিচ্ছিরি লাগে। আমাদের দেশে অনেক গরীব লেখক আছেন। আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে তাদের জীবন। যদি তারা লেখালেখির জগতে না এসে অন্য পেশা বেছে নিতেন তাহলে হয়ত বেশি ভাল করতেন। ফুল টাইম লেখক নাই বললেই চলে। প্রায় সব লেখকই অন্য কোনো না কোনো পেশায় নিয়োজিত আছেন। লেখালেখি আমাদের দেশে এখনও কোনো পেশা হিসাবে গড়ে উঠেনি। শুধু লিখে জীবন যাপন করা দুরুহ। অনেক লেখক অসুখে ঠিকমতো চিকিৎসা পান না, কন্যার বিয়ে দিতে পারেন না আর্থিক অনটনের জন্য, পড়াশুনা করাতে পারেন না সন্তানদের। অনেক আশা আর স্বপ্ন পূরন হয় না। লেখক কেনো কষ্ট করবে! লেখক কেনো আর্থিক দৈন্যদশায় ভুগবে! লেখককে কেনো অন্যের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাততে হবে! জীবনানন্দ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, আবুল হাসান, নজরুলের মতো লেখক কবিরা প্রচন্ড অর্থকষ্টে ভুগেছেন। আমাদের দেশে এমন অনেকেই আছেন যারা অনেক কষ্টে জীবন যাপন করেন। লেখক যখন অন্যের কাছে হাত পাতে, অন্যের অনুগ্রহ নেয়, সাহায্য চায় সেটা খুবই কষ্টের, গ্লানির।
তারপরও মানুষ কেনো লেখক হতে চায়! কেনো অন্য কিছু না করে শুধু লিখতে চায়! কেনো সে পুলিশ হতে চায় না, আমলা হতে চায় না, শিক্ষক হতে চায় না, ডাক্তার হতে চায় না, ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় না, এমপি, মন্ত্রী হতে চায় না, ব্যারিষ্টার হতে চায় না, খেলোয়াড় হতে চায় না! কেনো শুধু লেখক হতে চায়! আমি নিজেও নিজেকে এই প্রশ্ন করেছি বহুবার। আমি কেনো শুধু লেখক হতে চেয়েছি! আমার মা চাইতেন আমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা পাইলট হই। জেসমিনের সাথে যখন আমার পরিচয় হয় তখন সে জানতোইনা আমি লেখালেখি করি। সে মনে করেছিল পড়াশুনা শেষ করে আমি বিরাট বড় অফিসার হবো। বিসিএসে বসব। বিয়ের বহু বছর পর ততদিনে আমার প্রায় বিশ পঁচিশটি বই প্রকাশিত হয়ে গেছে, একদিন জিজ্ঞেস করল, তুমি কি লিখ! মাকেও আমি একদিন বলেছিলাম মা, আমাকে কেউ বিয়ে করবে না। মা বললেন কেনো করবে না! তোমার মতো ছেলে হয়! আমি বললাম, আমি তো কিছু হতে পারিনি। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ওসব কিছু। ওসবের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নাই। আমি লেখক হতে চাই মা। মা তখনই বুঝেছিলেন এই ছেলের মাথায় ঘু ঘু ডাকছে। এর কপালে দুঃখ আছে।
কিন্তু আমি গরীব এই কথা ভুলেও কোনোদিন উচ্চারন করিনি। আমার তারুণ্যের কালটা যখন থেকে আমি লেখালেখির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়লাম বা আমার ছাত্র জীবনের পুরোটাই ছিল ভয়াবহ টানাপোড়েনের, কষ্টের। বরিশাল থাকতে বা ঢাকায় এসে হলে থাকতাম আর পত্রিকা অফিসে লেখা পাঠাতাম মেইল করে। না খেয়ে সেই পয়সা দিয়ে এনভেলাপ কিনতাম। কখনও কোনো সম্পাদকের কক্ষেও যাইনি। লেখা ছাপানোর জন্য কারো সাথে খাতির জমাইনি। আমাকে কেউ চেনেও না সে সময়। আমি লাজুক আর ভীতু বলেও কারো সামনে যেতে পারতাম না। আমার