তাসের আড্ডা-২২
শুজা রশীদ
“রাশিয়া কি ইউক্রেনে কেমিকাল কিংবা বায়োলজিকাল বোমা মারবে মনে হয়?” রনি হাতের তাস দেখে মনক্ষুন্ন হয়ে বলল। পর পর কয়েকটা হাত একেবারে যাচ্ছে তাই যাচ্ছে। খেলার আগ্রহই চলে যাবার জোগাড়।
আজ রোববার রাত। জালালের বাসায় জমায়েত হয়েছে তারা কয়েকজন। শনিবারে সবাইকে পাওয়া যায় নি। বাচ্চারা কেউই আসে নি। তারা এখন একটু বড় হয়ে যাওয়ায় তাদেরকে আর আগের মত জোর জবরদস্তি করে কোথাও নেয়া যায় না। জোরাজুরি করতে গেলেই একেবারে বেঁকে বসে।
জালাল হাতের তাস দেখে মুগ্ধ। রাজা, রানী আর টেক্কার ছড়াছড়ি। সে এক গাল হাসি নিয়ে বলল, “ভাই, আপনি কেমিকাল বোমার কথা বলছেন, তারা তো নিউক্লিয়ার বোমা মারবে না সেটারও নিশ্চয়তা দিচ্ছে না।”
“ক্রিস্টিয়ান আমানপুরের সাথে ক্রেমলিনের স্পোকসম্যান দমিত্রি পেস্কভের ইন্টারভিউয়ের কথা বলছেন তো?” জিত বলল। “সে বলছে রাশিয়ার জীবন-মরনের প্রশ্ন উঠলে রাশিয়া নিউক্লিয়ার বোম মারবে। প্রশ্ন হচ্ছে কোনটা জীবন-মরনের প্রশ্ন আর কোনটা নয় সেটা নির্ধারণ করছে কে? ভøাদিমির পুটিন আর তার চাটুকারেরা? ইউক্রেন আক্রমণের পেছনেও তো একই যুক্তিই দিয়েছিল। এখন ব্ল্যাক আর কাস্পিয়ান সাগর থেকে সমানে হাইপারসনিক মিসাইল মারছে।”
সাইদ বলল, “হ্যাঁ, কিনযাল তো সাংঘাতিক অস্ত্র। ২০০০ কিলোমিটার দূরের টার্গেট শব্দের চেয়ে দশ গুণ বেশী স্পিডে গিয়ে আঘাত করতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলোর এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এই মিসাইল ডিটেক্ট নাও করতে পারে। যার অর্থ এতে নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড লাগিয়ে যদি ছোড়া হয় তাহলে সেটাকে হয়ত থামানো যাবে না। কেমন ভয়াবহ, বুঝতে পারছ? ঐ কারণেই পুটিনের গায়ের জোর একটু বেড়েছে মনে হয়। ভাবছে যুদ্ধ বাঁধলে তার একটা বড় হাতিয়ার হবে এই মিসাইল।”
কবীর হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “সবাই এখন এমনভাবে কথাবার্তা বলছে যেন নিউক্লিয়ার যুদ্ধ বাঁধলে বাঁধুক। কি আর করা! রাশিয়ার অধিকাংশ মানুষ কি আসলেই পুতিনকে সমর্থন করছে? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।”
“রাশিয়া হচ্ছে অটোক্রেটিক ডেমোক্রেসি,” সাইদ বলল। “পুতিন আসার পর তাদের জীবন যাত্রার মান ভালো হয়েছে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার পশ্চিমা দেশগুলোর মত নয়। এখনই তো খবরের কাগজে কি ছাপা হবে আর রেডিও, টিভিতে কি বলা হবে কিংবা দেখানো হবে সব কিছুই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করছে। রাশিয়ার ভেতরে মানুষ খুব একটা সত্য জানতেও পারছে না। কিন্তু বাইরে যে সমস্ত রাশিয়ানরা আছে তারা যে যেভাবে পারছে প্রতিবাদ করছে।”
“সত্যি সত্যি যুদ্ধ বাঁধলে কি হবে?” জালাল বলল। “রাশিয়ার চেয়ে তো নাটোর মিলিটারি পাওয়ার যথেষ্ট বেশী। রাশিয়ার তো যুদ্ধে পারার কথা না।”
সাইদ হাসতে হাসতে বলল, “দুই পক্ষ নিউক্লিয়ার বোম মারলে যে ক্ষয় ক্ষতি হবে তার পরে কে জিতল আর কে হারলো সেই হিসাব করে কি কোন লাভ হবে?”
