যে কারণে অভিবাসীরা বড় শহর ছেড়ে যাচ্ছে
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : মহামারি যদি কোনও কিছু প্রমাণ করে থাকে তাহলে সেটা হল এই যে, বড় বড় শহরের বাইরেও জীবন আছে। টরন্টো, মন্ট্রিল ও ভ্যাঙ্কুভারের মত কানাডার বড় নগরকেন্দ্র ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ দেশের ছোট শহরগুলোতে চলে গেছে। অধিকতর সস্তা আবাসন, প্রশস্ত জায়গা এবং অধিকতর সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন নবাগতদের আরও দূরে টেনে নিচ্ছে।
ব্রকভিলি এমনই একটি ঐতিহাসিক জনপদ যেটি তার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে অবদান রাখার জন্য নবাগতদের স্বাগত জানাচ্ছে। অন্টারিওর অন্তর্গত প্রাচীনতম এই টাউনের সমন্বয়কারীরা এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত করেছেন। নিউ ইয়র্ক রাজ্যে প্রবাহিত সেন্ট লরেন্স নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত ছোট্ট এই শহরটি অটোয়া, মন্ট্রিল ও টরন্টো থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। একদা পণ্যসামগ্রী প্রস্তুত ও বৃহৎ শিল্পকেন্দ্র ব্রকভিলিতে আবারও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ঘটছে।
ওয়াজাহাত খালিক (আকা ওয়াজি দ্য বেকার) এর মত অনেক অভিবাসী অর্থনৈতিক সুযোগ নেবার লক্ষ্যে ২০২০ সালে ব্রকভিলিতে চলে আসেন।
খালিক ২০০২ সালে পাকিস্তান থেকে অভিবাসী হিসাবে কানাডায় আসেন। এখানে তিনি কমার্সে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং কানাডার বেকিং অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে সনদ পাওয়া বেকারি বিশেষজ্ঞের স্বীকৃতি পান।
এরপর গ্রেটার টরন্টো এলাকায় বিভিন্ন বেকারি প্রতিষ্ঠানে ১৫ বছর ধরে কাজ করার পর তিনি মিসিসগায় নিজের ক্যাফে খোলেন। তার দোকানে সারাদিন ধরে নাশতা পরিবেশনের ব্যবস্থা রাখেন। তবে সানসেট গ্রিল নামের কোম্পানি যখন তাকে ব্রকভিলিতে তাদের প্রতিনিধি হিসাবে দোকান করার প্রস্তাব দেয় তখন তিনি অনেকটা বিশ্বাসে ভর করেই এগিয়ে যান এবং সেখানে ব্যবসায় শুরু করেন।
খালিক বলেন, “আমি জীবনের বেশিরভাগ সময় টরন্টোতে বাস করেছি। ব্রকভিলিতে আমার কোনও আত্মীয় বা বন্ধু ছিল না। কিন্তু এখানে আসার পর আমি গ্রাহক, কর্মচারী এবং প্রতিবেশিদের মধ্য থেকে প্রচুর বন্ধু পেয়েছি। ব্রকভিলি চমৎকার জায়গা। এখানে এসেছিলাম বলে আমি কৃতজ্ঞ। এই ছোট্ট শহরটিকে আমি ভালবাসি।”
ধীরগতির এই লেনে জীবন যেমন
ছোট শহরের জীবন নবাগতদের কাছে, যারা বড় নগরী থেকে আসেন, বিস্ময়কর রকমের একঘেয়ে লাগতে পারে। তবে আহমদ খাদ্রার মত অভিবাসীরা খুঁজে পান যে, সাংস্কৃতিক অভিঘাত তাদের প্রয়াসের দাম পুষিয়ে দেয়। ব্রকভিলির ঐতিহাসিক কেন্দ্রস্থলে কিন্ডা ইলেক্ট্রোনিকসের মালিক আহমদ খাদ্রা সিরিয়া থেকে ১৯৯৫ সালে কানাডায় এসে মন্ট্রিলে ওঠেন। তবে তিনি শিগগিরই মন্ট্রিল ছেড়ে ব্রকভিলিতে আসেন।