দরিদ্র দশা দেখে কেউ অবজ্ঞা করুক সেটাও চাইতাম না। অবহেলা জিনিসটা আমি একদম পছন্দ করি না। গরীব বা ধনী এই শব্দ দুটোর মধ্যে কোনো পার্থক্য করিনা আমি। ধনীদের যেমন তোয়াজ করিনা, তেমনি গরীবকে অবজ্ঞা করি না। যখন আমার কিছু ছিল না তখনও আমি যেমন ছিলাম, এখনও তেমনি আছি। মা বলতেন তুমিতো কখনও কিছু চাওনা। না চাইলে মায়েও দুধ দেয় না বুজছ! যখনই কেউ জিজ্ঞেস করত আমি কেমন আছি। আমি সবসময় বলতাম ভাল আছি। আগেও বলতাম, এখনও বলি। কেউ আমাকে করুনার চোখে দেখুক সেটা আমি মেনে নিতে পারি না।
টরন্টো ৮ অক্টোবর ২০২২
সুখ-দুঃখ ও কিছু গল্প কথা
জেসমিন প্রায় একমাস ছিল না। এই মাসটা ছিল ঘটনাবহুল। ছোট ছোট সুখ দুঃখের কাহিনী। আনন্দের ঘটনা যেমন আছে কষ্টেরও আছে। রিটন ভাইয়ের টরন্টোতে তিন দিন কাটানো ছিল অনেক আনন্দের। এই এক মাসে একবারও আমার ছেলে অর্কর সাথে দেখা হয়নি। অর্ক অন্য শহরে থাকে বলে আমাদের সাথে দেখা করার নিয়ম বদলে গেছে। তাছাড়া অর্ক ছিল ভ্যাকেশনে। আগে যখন টরন্টো ছিল তখন প্রতি ইউকেন্ডে আসত। কিন্তু এখন বাই উইকলি। অনেকটা অফিস করার মতো। নিয়ম মেনে আসে নিয়ম মেনে চলে যায়। এবং নিয়ম করে ফোন করে। কিন্তু আমার মেয়ে অরিত্রি এসব নিয়মের ধার ধারে না। অরিত্রি যখন মন চাইবে চলে আসবে। যখন তখন ফোন করবে। আমিও অরিত্রিকে যখন তখন বিরক্ত করি। অরিত্রির অটো টেক্সট, ‘বাবা আমি মিটংএ, উইল কল’। অরিত্রি জানে আমি কত অস্থির প্রকৃতির। ওর বাসা থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের ড্রাইভ আমার বাসা। সপ্তাহে দুই দিন অফিসে যেতে হয় ওকে। বাকী দিনগুলো হোম অফিস। অর্কর মাসে একদিন অফিসে গেলেই হয়। অরিত্রি’র হাজবেন্ড সাদ চাকরি করছে আটলান্টা জর্জিয়া। অরিত্রিও চলে যাবে যেকোনো সময়। অর্ক’র ওয়াইফ খাতিজা ফেডারেল জব করে বলে ওকে অফিসে যেতে হয়।
সবাই ব্যস্ত এই পৃথিবীতে। যার যার মতো জীবন। মানুষ কত একলা হয়ে যায়। অরিত্রি আমেরিকা চলে গেলে আমার জন্য সেটা হবে বিপর্যয়কর। ঘরে ঢুকেই কেউ বলবে না, বাবা চা বানাও। ব্যস্ততার মধ্যেও অরিত্রি এই একমাসে অনেকবার এসেছে। আমার যখন যা দরকার হয় অরিত্রিকে বললেই সমাধান হয়ে যায়। অরিত্রি ফ্রিজে খাবার রেখে যায়। বাজার জিনিসটা আমার খুব অপছন্দ। কিচেনও। তাও একমাস খারাপ কাটেনি আমার। স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করেছি। খাওয়া দাওয়ারও সমস্যা হয়নি। আমার বন্ধু আলম নিয়মিত দেশি খবার সাপ্লাই দিয়েছে। অতি সুস্বাদু রান্না ভাবির। আমি শুধু ভাত রান্না করেছি। কখনও কখনও ডাল আর ডিম ভাজা। ভাত চুলায় বসিয়ে কম্পিটারে বসি, তারপর বেমালুম ভুলে যাই যে চুলায় ভাত। দুই দিন ভাত পুড়েছে। হাড়ি পুড়ে হয়েছে কয়লা। একদিন ডালও পুড়েছে। একদিন রান্না করলাম পটল। দেখতে চমৎকার হয়েছে কিন্তু খেতে বসে দেখি প্রচন্ড লবন। একদিন করলাম ঢেঁরস, সেটা এমনই ঝাল হয়েছে যে মাথা দিয়ে ঘাম ছুটে গিয়েছিল। শুধু করল্লা চমৎকার স্বাদ হয়েছিল।
