এখানে জীবন যেমন

জসিম মল্লিক

আকাশে মেঘ জমেছে। ঘনকালো মেঘ। অন্ধকার হয়ে গেছে চারদিক। যে কোনো সময় বৃষ্টি শুরু হবে। সকাল সকাল বৃষ্টি! কোনো মানে হয় না। এখন সকাল এগারেটা। কর্ম দিন শুরু হয়েছে একঘন্টা আগে। এখন আগষ্ট মাস। সামার টাইম। বৃষ্টি বাদলার কোনো মাথামুন্ড নাই। শুরু হলেই হলো। কাউকেতো আর জিজ্ঞেস করে শুরু হবে না! প্রকৃতি তার খেয়াল খুশী মতোই চলবে। যখন তখন বৃষ্টি শুরু হতে পারে। যখন তখন থেমে যেতেও বাধা নাই। আবার নাও হতে পারে। বাতাসের দমকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে মেঘ। সূর্য মামা উকি দিতে পারে। দিনের প্রথম ডেলিভারি। আরিফ একটা পিজা স্টোরে ডেলিভারির কাজ করে। কাজটা আরিফ এনজয় করে। ফ্রিডম আছে। বসিং নাই তেমন। ক্যাশ পয়সা। প্রথম প্রথম খারাপ লাগত। ডেলিভারি জব! ছিঃ! এখন মানিয়ে নিয়েছে। কোনো কাজই ছোট না। নিজেকে সান্তনা দেয়। সাড়ে দশটায় কাজ শুরু করেছে আরিফ। আগে ছিল দশটায় শিফট এখন টাইম বদলে হয়েছে সাড়ে দশটা। স্টোর আগের চেয়ে বিজি কমে গেছে তাই আধা ঘন্টা কাটা গেছে ড্রাইভারদের ভাগ থেকে। বিজি কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে এই স্টোরের আন্ডারে যতখানি এড়িয়া ছিল তা তিন ভাগ হয়েছে। তাই এড়িয়া ছোট হয়ে গেছে। ওরা দুজন ড্রাইভার ওপেন করে এখন। একজন সাড়ে দশটায়, আর একজেেনর এগারোটায় শিফট। আগে দুজনেরই দশটায় শিফট ছিল। টাকা বাঁচােেনার জন্য এই ব্যবস্থা। আরিফ পাঁচদিন কাজ করে। তিন দিন ওপেন, আর দুদিন রাশ শিফট করে। বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত রাশ শিফট। মাত্র চার ঘন্টার শিফট।

সকালের চেয়ে বিকেলের রাশ শিফটটা আরিফ বেশি এনজয় করে। এই শিফটে মানি মেক করা যায়। কোনো ঝামেলাও নাই। সকালের শিফটে অনেক কাজ করতে হয়। পিজার বক্স বানানো, স্মল, মিডিয়াম, লার্জ, একস্ট্রা লার্জ বক্স। এছাড়া উইংস বক্স, ব্রেড বক্স, পাস্তা বাক্স, লাভা কেক বক্স বানাতে হয়। চিজের প্যাকেট থেকে খুলে বাকেটে রাখা, চিকেন উইংস প্যাকেট করা, চিকেন ক্রেকার্স প্যাক করা। আটটা করে চিকেনের পিস নিয়ে প্যাকেট বানাতে হয়। আগে ছিল দশটা উইংস। দুজন ড্রাইভারের ভাগ করা থাকে কে কোনটা করবে। বিকেলের শিফটে এসব কোনো ঝামালো নাই। শুধু ক্লক আউট হওয়ার আগে ডিশ ওয়াশ করতে হয়। আগে ডিশ ওয়াশ করত ইনসাইডাররা। এই কোম্পানীর সব ফুড আসে প্যাকেট হয়ে। প্রসেস করা। তাই হাতে কিছু করতে হয় না। বিকেলের শিফটে চারঘন্টায় নব্বই থেকে হান্ড্রেড বাকস পর্যন্ত ইনকাম হয়ে যায় সাধারণতঃ। খারাপ না। এতেই খুশী আরিফ। শুক্রবার একটু বেশি হয়। এইদিন বিকেলের শিফটে সবসময় স্টোর বিজি থাকে। দশ বারোজন ড্রাইভারের শিফট থাকে শুক্রবার। ফ্রাইডে নাইটে অনেকেই পিজ্জা খায়, ড্রিংক করে ফ্যামিলির সবাই মিলে। ঘন্টায় পঁিচশ ডলার মতো যদি হয় খারাপ নাতো। এদেশের মানুষরা বিশেষকরে সাদা মানুষরা অফিস থেকে ঘরে ফিরেই পিজ্জা অর্ডার করে।

