খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি : ভুগছেন স্বল্প আয়ের কানাডিয়ানরা, মুনাফা লুটছেন বৃহৎ গ্রোসারীর মালিকেরা
খুরশিদ আলম
কানাডায় খুব শীঘ্রই আমরা খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছি না। উপরন্তু ২০২৩ সালে খাদ্যমূল্য আরো বৃদ্ধি পাবে। আর এই মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বেশী ভোগান্তির শিকার হবেন ইমিগ্রেন্টসহ সীমিত বা স্বল্প আয়ের অধিবাসীরা।
খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতির কারণে ইমিগ্রেন্টসহ অন্যান্য স্বল্প আয়ের লোকেরা গত প্রায় তিন বছর ধরেই শিকার হয়ে আসছেন ভোগান্তির। আর এই ভোগান্তি অব্যাহত থাকবে আগামী বছরেও এবং আরো বেশী মাত্রায়।
প্রধানত কভিড মহামারী এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে দায়ী করা হচ্ছে এই পরিস্থিতির জন্য। অন্যদিকে আমেরিকান ডলারের তুলনায় কানাডিয়ান ডলারের মান কমে যাওয়ার কারণেও স্থানীয় বাজারে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ, কানাডার বাজারে যে সকল খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায় তার বেশীরভাগই আসে আমেরিকা থেকে।
কিন্তু দুর্মূল্যের এই বাজারে কানাডায় ইমিগ্রেন্টসহ স্বল্প আয়ের অধিবাসীদের কাছে আরো একটি খবর আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। আর সেই খবরটি হলো, এখানকার বৃহৎ সুপারমার্কেটগুলো চলমান মাহমারী ও যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও বিশাল অংকের মুনাফা করছে ক্রেতাদের পকেট কেটে।
বর্তমানে একদিকে সাধারণ আয়ের মানুষজন যখন তাদের খাবার কমিয়ে দিয়েছে মূল্যবৃদ্ধির কারণে, ফুড ব্যাংকে যখন লোকজনের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ঠিক তখন কানাডার বৃহৎ আকারের সুপারমার্কেটগুলোর মুনাফা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, সরকার এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে না বা করতে পারছে না। ঠিক যেন তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোর পরিস্থিতি এখন বিরাজ করছে কানাডায় যেখানে প্রভাবশালী ও ধনী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এবং সীমাহীন মুনাফা লুটে নেয় জনগণের পকেট কেটে। গরীব দেশে সেই মুনাফার ভাগ পায় সরকারের মন্ত্রী-আমলারা। কোন কোন দেশে আবার এই ধনী ব্যবসায়ীরা নিজেরাই থাকেন সরকারের অংশ হিসাবে। হয় মন্ত্রী হিসাবে না হয় এমপি হিসাবে।
কানাডায় তিনটি বৃহৎ আকারের চেইন সুপারমার্কেট আছে। এগুলো হলো, লভল কোম্পানিজ লিমিটেড (এর অধিনে আছে লবলজ, জেহরস, নো ফ্রিলস এবং রিয়েল কানাডিয়ান সুপারস্টোর), মেট্রো ইনক. (এর অধিনে আছে মেট্রো, ফুড বেসিকস এবং অন্যান্য আরো কয়েটি প্রতিষ্ঠান), এম্পায়ার কোম্পানী (এর অধিনে আছে সোবেস,আইজিএ, সেফওয়ে, ফার্ম বয়, ফুডল্যান্ড, ফ্রেসকো এবং আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান)। আর এই সবগুলো চেইন সুপারমার্কেটই বিপুল পরিমাণে মুনাফা লুটে নিচ্ছে মাহামারী ও যুদ্ধের এই সময়ে। মহামারীর আগে সময়ের (২০১৯) তুলনায় তাদের বর্তমান মুনাফা অনেক বেশী!
