এই প্রথম কানাডায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চে পৌঁছেছে : কৃতিত্ব প্রধানত ইমিগ্রেন্টদের

মোট জনসংখ্যার মধ্যে ইমিগ্রেন্টদের অনুপাতও অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ২৬ অক্টোবর, ২০২২ ॥ বেবি বুম নামে পরিচিত জন্মহার বৃদ্ধির আকস্মিক জোয়ারের পর (১৯৪৬-১৯৬৪) এই প্রথম কানাডায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। এটি প্রধানত ঘটছে ইমিগ্রেন্টদের কারণে। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার এক নতুন প্রকাশনায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।

চলতি বছরের ১ জুলাই কানাডায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা হিসাব করা হয় তিন কোটি ৮৯ লাখ, যা ২০২২ সালের ১ এপ্রিলের জনসংখ্যার চেয়ে ০.৭ শতাংশ বা দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৮২ জন বেশি। এটি হলো ১৯৫৭ সালের পর থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ গতি। এতে করে দেশটির জনসংখ্যায় দৈনিক ৩,১০০ মানুষ যোগ হয়েছে। খবর গ্লোবাল নিউজ এর। রিপোর্ট করেছেন আয়া আল-হাকিম।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্য অনুযায়ী, এই বৃদ্ধির হার ৯৪.৫ শতাংশই হয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসনের মাধ্যমে যাতে, জনসংখ্যা বেড়েছে দুই লাখ ৬৯ হাজার ৩০৫ জন।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্যে উল্লেখ করা হয় যে, তুলনামূলক নথিপত্র যখন থেকে “বিদ্যমান তখন থেকে এটি ছিল আন্তর্জাতিক অভিবাসনের সর্বোচ্চ বৃদ্ধি।” এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি ঘটেছে নন-পারমানেন্ট রেসিডেন্টদের (+১,৫৭৩১০)।

এতে আরও বলা হয়, “আশ্রয়প্রার্থী এবং পারমিট পাওয়া (ওয়ার্ক, স্টাডি এবং অন্যান্য পারমিট) লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মিলিয়ে ওই বৃদ্ধি ঘটে।”

ছবিতে বাংলাদেশী কানাডিয়ান ও ইমিগ্রেন্টদের দেখা যাচ্ছে টরন্টোতে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতে । ছবি: মেরী রাশেদীন

সংস্থাটি আরও জানায়, ২০২২ সালের দ্বিতীয় চতুর্থাংশে অভিবাসীর সংখ্যা ছিলো নথি সংরক্ষণের সময়কালের যে কোনও বছরের দ্বিতীয় চতুর্থাংশের চেয়ে বেশি (১,১৮১১৪জন)। এতে বলা হয়, “এর পরেই রয়েছে কানাডার অভিবাসন, উদ্বাস্তু ও নাগরিকত্ব দফতরের অভিবাসী গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা, যা মহামারির শুরুর দিকে নিম্নস্তরে চলে গেলেও এখন তাতে প্রবৃদ্ধি ঘটছে।”

টরন্টো মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং অভিবাসন ও বাস্তুসংস্থান বিষয়ক টরন্টো মেট্রোপলিটন সেন্টারের পরিচালক ঊষা জর্জ বলেন, দেশে জন্মহার কমতে থাকায় কানাডাকে আরও অভিবাসী গ্রহণ করতে হবে।

এক সাক্ষাৎকারে ঊষা জর্জ বলেন, “এটা নিশ্চিত যে কানাডায় অভিবাসনই হতে যাচ্ছে জনসংখ্যায় প্রবৃদ্ধি অর্জনের একমাত্র উৎস।”

তিনি গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার পূর্বাভাসের বরাত দিয়ে বলেন, তাতে বলা হয়, ২০৪১ সালে কানাডার জনসংখ্যার অর্ধেকই হবে অভিবাসী ও তাদের কানাডায় জন্ম নেয়া সন্তানরা।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্যমতে, “আগামী কয়েক দশকে কানাডার জনসংখ্যায় প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা হয়ে থাকবে অভিবাসন। ১৯৯০-এর দশকে শুরুর পর থেকেই এই প্রবণতা চলে আসছে।