আজকে একটা আনন্দের দিন আমার জন্য। জেসমিনরা এক ভাই এক বোন। দুজনই টরন্টো থাকে। আমার শশুড় মারা গেছেন চার বছর হয়ে গেছে। সেই থেকে আমার শাশুড়ি একলা। ঢাকা গেলে আমি তার তত্বাবধানে থাকি। যত রাত করেই ফিরি আমার জন্য জেগে বসে থাকেন। আমার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে ঘুমাতে যান। আমার রান্না বান্না নিজ হাতে করেন। কাজের মানুষদের রান্না আমাকে খেতে দেন না। আমি যে চিতই পিঠা আর আর গড়ুর মাংসে খেতে পছন্দ করি সেটা ভুলেন না। ঢাকা গেলে প্রতি দুই দিন পর পর করে দেন। জেসমিন প্রতিবার বলে ঢাকা গিয়ে আর কিছু না হোক একটা ভুঁড়ি বানিয়ে নিয়ে আসো। শুধু তাই না আমি যা যা খেতে পছন্দ করি সব তার মুখস্থ। আমার ঢাকায় যত দরকারি কাগজপত্র সবই তিনি মেইনটেইন করতেন। এমনকি ব্যাংকের হিসাব নিকাশও। কোভিডের সময় খুব একলা হয়ে গেছিলেন। একলা বাড়িতে থাকতেন। যদিও তার অনেক আত্মীয় স্বজন ঢাকায়। কিন্তু আজকাল সবাই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। অবশেষে আজ এসেছেন। আমার জন্য আরও আনন্দের যে আমাদের কাছে থাকবেন। মায়েরা সাধারণতঃ মেয়ের কাছে থাকতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন। সেটা আমি জানি। আমার ছেলে মেয়েরা কানাডা আসার আগে পর্যন্ত নানীর কাছেই বড় হয়েছে। তার জন্যও আনন্দের।
কোভিডের ৫ম ডোজ নিয়েছি কাল। এটা ফাইজার-বায়োএনটেক বিভালেন্ট। এটা অমিক্রন থেকেও সুরক্ষা দেবে। রাতে জ্বর জ্বর একটা ব্যাপার ছিল। বাঁ হাতে ব্যাথা। পাশ ফিরে ঘুমাতে পারছিলাম না। জ্বরের ঘোরে আজব আজব সব ব্যাপার ঘটতে লাগল। ঘোর জ্বরের মধ্যে অষ্পষ্ট ঘোর ঘোর হয়ে যাচ্ছিল পৃথিবী। স্বপ্নের মতো অবাস্তব হয়ে যাচ্ছিল চারধার। ঘুম ও জাগরণের তটরেখা ঘুচে যায়। মাঝে মাঝে আধা-চেতনায় চমকে উঠে টের পাই, গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে বালতিতে জল পড়ার গভীর বিষন্ন শব্দ। মনে হচ্ছে মাথা, মুখ আর কানের পিঠ বেয়ে জলের ধারা নামে। মনে হয় জলপ্রপাতের মধ্যে শুয়ে আছি। ছোট বেলায় যেমন মনে হতো।
আমার মেঝো ভাই অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে। হাই ডায়াবেটিস, স্ট্রোক করেছে। এই ভাই আমাদের পরম আদরে মানুষ করেছেন। শিশু বয়সে বাবা হারানোর পর এই ভাই সংসারের হাল ধরেছিলেন। লেখাপড়া বাদ দিয়ে চাকরিতে ঢোকেন। পুত্রস্নেহ পেয়েছি তার কাছ থেকে। যখন যা চেয়েছি দিয়েছেন। কোনোদিন না বলেন নি। আমার বোন সাজুর পড়াশুনা, বিয়ে দিয়েছেন তিনি। আমার মা শেষ দিন পর্যন্ত আমার ভাই ভাবির কাছেই ছিলেন এবং তার ওখানেই মারা যান। সংসারের জন্য তাঁর অনন্ত ত্যাগ আছে। ভাইকে দেখার জন্য আমার মনটা উথাল পাথাল করছে।
আমি একজন উজান ঠেলে চলা মানুষ। অনেক প্রতিকুল পরিবেশ অতিক্রম করে আমি বেঁচে থাকি। কিন্তু আমি সহজে কাউকে বুঝতে দেই না। লেখালেখির জগতে না এলে আমি আরো স্বস্তিতে থাকতাম। আমার শক্তির জায়গা হচ্ছে আমার মায়ের দোয়া আর মানুষের ভালবাসা। প্রকৃতি আমাকে সবসময় রক্ষা করে। কষ্টের গায়ে মলম মাখিয়ে দেয়। হারতে হারতে আমি জিতে যাই। জিততে জিততে হেরে যাই। কিন্তু সেই হেরে যাওয়াটা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উজানে মৃত্যুর মতো। পাওলো কোয়েলহোর আবার তল থেকে উঠে আসার মতো, হারাকু মুরাকামির ভাঙচুর ভাঙচুর শব্দের মধ্যেও জয়ের প্রবল স্বপ্ন।
