প্রবাসে সংস্কৃতির পুনরাবিষ্কার
ভাষা শেখা কেন নিজ ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হবার সেরা উপায় জানালেন অন্টারিয়াবাসী
তিন ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হোন যারা আবিষ্কার করেছেন যে, পূর্বপুরুষের ভাষা শেখার সময় কখনই পেরিয়ে যায় না
এক মেঘলা, হিমেল দিনে রিভারডেল খামারে কয়েকটি পরিবার এমন এক প্রচেষ্টায় অংশ নেন যাতে দীর্ঘকাল ধরে অস্তিত্ব বিলোপের হুমকির মখোমুখি হওয়া ভাষাগুলোর পুনরুজ্জীবন ঘটানো যায়।
লিন্ডসে হ্যাচে এসব ভাষার শিক্ষকদের কাছে হস্তান্তরের জন্য টেবিলের ওপর ওজিবওয়ে (Ojibway) এবং মোহক (Mohawk) (আদিবাসী ভাষা) ভাষার শব্দ লেখা ক্লিপবোর্ড সাজিয়ে রেখেছেন। এই শিক্ষণকালে বাবা-মা ও তাদের সন্তানেরা যেসব জিনিস ও প্রাণীর সঙ্গে পরিচিত হবে সেগুলোর নাম শিখতে এই ক্লিপবোর্ডগুলি সহায়ক হবে। টরন্টোর নেটিভ কানাডিয়ান সেন্টারের জন্য এটিই ছিল ভাষার ভুবনে প্রথম অভিযাত্রা।
আর্লিঅন ইন্ডিজেনাস ল্যাঙ্গোয়েজ অ্যান্ড ফ্যামিলি প্রোগ্রামের ম্যানেজার হ্যাচে বলেন, এ ধরণের কর্মকাণ্ড পরিবারগুলোর জন্য একসঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষের ভাষা শেখার ব্যাপারে সহায়ক হতে পারে।
সিবিসি টরন্টোর সঙ্গে এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমরা দেখেছি, নিজের ভাষা না জানা বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়ে গেছে।” হ্যাচে বলেন, এজন্যই সন্তানদের সঙ্গে বাবা-মায়েদেরও শেখাটা জরুরী।
তিনি বলেন, “এটা তারা বাড়িতে বসেও করতে পারবে। আবার স্কুলের ক্লাসে অংশ নিয়েও করতে পারবে। তবে নিশ্চিতভাবেই এটা এমন এক বিষয় যে, ভাষা শেখা এবং তা বাচ্চাদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সাফল্যের নিশ্চয়তা বিধানের প্রয়োজন আছে।”
তিনি বলেন, আদিবাসী জনগণের নিজস্ব সংস্কৃতির পুনরুদ্ধারের কাজটি তাদের ভাষা শেখার মধ্য দিয়েই শুরু করতে হবে।
তিনি বলেন, “ভাষার ভিত্তি সব সময়ই নিজ দেশ সম্পর্কিত জ্ঞানের ওপর। আমি সব সময়ই বলে থাকি, ভাষার মধ্যে কিছু বিশেষ সঙ্কেত (codes) আছে যা ব্যক্তির ডিএনএকে এমনভাবে সক্রিয় করে তোলে যাতে সে তার আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধার ও মনে করতে সক্ষম হয়।”
ড. হাউ হং আউ: ৭৫ বছর বয়সে ম্যান্ডারিন শিখছেন
ড. হাউ হং আউ জন্মেছিলেন মালয়েশিয়ায়। তার বাবা-মা ছিলেন মূল চীনা ভূখণ্ড থেকে আসা। তার পরিবার ঠিক করে দিয়েছিল যে, ম্যান্ডারিন বা ক্যান্টনিজ ভাষা শেখার চেয়ে ইংরেজি শেখা তার জন্য ভালো হবে।
এর ফলে মি. আউ কোনও চীনা ভাষাই তেমন করে জানেন না। তিনি কথাবার্তা চালানোর মত আঞ্চলিক ক্যান্টনিজ ভাষা মোটামুটি জানেন কিন্তু সে ভাষা পড়তে বা লিখতে জানেন না।
৭৫ বছর বয়সে মি. আউ এখন তার নাতির সঙ্গে টরন্টোর ম্যান্ডারিন স্কুলে পড়ছেন। তার নাতি ভাষাটা বেশ ভালো জানে। তিনি ভাষাটি বলতে, পড়তে এবং লিখতে শিখছেন।
“ম্যান্ডারিন বলতে পারাটা আমার নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সংযুক্ত হবার একটি সুযোগ।
