রাণীর মৃত্যুর পর কানাডায় রাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারও বিতর্ক শুরু
খুরশিদ আলম
গত ৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। সুদীর্ঘ ৭০ বছর ধরে তিনি ছিলেন ব্রিটেনের রাণী এবং একই সাথে কানাডারও রাণী। পাশাপাশি তিনি আরো এক ডজন দেশের রাণী ছিলেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে ব্রিটেন ও কানাডাসহ আরো অনেক দেশে। ঐ সকল দেশে অর্ধনমিত করে রাখা হয় জাতীয় পতাকা।
রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর প্রথাগতভাবেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন তাঁর বড় ছেলে ৭৩ বছর বয়সি তৃতীয় চার্লস। রাজা হিসেবে শপথ গ্রহণের সময় চার্লস বলেন, তিনি তাঁর কর্তব্য ও সার্বভৌমত্বের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে খুবই সচেতন। জনগণের ভালোবাসা ও আনুগত্যের মধ্য দিয়েই তিনি ক্ষমতায় থাকবেন।
এদিকে ব্রিটেনের পাশাপাশি কানাডায়ও গত ১০ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তৃতীয় চার্লসকে কানাডার রাজা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ফলে তিনি এখন কানাডারও রাজা তথা রাষ্ট্রপ্রধান। অনুষ্ঠানে কানাডার গভর্নর জেনারেল মেরী সাইমন ও প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো উপস্থিত ছিলেন। গভর্নর জেনারেল মেরী সাইমন কানাডায় রাজা তৃতীয় চার্লস এর প্রতিনিধি।
প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘মহামান্য রাজা তৃতীয় চালর্স এর সঙ্গে কানাডার বন্ধুত্ব বহুদিনের। কানাডা তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিনের এই বন্ধুত্ব উপভোগ করেছে। তিনি বহুবার সফর করেছেন কানাডায়। কানাডা সরকারের পক্ষ থেকে আমরা আমাদের নতুন রাজা মহামান্য তৃতীয় চার্লস এর প্রতি আমাদের অনুগত্য নিশ্চিত করছি এবং তাঁকে আমাদের পূর্ণ সমর্থন প্রদান করছি।’
তবে কানাডার সব মানুষই যে রাজার প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করেন এমনটা কিন্তু নয়। গত বছর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে রাজতন্ত্রের অবসান চান এমন কানাডিয়ান অধিবাসীর সংখ্যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর ছুঁয়েছে।
রিসার্চ কোং এই জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, জরিপে অংশ নেয়া কানাডীয়দের ৪৫ শতাংশই বলেছেন, দেশের সংবিধানের কথা বিবেচনা করলে তাঁরা রাণীর পরিবর্তে একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান থাকার বিষয়টিই অগ্রাধিকার দেবেন। খবর সিটিভি নিউজ এর।
গত বছর ১ মার্চ প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রিসার্চ কোং উল্লেখ করে যে, এই অগ্রাধিকার দানকারীদের সংখ্যা ‘ঐতিহাসিক স্তরের’ এবং তা ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই সংস্থার পরিচালিত অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের একই ধরণের জরিপের ফলাফলের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি।
রিসার্চ কোং-এর রিপোর্টে আরো বলা হয়, প্রতি চারজন কানাডিয়ান অধিবাসীর মধ্যে একজন (২৪ শতাংশ) বলেছেন, তাঁরা চান কানাডায় রাজতন্ত্র টিকে থাকুক, অন্যদিকে ১৯ শতাংশ বলেছেন, ‘কোনও পদ্ধতিতেই তাঁদের আপত্তি নেই’। আর ১৩ শতাংশ এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতার কথা জানিয়েছেন।