ঊষা জর্জ বলেন, অর্থনীতির জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু চাকরি ও আবাসনের ক্ষেত্রে বাড়তি জনসংখ্যাকে জায়গা করে দিতে কানাডা প্রস্তুত নয়।

তিনি বলেন, “আবাসনের ক্ষেত্রে আমাদের জটিলতা আছে। অভিবাসীরা এদেশে আসার পর তাদের জন্য যথাযথ কর্মসংস্থানের বিষয়েও আমাদের সমস্যা আছে।

তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, কানাডা অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন অভিবাসীদের নিয়ে আসে যারা এদেশে এসে তাদের বিশেষায়িত কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত চাকরি খুঁজে পায় নাÑ বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার কিংবা নার্সরা।

জর্জ বলেন, “এটি একটি অব্যাহত চ্যালেঞ্জে পরিণত হতে যাচ্ছে।”

তিনি বলেন, ওষুধ শিল্পের মত অনেক নিয়ন্ত্রিত পেশা আছে যেগুলি আধা-স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা, এগুলোর ওপর প্রাদেশিক সরকারের তেমন একটা নিয়ন্ত্রণ নেই তবে এদের ওপর সরকারের পক্ষ থেকে “হালকা চাপ” থাকুক এমনটা আশা করা হয়।

তিনি বলেন, “কিছু প্রতিষ্ঠানের আছে অযৌক্তিক চাহিদা।” তার জানা একটি ঘটনা উল্লেখ করে জর্জ বলেন, ডেন্টিস্ট হিসাবে যোগ্যতা প্রমাণের জন্য একজন ভারতীয় নারী অভিবাসীকে বলা হয়, সনদপ্রাপ্ত ডেন্টিস্ট হতে হলে তাকে অবশ্যই একটি কোর্স করতে ও  প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষায় অংশ নিতে ৬০,০০০ ডলার ব্যয় করতে হবে।

তিনি বলেন, “সবার অত টাকা থাকে না। সুতরাং মানের সঙ্গে আপস না করেই তারা যাতে নিজের পেশায় যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পায় সেজন্যে আমাদের প্রক্রিয়াগুলো সহজ করার দরকার আছে।”

ঊষা জর্জ সুপারিশ করেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি অভিবাসী পেশাজীবীদের এক্রিডিটেশন গ্রহণে কোনও ধরণের সনদ প্রদানের মাধ্যমে এদেশে নিজের পেশার কাজে যোগদান ও চর্চার সুযোগ দিয়ে সহায়তা করতে পারে। বিশেষ করে যেহেতু আরও বেশি অভিবাসী এদেশে আসছে তখন এটার প্রয়োজন আছে।

তিনি বলেন, “আমি অনুভব করি, এই মুহূর্তে কানাডায় মানুষের আবেগ অভিবাসনের অনুকূলে। কনজারভেটিভ এবং লেবার উভয় দলই কানাডায় অভিবাসনের গুরুত্ব স্বীকার করে কারণ ২০৪১ সালের মধ্যে… এমন আভাস আছে যে, পুরো প্রতিস্থাপনই হবে অভিবাসনের মাধ্যমে।”

তিনি বলেন, পুরো শ্রমশক্তির সরবরাহই আসতে যাচ্ছে অভিবাসন থেকে, সুতরাং অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা ও উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে হলে জনগণের মধ্য থেকে যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসতে পারে সে বিষয়ে সচেতন থাকা সত্যিই জরুরী।

তিনি আরও বলেন, “জনগণের আবেগ সম্পর্কে সতর্ক থাকার দরকার আছে। আমাদের এটা নিশ্চিত করার দরকার যে, কানাডায় অভিবাসনের গুরুত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট বোঝাপড়া আছে এবং এটা কতটা প্রয়োজনীয় সে বিষয়ে জনগণ সচেতন। এটা নিশ্চিত করা হলে আমরা জনগণের পক্ষ থেকে অভিবাসনের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হবো না।”

সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, কানাডা ২০২২ সালে ৪,৩১,৬৪৫ জন, ২০২৩ সালে ৪,৪৭,০৫৫ জন এবং ২০২৪ সালে ৪,৫১,০০০ নতুন পারমানেন্ট রেসিডেন্ট গ্রহণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

