মানবিকতা আর মায়ার দুই দেশ- কানাডা আর বাংলাদেশ

মাহমুদা নাসরিন

“সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি । ”  প্রবাসে  প্রতি  মুহূর্তে,  প্রতি ক্ষণে কি ভীষণ মায়ায় জড়িয়ে আছে আমার  দেশ  বাংলাদেশ বলে বোঝানো যাবে না। ভাগ্য আমাদেরকে  নিয়ে এসেছে   কানাডাতে । আর তাই কানাডা-বাংলাদেশ   ঘিরেই সব মায়ার বাঁধন গুলো   সদা সর্বদা  আবর্তিত হয় নিজের অজান্তেই।

বহু বছর আগে রেড ইন্ডিয়ান বা আদিবাসীদের  ভূমি  দখল করে যে  ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ কানাডা করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা এখনো করে চলেছে কানাডা।  আমরা সবাই এখানে ওঁদের জায়গা জমি দখল করে নিয়েছি, ওঁরাই কানাডার আদিবাসী।  কানাডার আদিবাসীরা তাঁদের  অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে এদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক সেটাই মনে প্রাণে প্রার্থনা করি । আর এজন্যে কানাডিয়ান হিসাবে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব আছে, সে দায়িত্ব আমরা কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারিনা।

আজ  কানাডা- বাংলাদেশের একটি  মায়া আর মানবিকতার ঘটনা বর্ণনা করবো যা সম্প্রতি   আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়েছে। মায়া আর মানবিকতা যে মানুষই ধারণ করে এবং তা কোনো স্থান, কাল, পাত্র মানে না আজকের বর্ণনাতে আমি তাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।  