রিসার্চ কোং-এর প্রেসিডেন্ট মারিও ক্যানসেকো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘এর আগে একই ধরনের প্রশ্ন রেখে ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পরিচালিত চারটি জাতীয় পর্যায়ের সমীক্ষায় একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান থাকার বিষয়টি কখনই ৪০ শতাংশের বেশি মানুষের সমর্থন পায়নি।’ তিনি আরও বলেন, দেশে একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান থাকার বিষয়টি সমর্থনকারীদের মধ্যে এগিয়ে আছেন, পুরুষ (৫১ শতাংশ), ৩৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী কানাডিয়ান (৪৬ শতাংশ), কুইবেকবাসী (৫৭ শতাংশ)।
গত ৮ সেপ্টেম্বর রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এর মৃত্যুর পর কানাডায় রাজতন্ত্রের পক্ষে ও বিপক্ষে আলোচনা আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। আদিবাসীদের অনেক সংগঠন শোকও প্রকাশ করেছে রাণীর মৃত্যুতে। পাশাপাশি নতুন রাজার সঙ্গে আগামী দিনগুলোতে ভাল সম্পর্ক তৈরী হবে এমন আশাবাদও ব্যক্ত করা হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে মেনিটোবার Métis Federation কথা বলা যায়। এই ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ডেভিড চাট্রান্ড বলেছেন, ‘আগামী দিনগুলোতে রাজা তৃতীয় চার্লস ও কানাডার আদিবাসীদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরী হবে। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো, এমনটা দেখার জন্য আমরা আশাবাদী।’
তবে অতীতে যাঁরা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের শিকার হয়ে নানানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে রাজন্ত্রের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার সংখ্যা বেশী। এদের মধ্যে আছেন কানাডার আদিবাসীদের বিভিন্ন গ্রুপ, এশিয়ান ও আফ্রিকান ইমিগ্রেন্টদের একটি অংশ।
উল্লেখ্য যে, গত বছর প্রথমে ব্রিটিশ কলম্বিয়ায়র কামলুপস রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের মাঠ থেকে ২১৫ জন শিশুর গণকবর এবং তার কয়েকদিন পর সাচকাচ্যুয়ানে মেরিভ্যাল ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের মাঠ থেকে ৭৫১ জন শিশুর গণকবর আবিস্কৃত হয়। এই আবাসিক স্কুলগুলোতে আদিবাসী শিশুদের জোর করে ধরে এনে ভর্তি করা হয়েছিল। এই গণকবর আবিস্কৃত হওয়ার পর গত বছর কানাডা ডে উদযাপনের দিন মেনিটোবাতে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও রাণী ভিক্টোরিয়ার ভাস্কর্য ভেঙ্গে মাটিতে ফেলে দেয়া হয়েছিল।
সেই সময় আদিবাসী শিশুদের এই গণকবর আবিস্কারের ফলে চরম বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে কানাডার সরকার। সংকটের মধ্যে নিপতিত হয় কানাডার ভাবমূর্তি। অতীতের এই নৃশংসতার জন্য ইতিমধ্যে ক্ষমাও চান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেন, এটি খুবই বেদনাদায়ক ও দেশের ইতিহাসে লজ্জাজনক এক অধ্যায়। ২০০৮ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার-ও ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন আদিবাসী শিশুদের জন্য নির্মিত আবাসিক স্কুলগুলোতে শিশুদের উপর দমন-নিপীড়ন চালানোর জন্য।
কানাডার আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রী ক্যারোলিন বেনেত বলেন, আদিবাসী শিশুদের জন্য নির্মিত আবাসিক স্কুলগুলো ছিল লজ্জাজনক ঔপনিবেশিক নীতির অংশ।
কানাডার বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসী আবাসিক স্কুলগুলোতে শিশুদের উপর নৃশংস নির্যাতনের তথ্য নতুন কিছু নয়। প্রায় এক শতাব্দীরও বেশী সময় ধরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্কুলে দেড় লক্ষ আদিবাসী শিশুর উপর চলে এই নির্যাতন। আর এই নির্যাতনে মারা যায় ৪ থেকে ৬ হাজারের মত শিশু। কানাডার ট্রুথ এ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশনের হিসাব এটি।