এদশে যারা অড জব করে যেমন ফ্যাক্টরি জব বা এই ধরণের পিজা বা ফুড স্টোরে বা ডেলিভারির জব করে তারা বলে কাজ। যারা অফিসিয়াল জব করে তারা বলে অফিস। পিজ্জা নর্থ আমেরিকার অন্যতম প্রধান খাদ্য। আরিফ যে স্টোরে কাজ করে এই স্টোরের ওনারের আরো সাতটা আটটা স্টোর আছে। ফ্রেঞ্চাইজি পিজ্জা। নিয়ম কানুন মতো চলে। ওনার মানুষটওা ভাল। কোনো উচ্চবাচ্য নাই তেমন। শান্ত স্বভাব। ব্যবসটা ভাল বোঝে। ব্যবসার সাথে কোনো সেক্রিফাইজ নাই। ব্যবসা টিকলেই সবই চলবে। ড্রাইভার বা ইনসাইডাররা আওয়ার পাবে। আরিফ এই স্টোরে প্রায় পাঁচ বছর ধরে কাজ করছে। যা টাকা পায় ঘর ভাড়া আর নিজের খরচের পরও যথেষ্ট সেভিংস করতে পারে। দেশেও তেমন কাউকে পাঠাতে হয় না। ডিপেনডেন্ট নাই কেউ। বছর দুই হয় স্ত্রীর সাথে সেপারেশন হয়ে গেছে। দেশ থেকে বিয়ে করে এনেছিল। সাদাসিদা মেয়ে মনে হয়েছিল। মা পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছিল।

আসার কিছুদিন পরই বুঝতে পারল সে আরিফের প্রতি খুশী না। প্রথম কারণ আরিফের ফ্যামিলী থেকে বলেছে আরিফ কানাডায় বিরাট বড় চাকরি করে। এসে দেখে করে পিজ্জা ডেলিভারি। আরিফকে ডিভোর্স করে অন্য একজনের সাথে জাড়িয়ে গেছে এরই মধ্যে। দুই বছর মাত্র টিকেছিল ওদের সংসার। সুন্দর একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছিল। এক বেডরুমের হলেও সুন্দর ছিল। সোফা, দামী টিভি কিনে দিয়েছিল। আরিফের পিজ্জা ডেলিভারির চাকরিটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। দেশের কাউকে বলতে পারে না স্বামী কি করে। এসে দেখছে সামান্য ড্রাইভার। মানুষের বাড়ি বাড়ি পিজ্জা ডেলিভারি করে! এতে তার সম্মান হানি হচ্ছিল। এ নিয়ে দুজনের অনেক ঝগড়া ঝাটি হয়েছে। আরিফের বউ খুবই এম্বিশাস। মফস্বলের মেয়ে, আরিফ মনে করেছিল সহজ সরল হবে কিন্তু বিয়ের পর বুঝল আরিফের ধারণা ভুল। দেশের মেয়েরা আর সহজ সরল নাই। লোভি আর স্বার্থপর হয়ে গেছে। এসেই আইফোন কিনল, দামী পোশাক আশাক কিনতে শুরু করল। দামী গাড়ি কেনার জন্য চাপ দিচ্ছিল। আরিফ খুবই অবাক হচ্ছিল। এতোসব জানে কিভাবে দেশের মেয়েরা! কোথায় দামী কি পাওয়া যাবে সব জানে। আরিফ খুবই সিম্পল মানুষ। বেশি চাহিদাও নাই। ভাল চাকরি পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টাই করেছে কিন্তু এখানের স্কুল কলেজের ডিগ্রী না থাকলে ভাল চাকরি পাওয়া খুবই কঠিন। দেশে ছিল ইঞ্জনিয়ার। এখানে এসে করছে পিজ্জা ডেলিভারি। প্রতিদিনই ভাবে এই চাকরি আর করবে না। আবার দিনশেষে দেখে এরচেয়ে সহজ কাজ আর কোথায় পাবে!