লাল ভাই এতক্ষণ নিঃশব্দে সবার আলাপ শুনছিল। সে এবার বলল, “পড়লাম রাশিয়া নাকি ইউক্রেনকে দুই ভাগ করে দেবার প্ল্যান করছে। কোরিয়ার মত। আবার ইউক্রেন থেকে হাজার হাজার মানুষ ধরে ধরে রাশিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে।”
সাইদ বলল, “হ্যাঁ, পোর্ট সিটি মেরিওপল থেকে নাকি ২০০০ বাচ্চা রাশিয়ার সমর্থক ডনেস্ক পিউপল রিপাবলিক আর লুহানসক পিউপিল রিপাবলিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাশিয়া বলছে তারা স্বেচ্ছায় গেছে। ইউক্রেনিয়ানরা বলছে তাদেরকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতিদিন মেরিওপল থেকে নাকি ১৭০০ জনকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। রাশানদের ভাষ্য হচ্ছে তাদেরকে কিয়েভের শাষন থেকে মুক্ত করা হচ্ছে। এই যুদ্ধ যে কোথায় গিয়ে শেষ হবে? সারা দুনিয়ায় সব কিছুর উপর এর প্রকোপ পড়ছে। তেলের দাম লিটার প্রতি দুই ডলারের কাছাকাছি চলে গেছে। জিনিষপত্রের দাম বাড়ছে। খুব তাড়াতাড়ি একটা সুরাহা না হলে খবর আছে।”
রনি বলল, “তাড়াতাড়ি শেষ হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। রাশিয়া তো ভেবেছিল দুই দিনের মধ্যে কিয়েফ (ইউক্রেনিয়ান উচ্চারণ) দখল করে নিজের একটা পোষা সরকার বসিয়ে হাসিমুখে দেশে ফিরবে। অথচ মাস খানেক হয়ে গেছে এখনও কিয়েফে পৌঁছাতেই পারে নি। শোনা যাচ্ছে হাজারের উপর রাশিয়ান সৈন্য মারা গেছে। সাত জন রাশিয়ান জেনারেল মারা গেছে। ইউক্রেনিয়ানরা এখন উলটা আক্রমণ করে রাশিয়ান অধিকৃত এলাকা থেকে তাদেরকে হটিয়ে দিচ্ছে। পুতিন বেপরোয়া হয়ে কিছু একটা করে ফেললে তখন নাটোকে হয়ত বাধ্য হয়ে জড়িয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে এখন পোলান্ডের কাছাকাছি বোমা মারছে। দু’ একটা পোলান্ডে গিয়ে পড়লে নাটোকে প্রতিক্রিয়া দেখাতেই হবে।”
কবীর বলল, “ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনসকি তো রাশিয়ার সাথে আলাপ করতে চাইছে। বলছে নাটোতে যোগ দেবে না। কিন্তু রাশানরা তো আলাপই করছে না। আজই পড়লাম ইংল্যান্ডের চেলসি ফুটবল টিমের মালিক বিলিওনিয়ার রোমান এব্রামোভিক আর ইউক্রেনিয়ান পিস নেগোশিয়েটরদেরকে কে বা কারা নাকি মার্চের প্রথম সপ্তাহে পিস টকের সময় বিষ খাইয়েছিল। এব্রামোভিক পিস টকে সাহায্য করছিল।”
জিত বলল, “খুবই সম্ভব। রাশিয়ানদের মধ্যেই একদল হার্ড লাইনার আছে যারা পুতিনকে চোখ বুঁজে সমর্থন করে। তারা হয়ত চায় না কোন শান্তি চুক্তি হোক। ভাবছে ইউক্রেনকে পুরোপুরি দখল করে সেখানে একটা পুতুল সরকার বসাবে।”
সাইদ বলল, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে পড়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তান তো ঠিক সেটাই করতে চেয়েছিল। তারা হবে শাসক, আর আমরা হব শাসিত।”
জালাল বলল, “আচ্ছা, এই প্রসঙ্গে যখন কথা উঠলই, ইউনাইটেড নেশন মার্চের ৩ তারিখে এমার্জেন্সী স্পেশীয়াল সেসনে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণকে আগ্রাসন সনাক্ত করে এক্ষুনিই সেখান থেকে রাশিয়ার সৈন্য সরিয়ে ফেলার প্রস্তাব দেয়। সেখানে বাংলাদেশ ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকে। কারণটা কি?”
