ব্যবস্থা না নিয়ে, দুঃখিত বলার কোনও মানে হয় না

ডেভিড এ. রবার্টসন

আমার বাবার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছিল উত্তর ম্যানিটোবার নরওয়ে হাউজ ক্রি নেশনে। অষ্টাদশ শতকে গোড়াপত্তনের সময় থেকেই এটি খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী একটি সংরক্ষিত (রিজার্ভ) এলাকা। তিনি এই কমিউনিটির কেন্দ্র রসভিলিতে হাডসন বে কোম্পানির হয়ে কাজ করতেন। ওই সময়েই তার সঙ্গে ইউনাইটেড গির্জার লোকদের পরিচয় হয়।  

তিনি তাকে প্রথাগতভাবে দত্তক নেয়া দাদা ওয়াল্টার কিপারের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটান। ওয়াল্টারের দুটি পরিচয় ছিল কমিউনিটিতে। একটি হলো তিনি গির্জার প্রবীন সদস্য, আরেকটি হলো স্বীকৃত প্রবীন ও ভেষজ চিকিৎসক। উভয় পরিচয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার একটি উপায় তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন। তিনি সমবেত প্রার্থনার জন্য মানুষের কাছে যেতেন আবার যখন পাশ্চাত্যের ওষুধে কাজ হতো না তখন চিকিৎসকের অনুরোধে হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের দাওয়াই দিতেন। বাবা ওয়াল্টারের বাড়িতে যাবার এবং সেখানে পোর্চের সিলিংয়ে ঝোলানো ভেষজ ওষুধপত্র দেখার স্মৃতিচারণ করতেন।

আমার বাবা পরে পাদ্রী হয়েছিলেন এবং ওই ভারসাম্য খুঁজে পান। তরুণ পাদ্রী হিসাবে  তিনি অল্প কিছুদিন একটি আবাসিক স্কুলে কাজ করেন। তিনি আমাকে কখনও বলেননি ওইসব স্কুলের একটিতে কাজ করতে তার কেমন লাগে। যেহেতু তিনি নিজে একসময় একটি দিবা স্কুলে পড়তেন এবং তার মা, সারাহ, ছিলেন নরওয়ে হাউজের ইন্ডিয়ান আবাসিক স্কুল থেকে বেঁচে যাওয়া শিক্ষার্থীদের একজন।

তিনি আমাকে বলেছেন যে, তিনি বাচ্চাদের যত্ন নিতেন এবং এই বিবেচনার ক্ষেত্রে ধর্ম ছিল তার চালিকা। একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, ধর্ম কোনও দুঃখজনক ঘটনা ঘটায় না, বরং সেটা ঘটায় মানুষ। আমি তার সঙ্গে একমত। আবাসিক স্কুলগুলোতে সেই মানুষেরাইÑ নারী ও পুরুষেরাÑ শিশুদের সঙ্গে ভয়ঙ্কর কাজ করেছে এবং তাদের সেই আচরণের পক্ষে ধর্মকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করেছে।

রোমান ক্যাথলিক গির্জার তরফে যদি অর্থবহ পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় তাহলে পোপের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনার কোনও মানে হয় না। ছবি : L’Osservatore Romano

আমার বাবা ধোয়া তুলসি পাতা ছিলেন না। তিনি জানতেন শিশুদের সঙ্গে কী ঘটছে। তিনি জানতেন, স্কুলগুলোতে হাজারও শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। তিনি জানতেন ব্রান্ডনে অচিহ্নিত কবর আছে। আহা, সেটি আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার দূরত্বে এবং কানাডাজুড়ে এমন আরও অনেক কবর আছে। তিনি জানতেন, বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি ও তাদের পরিবারগুলো ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুল ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষতির শিকার হচ্ছে।

দুঃখিত শব্দটি হতে পারে শক্তিশালী

কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের ক্ষমা চাওয়াটা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ২০০৮ সালের ১১ জুন হারপার বলেন, “আদিবাসী মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনে মারাত্মক ব্যর্থতার জন্য কানাডা সরকার আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছে এবং তাদের প্রতি ক্ষমা করার আর্জি জানাচ্ছে।”

