টরন্টোতে প্রতারকদের অভিনব কৌশল : মালিকের অজান্তে গোটা বাড়িই বিক্রি করে দিচ্ছে তারা!
খুরশিদ আলম
কানাডায় বাসা- বাড়িতে চুরি হয় একথা আমরা কমবেশী সবাই জানি। কিন্তু এখন দেখছি আস্ত বাড়িটাই প্রতারণার মাধ্যমে চুরি হয়ে যাচ্ছে! এবং জমিসহ! কানাডার মত দেশে এটি তো অকল্পনীয় ব্যাপার! অথচ গত কয়েকমাসের মধ্যে এরকমই তিনটি ঘটনা ঘটে গেল কানাডার টরন্টোতে। চোরেরা বাড়ির মালিকের অজান্তে জাল কাগজপত্র তৈরী করে আরেকজনের কাছে তা বিক্রি করে দেয়। একটি চুরির ঘটনা অবশ্য মাঝ পথে এসে আটকে যায় মালিক পক্ষের সতর্কতার কারণে।
তবে টরন্টোর এক বাঙ্গালীর কাছে এই প্রতারকরা একেবারেই শিশু। যে বাঙ্গালীর কথা বলছি উনি ২০১১ সালে বাড়িঘর সংক্রান্ত জাল কাগজ পত্র তৈরী করে ২০ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছিলেন। সে আমলে ঐ পরিমাণ ডলার দিয়ে টরন্টোতে অন্তত ৬০টি ডিটাচ বাড়ি ক্রয় করা যেত। কারণ তখন বাড়ির দাম এখনকার মত এত বেশী ছিল না। উনার কথায় পরে আসছি।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রথম ঘটনাটি ঘটে গ্রেটার টরন্টোর ইটবিকোকে। সেখানে এক বাড়ির মালিক স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কর্ম উপলক্ষে দেশের বাইরে গিয়েছিলেন কয়েক বছর আগে। বাড়িটি ভাড়া দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু একসময় প্রতারকদের নজরে পরে বাড়িটি। তারা তাদের প্রতারণার কৌশল অবলম্বন করে এক রিয়েল এস্টেট এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করেন। বাড়ি বিক্রির সাইনবোর্ডও ঝুলানো হয়। এবং দিন কয়েকের মধ্যে সেই বাড়ি বিক্রিও হয়ে যায়। অকল্পনীয় ব্যাপার। অথচ তাই ঘটে গেল। বিদেশে অবস্থানরত বাড়ির আসল মালিক প্রায় দুই মাস পর যখন ঘটনাটি জানতে পারেন তখন সেই বাড়ির দখল নিয়ে নিয়েছেন নতুন মালিক। বাড়ির মূল মালিক তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি পুলিশকে জানান। পরে পুলিশ দুই চোরের ছবি প্রকাশ করে মিডিয়াতে। এদের একজন পুরুষ আরেজন মহিলা। পুলিশ জনগণের সাহায্য চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় চোরদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য। তারা এখনো ধরা পড়েনি। তবে গত ২৭ জানুয়ারী টরন্টোর একটি ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলনের সময় পুলিশের হাতে ধরা পরে প্রতারক চক্রের অন্য তিনজন। এদের মধ্যে একজন মহিলা এবং বাকি দুজন পুরুষ।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছে টরন্টোর কুইন স্ট্রিট ও উডবাইন এলাকার কাছে। সেখানে Kew Garden এলাকার কাছে এক সিনিয়র সিটিজেন বাড়ি। ভদ্রলোকের বয়স ৯৫। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে তিনি ঐ বাড়িতে বাস করে আসছেন। সম্প্রতি একা চলাফেরা করতে অসুবিধা হচ্ছিল বলে তার নাতনী মেলিসা ওয়ালশ তাকে লং-টার্ম কেয়ার হোমে ভর্তি করিয়ে দেন। তখন ঐ বৃদ্ধের বিভিন্ন খরচ চালানোর জন্য পারিবারিকভাবেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বাড়িটি ভাড়া দেয়ার জন্য। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক স্থানীয় দুইজন রিয়েল এস্টেট এজেন্ট এর সাথে যোগাযোগ করা হয়। তারা বাড়িটি ভাড়া দেয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করেন। ভাড়া নেয়ার জন্য যারা আবেদন করেন তাদের কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে এক দম্পতিকে ভাড়া দেয়া যেতে পারে বলে পরামর্শ দেন। মালিক পক্ষ তখন সেই দম্পতিকে ভাড়া দেন। কিন্তু তারা তখন ঘুণাক্ষরেও টের পাননি কি ভয়াবহ এক প্রতারক দম্পতিকে তারা বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছেন।
এবং এরপরই প্রতারণার জাল বিস্তার করতে শুরু করেন ঐ ভাড়াটিয়া দম্পতি। তারা আসলে প্রতারণা শুরু করেছিলেন বাড়ি ভাড়া নেয়ার আগে থেকেই। তদন্তে দেখা গেছে নিজেদের আসল পরিচয় গোপন রেখেই তারা ভাড়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। এবং রেফারেন্স হিসাবে যাদের নাম উল্লেখ করেছিলেন আবেদন পত্রে, সেই নামও ছিল ভুয়া। এ কারণে অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ যখন তাদের খোঁজা শুরু করে তখন তাদের কোন হদিসই পাওয়া যায়নি। পুলিশ তখন তাদেরকে ‘ভূত’ হিসাবে উল্লেখ করে।
বাড়ি ভাড়া নেয়ার পর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই প্রতারকদের একজন নিজেকে বাড়ির মালিক পরিচয় দিয়ে দুইজন রিয়েল এস্টেট এজেন্ট এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে কথা বলেন। অথচ বাড়ির মূল মালিক বা মালিক পক্ষ তখনো কিছুই জানেন না। প্রতারক চক্র বাড়ির আসবাবপত্রও বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে নেন সম্ভাব্য ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য। অনলাইনে বিজ্ঞাপনও দেয়া হয়। সেখানে বাড়ির দাম উল্লেখ করা হায় ১.২৯ মিলিয়ন ডলার। খুব দ্রুতই বেশ কয়েকজন সম্ভাব্য ক্রেতা যোগাযোগ করেন। একজন তো ১.৯ মিলিয়ন ডলার অফার করেন বাড়িটি ক্রয় করার জন্য।
তবে প্রতারকরা বেশীদূর এগুতে পারেননি। তার আগেই মালিক পক্ষ টের পেয়ে যান। বাড়ির আসল মালিকের নাতনী মেলিসা ওয়ালশ বলেন বিষয়টি টের পাওয়ার পর আমার মুখ দিয়ে কোন বাক্য বের হচ্ছিল না। এটি কি ভাবে সম্ভব! কি হচ্ছে এখানে?
মেলিসা’র পরিবার শেষ পর্যন্ত প্রতারকদের হাত থেকে বাড়িটি রক্ষা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, কানাডার মত দেশে এটি কি করে সম্ভব? কি করে মালিকের অজান্তে একটি বাড়ি অন্য লোক বিক্রি করে দেয়? কানাডায় বাড়ি বিক্রি বা ক্রয় খুব সহজ প্রক্রিয়ায় হয় না। এর সঙ্গে জড়িত থাকেন মালিক ও ক্রেতা। আরো জড়িত থাকে ব্যাংক, আইনজীবী, রিয়েলটর। এতজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কি করে একজনের বাড়ি আরেকজন বিক্রি করে দেন?