কানাডায় দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের আইনটাও কেমন যেন কোম্পানীবান্ধব। বাজারে কোন পণ্যদ্রব্যের মূল্য কত দামে বিক্রি করা যাবে তা কোম্পানীগুলো নিজেরাই ঠিক করার ক্ষমতা রাখে। গত অক্টোবর মাসে ফেডারেল এগ্রিকালচার কমিটি অবশ্য একটি মোশন পাস করেছে পার্লামেন্টে যার মাধ্যমে ঐ বৃহৎ সুপারমার্কেটের প্রধান নির্বাহীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডাকা যাবে। অন্যদিকে প্রায় একই সময়ে কানাডার কনজুমার ওয়াচডগ ‘কম্পিটিশন ব্যুরো’-র পক্ষ থেকেও ঘোষণা করা হয় তারা মুনাফার বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা পেশ করবে কিভাবে প্রতিযোগিতার বিষয়টি সংশোধন করে আরো উন্নত করা যায়।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, তাতে কি সত্যিকারের কোন কাজ হবে? গুয়েল্ফ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সাইমন সোমোগী সিবিসি নিউজকে বলেন, ‘কম্পিটিশন ব্যুরো এ ব্যাপারে কিছু করতে পারবে বলে আমি পুরোপুরি বিশ^াস করি না। দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের বিষয়েও কম্পিটিশন ব্যুরো কিছু করতে পারবে না।’
উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, স্বল্প আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ কানাডিয়ানকেই তাদের পরিবারের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাবার যোগাতে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। এদের মধ্যে আছেন প্রথম প্রজন্মের এবং নতুন আসা অনেক ইমিগ্রেন্ট।
গত জানুয়ারীতে প্রকাশিত এঙ্গুস রেইডের ঐ জরিপে দেখা যায়, ৫৭ শতাংশ কানাডিয়ান জানিয়েছেন, সম্প্রতি তারা তাদের পরিবারের জন্য খাবার জোটাতে কঠিন সময় পার করছেন। ২০১৯ সালে সর্বশেষ যখন তাদেরকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো তখনকার চেয়ে এই সংখ্যা ৩৬ শতাংশ বেশি। সিটিভি নিউজের এক রিপোর্টে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। রিপোর্টে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, এই নতুন সংখ্যার ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির ভূমিকা আছে। কানাডা গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে রয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার উপাত্তে দেখা যায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ভোজ্য তেল (৪১.৪ শতাংশ) এবং সাদা চিনির (২১.৬ শতাংশ) মত পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
সম্প্রতি এঙ্গুস রেইড ইন্সটিটিউট ‘অর্থনৈতিক চাপের সূচক’ (Economic Stress Index (ESI) পরিগণনা করতে গিয়ে জরিপে অংশগ্রহণকারীদেরকে চারটি পৃথক শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। শ্রেণীগুলি হলো: সমৃদ্ধ, স্বস্তিকর, অস্বস্তিকর এবং সংগ্রামশীল।
ঊঝও প্রয়োগ করে এঙ্গুস রেইড ইন্সটিটিউট দেখতে পায়, সংগ্রামশীল শ্রেণীর এক বিরাট অংশের (৯৮ শতাংশ) জন্যই পরিবারের খাবার যোগানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
জরিপে বলা হয়, যারা সমৃদ্ধ শ্রেণীতে পড়েন তাদের কাছে খাবারের দাম চিন্তার কারণ নয়। যারা অস্বস্তিকর অথবা সংগ্রামশীল শ্রেণীতে পড়েছেন তাদের কাছে টেবিলে খাবার দিতে পারাটা উল্লেখযোগ চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
জরিপে এটাও দেখা গেছে যে, ৩৯ শতাংশ কানাডিয়ান মনে করেন, তাদের আর্থিক অবস্থা গত এক বছর সময়ে আরও খারাপ হয়েছে। এঙ্গুস রেইড ইন্সটিটিউট গত ১৩ বছর ধরে কানাডিয়ানদের আর্থিক অবস্থা অনুসরণ করছে। আর আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়েছে বলে যারা মনে করছেন তাদের এই সংখ্যাটি গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সব মিলিয়ে, গত এক বছরে আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে বলে সবচেয়ে বেশি মনে করতে পারেন যেসব অঞ্চলের মানুষ তারা হলেন, আলবার্টা (৪৯%), সাসকাচুন (৪৭%), এবং নিউ ফাউন্ডল্যান্ড ও ল্যাব্রাডরের (৪৭%)।