আউ বলেন, অন্য একটি ভাষা জানাটা ঐশ্বরিক দানের মতই ভাবা উচিৎ। আর শেখার প্রক্রিয়াটি খুবই ফলপ্রসু একটি অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, যারা তাদের সাংস্কৃতিক শিকড়ের ভাষা শেখার কথা ভাবছেন তাদের সেটা শেখা উচিৎ।
“এটিকে আপনার চেতনা মুক্ত করে দেয়ার সুযোগ হিসাবে ভাবুন এবং আপনার শেকড়ে ফিরে যান যেখানে আপনি আপনার প্রজন্ম ও পুর্বপুরুষের চেতনার সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচতে পারেন।”
মারলা কিশিমাতো: ভাষার সঙ্গে সংযোগ খুব কঠিন
আধা জাপানি ও আধা শ্বেতাঙ্গ মারলা কিশিমাতো জাপানি সংস্কৃতিতে সব সময়ই মুগ্ধ। কিন্তু তিনি নিজের শিকড় সম্পর্কে জানার তেমন একটা চেষ্টা কখনই করেননি।
সেই পুরো ব্যাপারটাই পাল্টে যায় ২০১৮ সালে জাপান সফরের সময়।
টরন্টোতে বসবাসকারী কিশিমাতো (৩৫) বলেন, “যখন আমি ফিরে আসি, তখন সিদ্ধান্ত নিই, এর পর যখন যাবো তখন যেন জাপানী ভাষায় যোগাযোগ করতে পারি। “আমি কার্যকরভাবে ক্লাসে যোগ দেয়ার জন্য ভর্তি হই এবং আন্তরিকভাবেই ভাষাটি শেখার চেষ্টা শুরু করি।”
তিনি বলেন, তার পারিবারিক ইতিহাসের যেটুকু তিনি জানেন তার বেশিরভাগই কেন্দ্রীভূত ছিল তার দাদা-দাদীর মধ্যে যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বন্দীশিবিরে কাটান এবং শেষ পর্যন্ত টরন্টোতে চলে আসেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি ওই সময় সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জেনেছেন। এখন তিনি তার দাদার সেইসব সম্পত্তির রেকর্ডপত্র খুঁজে বের করেছেন যে সম্পত্তিগুলি কানাডা সরকারের বন্দীশিবিরে থাকার সময় বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল।
কিশিমাতো বলেন, তিনি অনুভব করেন যে, তার শিকড় ও ভাষা সম্পর্কে আরও বেশি জানাশোনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যুদ্ধের পর অনেক জাপানি মানুষ নিজের ঐতিহ্য ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করেন।
তিনি বলেন, “তারা নিজের সমাজের বাইরের মানুষদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমার বাবা ও তার ভাই-বোনেরা পুরো শ্বেতাঙ্গদের বিয়ে করেন… আর আমার মনে হয়, এই সংস্কৃতির অনেকটাই হারিয়ে গেছে সত্যিই শুধু এই কারণে যে, দেশের অবশিষ্ট মানুষ জাপানি সংস্কৃতিকে খুব একটা ইতিবাচকভাবে দেখতো না।
“ভাষা ভুলে যাওয়া এবং সংস্কৃতির সব ছোটখাট ব্যাপার হারিয়ে ফেলে আমার মনে হয়, সেগুলোর সঙ্গে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করার এখনই সময়, এখন আমরা এটা করতে পারি।”
কিশিমাতো ২০১৮ সালে জাপান ফাউন্ডেশনে ক্লাস করতে শুরু করেন এবং দুবছর ধরে তা অব্যাহত রাখেন। তখন থেকেই তিনি কয়েকজন জাপানী বন্ধুর সঙ্গে ভাষার চর্চা করতে শুরু করেন। আগামী বছর তিনি আবার জাপান সফরের পরিকল্পনা করছেন।
তিনি বলেন, সংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের অনেক উপায় রয়েছে, তবে তার কাছে এর সবচেয়ে সঠিক তোরণ বলে মনে হয়েছে ভাষাকে। বিশেষ করে যখন জাপান সফরের প্রশ্ন থাকে।
“সুতরাং, ভাষার মধ্যে ইতিহাসের এতই বিরাট অংশ নিহিত থাকে যে, আমার মনে হয়, ভাষা শেখার মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই অনেক দরোজা খুলে যায়।”
সূত্র : কীর্তন শশীশরণ/সিবিসি নিউজ