খাদ্রা বলেন, “কেউ যদি প্রকৃতি, উন্মুক্ত পরিবেশ, প্রশান্ত জীবন পছন্দ করে তাহলে তার জন্য এটাই সেরা জায়গা।” তিনি বলেন, “গ্রীষ্মকালে মাঝেমধ্যে আমি লোকজন নিয়ে সেন্ট লরেন্স নদীতে নৌ-বিহারে যাই। সেপ্টেম্বরের শেষভাগে নৌকাভ্রমণকালে যখন নদীতে সূর্যাস্ত দেখি- মনে হয় এটাই স্বর্গ।”
তিনি এখানে আসার পর ব্রকভিলির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। খাদ্রা বলেন, “আমার মনে আছে এখানে আসার প্রথম দিকে রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম আর তিনজন মানুষ আমার দিকে এগিয়ে আসছিলো। তাদের মধ্যে একজন একদম শুদ্ধ উচ্চারণে আমাকে বললেন, ‘আসসালামু আলায়কুম।’ আমি মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তুলেছিলাম এটা ভেবে যে তারা আমাকে মারতে চান! একজন হিজাব পরা মহিলার স্বামী হিসাবে আমি পরিচিত ছিলাম।’ ব্রকভিলির লোকজন খুবই সহৃদয়, খুবই খোলামেলা।”
আরেক নবাগত মার্ক গোমেজ-সেগুও দেখেছেন যে, একটি ছোট শহরে বসবাস করতে এসে মানিয়ে নেয়া খুবই কঠিন। তিনি ২০১৫ সালে এখানেই বেড়ে ওঠা তার স্ত্রীর সঙ্গে বাস করতে আসেন। গোমেজ-সেগু বলেন, “আমি কৌতুক করে বলতাম, আমাকে জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।”
তবে তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। “আমি সামান্যই ইংরেজি জানতাম। কিন্তু আমি স্কুলে ভর্তি হয়ে শিখে নিয়েছি।” এখন তিনি ব্রকসভিলির সামান্য পুবে প্রেসকট টাউনে এল রেবস্ট ডি লা মিলেস নামে একটি সফল খাদ্য আমদানির ব্যবসায় পরিচালনা করেন। তিনি ২০২১ সালে লিডস ও গ্রিনভিলির তরফে অভিবাসী উদ্যোক্তা পুরস্কারও জয় করেছেন। তিনি সম্প্রতি মহামারির সময় খাবার সরবরাহের একটি শাখাও খুলেছেন যাতে বাড়তি উপার্জন আসে। আর এটি নিয়ে লোকেদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়।
তিনি বলেন, ৪০১ হাইওয়ের কাছে প্রেসকটের অবস্থানটাও একটা বড় সুবিধা। “আমার জন্য, আমার পাইকারী ব্যবসার জন্য কানাডার বৃহত্তম শহরগুলোর মাঝখানের মতই এটি সবচেয়ে যথার্থ জায়গা। আমি বলবো, এই জায়গাটার প্রচুর সম্ভাবনা আছে, যদি তা কারও জন্য লাগসই হয়।”
বিকাশমান বৈচিত্র
কানাডার বেশিরভাগ ছোট শহরের মতই ব্রকভিলির জনসংখ্যা শ্বেতাঙ্গপ্রধান। নতুনদের আকৃষ্ট করার জন্য এই অঞ্চলের সক্ষমতা বাড়ানো, তাদের এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস এবং সমাজে একাত্ম হতে সহায়তাকারী বিভিন্ন সংগঠনের জোট সেন্ট লরেন্স-রিডিউ ইমিগ্রেশন পার্টনারশিপের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মেলিসা ফ্রান্সিস যেমনটা বললেন, কিছু পদক্ষেপ এই অঞ্চলের বিকাশমান বৈচিত্র্য তুলে ধরে। তিনি বলেন, “প্রতি বছর আমরা অভিবাসী উদ্যোক্তাদের একটি পুরস্কার দিই, যা নবাগতদের সাফল্য তুলে ধরতে সহায়ক। আর ‘আমরা প্রতিবেশী’ শীর্ষক আমাদের, প্রচারণা আমাদের জনগণের বৈচিত্র্যের এবং এখানকার জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক উপস্থাপন করে।”