পুলিশ অবশ্য ধারণা করছে এই একই প্রতারক ইটোবিকোক এর বাড়ি বিক্রির সঙ্গেও জড়িত। মেলিসা ওয়ালশ সিবিসি নিউজকে বলেন, ‘শুরুতে আমার ধারণা ছিল খুব অল্প সংখ্যক রিয়েল এস্টেট এজেন্ট আছেন যারা তাদের কাজগুলো ঠিকমত করছেন না। কিন্তু যখন জানতে পারলাম, অন্য আরেকটি বাড়িও প্রতারকরা মালিকের অজান্তে বিক্রি করে দিয়েছে তখন মনে হচ্ছে এই ব্যবসায় অবশ্যই গভীর একটা সমস্যা রয়ে গেছে।
সিবিসি নিউজ উল্লেখ করে, গত এক বছরে তারা বেশ কিছু রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে বাড়ি ভাড়া অথবা মর্টগেজ অনুমোদনের জন্য ভুয়া পরিচয় বা ডকুমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। তবে এবার আস্ত বাড়ি জমিসহ চুরির ঘটনায় এটি প্রতীয়মান হচ্ছে যে, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় জালিয়াতি নতুন এক মাত্রায় পৌঁছেছে যা সত্যিই উদ্বেগজনক।
উপরে উল্লেখিত জালিয়াতির দুটি ঘটনা নিয়ে টরন্টোর লোকজন যখন উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন ঠিক তখনই এরকম আরেকটি জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ পায় স্থানীয় পত্রিকায়। তবে এবার বাড়ি বিক্রি নয়, কন্ডো বিক্রির খবর আসে পত্রিকায়। টরন্টোর ডাউনটাউনের কেন্দ্রস্থলে ইয়াং স্ট্রিটে জালিয়াতির মাধ্যমে একজনের কন্ডো বিক্রি করে দেন আরেকজন। এই অপকর্মটি ঘটেছে গত বছর মে মাসে। তবে এতদিন মিডিয়াতে আসেনি খবরটি।
জালিয়াতির শিকার ব্যক্তি একজন ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট। তার নাম মফি ইউ। এই মহিলা চীন থেকে কানাডায় এসেছিলেন লেখাপড়া করতে। সেই সময় এই এপার্টমেন্টটি কিনেন তিনি। বর্তমানে মফি ইউ চীনের হুবেই প্রভিন্সে বাস করছেন। দি কানাডিয়ান প্রেস এর খবরে বলা হয়, দুই বেডরূমের কন্ডোটি বিক্রির জন্য গত বছর ১১ মে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল। প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার দিয়ে এপার্টমেন্টের ভিতরের সাজানো গোছানো আসবাবপত্রের ছবি তুলে সুন্দর করে প্রচার করা হয়েছিল। দাম হাকা হয়েছিল ৯ লাখ ৭৮ হাজার ডলার। পরে ৯ দিনের মাথায় ৯ লাখ ৭০ হাজার ডলারে তা বিক্রি হয়ে যায়। অথচ আসল মালিক মফি ইউ কিছুই জানতেন না। তিনি কন্ডো বিক্রির কোন বিজ্ঞাপনই দেননি কোথাও। অথচ কেমন নিপুণভাবে তা চুরি হয়ে গেল। মফি ইউ এই কন্ডোটি কিনেছিলেন ২০১৭ সালে। সেই সময় এর বাজার মূল্য ছিল ৮ লক্ষ ডলারেরও বেশী। তখন থেকে প্রতি মাসে তার একাউন্ট থেকে মেইন্টেনেন্স ফি কেটে নেয়া হতো। কিন্তু গত বছর জুলাই মাসে তার একাউন্ট থেকে মেইন্টেনেন্স ফি কেটে নেয়া হয়নি। তখন তিনি যে রিয়েল এস্টেট এজেন্টের মাধ্যমে কন্ডোটি ক্রয় করে ছিলেন তার সাথে যোগাযোগ করেন এবং অনুরোধ জানান বিষয়টি একটু খোঁজ নেয়ার জন্য। সেই এজেন্ট খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন কন্ডোর মালিকানা পরিবর্তন হয়ে গেছে। সেটি মফি ইউ’র নামে আর নেই। নতুন মালিক। এই খবর শুনে মফি ইউ’র তখন মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। কানাডার মত জায়গায় এটি কি করে সম্ভব?