তারপর থেকে আরিফ একলা। টরন্টোর স্কারবোরো এলাকায় একটা বেজমেন্টে ভাড়া থাকে। মিডল্যান্ড এন্ড লরেন্স ইন্টারসেকশন। ওর কাজের জায়গা হচ্ছে এগলিনটন এলাকা। বাসা থেকে একটু দুর হলেও কাজের এলাকাটা খুবই ভাল। কাজের পরিবেশটাও ভাল। কোনো চিল্লা পাল্লা নাই। সিস্টেম মতো সব চলে। অপেক্ষাকৃত ধনী নেইবারহুড। আরিফ যেখানে থাকে সেটা দুই রুমের বেজমেন্ট। দুজনে আটশ করে ষোলশ ডলার ভাড়া দেয়। দুই বছর আগেও এরকম একটা বেজমেন্টের ভাড়া ছিল হাজার বারোশো। হঠাৎ করে টরন্টোতে ভাড়া বেড়েছে অনেক। বাড়ির দামও বেড়েছে। আটশো হাজার ডলারের বাড়ি এখন ওয়ান পয়েন্ট টু থ্রি মিলিয়নের মতো। আরিফদের সুন্দর সাজানো গোছানো বেজমেন্ট। দুইটা রুম, ওয়াশরুম, সেপারেট দরজা। বাড়িওয়ালার সাথে  তেমন কোনো সংযোগ ঘটেনা। বউ চলে যাওয়ার পর থেকেই এখানে থাকে। বাড়িওয়ালা সাদা মানুষ কিন্তু খুউব বন্ধু বৎসল। আরিফকে পছন্দ করে। আরিফের বন্ধু চাকরি করে টিডি ব্যাংকে। দুজনেই ব্যাচেলর। দুজনে মিলে রাঁধে, মজা করে খায়। আরিফ ভালো রাধুঁনি হয়েছে। আরিফের বন্ধু নয়নও ভাল রাঁধতে পারে। নয়ন আরিফের চেয়ে চার বছরের ছোট। আরিফ এখন বত্রিশ আর নয়ন আটাশ। বেজমেন্টেই আলাদা কিচেন, ডাইনিং এবং লীভং এর একটু স্পেস আছে, লন্ড্রি আছে। উইন্টারে স্নো ক্লিনিং এ হেল্প করে বাড়িওয়ালাকে। বুড়া বুড়ি দুজন মানুষ। দুই ছেলে আছে তারা আলাদা থাকে। বড়জন থাকে আমেরিকার হিউস্টিন আর ছোটটা টরন্টোতেই। মাঝে মাঝে ছোটজন প্যারেন্টসদের সাথে দেখা করে যায়।

