মূল্যস্ফীতি: কানাডায় বেতনের টাকায় চলা সম্ভব হচ্ছে না অনেকের

ডন পিটিস

মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পরিচিত কানাডীয়রা ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে এখন এযাবতকালের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মুখে।

পেট্রোলের ক্রমবর্ধমান দাম এখন ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। আমরা বেড়ে উঠেছি খাদ্য এবং আমদানি করা জিনিসের ক্ষেত্রে জাহাজীকরণে বিলম্বের প্রভাব থাকবে এটা জেনেই। আবাসনের বিপুল ব্যয় এখন কানাডীয় জীবনের এক চরম সত্য।

কিন্তু ২০২১ সালের শেষের দিকে মূল্যবৃদ্ধির সেই স্বীকৃত ধরণ পাল্টে যেতে থাকে। এখন থেকে তিন মাস আগে পর্যন্তও কানাডীয়রা তাদের সাপ্তাহিক বাজেট ভাগ করতে গিয়ে দেখতে পেতেন খাবার, জ্বালানি ও আবাসন খাতের মত কিছু খুবই বিচ্ছিন্ন, তুলনামূলকভাবে অস্থির খাতে বাড়তি দাম দিতে হচ্ছে।

মূল্যস্ফীতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত

মূল্যস্ফীতি কেন ঘটছে এবং এই পরিবর্তন ঠিক কীভাবে কানাডীয়দের ওপর প্রভাব ফেলবে সে বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা যখন বিভক্ত তখন আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি সবাই অন্তত একটি বিষয়ে একমত।

টরন্টোর অর্থনীতিবিদ এবং আরএসএম কানাডার পরামর্শক তু নগুয়েন বলেন, “ব্যাপারটা এখন আর খাদ্য, জ্বালানি বা আবাসনের মধ্যে সীমিত নেই, এটি এখন অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি জিনিসের ক্ষেত্রেই সত্য।”

সচরাচর যেটা ঘটে সেটি হলো, কানাডীয়রা অপেক্ষাকৃত সস্তা পণ্য কিনে তাদের বাজেটের মধ্যে সঙ্কুলানের চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ, পেট্রোলের দাম যখন চড়া তখন তারা গাড়ি ব্যবহার এড়িয়ে যেতে পারেন অথবা আমদানি করা খাদ্য বাদ দিয়ে নিজেদের খাদ্যাভ্যাস পাল্টাতে পারেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতি যখন সবকিছুতেই তখন সেটা কঠিন হয়ে যায়।

কিছু অর্থনীতিবিদের মতে, এটা হলো সম্ভবত মূল্যস্ফীতি দীর্ঘ সময়ের জন্য বেড়ে যাবার একটি লক্ষণ এবং তা কানাডীয়দেকে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করবে।

নারী, নবাগত অভিবাসী এবং অনিশ্চিত কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিসহ যারা বেতন কাঠামোর নিম্নতম স্তরে রয়েছেন – তারা সর্বাত্মক মূল্যস্ফীতির কারণে আরও বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ এবং যাদের দরকষাকষি করার সামর্থ কম তারা যেসব পণ্য ও পরিষেবার ওপর নির্ভরশীল সেগুলো এমনকি স্বল্প ব্যয়বহুল হলেও বেশি দাম দিতে বাধ্য হন। 

“সবকিছুতেই মূল্যস্ফীতি”র জোয়ার শুরু হবার নতুন প্রমাণ উঠে এসেছে স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার সেই একই রিপোর্টে যাতে দেখানো হয়েছে যে, সার্বিকভাবে পণ্যমূল্য এক বছরে লাফিয়ে ৫.১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা ১৯৯১ সালের পর সর্বোচ্চ।

নিজেকে রক্ষণশীল বলে পরিচয় দেয়া এবং মুদ্রাবাদী অর্থনীতির প্রবক্তা মন্ট্রিলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ টম ভেক জোর দিয়ে বলেন, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবার আরেকটি কারণ আছে। সেটি হলো: অর্থনীতিতে খুব বেশি পরিমাণ অর্থের প্লাবন।

ভেক তার ভারমন্টের খামার থেকে আমাকে বলেন, “যখন সর্বত্রই বিপুল পরিমাণ অর্থের যোগান থাকে তখন সব কিছুরই দাম বেড়ে যায়।” তিনি বলেন, ভারমন্টে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ডিমের দাম প্রতি ডজন প্রায় ৮ ডলারে পৌঁছেছে।

কানাডীয়রা ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে এখন এযাবতকালের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মুখে। ছবি : প্রবাসী কণ্ঠ