দি কানাডিয়ান প্রেস তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করে, টরন্টো পুলিশ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে। তবে এই মুহূর্তে বিস্তারিত কিছু জানায়নি তারা।
অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন যে, বাড়ির আসল মালিকের তো কোন দোষ নেই এখানে। তাহলে তিনি কি তার সম্পত্তি ফিরে পাবেন না তাৎক্ষণিকভাবে? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। কারণ, জালিয়াতির মাধ্যমে বিক্রি হয়ে যাওয়া বাড়ি পুনরুদ্ধার করা এক দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া। স্বতন্ত্র একটি তদন্তকারী সংস্থা ‘কিং ইন্টারন্যাশনাল এ্যাভাইজারী গ্রুপ’ এর কর্মকর্তা ব্রায়ান কিং দি কানাডিয়ান প্রেসকে বলেন, ‘টাইটেল জালিয়াতি একটি অতিমাত্রার সমস্যাযুক্ত বিষয়। এখানে বাড়ির আসল মালিক এবং নতুন ক্রেতা দুজনেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি।’
‘টাইটেল জালিয়াতি’র ব্যাপারটি হলো, প্রতারকরা যখন কোন ব্যক্তির নাম, ঠিকানা, বয়সসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে নিয়ে অথবা জাল কাগজপত্র তৈরী করে তার অজান্তে তার বাড়ি নিজের নামে করিয়ে নেয় অথবা অন্যের কাছে বিক্রি করে দেয়।
এদিকে সিবিসি নিউজের আরেক খবরে বলা হয়, গ্রেটার টরন্টো এলাকায় মুষ্টিমেয় কয়েকটি সংগঠিত অপরাধ গোষ্ঠি রয়ছে যারা এই সকল অপকর্মের পিছনে কাজ করছে। জালিয়াতির মাধ্যেমে বাড়ি ঘর বিক্রি করে দেয়াসহ মর্টগেজ জালিয়াতির সঙ্গেও জড়িত এরা। সাম্প্রতিক সময়ে এদের জালিয়াতির শিকার হয়েছে অন্তত ৩০টি বাড়ি। এই বাড়িগুলোর মধ্যে অন্তত চারটি বিক্রি করে দিয়েছে জালিয়াত চক্রের সদস্যরা এবং অন্য বাড়িগুলোর ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে আসল মালিকের অজান্তেই।
আর এই অপরাধীদের খুঁজে বের করা নিশ্চিতভাবেই খুব কঠিন কাজ। সিবিসি নিউজকে এ কথা বলেন ব্রায়ান কিং। তিনি আরো বলেন, আমাদের হাতে যে তথ্য এসেছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে গ্রেটার টরন্টো এলাকায় চার থেকে পাঁচটি সংগঠিত অপরাধ গোষ্ঠী রয়ছে যারা এর সঙ্গে জড়িত।
এসকল প্রতারকরা জালিয়াতির মাধ্যমে যে অর্থ হাতিয়ে নেয় তা হয় ক্রিপ্টোকারেন্সীতে রূপান্তরিত করে নেয়, অথবা স্বর্ণ কিনে কিংবা দ্রুত তা বিদেশে পাচার করে দেয়। ফলে সেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়ে উঠে না প্রায় কোন ক্ষেত্রেই।
আসলে প্রতারক চক্র দুনিয়ার সব দেশেই আছে। আছে কানাডায়ও। আমরা জানি কানাডা সুশৃঙ্খল দেশ, আইনের শাসন আছে এদেশে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট উন্নত এখানে। মানুষজন যথেষ্ট ভদ্র। কিন্তু তারপরও এখানে কিছু অপকর্ম ঘটে। ঘটে খুনাখুনিও। জালিয়াতির মাধ্যমে অন্যের টাকাপয়সা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা এখানেও ঘটছে। বিশেষত টেকনলোজির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এই জালিয়াতি আরো বেড়েছে। এইতো মাস তিনেক আগের ঘটনা। বিনিয়োগ সংক্রান্ত চক্রান্তের জালে জাড়িয়ে সাড় সাত লাখ ডলার খুইয়েছেন অন্টারিও’র এক বৃদ্ধা। ঐ চক্রান্তে প্রতারকরা বিশে^র অন্যতম সেরা ধনী ইলন মাস্ক এর ছবি ব্যবহার করেছিল। প্রতারণার শিকার ঐ বৃদ্ধা এলিজাবেথ বাকোস সিটিভি নিউজকে বলেন, ‘সমস্ত সঞ্চয় এবং ব্যাংকের ঋণসহ আমি সর্বমোট সাড়ে সাত লাখ ডলার হারিয়েছি। আমি এখন মরিয়া হয়ে উঠেছি, আমি খেতে পারছি না, ঘুমাতে পারছি না।’
ভাবা যায় জীবন সায়াহ্নে এসে এক বয়স্কা মহিলা কতটা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে!