ফ্রান্সিস বলেন, “অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। আমরা শুনতে পারছি, লোকেরা বলে যে, এখানে বৈচিত্র্য আছে এবং নবাগতদেরও অবিশ্বাস্য ও চমকপ্রদ সাফল্যের কাহিনী আছে।”
সংস্থার কর্মসূচি সমন্বয়কারী লরেন স্মিথ আরও যোগ করেন, “আমি ব্রকভিলিতেই জন্মেছি
এবং বেড়ে উঠেছি। এই অঞ্চলের দৃশ্যমান পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করেছি। এটি ধীর ও পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন। তবে এটি ১০ বছর আগে যেমন ছিল তার চেয়ে ভিন্ন।”
প্রীতি লুহাদিয়া ২০২১ সালের নভেম্বরে ব্রকভিলি শহর পরিষদের একটি অন্তর্বর্তী আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন, যদিও তিনি কখনই রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। তিনি বলেন, “আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম, কারণ আমি ওখানে বৈচিত্র্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি, যাতে আরও বেশি মানুষ এতে জড়িত হয় এবং তাদের নিজেদের কণ্ঠস্বর এখানে যোগ হয়। ব্রকভিলিতে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষও বাস করে কিন্তু তাদের প্রতিনিধিত্ব কখনই থাকে না।”
২০ বছর ধরে ব্রকভিলিতে বসবাসকারী ফার্মাসিস্ট প্রীতি লুহাদিয়া শহর পরিষদে বিজয়ী না হলেও এরই মধ্যে তিনি এই শহরের জন্য উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তিনি বলেন, “২০২১ সালে আমাদের ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন ছিল চমৎকার। ব্রকভিলির ঐতিহাসিক কোর্ট হাউজ চত্বরে এই অনুষ্ঠান আয়োজনে আমি সাহায্য করেছি। অন্য অনেক বিশিষ্টজনের সঙ্গে আমাদের স্থানীয় এমপি এবং এমপিপি অনুষ্ঠানে যোগ দেন।”
অপেক্ষাকৃত ছোট শহরে আসতে ইচ্ছুক নবাগতদের প্রতি তার পরামর্শ হল, কানাডীয় অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। তিনি বলেন, “আমি নবাগতদের জন্য সর্বান্তকরণে সুপারিশ করি ব্রকভিলির মত ক্ষুদ্রতর কেন্দ্রগুলো বেছে নেবার জন্য। নিজের পরিবার পালনের জন্য এটি সর্বোত্তম জায়গাগুলোর অন্যতম।”
এছাড়াও তিনি বলেন, ক্ষুদ্রতর জনপদ বেছে নিলে তা আপনাকে কানাডীয় জীবনের অপেক্ষাকৃত ভালো রূপটি দেখার সুযোগ করে দেবে। “আপনি যদি টরন্টো, ব্রাম্পটন বা মন্ট্রিলে থাকেন তাহলে অনেকটা নিজের সমাজে থাকার অনুভূতিই পাবেন, কিন্তু কানাডীয় জীবন কেমন তার পুরো স্বাদ পাবেন না। একজন অভিবাসী হিসাবে কানাডীয় জীবনধারা থেকে আপনি অনেক কিছু পাবেন এবং আপনি সেই জীবন ও সেই স্বপ্ন গড়ে তুলতে পারবেন যার জন্য আপনি এদেশে এসেছেন। ক্ষুদ্র জনপদগুলো আপনাকে অনেক কিছু করার মত অনেক বেশি সুযোগ এনে দেবে।”
সূত্র : ক্যারোলিন বেনেট / কানাডিয়ানইমিগ্রান্ট.সিএ।