আজকের প্রথম অর্ডারটা আরিফের। কারণ আরিফ আগে শিফট শুরু করেছে। পুরোটাই কম্পিউটারাইজড। কম্পিউটারেই দেখায় কে কোন ডেলিভারি পাবে। ভাল ডেলিভারি হোক আর খারাপ যার ভাগে যেটা পরবে সেটাই তাকে নিতে হবে। অনেকটা লটারির মতো। এলাকাটা আরিফের ভাজা ভাজা। প্রথম প্রথম জিপিএস লাগত। এখন চোখ বন্ধ করে যে কোনো এড্রেসে যেতে পারে। যে অর্ডারটা এসেছে এটা একটা হাউজ। আগেও অনেকবার গিয়েছে এখানে। কিছু নিয়মিত কাষ্টমার আছে যারা সপ্তাহে একবার হলেও পিজ্জা অর্ডার করবে। ডেলিভারির আসল মজা হচ্ছে টিপস। কোম্পানী থেকে প্রতি ডেলিভারির জন্য মাইলেজ দেয় দেড় ডলার, যখন শুরু করেছিল আরিফ তখন ছিল এক ডলার পঁচিশ সেন্ট। এখন একটু বেড়েছে। আর পার/আওয়ার হচ্ছে দশ ডলার। সেটা ডেলিভারি থাকুক আর না থাকুক। আট ডলারে কাজ শুরু করেছিল আরিফ এই স্টোরে। এখন সবকিছুই বাড়তি। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে। গ্যাসের দামও বাড়তি। প্রতিদিনই বাড়ছে। এক লিটার এক ডলার সত্তুর সেন্ট। তাই পে- রেট কিছুটা বেড়েছে। ড্রাইভারদের স্বপ্ন হচ্ছে টিপস। তবে এখানে ড্রাইভারদের কোনো হাত নাই। পুরোটাই ভাগ্যের ব্যপার। এ ধরণের ফ্রেঞ্চাইজি যারা চালায় তারা জানে যে ড্রাইভাররা টিপস পাবেই তাই আওয়ার কম দেয়। এমনিতে সরকারিভাবে মিনিমাম আওয়ার হচ্ছে পনোরো ডলার। যেহেতু ক্যাশ পেমেন্ট, ট্যাক্স দিতে হয় না তাই আওয়ার রেট কম।

পিজ্জা ব্যাগে ভরে রওয়ানা হবে এমন সময় ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। বৃষ্টি যে হবে বোঝাই যাচ্ছিল। আকাশ মেঘে ছেয়ে ছিল। কাল রাতেই আবহাওয়া অফিস দেখাচ্ছিল সকালে বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি হলে পিজ্জা অর্ডার একটু বেশি হয়। কোনো একটা অদ্ভুত কারণে এই দেশের সাদা মানুষরা বৃষ্টি বা আবহাওয়া একটু খারাপ দেখলেই পিজ্জা অর্ডার করে। আরো করে যেদিন খেলা থাকে। টরন্টোর খেলা থাকলেতো কথাই নেই। খেলা দেখবে আর খাবে। সাথে থাকবে ড্রিঙ্কস। স্নোর সময়ও পিজা অর্ডার করে। ওই সময় বাইরে যাওয়া ঝামেলা তাই ঘরে বসেই গরম গরম খাওয়া খায়। স্নোর সময় খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পিজ্জা ডেলিভারি। বিশেষকরে যখন ফ্রিজিং রেইন থাকে তখন। গাড়িতে অবশ্যই উইন্টার টায়ার লাগাতে হয় না হলে এক্সিডেন্ট হওয়ার সম্ভবনা থাকে। কত ড্রাইভার স্লিপ করে পড়ে ব্যথা পায়। আরিফও একবার পিজ্জার ব্যাগ সহ পড়ে গিয়ে হাত পা ছরে গিয়েছিল। তাছাড়া ড্রাইভারদের প্রচুর পার্কিং টিকিট খেতে হয়। আরিফও অনেক টিকিট খেয়েছে। এইেেতা সেদিন একশ দশ ডলার টিকিট খেলো। সেটা পার্কিং টিকিট না। কিছু রাস্তা আছে রাশ আওয়ারে যেমন চারটা থেকে ছয়টার মধ্যে রাইটে এক্সিট নেওয়া যায় না। কিন্তু আরিফের তাড়া ছিল। সেদিন আবার শুক্রবার। ওইদিনই বেশি পয়সা মেইক করার চাঞ্চ। আরিফ ঠিক পৌনে ছয়টা সময় বেভিউতে রাইট নিতে গিয়েছিল। পুলিশ কোথায় হাইড করে ছিল। পাকরাও করল। একশ দশ ডলার ফাইন সাথে তিন ডিমরেটি পয়েন্টস। আরিফ বাধ্য হয়ে লইয়ার ধরল পয়েন্টস সেভ করার জন্য। এদেশের পুলিশ এসব ব্যাপারে খুবই ক্রয়েল। একবার ধরলে রক্ষা নাই। সবসময় যে ধরবে এমন না। আরিফের আগেই কয়েকজন রাইট নিয়েছে কিন্তু কাউকে ধরেনি। আরিফকে র‌্যান্ডমলি ধরেছে। কিছুটা রেসিজিমও আছে। ব্রাউন বা কালো হলে রক্ষা নাই। সাদা হলে ইগনোর করে এমনও আছে।