অন্যদিকে ২০২১ সালে মহামারী চলাকালীন প্রকাশিত টরন্টো ইউনিভার্সিটির গবেষকদের এক নতুন সমীক্ষায় বলা হয়, কানাডার প্রায় ৫.৮ মিলিয়ন মানুষ কোনও না কোনও ধরণের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি অবস্থানে আছেন। ‘কানাডায় পরিবারগুলোর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা -২০২১’ শিরোনামের ওই সমীক্ষায় বলা হয়, দেশের ১০টি প্রদেশের সব কয়টি মিলিয়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়া পরিবারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫.৯ শতাংশে। সমীক্ষায় পুরো মহামারীকাল ও তার পরবর্তী বর্তমান রেকর্ড পরিমাণ মূল্যস্ফীতির সময় পর্যন্ত দেশের প্রদেশগুলিতে খাদ্য নিরাপত্তহীনতার হার পর্যবেক্ষণ করা হয়। গবেষকরা দেখেছেন, গত তিন বছরে সমস্যার খুব একটা উত্তরণ ঘটেনি।
টরন্টো ইউনিভার্সিটির টেমার্টি ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিনের পুষ্টিবিজ্ঞানের প্রফেসর ভ্যালেরি তারাসুক বলেন, ‘কানাডায় স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কোনও স্পষ্ট উন্নতি আমরা দেখতে পাইনি।’
অন্টারিওতে ২০২১ সালে প্রতি ছয়টির মধ্যে একটি বা ১৬.১ শতাংশ পরিবারের খাদ্য প্রাপ্তি ছিল অনিরাপদ, যা সংখ্যায় ২.৩ মিলিয়ন মানুষের সমান। একইভাবে এই প্রদেশের ৪.৬ শতাংশ বা দুই লাখ ৫৯ হাজার পরিবার মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তহীনতার মুখে পড়ে। এর অর্থ হলো, পরিবারের সদস্যরা কিছু বেলায় না খেয়ে থেকেছেন, খাওয়ার পরিমাণ কমিয়েছেন অথবা টাকার অভাবে দিনের পর দিন তেমন কিছু না খেয়েই কাটিয়েছেন।
সিবিসি নিউজের রিপোর্টে বলা হয়, গবেষকদের মতে, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উচ্চ হার অব্যাহত রয়েছে এবং মানুষের স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর প্রভাবের দিক থেকে এটি ‘গভীর উদ্বেগের’ বিষয়। তারা মনে করেন, মানুষের আয় যদি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হয় তাহলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
এদিকে গত জুলাই মাসে প্রকাশিত ফুড ব্যাংকস কানাডার এক সমীক্ষায় বলা হয়, দেশজুড়ে ক্ষুধা ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। পাস্তা, রুটি এবং গোশতের মত নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কানাডার ক্রমবর্ধমান সংখ্যক মানুষ কষ্টেসৃষ্টে চলছেন। আর মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্বল্পআয়ের কানাডিয়ানরা। দি কানাডিয়ান প্রেস এর এক রিপোর্টে এ সংবাদ পরিবেশিত হয়। মেইনস্ট্রিট রিসার্চ নামের এক সংগঠনের পরিচালিত সমীক্ষার বরাত দিয়ে রিপোর্টে আরো বলা হয়, দেখা গেছে, কানাডিয়ানদের প্রায় এক-চতুর্থাংশই জানান, তারা প্রয়োজনের চেয়ে কম খাবার খাচ্ছেন। কারণ খাবার কেনার মত যথেষ্ট অর্থ নেই। বছরে ৫০ হাজার ডলারের কম উপার্জন করেন এমন কানাডীয়দের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ।
ফুড ব্যাংকস কানাডার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্রিসটিন বিয়ার্ডসলে বলেন, ফুড ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগই এরই মধ্যে তাদের সামর্থের সীমা পেরিয়ে এসেছে। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘কানাডার বেশিরভাগ অঞ্চলের ফুড ব্যাংকগুলোতে প্রথমবারের মত আসা কানাডীয়দের জোয়ার দেখা যাচ্ছেÑ কিছু অঞ্চলে এধরণের মানুষের সংখ্যা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।’
‘কানাডিয়ানরা আমাদের বলছেন, বাড়ি ভাড়া, পেট্রোল, বিদ্যুৎ ও খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের হাতে খাবার কেনার মত অর্থ থাকছে না।’
আসলে স্বল্প আয় বা দারিদ্রতা যে কোন দেশে এবং যে কোন বিচারেই একটি অভিশাপ। এটি দরিদ্র দেশে যেমন সত্যি তেমনি সত্যি ধনী দেশেও। আমরা দেখেছি কানাডায় যখন করোনা মহামারী আঘাত হানলো তখন সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন এই স্বল্প আয়ের বা দরিদ্র জনগোষ্ঠিই। তারা আর্থিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন শারীরিকভাবেও। মহামারীতে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে।