উল্লেখ্য যে, আদিকালে খ্রীষ্টান চার্চগুলো বিভিন্ন দেশে ব্রিটেন-সহ ইউরোপিয়ান আরো কয়েকটি দেশের অবৈধ সাম্রাজ্য বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। কানাডায়ও তাঁরা একই কাজ করেছে। ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ও তাঁদের সহায়কের ভূমিকা পালনকারী খ্রীষ্টান চার্চগুলোর বিরুদ্ধে কানাডার আদিবাসীদের ক্ষোভ সৃষ্টির এটিও একটি অন্যতম কারণ।
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার স্থানীয় একটি আদিবাসী গ্রুপের প্রভাবশালী এক নেতা ডরিন ম্যানুয়েল গ্লোবাল নিউজকে বলেন, আমার খুব কষ্ট হয় যখন দেখি লোকজন রাণীর প্রতি এতটা উচ্চমাত্রার শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে। আমি মনে করি সাধারণভাবে মানুষজন গণহত্যার বিষয়টি ভাবছে না এবং এই গণহত্যার প্রভাব আমাদের আদিবাসীদের উপর কতটুকু প্রভাব ফেলেছে তাও ভাবছে না। তাঁরা কেবল একজন রাণীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছে যাকে তাঁরা হয়তো ভাল করে জানেও না।
ক্যাপিলানো ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ভেঙ্কুভার এর Bosa Centre for Film and Animation পরিচালক এই ডরিন ম্যানুয়েল নিজেও একজন ছাত্রী ছিলেন অদিবাসী শিশুদের আবাসিক স্কুলে। তিনি বলেন, ‘গত শতকের ষাটের দশকে সেই স্কুলে আমাকে মারধর করা হয়েছিল, আমাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল, আমাকে ক্ষুধার্থ রাখা হয়েছিল। আমার মাথা পানিতে চুবিয়ে রাখা হয়েছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি তখন একেবারেই একজন শিশু ছিলাম।’
বর্তমানে ৬২ বছর বয়সী ডরিন ম্যানুয়েল অতীতে তাঁর উপর এবং তাঁর প্রজন্মের অন্যান্য আদিবাসী শিশুদের উপর দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতিগত নির্যাতন চালানোর প্রতি সমর্থন দানের জন্য ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের উপর সরাসরি দোষারোপ করেন। তিনি জানান, এখনো তিনি দুঃস্বপ্ন এবং অনিদ্রায় ভুগেন সেই সব দিনের নির্যাতনের কথা মনে করে। রাতে তিনি অন্ধাকরে ঘুমাতে পারেন না। ঘরে মৃদু আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়।
ডরিন ম্যানুয়েল আরো বলেন, ‘সেই ব্রিটিশ রাজতন্ত্র এবং সেই সময়কার কানাডিয়ান সরকার আদিবাসীদের উপর গণহত্যা চালানোর অনুমোদন দিয়েছে, তাঁরা শিশুদের ধর্ষণ ও হত্যার অনুমোদন দিয়েছে। সেই সব দিনগুলোতে আমি ও আমার মত যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে তাঁদের কাছে রাণীর চিত্রটি সুুখকর নয়। রাজতন্ত্র ধনী হয়েছে আমাদের জমি দখল করে আর আমরা জীবন কাটিয়েছি দারিদ্রতার মধ্যে। আমাদের অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে অনাহারে।’
অন্টারিও’র Swampy Cree এলাকার আদিবাসী Chance Paupanekis সিবিসি নিউজকে বলেন, দৃশ্যত: রাণীকে মিষ্টি ও দয়ালু বলে মনে হয়। কিন্তু বাস্তবিকভাবে তিনি ও তাঁর পূর্বসূরিরা সারা বিশ্বে আদিবাসীদের উপর গণহত্যার অভিযান পরিচালনার জন্য দায়ী।
অন্যদিকে কানাডার ‘ফার্স্ট নেশনস’ এর ন্যাশনাল চীফ রোজেন আর্কিবল্ড সিটিভি নিউজকে বলেন, ‘ব্যর্থতার জন্য এবং বিশেষ করে ফার্স্ট নেশনস জনগণের উপর উপনিবেশবাদীদের ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালানোর জন্য রাজপরিবারকে ক্ষমা চাওয়া উচিত।’