পিজ্জার ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতেই আধাভেজা হয়ে গেলো আরিফ। সকাল সকাল বৃষ্টি কোনো মানে হয়! কিন্তু কিছু করার নাই। সময়মতো পিজ্জা পৌঁছাতেই হবে। কোনো অজুহাত কাজ করবে না। আনলেস গাড়ি খারাপ হয়ে বসে না গেলে বা কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে। আরিফের সিএএ মেম্বারশিপ আছে। বছরে চারবার রোড এসিট্যান্ট পায়। টায়ার ফ্লাট হলে এসে ঠিক কওে দিয়ে যায়। উইন্টারে খুব কাজ দেয়। এজন্যে বছরে প্রায় একশ তিরিশ ডলার পে করতে হয়। এই এলাকার কাষ্টমাররা বেশিরভাগই সাদা। তারা যথেষ্ট বোঝে। সহজে মাউন্ড করে না। একটু দেরি হলেও সহজভাবে নেয়। কিছু পিজ্জা কোম্পানী আছে নির্দিষ্ট টাইমে না পৌঁছাতে পারলে পিজ্জা ফ্রি দিতে হয়। দুষ্ট কাস্টমাররা দেরি করে দরজা খোলে যেনো দেরি হয় এবং ফ্রি পিজ্জা পায়। আরিফ যে কোম্পানীতে কাজ করে সেখানে ফ্রির অপশন নাই। তাই কোনো তাড়াহুড়া নাই। তবে ড্রাইভারদের একটা তাগাদা থাকেই তাড়াতাড়ি করার। আরিফের থাকে। কেউ কেউ আছে স্পিড লিমিট মানে না। যত বেশি তাড়াতাড়ি ডেলিভারি করতে পারবে তত বেশি টিপস পাওয়ার চাঞ্চ থাকবে। আরিফ যেহতেু সব চেনে তাই দ্রুত ডেলিভারি করতে পারে। কিন্তু টিপসের ব্যাপারটা একদম ভাগ্য। কিছু ডেলিভারি আছে ক্যাশে পে করে, কিছু আছে অনলাইনে আগেই পে করে কাস্টমার, টিপসও  এড করে দেয়, কিছু আছে নট পেমেন্ট অর্থাৎ ডেবিট মেশিন নিয়ে যেতে হয়, মেশিনে পে করে, তখনই যার ইচ্ছা টিপস এড করে, যার ইচ্ছ করে না। টিপস দিলে খুবই ভাল লাগে আরিফের না দিলে মন খারাপ হয়ে যায়। মনে মনে গালি দেয়। আমেরিকায় দশ পার্সেণ্ট টিপস বাধ্যতামূলক কিন্তু কানাডায় তা না। এখানে টিপস না দিলেও কিছু বলার নাই। চেয়ে নেওয়া যাবে না। চাওয়াটা অফেন্স। কাষ্টমার কমপ্লেন করলে চাকরিও চলে যেতে পারে। ডেলিভারির চাকরি যদিও পারমানেন্ট কিছু না, কোনো বেনিফিটও নাই, চুক্তিভিত্তিক। এই আছে, এই নাই। মালিকের মর্জির উপর। অনেক সময় ম্যানেজাররাও চাকরি খেয়ে দিতে পারে। অনেক ম্যানেজার আছে চুতিয়া টাইপ। পছন্দের মানুষকে ফেবার করে। ডেলিভারি টেম্পারিং করে। এটা নিয়ে অনেকবারই আরিফের সাথে ম্যানেজারদের সাথে ফাইট হয়েছে। আরিফ একদম দুই নম্বরি পছন্দ করে না। কোনো ফেবারও চায় না। নিয়ম মতো সব চললেই খুশী। কিন্তু পৃথিবীতে কিছুই নিয়মমতো চলে না। সর্বত্রই কিছু অনিয়ম আছে। অবশ্য অনিয়ম করে বেশিদিন কেউ এখানে টিকেত পারে না। কতজন এলো আর গেলো। মালিক সবাইকেই সুযোগ দেন। কিন্তু অনিয়ম দেখলে কারো রক্ষা নাই। তিনি অনেক মানবিক মানুষ কিন্তু বিজনেসের ক্ষেত্রে অনেক কঠোর।