জনসংখ্যা কি সব প্রদেশ ও টেরিটোরিতে বাড়ছে

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা বলছে, শুধু নর্থওয়েস্ট টেরিটোরি ছাড়া আর সব প্রদেশ ও টেরিটোরিতে জনসংখ্যা বেড়েছে। নর্থওয়েস্ট টেরিটোরিতে বছরের দ্বিতীয় চতুর্থাংশে   জনসংখ্যা ০.২ শতাংশ কমেছে।

জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড (+১.৪ শতাংশ), নোভা স্কশিয়া (+১.২ শতাংশ) এবং নিউ ব্রান্সউইকে (+১.১ শতাংশ।

অন্টারিওতে (-২১.০০৮), ম্যানিটোবায় (-২,৮৯১) এবং সাসকাচুনে (-১,৯৪৮) বছরের দ্বিতীয় চতুর্থাংশে সবচেয়ে বেশি মানুষ কমেছে আন্তঃপ্রদেশ অভিবাসনের কারণে। এছাড়া কুইবেক (-৪২৯), নর্থওয়েস্ট টেরিটোরি (-২৪৪), নুনাভুত (-৪১) এবং ইউকনও (-৩২) জনসংখ্যা হারিয়েছে।

এতে বলা হয়, “মহামারির সময় অন্টারিও থেকে লোকেদের মেরিটাইমস প্রভিন্সে (ঘবি ইৎঁহংরিপশ, ঘড়াধ ঝপড়ঃরধ, ধহফ চৎরহপব ঊফধিৎফ ওংষধহফ) চলে যাবার যে প্রবণতা দেখা গিয়েছিল সেটা অব্যাহত আছে।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা জানাচ্ছে, ২০১৭ সালের তৃতীয়-চতুর্থাংশ থেকে এখন পর্যন্ত অন্টারিও হলো আটলান্টিক কানাডায় আন্তঃপ্রাদেশিক অভিবাসী সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস।

সংস্থাটি তার সেপ্টেম্বরের তথ্যে এমন পূর্বাভাসও দেয় যে, ২০৪১ সালে অভিবাসী জনসংখ্যার একটি বড় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মেট্রোপলিটন এলাকায় বসবাস করবে। ওই সময় টরন্টো, ম্যানিটোবা ও ভ্যাঙ্কুভার অভিবাসীদের বসবাসের তিনটি প্রাথমিক এলাকা হিসাবেই থেকে যাবে।

এদিকে অন্য একটি সংবাদ মাধ্যম সিবিসি নিউজ স্ট্যাটিসটিকস কানাডার বরাত দিয়ে, জানায়  কানাডার মোট জনসংখ্যা মধ্যে ইমিগ্রেন্টদের অনুপাত অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ২৩% ইমিগ্রেন্ট। ধারণা করা হচ্ছে এই অনুপাত আরো বৃদ্ধি পেয়ে ২০৪১ সালে মধ্যে ৩৪% এ দাঁড়াবে।

স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসাব মতে বর্তমানে দেশটিতে ইমিগ্রেন্টদের সংখ্যা ৮.৩ মিলিয়ন। শতকরা হারে মোট জনসংখ্যার ২৩%। এর আগের রেকর্ড ছিল ২২.৩%। আর সেই রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় শত বছর আগে ১৯২১ সালে।

কানাডার বর্তমান এই রেকর্ড জি-৭ তথা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যেও সর্বোচ্চ। জি-৭ ভুক্ত দেশগুলো হলো কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালী, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।

স্ট্যাটিসটিকস কানাডার তথ্য অনুয়ায়ি আরো দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক কালে আসা ইমিগ্রেন্টরা বয়সে তরুণ এবং কানাডার জব মার্কেটের জন্য এরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ইমিগ্রেন্টদের ৬৪% এর বয়স ২৫ থেকে ৬৪ এর মধ্যে। তবে এদের মধ্যে মাত্র ৩.৬% এর বয়স ৫৫ থেকে ৬৪ এর মধ্যে এবং ১৭% এর বয়স ১৫ বছরের নিচে।