আসলে জীবনে কিছুই অপরিহার্য্য মনে হয় না। এটা চাই, ওটা চাই নিয়ে কোনো হা পিত্যেশ নেই। জীবনে অনেক কিছুই পাবো না, তাই বলে জীবন বৃথা হয়ে যাবে না। কষ্টের দিনে মানুষের পাশে থাকাই মানবতা। আমি অনেক অচেনা অদেখা মানুষকেও সাহায্য করি। কারো ক্ষতির চিন্তা করি না। আমরা প্রায়শঃই ভিতরের পশুটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। অন্যের সাফল্যে হৃদয় ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। আমি পশু হয়ে বাঁচতে চাই না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করছি…
“আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি
তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে..।”
টরন্টো ২৪ অক্টোবর ২০২২
প্রবাসে নতুন প্রজন্ম কেমন আছে!
প্রবাসে আমাদের নতুন প্রজন্ম যারা এদেশে জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে এমনকি যেসব তরুণরা পড়তে বা চাকরি নিয়ে আসছে তাদের নিয়ে আমার অনেক গর্ব হয়। প্রায়ই আমি তাদের নিয়ে লিখি। লিখতে ভাল লাগে। নতুন প্রজন্ম নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন, আশা। আমি খুবই আশাবাদী মানুষ। স্বপ্নবাজ মানুষ। বিদেশে বাঙালি তরুণদের সাফল্য দেখে আনন্দে চোখ ভিজে যায় আমার। আমাদের প্রজন্মের সাথে নতুন প্রজন্মের চিন্তা ভাবনা, ধ্যানধারণার কী বিস্তর ফারাক ভাবলে অবাক হতে হয়। অথচ মাত্র এক জেনারেশনের ব্যবধান। নর্থ আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, জাপান বা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে আমাদের বাঙ্গালি নতুন প্রজন্মের সাফল্যের গল্প শুনলে বুক ভরে যায়। তাদের উদারতা, মানবিক মূল্যবোধ, সততা আমাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।
আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম বলেই সবুজ পাসপোর্ট পেয়েছি। স্বাধীন হয়েছি বলেই আমরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরতে পেরেছি। আর সেজন্যেই আমাদের সন্তানেরা বিদেশে মাথা উঁচু করে দাপটের সাথে বিচরন করতে পারছে এবং ক্রমাগত অন্যদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের একজন বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন বলেই আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে তিনি আমাদের মুক্তি দিয়েছিলেন। স্বাধীন হয়েছিলাম বলেই আজ আমরা বিদেশে আসার সুযোগ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের পতাকাকে আরো মর্যাদাবান করেছেন। টরন্টো পীয়ারসন এয়ারপোর্টে বিলবোর্ডে যখন বিমান বাংলাদেশ লেখা ভেসে উঠে, গর্বে বুক ভরে উঠে।