কলামের শুরুতে এক বাঙ্গালী ব্যক্তির কথা বলেছিলাম। উনার নাম মনজুর মোর্শেদ খান। প্রথম দিকে হাইরাইজ বিল্ডিং এ সুপারিনটেন্ডেন্ট এর কাজ করতেন। স্কারবরোতেও দুটি হাইরাইজ বিল্ডিং এ কাজ করেছন। পরে আস্তে আস্তে বিল্ডিং ম্যানেজমেন্টে দক্ষতা অর্জন করে নিজেই একটি প্রপার্টি ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানী খুলে বসেন। কোম্পানীর নাম রাখেন চ্যানেল প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট। তারপর আস্তে আস্তে শুরু হয় তার জালিয়াতির জাল বুনা।
মনজুর মোর্শেদের ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীর অধীনে বেশ কয়েকটি কন্ডো ছিল। তিনি অবশ্য দাবী করতেন চল্লিশটিরও বেশী কন্ডোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে তার কোম্পানী। কিন্তু তার অধিনস্থ কর্মচারীদের কাছে জানা যায় ঐ সংখ্যা পনেরটির বেশী ছিল না।
মনজুর মোর্শেদ এই কন্ডোগুলোর মধ্যে কয়েকটির নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করে ব্যাংক বা অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। একটি কন্ডোর নামে ঋণ নিতে গিয়ে তিনি তার অধিনে কর্মরত দুইজন কর্মচারীর নাম কন্ডো বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারী হিসাবে ব্যবহার করেন। কন্ডো বোর্ডের কর্মকর্তাদের অজান্তে তিনি ভুয়া ব্যাংক একাউন্ট খুলে ঋণের অর্থ সেখানে জমা করতেন। এভাবে আস্তে আস্তে তিনি ২০ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেন বিভিন্ন কন্ডোর নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করে। অথচ বেশ কয়েক মাস ধরে চলতে থাকা এই অপকর্ম শুরুতে কেউই টের পাননি। কিন্তু যখন টের পেলেন তার আগেই মনজুর মোর্শেদ পগাড় পার। তিনি আসলে আগে থেকেই সবকিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন ঠিক কখন পালাতে হবে।
কন্ডো বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা বলেন এ খাতে এ ধরণের জালিয়াতি তারা আগে কখনো দেখেননি। এটি সম্পূর্ণ নজিরবিহীন। টরন্টো স্টারকে এ কথা বলেন এসোসিয়েশন অব কন্ডোমিনিয়াম ম্যানেজার্স অব অন্টারিও’র প্রেসিডেন্ট ডিন ম্যাককেব। তিনি বলেন, ইন্ডাস্ট্রিতে সবাই হতবাক।
মনজুর মোর্শেদ এরকম জালিয়াতির মাধ্যমে যে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলেন তা দিয়ে তিনি রাজকীয় জীবন যাপন করতেন কানাডায়। ব্র্যাম্পটনে তার দোতালা বাড়ির সামনে দামী দামী সব গাড়ি পার্ক করা থাকতো। এর মধ্যে ছিল মার্সিডিজ, লেক্সাস, অডি, বিএমডাব্লিও ইত্যাদি ব্র্যান্ডের গাড়ি। তার একজন কর্মচারীর ভাষ্যমতে তিনি কিছুদিন পর পর গাড়ি বদলাতেন জুতা বদল করার মতো। হাতের সবকটি আঙ্গুলে তিনি স্বর্ণ বা হীরার আঙ্গটি পরে থাকতেন।