করোনা মহামারী এখনো বিদায় নেয়নি। কানাডায় যারা স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষ বা দরিদ্র তাদের মাথায় এখন নতুনভাবে ভর করেছে বর্ধিত দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় চাপ। এই স্বল্প আয় বা দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশই প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্ট বা সাম্প্রতিক সময়ে আসা ইমিগ্রেন্ট। মাহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে একটা নিদারুণ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে তাদেরকে দিন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকট তাদের আগেও ছিল। কিন্তু এতটা প্রকট ছিল না যা এখন তাদেরকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বাজারে গেলে অনেক প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করা থেকে তাদেরকে বিরত থাকতে হচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ি ভাড়ার জন্যও তাদেরকে গুনতে হচ্ছে বেশী অর্থ। গাড়ির গ্যাস কিনতে গিয়েও একই পরিস্থিতির মুখমুখি হতে হচ্ছে তাদেরকে। ফলে দেখা গেছে নতুন ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে কেউ কেউ কানাডা ছেড়ে অন্য কোন দেশে বা নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন।
চলতি বছর মার্চে প্রকাশিত নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, নতুন ইমিগ্রেন্টদের ৩০ শতাংশই আগামী দুই বছরে কানাডা ছেড়ে চলে যেতে পারেন। সিটিভি নিউজে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে এই তথ্য জানা যায়। ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয়, ইন্সটিটিউট ফর কানাডিয়ান সিটিজেনশিপ (আইসিসি) এর জন্য লেগার-এর পরিচালিত এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ১৮-৩৪ বছর বয়সী নতুন ইমিগ্রেন্টদের ৩০ শতাংশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত নব্য কানাডিয়নাদের ২৩ শতাংশ বলেছেন, তারা আগামী দুই বছরের মধ্যে অন্য কোনও দেশে চলে যেতে পারেন।
আইসিসির সিইও ডেনিয়েল বার্নহার্ড এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘কানাডা হল ইমিগ্রেন্টদের দেশÑ আর আমরা নিজেদেরকে যেসব কাহিনী শোনাই তার একটি হল, নতুন ইমিগ্রেন্টরা যেখান থেকেই আসুক না কেন আমরা তাদের স্বাগত জানাই।’
‘কিন্তু কথাটা সাধারণভাবে সত্য হলেও নতুন সমীক্ষার তথ্য দেখাচ্ছে যে, নব্য কানাডিয়ানদের অনেকের মধ্যেই কানাডার প্রতি আস্থা নিয়ে সমস্যা আছেÑ আর এটিকে পুরো অটোয়াজুড়ে সতর্কীকরণ ঘণ্টাধ্বনি হিসাবে নেয়া উচিৎ।’
ইমিগ্রেন্টদের চ্যালেঞ্জগুলোও সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়েছে। সেটি হল, কানাডায় জীবনযাত্রার ব্যয়। সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সী নব্য কানাডিয়ানদের ৭৫ শতাংশই বলেছেন, তারা মনে করেন, জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের অর্থ হল ইমিগ্রেন্টদের কানাডায় অবস্থানের সম্ভাবনা কমে যাওয়া। একই বয়সসীমার ৪৬ শতাংশ কানাডিয়ানও এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত।
জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়তে থাকার পাশাপাশি নব্য কানাডিয়ানদের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল ন্যায্য ও জীবনযাপনের উপযোগী বেতন-ভাতায় কর্মসংস্থান। অন্যসব নব্য কানাডিয়ানের তুলনায় যথাযোগ্য চাকরি ও বেতন-ভাতার সুযোগ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী ইমিগ্রেন্টদের খুব কম সংখ্যকই ইতিবাচক মতামত দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী ইমিগ্রেন্টদের মাত্র ২৯ শতাংশ একমত যে তারা কাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ন্যায্য মজুরি পান।
এদিকে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ শ্রম খাতে শূন্যপদ পূরণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকার আগামী তিন বছরে কানাডায় পারমানেন্ট রেসিডেন্টের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। তবে গবেষকরা বলছেন, এটা করতে হলে নব্য কানাডিয়ানদের আরও বেশি সমর্থন দিতে হবে।