নতুন প্রজন্মের সাফল্যের জন্য আমি বিশেষভাবে প্রবাসী নারীদের ধন্যবাদ দিতে চাই। তাঁদের প্রচেষ্টার কারণেই আমাদের সন্তানেরা সর্বক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্য দেখাচ্ছে। স্কুল, ইউনির্ভাসিটি, রাজনীতি, ব্যবসা এবং কর্মক্ষেত্রে দাপট দেখাচ্ছে। অন্য দেশীয়দের সাথে প্রতিযোগিতা করে বড় বড় পদে চাকরি করছে, ব্যবসা করছে। দামী দামী ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। বাংলাদেশের মুখ উজ্জল করছে। ছোট ছোট শিশুদের নিজের দেশকে জানতে শেখাচ্ছেন মায়েরা। ভাষা শেখাচ্ছেন। সংস্কৃতি শেখাচ্ছেন। নাচ, গান শেখাচ্ছেন। তারা চমৎকার বাংলা বলছে। কোনো অনুষ্ঠানে যখন তারা বাংলা গানের সাথে নাচ করে, বাংলা গান গায় দেখে আমার ভিতর থেকে একটা উৎগত আবেগ কান্না হয়ে বেড়িয়ে আসতে চায়। দেশের যেকোনো সাফল্য দেখলেই আমার এমন হয়। আমাদের নতুন প্রজন্ম এতোটাই স্বচ্ছ, বন্ধুবৎসল, অনেষ্ট আর মানবিক যে আমি মুগ্ধ হই। তারা মিথ্যা বলা শেখেনি, ছল চাতুরি জানে না, পরপকারী এবং রেসিজমকে ঘৃণার চোখে দেখে। কালো সাদার বিভাজন বোঝে না। ধনী গরীবের পার্থক্য করে না।
নতুন প্রজন্ম সব জাতির সাথে বন্ধুত্ব করতে পারে। একসাথে চলতে পারে, খেতে পারে, বেড়াতে পারে, হাসতে পারে, পার্টি করতে পারে, জীবনসঙ্গী করতে পারে। ওদের কোনো সমস্যা হয় না। নিজের দেশ নিয়ে আমাদের মতো অভিযোগ করে না, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে না। ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে চর্চ্চা করে না, খাদ্যে ভেজাল নিয়ে কথা বলে না, রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না। পরনিন্দা, পরচর্চ্চা নিয়ে পড়ে থাকে না। ওসব জানেই না। নতুনরা যে দেশে বাস করছে সে দেশকে ভালবাসে। মেইনস্ট্রিমে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করছে। যে দেশটায় বাস করে সেটার জন্য সব করতে পারে। তারা অকপটে অন্যের প্রশংসা করতে পারে, বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারে। তরুণরাই আমাদের স্বপ্ন, আমাদের গর্ব।
টরন্টো ২৮ অক্টোবর ২০২২
আত্মকথন
শৈশবে আমি খুউব দুরন্ত প্রকৃতির ছিলাম। হেনো কোনো দুষ্টুমি নাই যা আমি করি নাই। কখনও একা, কখনও দলবেঁধে এসব করতাম। পুরো পাড়া মাতিয়ে রাখতাম। আমার দুরন্তপনা এতোটাই প্রবল ছিল যে বাড়ির অনেকে তাদের সন্তানদের আমার সাথে মিশতে দিত না, ওরা নষ্ট হয়ে যাবে এই ভয়ে। আমার মাকে এজন্য কম গঞ্জনা সহ্য করতে হইনি। মা শুধু চোখের পানি ফেলতেন। ভাবতেন আমার ছেলেটা কেনো যে এমন হলো! অনেক শাসনে করতেন। চোখে চোখে রাখতেন। কখন কি করে বসি তার ঠিক নাই। সারাদিন পাড়া, মহল্লা দাপরিয়ে বেড়াই। সেই বয়সেই স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখা শুরু করি। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটা দিয়ে সুন্দর সুন্দর মেয়েরা স্কুলে যেতো। সেইসব রুপসী কন্যাদের দেখতাম লুকিয়ে লুকিয়ে। একটা মেয়ে ছিল এতোটাই রুপসী যে মনে হতো লাউগডার মতো দুলছে। ওকে দেখতেই দাঁড়িয়ে থাকতাম। কি ভয়াবহ কথা! তখন থেকেই ঘুড়ি উড়াতাম, সুতায় মাঞ্জা দিতাম, কাঁটা ঘুড়ির পিছনে দৌড়াতাম। ক্যাপস্টান, ব্রিস্টল, স্টার সিাগারেটের কাগজ দিয়ে চারা খেলতাম, মার্বেল খেলতাম। সে সময় মার্বেল খেলত রাস্তার ছেলেরা। সাত চারা খেলতাম, সাইকেলের রিং চালাতাম সিএন্ডিবি রোডে। বেয়ারিং দিয়ে তিন চাকার গাড়ি বানিয়ে চালাতাম। একজনকে পিছন থেকে ধাক্কা দিতে হতো। তারপর ঘর ঘর করে চলত।