বাড়িটা চমৎকার। কম করে হলেও পাঁচ ছয় মিলিয়ন ডলার দাম হবে। কতবার এসেছে এ বাড়িতে ডেলিভারি নিয়ে। নিয়মিত পিজ্জা অর্ডার দেয়। বাড়ির স্বামী স্ত্রী দুজনই খুবই নাইস মানুষ। ভাল টিপস দেয়। কোনো ফিক্স কিছু না। যা দাম তার উপর পার্সেন্টেজ ধরে দেয় কেউ কেউ। কেউ দেয় দশ পার্সেন্ট, কেউ দেয় পাঁচ পার্সেণ্ট, কেউবা বিশ পার্সেণ্টও দেয়। নির্ভর করে কাষ্টমারের মর্জির উপর। কেউ কেউ জাষ্ট একটা এমাউন্ট বসিয়ে দেয়। কেউ কেউ কিছুই দেয় না। সাধারণত ব্রাউন কালার মানুষরা টিপস কম দেয় বা দেয়ই না। মুসলিম পিপলরাও টিপস দেয় খুব কম ক্ষেত্রে। আরবরা একদমই দেয় না। খবিস টাইপ। কালোরাও টিপস দিতে কার্পণ্য করে। কেউ কেউ অবশ্য খুবই ভাল কালোদের মধ্যে। সাদা কাষ্টমারদের ব্যবহারও খুব ভাল। তারা ডেলিভারি ম্যানদের সম্মান করতে জানে। স্যার বলে সম্বোধন করে। অনেক কাষ্টমার আছে ডেলিভারিম্যানদের হার্ডটাইম দেয়। দরজা দেরি করে খোলে, ফোন ধরে না। অনেক কাহিনী করে। রুড হয়। কিন্তু ড্রাইভারদের কিছুই করার থাকে না। সবই সহ্য করতে হয়। কাষ্টমারদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করা যাবে না। মিথ্যা অফিযোগ করে ফ্রি পিজ্জাও নেয় অনেকে। কিছু একটা ত্রুটি বের করে। তবে এরকম কাষ্টমার খুউবই অল্প। পৃথিবীতে ভাল মন্দ থাকবেই।

বাড়ির কাছে পৌঁছাতেই বৃষ্টির তোরটা কমে গেছে। এদেশের আহাওয়ার কোনো মাথামুন্ড নাই। আকাশও হঠাৎ করে পরিষ্কার হয়ে গেছে। সকালে যেভাবে ঘনকালো হয়ে উঠেছিল আকাশ তা আর এখন নাই। একদিকে কিছু কালো মেঘ এখনও রয়ে গেছে। এক জায়গায় বৃষ্টি তো অন্য জায়গায় রোদ এমনও দেখা যায় এদেশে।

দরজায় কলিংবেল দিতেই দরজা খুলল জেনিফার। যেনো রেডি হয়েই ছিল। সাদারা এমনই। সিনসিয়র। বেশিরভাগ সময় জেনিফারই পে করে। কখনও তার হজাবেন্ড করে।

হাই ম্যাম হাউ আর ইউ।

ওহ গুড গুড। হাউ এবাউট ইউ!