বেতন তাল রাখতে পারছে না

কানাডার বেসরকারি খাতের বৃহত্তম ইউনিয়ন ইউনিফর-এর নীতি বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ মিজ. কেইলি টিয়েসেন-এর মতে, অর্থনীতিতে যদি সত্যিই খুব বেশি পরিমাণ অর্থের প্রবাহ থেকে থাকে তাহলে যারা কাজ করে তাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ যাচ্ছে না।

কানাডীয়রা যদি পিছিয়ে পড়ে তাহলে সেটা মূল্যবৃদ্ধির কারণেই কেবল নয়। সমস্যাটা এই যে, গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি পাঁচ শতাংশের বেশি বেড়ে গেলেও মানুষের আয় সেই ধারায় বাড়তে পারেনি।

টিয়েসেন গত সপ্তাহে এক টেলিফোন আলাপে বলেন, “আর এর অর্থ হলো, শ্রমিকরা তাদের ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে।”

নিশ্চয়ই সব চাকরিজীবীই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। সোবেস ওয়্যারহাউজের কর্মীরা সম্প্রতি আলোচনার ভিত্তিতে চার বছরের জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছেছেন যাতে ২০ শতাংশ বেতন বাড়ানোর বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। চুক্তির মেয়াদকালে এই পরিমাণ বেতন বাড়ানো হবে। অতীতে যারা বেতন ও মূল্য বৃদ্ধির অর্থনীতি পাঠ করেছেন, তারা বলেন, মূল্যস্ফীতির একটি সুবিধা হলো, এটি বেতন ও মূল্যের সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক লুব্রিকেন্ট (পিচ্ছিলকারক তরল) হিসাবে কাজ করে, যা সবারই বেতন বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়Ñ যদিও তাদের সেক্টরের চাহিদা অনুযায়ী কিছু শ্রমিক ও বিক্রেতার বেতন বেশি বাড়ে এবং কিছু লোকের কম।

ব্যাংক অব ইল্যান্ডের গভর্নর এন্ড্রু বেইলি Ñ সমালোচকদের ভাষায় যিনি বছরে লাখ লাখ পাউন্ড আয় করেনÑ সম্প্রতি মূল্যস্ফীতির কারণে ব্রিটিশ শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর দাবি না করার জন্য সতর্ক করে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন। শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে  যেতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে তিনি এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। মিজ. টিয়েসেন প্রায় একইরকম বয়ান শুনতে পান যখন কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ বেতন ও মূল্যের মধ্যকার পেঁচ সম্পর্কে সতর্ক করেন।

বস্তুত তিনি বলেন যে, ক্রমবর্ধমান সার্বিক মূল্যস্ফীতি সত্বেও শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবার আগেই সুদের হার বাড়ানো বিপজ্জনক হতে পারে।

তিনি বলেন, “আমরা নিশ্চয়ই নিজেদেরকে এমন অবস্থানে নিয়ে যেতে পারি না যেখানে শ্রমিকরা সব সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” “আমাদের অর্থনীতিকে কোনওভাবেই সেরকম অবস্থানে নিয়ে যাওয়া উচিৎ হবে না।”

মিজ. টিয়েসেন বলেন, নিত্যপণ্যের দাম এবং কানাডীয়দের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে যে ব্যবধান তা কেবল শ্রমিক ও তাদের পরিবারের জন্যই খারাপ তা নয়। তিনি বলেন, যখন ব্যয়ের সার্বিক সক্ষমতা সঙ্কুচিত হয় তখন তা পুরো অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। তিনি উদ্বিগ্ন এজন্য যে, মহামারির বিরূপ প্রভাব থেকে অর্থনীতিকে রক্ষার উপযোগী প্রয়াসে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়টি ভুলে যাওয়া হয়েছে।  ইউনিফর এই অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারণার জোরালো প্রবক্তা।

মাত্র কয়েক মাস আগে যখন মূল মূল্যস্ফীতি (core inflation) মাত্র দুই শতাংশের নিরাপদ সীমায় ছিল তখন এখানকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের ধৈর্য ধারণ করা এবং অর্থনীতিকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেয়াই ছিল যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এখন যখন একদা-স্থিতিশীল সাধারণীকৃত মূল্যস্ফীতির পরিমাপ তীব্রভাবে বাড়ছে তখন এটা প্রায় নিশ্চিত করেই মনে হচ্ছে যে, ব্যাংকগুলি সুদের হার বাড়িয়ে দিয়ে এর লাগাম টানার চেষ্টা করবে।

কিন্তু বেতন যখন অব্যাহতভাবে পেছনে পড়ে থাকছে সেই সময় ব্যাংক অব কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ যদি “সবকিছুতে মূল্যস্ফীতি”র বিষয়টি উচ্চতর সুদের হার দিয়ে সামলানোর কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করে তাহলে সাধারণ মানুষ চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করার দায় নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের ওপরই এসে পড়বে যারা তাদেরকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায়।

সূত্র : সিবিসি নিউজ