খেলাধুলাও করতাম। আমাদের নিজস্ব মাঠে নানা ধরণের খেলাধুলার প্রচলন ছিল। আমি নিজেই আয়োজকদের একজন ছিলাম। ফুটবল, হাডুডু, হকি, ক্রিকেট খেলতাম। শীতের সময় রাতে লাইট জ্বালিয়ে ভলিবল, ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা করতাম। হাইজাম্প, লং জাম্প, দৌড় প্রতিযোগিতা হতো। বড়রা করত নাটক। সবকিছুতেই আমার অংশগ্রহন থাকত। ব্যাডমিন্টন আমার খুব প্রিয় খেলা ছিল। বাড়ির পুকুরে বা খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটতাম। গায়ের চামড়া সাদা হয়ে যেতো তাও পানি থেকে উঠতাম না। মা এসে টেনে তুলে নিয়ে যেতো, আর আচ্ছামতো পিটুনি দিত। সাঁতার শিখেছিও একা একা। নৌকা বাইতাম মামা বাড়ি গেলে, ডোঙ্গা উল্টে কতবার পানিতে পড়ে হাবুডুবু খেয়েছি। কলা গাছের ভেলায় ভেসে বেড়াতাম। মামাত ভাইদের সাথে বিড়ি ফুঁকতাম। শীতের দিনে পানিতে ডুব দিয়ে শিং, কৈ ধরেছি। শিং মাছের কাঁটায় কতবার রক্ত বের হয়েছে। চিনে জোকে রক্ত চুষে নিত। সহজে ছাড়ানো যেতো না। শীতের দিনে ধান মাড়াই হতো। গরুর পিছন পিছন ছুটতাম, রাতে সিদ্ধ ধানের নাড়ার মধ্যে ঘুমাতাম। দারুণ ওম ছিল।
তখন থেকে লাইব্রেরিতেও যাওয়া শুরু করলাম। আমাদের বাড়িতেই একটা পাঠাগার ছিল। সেখানে কিছু বই ছিল, কেরামবোর্ড ছিল, দাবা ছিল, টেবিল টেনিস ছিল। সেসব খেলতাম। দাবা খেলাটা যে কে আবিস্কার করেছে! বড্ড জটিল। তাসও তেমনি। কখনও শেখা হলো না। মাঝে মাঝে বই নাড়া চাড়া করতাম। দু’একটা সংবাদপত্র রাখা হতো। বই পড়তে গিয়েই আমার ক্ষতিটা হয়ে গেলো। পাড়ার লাইব্রেরির পরিবর্তে আমি বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরির খোঁজ পেলাম। বারো তেরো বছর বয়স পর্যন্ত আমার দুরন্তপনার স্থায়ীত্বকাল ছিল। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ফটিকের মতো ছিল আমার স্বভাব। তারপর হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম, আমি আর সেই আমি নাই। আমি বদলে গেছি। নির্জন হয়ে গেছি। আমার খেলার সাথীরা খুবই অবাক হলো। মা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মা মনে করছেন আমার মাথার সমস্যা হয়েছে। তার ছিঁড়ে গেছে। মাথায় ঘু ঘু ডাকছে। হ্যাঁ তাই। মাঝে মাঝে আমার মাথায় ঘুঘু ডাকত। এখনও ডাকে। আমি একা হয়ে যেতাম। একা একা ঘুরতাম, নিজের সাথে নিজে কথা বলতাম। কারো সাথে মিশতে ইচ্ছে করত না। শুধু বইয়ের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠল। কলেজ উঠেও তাই। পড়াশুনাও মন দিয়ে করিনি। তাও রেজাল্ট ভাল হতো। অবাক কান্ড! পেনপলস করতাম। আমার একশর বেশি পত্রবন্ধু হয়েছিল। তাদের নিয়মিত চিঠি লিখতাম। নিজের কথা শেয়ার করতাম।