‘দুঃখিত’ একটি শক্তিশালী শব্দ হতে পারে। আবার এটি দায় এড়ানোর সুযোগও হতে পারে।

আমার পাঁচটি সন্তান আছে। আমি ও আমার স্ত্রী আমাদের সন্তানদেরকে তাদের প্রতিটি কাজের জবাবদিহি এবং ভুল থেকে শিক্ষা নেয়া ও তার পুনরাবৃত্তি না করার শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি।

একটি শিশু আরেকটি শিশুকে কেবল সরি বলবে তা যথেষ্ট নয়। এতে ভুল আচরণের স্বীকৃতি দেয়া হয় বটে তবে তাতে তার আচরণের প্রায়শ্চিত্য বা নিরাময় হয় না। আমাদের কোনও শিশু যখন ভুল করে তখন তারা ভুলের জন্য ক্ষমা চায়, যে আচরণ করেছে তা উল্লেখ করে এবং এমন ভুলের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে তার জন্য কী পদক্ষেপ নেবে সেটাও স্পষ্ট করে।

মনে হতে পারে যে, এটা প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, কেন্দ্রীয় সরকারের যেটা মূল আমলনামা, কানাডার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান প্রতিপালনের কথা যখন আসে, তখন মানুষ সরকারের কাছে অনেক কিছু আশা করে। তারা দাবি করে যে, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের যে ৭৬টি আহবানের ব্যাপারে তারা সরাসরি দায়িত্ববান সেগুলোর মধ্যে ১৭টি তারা সম্পন্ন করেছে- (কিন্তু এই সংখ্যাটি এরই মধ্যে অপ্রীতিকর সংখ্যায় পরিণত)। এখনও সিবিসি নিউজসহ তিনটি স্বাধীন সংস্থা একমত যে, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের যেসব ক্ষেত্র কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বে ছিল তার মধ্যে সম্পন্ন হওয়া পদক্ষেপের সংখ্যা ছয়টি কি সাতটি মাত্র। ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান প্রকাশের পাঁচ বছর পর ২০২০ সালে ফার্স্ট নেশনের সংসদে ওইসব পদক্ষেপের বেশিরভাগের ক্ষেত্রে সরকারের অগ্রগতির তালিকা তৈরি করে। এতে বলা হয়, সরকারের অগ্রগতি “সামান্য” থেকে “মাঝারি” ধরণের।   

কমিউনিটির প্রধান টনি অ্যালেক্সিস ২০১৬ সালে প্রথম পোপ ফ্রান্সিসকে লেক সেন্ট অ্যানিতে আসার আমন্ত্রণ জানান। ছয় বছর পর তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, ওই সফর অ্যালেক্সিসের জাতি নাকোতা সিওক্স-এর জন্য নিরাময় ও পুনর্মিলনের অনুভূতি ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে।

এর পর বিভিন্ন গির্জা, রাজনীতিক এবং আরসিএমপি’র (Royal Canadian Mounted Police) পক্ষ থেকে ক্রমবর্ধমান হারে ক্ষমা প্রার্থনা করা হতে থাকে। এ ধরণের ক্ষমা প্রথম চেয়েছিল কানাডার ইউনাইটেড গির্জা, সেই ১৯৮৬ সালে। ওইসব ক্ষমা প্রার্থনার ঘটনা স্থায়ী পরিবর্তনের সূচনা করুক বা না করুক এগুলি বিতর্কের অবতারণা করে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আরসিএমপির কথা। শিশুদেরকে বলপূর্বক বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে ভর্তি করার মত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য সংস্থাটি ক্ষমা চেয়ে থাকতে পারে (দুবার)। কিন্তু তারপরও তারা কিন্তু পরিবেশগত ক্ষতির আশঙ্কায় শত কোটি ডলারের পাইপলাইন স্থাপনের বিরোধিতাকারী ফার্স্ট নেশনের লোকজনকে এমনকি প্রবীনদেরও গ্রেফতার করতে দ্বিধা করছে না। উপকূলীয় গ্যাসসংযোগ লাইন ওয়েটসুওয়েইন টেরিটোরির ভেতর দিয়ে নিয়ে যাবার বিষয়টি বংশগতভাবে দায়িত্বে থাকা গোত্রপ্রধানরা অনুমোদন দেননি, তাই ওয়েটসুওয়েইন এবং হাউডোনোসাউনির মানুষই দৃশ্যত দেশের আইন ভঙ্গ করেছিল।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সাবেক রেসিডেন্সিয়াল স্কুলগুলোর চত্বরে অচিহ্নিত গোরস্তানে পাওয়া শিশুদের স্মরণসভায় হাঁটুমুড়ে বসতে পারেন আবার একই সময় তিনি ওইসব স্কুল আদিবাসী জাতিগুলির ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব রেখেছে সেজন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেয়া এমন যুক্তির বিরুদ্ধে আদালতে লড়াইও চালাতে পারেন।

তাহলে এই ক্ষমা প্রার্থনার প্রাসঙ্গিকতা কোথায়?