তিনি আরো বলেন, গত মে মাসে তৃতীয় চার্লস যখন কানাডায় এসেছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে তিনি সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আন্তরিক। কিন্তু এটাও লক্ষ্য করা গেছে যে, তিনি আদিবাসী শিশুদের আবাসিক স্কুলে যে নির্যাতন চালানো হয়েছিল সে ব্যাপারে কোন ক্ষমা চাননি। ইয়োলোনাইফে এক অনুষ্ঠানে চার্লস জনতার উদ্দেশ্যে কেবল বলেছিলেন, ‘আমি আদিবাসীদের কষ্ট স্বীকার করতে চাই এবং বলতে চাই যে আমাদের হৃদয় তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারের প্রতি সমবেদী।’
তবে রাণীর মৃত্যুর পর শুধু কানাডার আদিবাসীরাই যে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তা নয়। এখানকার দৃশ্যমান বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনদের মধ্যেও কেউ কেউ তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কারণ হিসাবে তাঁরা জানিয়েছেন, তাঁদের নিজ নিজ জন্মভূমিও একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা দখল করে নিয়েছিল এবং নানা ভাবে তাঁদের পূর্বপুরুষদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ ও লুণ্ঠন চালিয়েছিল।
তাঁরা বলেন, রাণীর মৃত্যুর পর এবার কানাডায় রাজতন্ত্রের অবসান ঘটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ‘ইন্ডিয়া কানাডা এসোসিয়েশন’ এর সভাপতি পরমোদ ছাবরা দি কানাডিয়ান প্রেস কে বলেন, ‘তিনি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে সম্মান করেন কানাডার রাণী হিসেবে। তবে এখন সময় এসেছে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের কবল থেকে বের হয়ে আসার।’
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা যখন ভারত শাসন করেছিল তখন ভারতীয়দের বিরুদ্ধে পরিচালিত তাঁদের নৃশংসতার কথা স্মরণ করে ছাবরা বলেন, ‘আমি মনে করি রাজতন্ত্রের চলে যাওয়ার সময় এসেছে এখন।’
তিনি আরো যোগ করেন, ‘আমাদের উচিৎ ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সঙ্গে কানাডার সম্পর্কের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা এবং রাণী বা রাজাকে আমাদের দেশের প্রধান হিসাবে রাখার পরিবর্তে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার ব্যাপারে চিন্তা করা। কারণ আমরা এই রাজা বা রাণীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করি না।’
একই মনোভাব শেয়ার করেছেন ‘ন্যাশনাল বাংলাদেশী-কানাডিয়ান কাউন্সিল’ এর সভাপতি মনির হোসেন। তিনি বলেন, ‘কানাডাকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন দেশ হওয়া উচিৎ।’
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে চরমভাবে নিগৃীত, নির্যাতিত ও শোষিত আরেক মহাদেশ হলো আফ্রিকা। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে (৭০ বছর) সিংহাসনে থাকা রাণীর সময়ে সাম্রাজ্যের সহিংসতার শিকার হয় লাখো মানুষ। এই মহাদেশটির বিভিন্ন দেশ থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের জোর করে ধরে এনে দাস বানাতো ব্রিটিশসহ ইউরোপীয়রা। ফলে তাঁদের মধ্যেও রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এর মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া।
আর সে কারণে রাণীর মৃত্যুতে শোক জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে সাউথ আফ্রিকার বামপন্থী রাজনৈতিক দল ইকোনমিক ফ্রিডম ফাইটার্স। এক বিবৃতিতে দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমরা তাঁর মৃত্যুতে শোক জানাতে পারি না, কারণ তাঁর রাজত্বকালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি গোটা আফ্রিকায় বর্বরতা ও নৃশংসতা চালিয়েছে। রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁর সময়কালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিপীড়ন, গণহত্যার দায় এড়াতে পারেন না।