এই ঘটনার মূল চরিত্র হাসিবুল আলম।  সে বাংলাদেশের নোয়াখালীর চৌমুহনী থেকে কানাডার হাম্বার কলেজে পড়তে এসেছিলো। ২০১৯  সালের ৭ই জানুয়ারী হাসিবুল  দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে কানাডা আসে। নোয়াখালীর প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সে কানাডা এসেছিলো পড়তে, পড়াশুনা করে বাবা-মা আর দেশ ও দশের জন্যে কিছু করতে চেয়েছিলো।  মা-বাবার তিন ছেলের মধ্যে সেই ছিল সবার ছোট আর সেই চলে গেলো সবার আগে। হাসিবুলের বাবা সারোয়ার ভাই আমাকে ফোনে বারবার একথাটিই বলেছেন যা আমার বাবা-মায়ের কষ্টের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে বারে বারে । আমার বড় ভাইও মারা গেছেন আমার বাবা মায়ের সামনে- খুব অল্প বয়সে ! হাসিবুল প্রথমে এসেছিলো লেকহেড ইউনিভার্সিটি, সাদবাড়ীতে জানুয়ারী ৭, ২০১৯ এ ।  আসার দুই এক দিনের মধ্যেই সে টরেন্টো চলে আসে । প্রথমে সেনেকা কলেজে এবং পরে সে হাম্বার কলেজে ভর্তি হয় । হাম্বার কলেজে সে হসপিটালিটি, ট্যুরিজম   এন্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট এর উপর ডিপ্লোমা প্রোগ্রামের শেষ সেমিস্টার এ অধ্যনরত ছিল। এর মাঝে ২০২১  সালের আগস্ট মাসে সে ৪১ দিনের জন্য বাংলাদেশে বেড়াতে যায়। টরেন্টোতে  একদিন হঠাৎ হাসিবুলের শরীর ভীষণ খারাপ হলে বন্ধু-বান্ধব এবং রুমমেটরা  তাকে হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যায়।  সেখাইনেই প্রথম তার লিউকোমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। দুই এক দিনের মধ্যেই সে ২০২২  সালের ২রা এপ্রিল মারা যায়। কানাডাতে হাসিবুলের দূর সম্পর্কের এক কাজিন আকাশ ছাড়া কোনো আত্মীয় পরিজন ছিল না। হাসিবুলের বাবা সারোয়ার আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এবং হাসিবুলের মা কান্নায় ভেঙে পড়েন- হাসিবুল তাঁদের সবচেয়ে  ছোট  সন্তান- কত আশা ভরসা ছিল তাকে  নিয়ে। এভাবে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে সে যে এভাবে চলে যাবে কেউ তা কখনো ভেবেছে? হাসিবুলের বাবা-মা আর দুই ভাই চাইলেন হাসিবুলকে বাংলাদেশে দাফন করতে।  হাসিবুলের মৃত্যুর খবরে বাংলাদেশ ফিউনেরাল সার্ভিস কানাডার রাফাত আলম ভাই আলবার্টা থেকে টরোন্টোর দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈয়দ আমিনুল ইসলামের মাধ্যমে   তাৎক্ষণিক ভাবে হাসিবুলের মরদেহ বাংলাদেশে  কত দ্রুত সময়ে পাঠানো যায়  সেই ব্যবস্থায়  লেগে  গেলেন  ।  হাইলি   মোফাত,  ফিউনেরাল ডিরেক্টর অফ হেরিটেজ  ফিউনেরাল সেন্টার এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো । সে জানালো মরদেহ ধোয়া, জানাজা পড়ানো, বিমান ভাড়া  সহ দেশে পাঠাতে বারো হাজার ডলারের মতো খরচ হবে।  তাৎক্ষণিক ভাবে  বিসিসিবি, বাংলাদেশ ফিউনেরাল সার্ভিস , হাসিবুলের দূর সম্পর্কের কাজিন  আকাশ সহ টরেন্টোর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট এবং বাংলাদেশী কমিউনিটি এই টাকা জোগাড় করতে লেগে গেলো।  সকলেই মুক্ত হস্তে টাকা দেয়া শুরু  করলেন।  হাইলিই মোফাত,  ফিউনেরাল ডিরেক্টর অফ হেরিটেজ  ফিউনেরাল সেন্টার, প্রথম জানালো,  এব্যাপারে হাম্বার কলেজের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, হাসিবুলের এই খরচ তার হেলথ  ইন্সুরেন্স কোম্পানি আই এ এসিস্ট প্রদান করবে, তবে মরদেহ বাংলাদেশে পাঠাতে কাগজপত্র তৈরির জন্যে   কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন ।   হাইলিই মোফাত মেয়েটি নিজেই অনলাইনএ বাংলাদেশ হাইকমিশনের ফর্ম ফিলাপ  করে, টেলিফোনে এপয়েন্টমেন্ট নিতে ব্যর্থ হয়ে সৈয়দ আমিনুল ইসলামের সহযোগিতা চায়।  সৈয়দ আমিনুল ইসলাম তাঁর ব্যাক্তিগত পরিচয়ের সূত্র ধরে গভীর রাতে হাইকমিশনের কর্মকর্তার সহযোগিতায় সকল পেপার ওয়ার্ক খুবই অল্প সময়ের মধ্যে করে  হাসিবুলের মরদেহ হাসপাতাল থেকে ফিউনারেল সার্ভিসে নিয়ে, ধৌত কোরে,  জানাজার পর  বিমানযোগে  বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়- একটি পয়সাও কারো পকেট থেকে খরচ করা লাগে নি।