এভাবেই শুরু করে প্রতিটি কাষ্টমারের সাথে কথা। আরিফ যে খুব ভাল ইংরেজি বলে এমন না কিন্তু কাজ চলে যায়।

ব্যাগ থেকে পিজ্জা বের করে হাতে দেয়। তখনও ধোঁয়া উড়ছিল পিজ্জা থেকে।

ওয়াও নাইস এন্ড হট। কাষ্টমার বলে। সাদারা এমনই। সবসময় প্রশংসা করে।

আরিফ মিষ্টি হেসে বলে, ইয়েস ম্যাম অলওয়েজ ফ্রেস।

তারপর ইনভয়েসটা হাতে দেয়। দাম ঊনষাট ডলার তেইশ সেন্ট। মনে মনে বলে আরিফ টেন পার্সেণ্ট দিলেও দিনের প্রথম ডেলিভারিতে প্রায় ছয় ডলার হয়ে যাবে। মন্দ হবে না। পনোরো পার্সেণ্ট দিলে প্রায় দশ ডলার হবে। যেহতেু এটা আগেই অনলাইন পে করা নাই তাই ডেবিট মেশিন হাতে দিল জেনিফারের। এমাউন্ট আরিফ সবসময় নিজেই বসিয়ে দেয়। পে করার সময় আরিফ টুকটাকি কথা বলে।

হাউ ইজ ইয়োর হাজবেন্ড।

হি ইজ গুড।

সে মাই হ্যালো।

ওহ সিওর, থ্যাংকস।

অনেক বাড়িতে বা এপার্টমেন্ট নিয়মিত আসে বলে আরিফ অনেককেই চেনে, নামও জানে। অনেক বাসার বাচ্চাদেরও চেনে। ওদের কথাও জানতে চায়। ছোটরা একসময় বড় হয়ে যায়। সময় দ্রুত যায় জীবন থেকে। এসব কথায় সাদা কাষ্টমাররা খুশী হয়। সবকিছুই করে ভাল টিপসের জন্য। না হলে এসবের কোনো ভ্যালু নাই কারো কাছে। কেউ কনভিন্স হয় সাধারণতঃ কেউ কেউ কেয়ার করে না। এমন হয়েছে অনেক সময় আরিফ আগে থেকেই বলতে পারে কে টিপস দেবে কে দেবে না। চেহারাই বলে দেয়। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বোঝা যায়। কেউ আছে খুব মধুর কথা বলে কিন্তু টিপস দেয় না। অনেক মিলিনিয়ররাও টিপস দেয় না। আবার অনেক মধ্যবিত্তরাও নিয়মিত টিপস দেয়। কেউ কেউ আছে নিয়মিত পিজ্জা অর্ডার করে, বড় বাড়িতে থাকে কিন্তু কখনও টিপস দেয় না। এই ধরণের কাষ্টমারের অর্ডার পরলে ড্রাইভাররা খুব বিরক্ত হয়। কোনো এক অদ্ভুত কারণে বুড়ারা খুব কিপটা হয়। কিছু এড়িয়া আছে ড্রাইভাররা লাইক করে না। বিশেষকরে এপার্টমেন্ট যেতে। সময় বেশি খরচ হয় আবার পার্কিং সমস্যা। এপার্টমেন্টের সামনে পার্কিং অপশন থাকে না প্রায়ই। ওটা হচ্ছে ফায়ার এক্সিট। আড়াইশ ডলার টিকিট দেয় পার্র্কিং এনফোর্সমেন্টের লোকেরা। ডেলিভারির এটাই সমস্যা, টিকিট। এমন কোনো ড্রাইভার নাই যে টিকিট খায় না। আর টিকিট খায় ট্যাক্সি এবং উবার ড্রাইভাররা।

পেমেন্ট ডান।

ইউ ওয়ান্ট রিসিট ম্যাম!