ব্রিটেনের ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন’ এর ইতিহাসের অধ্যাপক ম্যাথিউ স্মিথ লন্ডন থেকে টেলিফোনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিউজউইককে বলেন, ‘আমার মনে হয় সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তির সমালোচকরা ঘৃণা করেন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রকে, যে ব্যবস্থার প্রতিটি পদে পদে রয়েছে নিষ্পেষণ ও শোষণের ইতিহাস। তবে তাঁরা রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে ঘৃণা করেন না।’ তিনি আরো বলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক এ ব্যবস্থায় পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ লুট, নিপীড়ন, জোরপূর্বক দাস বানানো ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের সরাসরি যোগসাজশ রয়েছে।’
গত ৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মায়া জ্যাসানফ লিখেছেন, ‘রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ঔপনিবেশিকতার একটি রক্তাক্ত ইতিহাসকে আড়াল করতে সাহায্য করেছিলেন।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় অবস্থিত কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উজু আনিয়া এক টুইটবার্তায় লিখেছেন, ‘আমার বাবা ও মা উভয়ের দিক থেকেই আমি সেসব পরিবারের উত্তরাধিকার, যারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে গণহত্যার শিকার হয়েছেন এবং জোরপূর্বক তাঁদেরকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। এ কারণে রানির মৃত্যুতে অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছু আমার জানানোর নেই। আমার যেসব আত্মীয়- স্বজন এখনও বেঁচে আছেন, তাঁরা সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন আজও। আমি প্রতিদিনই প্রার্থনা করি, তাঁদের সেই মানসিক যন্ত্রণা যেন দূর হয়।’
উল্লেখ্য যে, আফ্রিকায় একসময় দাস ব্যবসার একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল ব্রিটেনের রয়াল আফ্রিকান কোম্পানির হাতে। ধারণা করা হয়, ১৬৭২ সাল থেকে ১৬৮৯ সাল পর্যন্ত এই কোম্পানীর জাহাজে করে প্রায় ৮০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ, নারী ও শিশুকে আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল। তাঁদের গায়ে কোম্পানির নামে সিল মেরে আমেরিকাগামী জাহাজে তোলা হতো। শেকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় তাঁদের শুইয়ে দেওয়া হতো জাহাজের খোলের মধ্যে। ১৬৯৮-১৮০৭ সাল পর্যন্ত ব্রিস্টল থেকে মোট ২,১০০টি জাহাজ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের নিয়ে আমেরিকার উদ্দেশে যাত্রা করেছিল।
বৃটেনের ব্রিস্টলের বাসিন্দা কৃষ্ণাঙ্গ কবি মাইলস চেম্বার্স বিবিসিকে বলেন, ‘কিছু লোক আছে যারা বুঝতেই পারে না যে সেই দাসত্বের প্রভাব এখনো কীভাবে কৃষ্ণাঙ্গরা তাঁদের জীবনে অনুভব করেন। দাসদের উত্তরসূরিরা অর্থনৈতিকভাবে এখনো দরিদ্র, মানসিকভাবে তাঁরা নিজেদের নিকৃষ্ট বলে অনুভব করেন, আফ্রিকান-ক্যারিবিয়ান পুরুষরা এখনো বিসদৃশ সংখ্যায় কারাগারে, তাঁরা পড়াশোনায় ভালো করতে পারছেন না, কাজ পাচ্ছেন না বা পেলেও কম বেতন পাচ্ছেন। দাসপ্রথা উচ্ছেদ হয়ে গেলেও এসব বদলায়নি। সেই ইতিহাসের কারণে আমরা এখনো দাসত্বের অনুভূতি থেকে বের হতে পারিনি।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা দেখতে পাই, শত শত বছর ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা বিশ্বজুড়ে তাঁদের শাসন, শোষণ ও লুটতরাজ চালানোর জন্য একের পর এক দেশে অভিযান চালিয়েছে। বাংলায় তাঁদের ঔপনিবেশিক শাসন পাকাপোক্ত করতে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করেছিল নবাব সিরাজউদদৌলাকে। তাঁদের অবিচার-নির্যাতন-লুটপাটের বিরুদ্ধে সরব হওয়ায় সেদিন প্রাণ দিতে হয় ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারসহ অনেক বিপ্লবীকে।