লেগার’এর নির্বাহী ভাইস-প্রেসিডেন্ট ডেভ শোলজ এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, তরুণ, বিশেষ করে উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন ইমিগ্রেন্টরা এই জটিলতার শিকারে পরিণত হতে শুরু করেছে। সফল হবার জন্য নবাগতদের যতটা সম্পদ দরকার তাই দিয়ে তাদেরকে স্বাগত জানানো নিশ্চিত করতে এবং অবারিত সুযোগের দেশ হিসাবে অবস্থান ধরে রাখতে আমাদের কঠোর প্রয়াস অব্যাহত রাখার দরকার আছে।’
এদিকে কানাডায় নতুন এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশটিতে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ২০২৩ সালেও বাড়তে থাকবে এবং এই বৃদ্ধির হার সাত শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। গবেষকরা বলছেন, চারজনের একটি পরিবারে বার্ষিক গ্রোসারী বিল গিয়ে দাঁড়াতে পারে ১৬,২৮৮ ডলারে। ২০২২ সালের তুলনায় ১,০৬৫ ডলার বেশী।
চল্লিশের কোঠায় বয়স এমন একজন কানাডিয়ান সিঙ্গেল মহিলাকে ২০২৩ সালে ৩,৭৪০ ডলার ব্যয় করতে হবে গ্রোসারীর বিল মিটাতে। আর একই বয়সের একজন পুরুষকে ব্যয় করতে হবে ৪,১৬৮ ডলার। নতুন গবেষণা ও স্ট্যাটিসটিকস কানাডা এ তথ্য জানায়।
ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং নতুন এই রিপোর্টের প্রধান লেখক সিলভাইন শার্লেবোইস কানাডিয়ান প্রেসকে বলেন, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে কানাডায় খাদ্যদ্রব্যের মূল্য অনমনীয়ভাবে উচ্চ পর্যায়ে থাকবে। এরপর হয়তো খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি সহজ হতে শুরু করবে।
রিপোর্টে বলা হয়, আগামী বছরের প্রথমার্ধেও মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকার পিছনে একাধিক বিষয় কাজ করবে। এর মধ্যে আছে জলবায়ু পরিবর্তন, ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত, ক্রমবর্ধমান জ¦ালানী খরচ এবং কভিড-১৯ এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। কানাডিয়ান ডলারের মূল্য পড়ে যাওয়ার কারণেও দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি অব্যাহত থাকবে। ২০২২ সালের প্রথমদিকে ইউএস ডলারের তুলনায় কানাডিয়ান ডলারের মূল্যমান ছিল ৮০ সেন্টস। কিন্তু গত অক্টোবরের দিকে এসে তা ৭২.১৭ সেন্টস এ দাঁড়ায়। গত কয়েক সপ্তাহে অবশ্য তা সামান্য পরিমানে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ সেন্টের দিকে। ডলারের মূল্যমান কমে গেলে আমদানী খরচ বৃদ্ধি পায়। দেখা গেছে কানাডায় আমদানীকৃত খাদ্যদ্রব্যের বেশীরভাগই আসে আমেরিকা থেকে।
খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে কানাডার সাধারণ আয়ের মানুষের মধ্যে হতাশা ও বিরক্তি এখন চরম পর্যায়ে। তারা সহসা এর থেকে মুক্তির পথও দেখছেন না। কারণ, কভিড আমাদের পিছ ছাড়ছে না। সেই সাথে বিশ^রাজনীতি ইন্ধন যোগাচ্ছে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির পিছনে। আর এই সুযোগে বৃহৎ আকারের গ্রোসারীর মালিকেরা পকেট কাটছে সাধারণ আয়ের ক্রেতাদের। যারা স্বচ্ছল বা উচ্চ আয়ের ক্রেতা, বাজারে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে তাদের কিছু যায় আসে না। যায় আসে সাধারণ আয়ের বিশেষত স্বল্প বা সীমিত আয়ের ক্রেতাদের। প্রথম প্রজন্মের বা নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদের সিংহভাগই আছেন এই ক্যাটাগরীতে।
এই পরিস্থিতিতে কানাডার নীতিনির্ধারকরা যদি কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন তবে ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে হতাশা এবং বিরক্তি আরো বাড়বে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এবং পরিনতিতে কেউ কেউ বিশেষ করে নতুন আসা ইমিগ্রেণ্টরা কানাডা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেই পারে যা কানাডার অর্থনীতির জন্য ভাল খবর নয়।
সেন্টার ফর ফিউচার ওয়ার্ক এর পরিচালক অর্থনীতিবিদ জিম স্ট্যান্ডফোর্ড এর মতে বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ আয়ের মানুষদেরকে রক্ষার জন্য ক্রমবর্ধমান খাদ্যদ্রব্যের মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মজুরি নির্ধারণ করা উচিৎ। এবং একই সাথে নিন্ম আয়ের পরিবারগুলোর জন্য আয়-সহায়তা কর্মসূচি চালু করা উচিত যা অসহনীয় মূল্যস্ফীতির হাত থেকে তাদেরকে কিছুটা সুরক্ষা দিতে পারে।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