সেই যে কৈশোরে আমি একা হয়ে গিয়েছিলাম, সেই একাকীত্ব আজও ঘোচেনি। কখনও ঘুচবেও না। চারিদিকের এতো আয়োজন, কোলাহল, পরিবার, সন্তান, বন্ধু, আত্মীয়, সমাজ, দলাদলি, ঈর্ষা, নোংরামি, অপমান, এতো কিছু ঘটনার মধ্যে আমি একাকী একজন। এই যে এতো কিছু করি, জীবন ফেনানো যাকে বলে। লেখালেখি, বন্ধুত্ব, আতিথেয়তা, সংসার, বেড়ানো, দাওয়াত খাওয়া, মনে হয় আমি এসবের অংশ না। অন্য কেউ করছে। অন্য এক আমি এসব করছে। আমি নিজেকে নিজে প্রায়ই প্রশ্ন করি, আচ্ছা আমি কি কখনও কারো ছিলাম! কেউ কি কখনও আমার হতে পেরেছে! উত্তর হচ্ছে, না। আমি কখনও কারো ছিলাম না। কেউ আমার হয়নি। পৃথিবীতে কেউ কারো না। সবকিছু মিথ্যে, মরীচিকা। মিছে মায়া। সবাই একা। স্বার্থপর দুনিয়ায় সবাই নিজেরটা বুঝে। প্রতিহিংসা পরায়ন মানুষ, হিংস্র মানুষ চারিদিকে। তাই আমি সবসময় একা। জাগতিক যা কিছু করি তার সাথে আত্মার কোনো সম্পর্ক নাই। যেনো আমি করি না। অন্য কেউ করে।
সবারই নিজের সাথে নিজের কিছু বোঝাপড়া থাকে। আমারও আছে। কনফেশন। বাইরের নিষ্ঠুর পৃথিবীতে মানুষ কেমন করে বেঁচে থাকে! যেখানে এতো স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, হিংসা, অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা সারাক্ষন, সেখানে মানুষ কিভাবে টিকে থাকে! টিকে থাকে কারণ প্রকৃতি মানুষকে অষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। মানুষকে আগলে রাখে। বিপদ থেকে মুক্ত রাখে। তেমনি প্রকৃতির মতো কিছু উদার মানুষ আছে পৃথিবীতে। তাদের ভালবাসাই বাঁচিয়ে রাখে। আমার ক্ষেত্রেও তাই। আমি মানুষের অনেক ভালবাসা পেয়েছি, আনুকল্য পেয়েছি যা পাওয়ার যোগ্য আমি না। প্রকৃতি যেমন আমাকে আগলে রাখে তেমনি মানুষের ভালবাসাও আমাকে সতেজ রাখে, অনুপ্রাণিত করে। আমি হারতে হারতে জিতে যাই। আমিও কি ভুল করি না! অনেক ভুল করি। আমিও কি ঈর্ষান্বিত হই না! হই। আমি কখনও কারো ক্ষতির চিন্তা করিনি। আমি কখনও প্রতিশোধ পরায়ন হইনি! অনেক ক্ষতি মেনে নিয়েছি। আমার কিছু দুর্বল দিক আছে। অনেকে সেটা ব্যবহার করে।
একটা গল্প বলে শেষ করছি। তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। রাস্তায় মার্বেল খেলতে গিয়ে এক বন্ধুর সাথে ঝগড়া লেগে গেলো। বন্ধুটি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল রাস্তায়। কিল ঘুষি দিল। সে ছিল ষন্ডা মার্কা। আমি ছিলাম হালকা, পটকা। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি আসলাম। মা বললেন, তুমি কিছু বলো নাই তো! আমি বললাম, না বলি নাই। মা বললেন, ঠিক করেছো। পরে মা সেই বন্ধুকে ডেকে মিলমিশ করে দিয়েছিলেন। মা সবসময় অহিংস হতে শিখিয়েছিলেন। ভালবাসতে শিখিয়েছেন। কাউকে অপছন্দ হলে এভোয়েড করতে বলেছেন। কিন্তু প্রতিশোধ পরায়ন হতে বলেন নি। কিন্তু আমার মনে হয় মায়ের এই ধারণা ঠিক না। শিখদের একটা প্রবাদ আছে, কেউ যদি অন্যায়ভাবে তোমার এক গালে একটা চর মারে, তুমি তার অন্য গালে চারটা চর মেরো।
টরন্টো ১ নভেম্বর ২০২২
জসিম মল্লিক, লেখক ও সাংবাদিক, টরন্টো, কানাডা।