ইঁটস ওকে।

বেশিরভাগই রিসিট চায় না। কারণ আগেই ইনভয়েস দিয়েছে আরিফ। পেমেন্ট না দেখেই থ্যাংকস দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে আরিফ। আর একই সাথে ডেবিট মেশিন থেকে মার্সেন্টাইজ কপি প্রিন্ট নেয়। তাকিয়ে দেখে বিশ পার্সেণ্ট টিপস দিয়েছে। প্রায় তেরো ডলার। সকালেই মনটা ফুরা ফুরা হয়ে যায়।

বৃষ্টিটা এখনও আছে। তবে একটু কম। স্টোরে এসে দেখে অনেকগুলো অর্ডার। অন্যজন আজকে ওপেন করেছে ওর নাম জন। শ্রীলঙ্কান। আসলে তামিল। ভাল ছেলে। অনেকদিন থেকে কাজ করে। কিন্তু একটু ভাব আছে। তামিলরা লেখাপড়া করে নাই জানা কথাই কিন্তু এরা পরিশ্রমী, দুই তিনটা কাজ করে সবাই এবং প্রথমেই তারা বাড়ি কিনে ফেলে। শ্রীলঙ্কানরা অনেষ্ট। বাঙালিদের চেয়ে ভাল। বাঙালিদের কয়েকজনের সাথে কাজ করেছে আরিফ, বিশেষকরে ম্যানেজারগুলো বেশি খবিস হয়। ক্ষমতা পেলে একটা ভাব মারে। মনে করে দেশের প্রেসিডেন্ট। এই স্টোরে অন্য দেশের ম্যানেজার ছিল। তাদের সাথে কাজ করে আরাম ছিল। একজন চাইনিজ ছিল। জেফ নাম। খুউব কড়া ছিল। কাউকে এক্সট্রা খাতির করত না। বাঙালিগুলা তোষামোদি পছন্দ করে। আরিফ  কাউকে তোষামোদ করতে পারে না। স্বভাবেও নাই। তাই আরিফকে অনেক ডিপ্রাইভ সহ্য করতে হয়। ঠিকমেেতা শিফট দিতে চায় না।

পরের ডেলিভারিটা দেখেই মন খারাপ হয়ে গেলো। খুবই সুন্দরী এক মেয়ে। নিয়মিত পিজ্জা অর্ডার করে। থাকেও ধনী এড়িয়ায়। দামী বাড়িতে। কিন্তু টিপস দেয় না। কিন্তু কিছু করার নাই। মনে মনে বিরাগ নিয়ে গেলো ডেলিভারিতে। চুপচাপ ডেলিভারি দিয়ে আসল। কোনো থ্যাংকসও বলেনি। অন্ততঃ এক ডলার দিলেও দে বাবা। কিছুই দিবিনা এটা কেমন ভদ্রতা! জানোসইতো টিপসই ড্রাইভারদের প্রধান ইনকাম। সাড়ে ছয়টায় ক্লক আউট হলো আরিফ। যেদিন বেশি বিজি হয় সেদিন আরো বেশি সময় থাকতে পারে। এখন রাশ আওয়ার যতটা বিজি হওয়ার কথা ততটা হচ্ছে না বলে ম্যানেজার গো হোম বলে দিছে। লং ইউকেন্ড থকলে বেশি বিজি হয় শেষ দিন। আরিফ মনে মনে সাতটা পর্যন্ত থাকতে চেয়েছিল। সারাদিনে মাত্র এগারেটা ডেলিভারি করেছে। আর একটা করতে চেয়েছিল। হলো না। ডিশ ওয়াশ শেষ করে ক্যাশড্রপ করে সাইন আউট হলো। টোটাল ইনকাম হয়েছে একশ পঁিচশ ডলার তিরিশ সেন্ট। এটাকে তেমন ভাল বলা যায় না। কিন্তু কিছুই করার নাই। এটাই ডেলিভারি চাকরির চরিত্র। কখনও হাতাশার কখনও ভাললাগার। (সমাপ্ত)

(এই গল্পের চরিত্র ও প্রেক্ষাপট কাল্পনিক। কোথাও কোনো মিল পেলে তা নিতান্তই কাকতলীয়) জসিম মল্লিক টরন্টো প্রবাসী সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ঔপন্যাসিক