হাসিবুলের মরদেহ দেশে পাঠানোর জন্যে হাম্বার কলেজ আর ইন্সুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের জন্যে বিএফএস এর সৈয়দ আমিনুল ইসলাম আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।  কেননা আমি দীর্ঘদিন যাবৎ দেশে বিদেশে শিক্ষকতা করেছি, আর আমি যেহেতু ক্যানবাংলা ইমিগ্র্যাশন সার্ভিসেস এর মাধ্যমে কানাডার ইমিগ্রেশনে এবং  ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের সাহায্য করি । কলেজ এবং ইন্সুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে আমি এখনো পর্যন্ত নেগোশিয়েশন করে চলেছি।  আমি হাম্বার কলেজে যোগাযোগ শুরু করলাম- প্রথম কন্টাক্ট করলাম আইয়ান ক্রকসাঙ্ক, এসোসিয়েট ভাইস প্রেসিডেন্ট এন্ড ডীন, স্টুডেন্ট সাকসেস এর সঙ্গে । কি ভীষণ মানবিক একজন মানুষ- কল্পনাই করা যায় না।  হাসিবুলের মৃত্যুর খবরে  দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে  প্রথমেই বললেন- আমাদের পরিবারেরই একজন চলে গেল। টেলিফোনে হাসিবুলের মা-বাবাকে সান্ত্বনা দিলেন,  তাঁদেরকে ইমেইল করেছেন তাঁদেরকে ইমেইল করেছেন। হাসিবুলের লাস্ট সেমেস্টার এর টুইশন ফির পুরা টাকা হাসিবুলের বাবার বাংলাদেশের একাউন্টে জমা দিয়ে দিলেন, হাসিবুলের ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিলেন, হাম্বার কলেজের পতাকা অর্ধ নমিত থাকলো একদিন।  এরপর হাসিবুলের বাবা-মা আর দুই ভাইকে দিলেন লেটার অফ ইনভাইটেশোন।  আর তা দিয়ে আমি ক্যানবাংলা ইমিগ্র্যাশন সার্ভিসের মাধ্যমে উনাদের কানাডা ভ্রমণের ভিসার আবেদন করলাম।  উনারা হাম্বার কলেজে যেখানে তাঁদের আদরের সন্তান লেখাপড়া করেছে দেখতে আসতে চাইলেন, দেখা করতে চাইলেন হাম্বার কলেজের মহানুভব শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সঙ্গ।  এর পর ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে হাম্বার কলেজের রিপ্রেসেন্টেটিভে নিকোল, হাম্বার কলেজের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ম্যানেজার আমান্ডা কস্কি এখনো পর্যন্ত  হাসিবুলের পরিবারকে যাবতীয় সহযোগিতা কোরে চলেছে।  হাম্বার কলেজ লাস্ট সেমেস্টার এর টুইশন ফী ফেরত দিলেও আমার দাবি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত হাসিবুল যে টুইশন ফী দিয়েছে সবই তার বাবার বাংলাদেশ একাউন্টে ফেরত দিতে। পুরো টুইশন ফি হাসিবুলের বাবাকে ফেরত দেয়ার- এখনো আলোচনা চলছে কলেজের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ডীনের সঙ্গে।  ইন্সুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে   বিমানভাড়া আর ফিউনেরাল খরচ আদায় করা গেলেও, আমি এখনো লড়ে যাচ্ছি লাইফ ইন্সুরেন্স এর ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্যে।  কেননা হাসিবুল মারা গেছে,  সে শুধু হেলথ ইন্সুরেন্স নয়, লাইফ ইন্সুরেন্স ও পেতে পারে। কলেজ কতৃপক্ষ আমার সাথে আছে- আশা করি আদায় করতে পারব। 

হাসিবুলের দুঃখজনক অকাল মৃত্যুটি মনে করিয়ে দেয় আমাদের ক্ষণস্থায়ী, অনিশ্চিত মানব জীবনের কথা। আর এও দেখলাম- মানবিকতা মানুষই ধারণ করে আর সেটিই মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম -এরচেয়ে বড় কোনো ধর্ম নেই। হাসিবুলের আত্মা শান্তিতে থাকুক, ওঁর বাবামাকে পরম  করুনাময় শোক সইবার শক্তি দিক।   

মাহমুদা নাসরিন

প্রিন্সিপাল কনসালট্যান্ট, ক্যানবাংলাইমিগ্রেশনসার্ভিসেস , শিক্ষক ও সমাজকর্মী। সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ও কিং খালেদ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদিআরব। nasrinmahmuda8@gmail.com