চলতি বছরের আরও আগের দিকে, পোপ ফ্রান্সিস ইন্ডিয়ান আবাসিক স্কুলগুলির শিক্ষার্থী শিশুদের প্রতি যে “ঘৃণ্য” অসদাচরণ করা হয়েছে তার

জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ক্যাথলিক গির্জা ছিল সেই অপকর্মের দায় অস্বীকারকারীদের অন্যতম। এই ক্যাথলিক গির্জাই কানাডার ৬০ শতাংশেরও বেশি আবাসিক স্কুল পরিচালনার দায়িত্বে ছিল। কিন্তু তারা অতি সাম্প্রতিককালে এমনকি ২০১৮ সালেও ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করেছিল।

চলতি সপ্তাহে পোপ ফ্রান্সিস কানাডায় অবস্থান করছেন এবং আদিবাসী কমিউনিটিগুলির সঙ্গে বৈঠক করছেন। তিনি তার আগের ক্ষমা প্রার্থনার সঙ্গে কিছু কথা যোগ করেছেন। তিনি আবাসিক স্কুলগুলোতে ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং ওই ভূমিকার জন্য ক্যাথলিক গির্জাকে ক্ষমা করে দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন। 

এসবের কী অর্থ?

আসলে কোনও অর্থই নেই, যদি না রোমান ক্যাথলিক গির্জার তরফে ক্ষমা চাওয়ার পর কোনও কার্যকর ও অর্থবহ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এনিশিনাবি (Anishinaabe) পণ্ডিত নিগান সিনক্লেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণে অন্যথা হলে এসব ক্ষমা প্রার্থনাকে “বেহুদা সৌজন্য’ বলে অভিহিত করেছেন।

আমি প্রায়শ বলে থাকি যে, ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুল ব্যবস্থা আদিবাসীদের নয় বরং এটি হলো কানাডার ইতিহাস। সেজন্যে, প্রত্যেক কানাডীয়র উচিৎ পুনর্মিলন বা বিষয়টি মিটমাট করার পথে চলার জন্য অপকর্মের দায় বোধ করা। এই দায়বোধের মধ্যে রয়েছে রাজনীতিক, আরসিএমপি এবং গির্জার প্রতি যথাযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানানো এবং এটা নিশ্চিত করা যে, এসব ক্ষমা প্রার্থনার সত্যিই কিছু অর্থময়তা আছে।

রোমান ক্যাথলিক গির্জার কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ সে বিষয়ে গভীর আলোচনার জন্য পুরোপুরি আরেকটি ভিন্ন নিবন্ধ রচনার প্রয়োজন হবে। এতে আসবে চুরি করে দখল করা ভূমি ফিরিয়ে দেয়া, আবাসিক স্কুলগুলোতে বেড়ে ওঠা সামান্য ভগ্নাংশের বাইরে যারা সেখান থেকে বেঁচে ফিরছেন তাদের কাছে যে ঋণ আছে তার জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া, এ বিষয়ক নথিপত্র প্রকাশ এবং চুরি করা শিল্পকর্ম ফিরিয়ে দেওয়া, শিশুদের নিপীড়নের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, যদি সেটি মরণোত্তরও হয়, এবং ওইসব স্কুল থেকে বেঁচে আসা ব্যক্তি, তাদের পরবর্তী প্রজন্মের উত্তরসূরি, তাদের পরিবার ও কমিউনিটির লোকেদের জন্য নিরাময় ও কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ।

কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া, দুঃখিত একটি আলটপকা এবং বস্তুত, অর্থহীন শব্দ।

জুলাই ২৬, ২০২২

সূত্র : ডেভিড এ. রবার্টসন  –  সিবিসি