লোক মুখে শুনেছি উনি বাংলাদেশে গিয়ে দানবীর সেজেছিলেন। নিজ গ্রামে তিনি মসজিদ মাদ্রাসা তৈরী করে দিয়েছেন। পরে দুবাইতে এসে আত্মগোপন করেছেন। এগুলো অবশ্য শুনা কথা। প্রমাণ নেই। তবে ২০ মিলিয়ন ডলার চুরির বিষয়টি টরন্টোর বিভিন্ন পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল।
এখন জালিয়াত চক্র যখন আমাদের আশপাশেই আছে তখন এদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কৌশলও অবলম্বন করতে হবে। বাড়ি বা কন্ডো নিয়ে যারা জালিয়াতি করেন তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার স্মার্ট ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নাকি ‘টাইটেল ইন্সুরেন্স’ পলিসি ক্রয় করা। দি কানাডিয়ান প্রেস-কে এ কথা বলেন অন্টারিও রিয়েল এস্টেট এসোসিয়েশন এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিম হুডাক।
প্রতারকরা যখন কারো ব্যক্তিগত তথ্য (ড্রাইভার্স লাইসেন্স এর নাম্বার, জন্ম তারিখ, পাসপোর্ট নাম্মার, স্যোসাল ইন্সুরেন্স নাম্মার ইত্যাদি) চুরির পর সেগুলো দিয়ে ভুয়া দালিলপত্র তৈরী করে বাড়ি বা কন্ডো হাতিয়ে নেয় বা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় তখন আসল মালিক কার্যতই অসহায় হয়ে পড়েন। ঐ অবস্থায় তিনি তার নিজের বাড়ির ইকুইটি মানির উপর নিয়ন্ত্রণ হারান, বাড়ি বিক্রিও করতে পারেন না যতক্ষণ না সেই বাড়িটি আবার আদালতের মাধ্যমে তার নামে ফিরিয়ে আনতে পারেন। বাড়ি একবার প্রতারণার মাধ্যমে হাতছাড়া হয়ে গেলে তা আবার নিজের নামে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ। তাছাড়া অনেক অর্থও ব্যয় হয় এগুলো করতে গিয়ে। ফার্স্ট কানাডিয়ান টাইটেল ইন্সুরেন্স কোম্পানী এরকম তথ্য দিয়ে রেখেছে তাদের ওয়েবসাইটে।
এই ধরণের প্রতারণার প্রথম কৌশল হলো কারো ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেয়া। সুতরাং প্রতারণার হাত থেকে বাচতে হলে এই ব্যক্তিগত তথ্যসমূহ সবসময়ই নিরাপদে রাখতে হবে। কানাডিয়ান এন্টি ফ্রড সেন্টারের পরামর্শ হলো,
– আপনি কার সাথে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করছেন সে সম্পর্কে সতর্ক থাকুন।
– নিয়মিত ক্রেডিট কার্ড রিপোর্ট, ব্যাংক এবং ক্রেডিট কার্ড স্টেটমেন্ট চেক করুন এবং কোন অনিয়ম ধরা পড়লে সাথে সাথে তা ব্যাংককে অবহিত করুন।
– আবর্জনা বা রিসাইকেল বিনে রাখার আগে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য সম্বলিত নথিগুলো কুচি কুচি করে কেটে ফেলুন।
– নিয়মিত মেইল বক্স চেক করুন।
– আপনি যদি ঠিকানা পরিবর্তন করেন তবে তা পোস্ট অফিস, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য পরিষেবা প্রদানকারীদের অবহিত করুন।
অনেকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন এই ধরণের জালিয়াতির শিকার হলে সেটা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা সহজ পন্থা হলো ‘টাইটেল ইন্সুরেন্স’ পলিসি ক্রয় করা। এই পলিসি বাড়ি ক্রয়ের সময় নিলে পরবর্তী সময়ে নাকি উদ্বেগমুক্ত থাকা যায়। কারণ জালিয়াতির কবলে পড়লে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবে তখন ইন্সুরেন্স কোম্পানী। এই পলিসির দাম প্রতি হাজারে এক ডলার। কেউ ৫ লাখ ডলারে বাড়ি কিনলে ৫০০ ডলারে এই পলিসি কিনতে পারেন। আর বাড়ির দাম দশ লাখ ডলার হলে এই পলিসি কিনতে ১ হাজার ডলার লাগবে। টরন্টোর ডাউনটাউনে কন্ডো প্রতারণার শিকার মফি ইউ বলেন, আমার ভাগ্য ভাল যে আমি এই টাইটেল ইন্সুরেন্স পলিসিটি কিনে রেখেছিলাম।
অন্টারিও’র সরকারী ওয়েবসাইট www fsco.gov.on.ca/en/insurance এ এই বিষয়ে যে তথ্য দেয়া আছে তাতে বলা হয়েছে টাইটেল ইন্সুরেন্স এর সুবিধাটা হলো, এটি আবাসিক বা বাণিজ্যিক সম্পত্তির মালিক ও তাদের ঋণদাতাদের রক্ষা করে যখন মালিকানার বিষয়ে কোন জটিলতা দেখা দেয় বা কোন ক্ষতি হয়। এখানে টাইটেল কথাটি ব্যবহার হয়েছে একটি আইনী শব্দ হিসাবে যার অর্থ হলো আইনগতভাবে আপনি সম্পত্তির মালিক। বিক্রেতা যখন আপনার কাছে সম্পত্তি হস্তান্তরের ডকুমেন্টে সই করেন তখন আপনি আইনগতভাবে টাইটেল প্রাপ্ত হলেন সম্পত্তির। এবং এই টাইটেল তখন সরকারী খাতায় আপনার নামে রেজিস্ট্রি হয়। তবে অন্টরিওতে এই টাইটেল ইন্সুরেন্স পলিসি ক্রয় করা বাধ্যতামূলক নয়। ঐচ্ছিক। এ ব্যাপারে আপনি আপনার রিয়েল এস্টেট এজেন্ট, ইন্সুরেন্স ব্রোকার বা আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন বিস্তারিত জানার জন্য এবং এর সুবিধা ও অসুবিধা কি তা জানার জন্য।
তদন্তকারী ব্রায়ান কিং বলেন, ‘প্রতারণার মাধ্যমে বাড়ি বিক্রির কাজগুলোও ইনফ্যাক্ট আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্পাদিত হয় যা বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলে। এই জটিলতার কারণে বাড়িটি আবার আসল মালিকের কাছে ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট সময় লাগতে পারে, যেহেতু এটিকে বিভিন্ন বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।’
অবশ্য টাইটেল ইন্সুরেন্স পলিসি ক্রয় করা থাকলেই যে কেউ প্রতারণা শিকার হবেন না তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। তবে এই পলিসি ক্রয় করা থাকলে প্রতারিত হওয়ার পর সেই ক্ষতি প্রশমিত করার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। এই সকল পরিস্থিতিতে টাইটেল ইন্সুরেন্স প্রতারিত ব্যক্তিদের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং তাকে রক্ষা করে। সিবিসি নিউজকে এ কথা বলেন রিয়েলটর, প্রপার্টি ম্যানেজার এবং হাউজিং এ্যাডভোকেট ভরুন শ্রীস্কানা। তিনি বলেন, কেউ আপনার সাথে প্রতারণা করলে এই পলিসি আপনাকে রক্ষা করবে।
ফার্স্ট কানাডিয়ান টাইটেল ইন্সুরেন্স কোম্পানীর তথ্য অনুযায়ী, প্রতারিত বাড়ির মালিক তার সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে আইনি লড়াইয়ে যে খরচের মুখমুখি হন সেটা ফিরে পাবেন পলিসি নেয়া থাকলে।