ভারতে ব্রিটিশবিরোধী তুমুল আন্দোলনের সময় অমৃতসর শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক একটি প্রাচীর ঘেরা বদ্ধ মাঠে সমবেত নিরস্ত্র জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল বৃটিশদের লেলিয়ে দেওয়া সৈন্যরা। ঐ হামলায় শত শত মানুষ প্রাণ হারায়। ঘটনাটি উপমহাদেশের অন্যতম র্ববরোচিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে কুখ্যাত হয়ে আছে।
আরও স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৪৩ সালে তাঁরা ভারতে উৎপাদিত লক্ষ লক্ষ টন গম ব্রিটেনে পাচার করে দিয়েছিল। ফলে ভারতবর্ষের ইতিহাসে ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। সেই দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়ে ভারতের ১ কোটি ২০ লাখ থেকে ২ কোটি ৯০ লাখ মানুষ শুধু না খেতে পেয়েই মারা যায়। এর মধ্যে কেবল বাঙ্গালী অধ্যুষিত অঞ্চলেই চল্লিশ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যায়।
সেই মর্মস্পর্শী দুর্ভিক্ষে নিজেদের দায় অস্বীকার করার জন্য তৎকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘আমি ভারতীয়দের ঘৃণা করি। অসভ্য ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে তাঁরা পশুরমত জীবন যাপন করে। খরগোশের মত অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা উৎপাদনের কারণেই তাঁরা দুর্ভিক্ষে পতিত হয়েছে’।
এই হলো ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাস। আর সেই রাজপরিবারের রাণীর মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়েছে শোক দিবস। বাদ যায় নি বাংলাদেশও। তিনদিনের রাষ্ট্রিয় শোক পালন করা হয় দেশটিতে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী লন্ডনেও গিয়েছিলেন রাণীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যোগ দিতে। শোক পালন করা হয় কানাডাতেও। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও গিয়েছিলেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যোগ দিতে। গিয়েছিলেন কানাডার গভর্নর জেনারেলও যার ধমনীতে বইছে কানাডার আদিবাসীদের রক্ত।
এখন ব্রিটিশ সেই রাজের প্রতি কানাডার আনুগত্য আগামী দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে, না থাকবে না তা সময়ই বলে দিবে। তবে কানাডায় ব্রিটিশ রাজতন্ত্র নিয়ে সাংবিধানিক বিতর্ক পুনরায় শুরু করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। রাণীর মৃত্যুর পর কানাডায় রাজতন্ত্রের ভূমিকা নিয়ে আবারও বিতর্ক শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে ট্রুডো গত ১৮ সেপ্টেম্বর তাঁর এ মত ব্যক্ত করেন। এএফপির এক খবরে বলা হয়, শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে যোগদান করতে গিয়ে লন্ডনে রেডিও-কানাডাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রুডো বলেন, ‘আমার জন্য এটি কোনো অগ্রাধিকার নয়। এমনকি এটি এমন কিছু নয় যা আমি আলোচনা করার কথা বিবেচনা করি। বিশ্বের সেরা, সবচেয়ে স্থিতিশীল এমন একটি পদ্ধতিতে গভীর পরিবর্তন আনা আমার জন্য এখন ভালো হবে না।’
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