আর যদি একজন ক্রেতা না জেনে প্রতারকদের কাছ থেকে বাড়ি কিনে থাকেন তবে টাইটেল ইন্সুরেন্স তাকেও রক্ষা করবে। এরকম পরিস্থিতিতে বাড়ির প্রকৃত মালিক তার বাড়ি ফিরে পাবেন এবং প্রতারণার বিষয়টি না জেনে যিনি বাড়ি কিনেছেন তিনিও তার অর্থ ফিরে পাবেন।
কিন্তু তারপরও কিছু সমস্যা থেকেই যায়। প্রথমত, ইন্সুরেন্স কোম্পানীগুলোর উপর কতটা নির্ভর করা যায়? প্রিমিয়াম নেয়ার বেলায় তারা যতটা তৎপর থাকে, ক্লেইম বা ক্ষতিপূরণের বেলায় কি ততটা তৎপর থাকে? আর এভাবে প্রতারণার সংখ্যা যদি বাড়তেই থাকে তবে টাইটেল ইন্সুরেন্স কোম্পানীগুলোও একসময় পিছুটান দিবে। কারণ আয়ের চেয়ে যখন তাদের ব্যয় বেশী হবে তখন তারা হয় প্রিমিয়াম আকাশচুম্বী করবে আর না হয় ব্যবসা বন্ধ করে দিবে। ইন্সুরেন্স কোম্পানী সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তারা প্রথম দেখবে লাভ। গাড়ির ইন্সুরেন্স এর বেলায় আমরা দেখে আসছি প্রতি বছর তারা কয়েক বিলিয়ন ডলার প্রফিট করছে কিন্তু প্রিমিয়াম কমাচ্ছে না। সরকারও কিছু করতে পারছেনা এদের বিরুদ্ধে। অতীতে দেখা গেছে কোন কোন রাজনৈতিক দল ভোটের আগে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় গেলে তারা প্রিমিয়াম কমানোর ব্যবস্থা করবে। কিন্তু উল্লেখ করার মত কিছুই হয়নি এ পর্যন্ত। কানাডায় সবচেয়ে বেশী প্রিমিয়াম গুনতে হয় অন্টারিওর গাড়ি চালকদের। গাড়ি চালকরা জিম্মি হয়ে আছেন এই ইন্সুরেন্স ব্যবসায়ীদের হাতে।
এখন কথা হলো, দেশে প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইন যদি কঠোর হয়, বাড়ি ঘর ক্রয় বিক্রয়ের নিয়মগুলো যদি নিখুঁত হয় বা ত্রুটিপূর্ণ না হয় তবে এই টাইটেল ইন্সুরেন্স এর দরকারটা কোথায়? অযথা গ্রাহকের উপর একটা বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়ে দেয়া নয় কি? একটা বাড়ি কিনতে গেলে বা বিক্রি করতে গেলে কয়েকটা ধাপ পার হতে হয় এখানে। এর মধ্যে আছে ব্যাংক বা অর্থালগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান, রিয়েল এস্টেট কোম্পানী, উকিল। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে যারা কাজ করেন তারা সবাই উচ্চ শিক্ষিত ও দক্ষ। এতগুলো চোখকে ফাঁকি দিয়ে কি ভাবে প্রতারণা করা সম্ভব?
হ্যা সম্ভব। এবং সম্ভব হচ্ছে বলেই প্রতারণা হচ্ছে। নিশ্চই এই ধাপগুলোর মধ্যে এমন কিছু ফাঁক-ফোকর রয়েছে যেগুলো প্রতারকরা জানে কি ভাবে অপব্যবহার করা যায়। এখন দরকার সেই ফাঁক-ফোকরগুলো খুঁজে বের করা। বাড়ি বিক্রি বা ক্রয়ের নিয়ম কানুনগুলো আরো স্মার্টার করা যাতে করে প্রতারণার কোন সুযোগ না থাকে। সম্পত্তি কিনে কেউ যাতে প্রতারকের খপ্পরে না পড়েন তার বিরুদ্ধে কঠোর আইন করা সরকারেরই দায়িত্ব।
খুরশিদ আলম, সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রবাসী কণ্ঠ