জিত বলল, “হ্যাঁ ১৯১ টা দেশের মধ্যে ১৪১ টা দেশ ভোট দিয়েছিল রেজুলেশনের পক্ষে। রাশিয়া সহ চারটা দেশ রেজুলেশনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। আর পঁয়ত্রিশটা দেশ ভোট দেয়া থেকে বিরিত ছিল। দক্ষিণ এশিয়া থেকে ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকাও ভোট দেয় নি কিন্তু নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ এবং আফগানিস্তান আবার পক্ষে ভোট দিয়েছিল।”
রনি বলল, “বাংলাদেশের ফরেইন মিনিস্টার বলেছেন বাংলাদেশ ভোট দেয় নি কারণ বাংলাদেশ শান্তি চায়। ড্রাফট রেজুলেশন নাকি দোষারোপ করার জন্য প্রস্তাবিত হয়েছিল, শান্তির জন্য নয়। সত্য হচ্ছে সরকার রাশিয়াকে ক্ষেপাতে চায় না । আমাদের দেশে প্রচুর রাশিয়ান প্রজেক্ট চলছে। রুপপুরে নিউক্লিয়ার প্লান্টও তৈরী করছে ওরা প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচে। তার ৯০ ভাগ রাশিয়ান ক্রেডিটে হচ্ছে।”
সাইদ বলল, “সেটা বুঝলাম, কিন্তু বাংলাদেশ অতীতে ক্ষুদ্র দেশ কিংবা এলাকার স্বাধীনতার প্রশ্নে ইউনাইটেড নেশনের রেজুলেশন সমর্থন করেছে। ১৯৭৯ তে কম্বোডিয়ায় ভিয়েতনামের মিলিটারি অপারেশন, ১৯৮০ তে আফগানিস্থানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন, প্যালেস্টাইনে ইস্রাইলের আক্রমণ – আমাদের সমর্থন জানাতে আমরা কোথাও ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাই নি। এবার কেন তার ব্যাতিক্রম হল সেটা আমার কাছে খুব একটা পরিষ্কার না। ব্যবসা বানিজ্য তো থাকবেই। কিন্তু সেই কারণে কি নৈতিকতাকে বিসর্জন দিতে হবে?”
লাল ভাই বলল, “বাংলাদেশ সরকার তো বাংলাদেশের ভালোটাই দেখবে, তাই না? ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাও তো ভোট দেয় নি। শুধু বাংলাদেশকে দোষ দিয়ে কি লাভ? যাই হোক, ২৬ শে মার্চে যে বাংলাদেশ থেকে নন-স্টপ বিমানের ফ্লাইট চালু হয়েছে সেটা তো নিশ্চয় শুনেছেন সবাই। কত বড় একটা ব্যাপার বলেন তো! আমি তো খুব খুশী হয়েছি। এখন বিমানে চেপে সোজা দেশে যাবো আর আসব।”
রনি টিপ্পনি কাটল, “হ্যাঁ ভাই, আপনার তো দেশে রাজার ভাণ্ডার আছে। দেশে যাবেন, হীর জহরত নিয়ে ফিরবেন। আপনার তো চিন্তার কোন কারণ নাই। আমি তো গত দশ বছর দেশ মুখো হই নি। নন-স্টপ নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই।”
লাল ভাই হাসতে হাসতে বলল, “আপনি তো ভাই একেবারে কানাডিয়ান হয়ে গেছেন। আমার আবার একটু দেশে না গেলে ভালো লাগে না। জন্মভূমির একটা আলাদা স্বাদ আছে, বুঝলেন না!”
সাইদ বলল, “অনেকেই খুব উৎফুল্ল! শুধু নন-স্টপ বলে নয়। দেশের প্লেন। প্রধানত সব দেশী লোকজনই যাবে। একটা আলাদা আবহাওয়া। আমিও গেলে হয়ত বিমানেই যাবো।”
রনি বলল, “এবার যেটা এসেছে সেটা টেস্ট ফ্লাইট। সব কিছু ঠিকঠাক মত হলে তবে রেগুলার ফ্লাইট শুরু হবে। সুতরাং বেশী খুশী হবার এখনও সময় হয় নি। মনে আছে নিউ ইয়র্কেও বিমান আসত। তারপর কি ক্যাঁচাল ফ্যাঁচাল লেগে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। এবার কোন ক্যাঁচাল না লাগলেই হয়।”
জিত বলল, “এবার কোন সমস্যা হবার কথা নয়। যা শুনলাম টেস্ট ফ্লাইট ভালোই গেছে। তবে যেটা শুনে খুব মজা পেলাম সেটা হল প্রচুর সরকারী কর্মকর্তারা নাকি পরিবার পরিজন নিয়ে এসেছেন। সেসব নিয়ে দেশেও বেশ কথাবার্তা হয়েছে।”
সাইদ বলল, “আরে, সব কিছু নিয়ে এতো ক্রিটিকাল হলে হয় নাকি? এতো বড় একটা প্রজেক্ট। না হয় কিছু মানুষ এলো নায়েগ্রা ফলস দেখার জন্য। প্রজেক্ট চালু হলে খুব লাভজনক হবে মনে হয়। যত মানুষের সাথে আলাপ হচ্ছে সবাইতো দেখি বিমানেই যেতে চায়।”
লতা মনে হয় দূর থেকে আলাপের কিয়দংশ শুনে থাকবে। সে দৌড়ে এলো। “বিমানের প্লেনেতো বেলা ভাবির ভাই পাইলট ছিলেন। রনি ভাই বলে নি?”
জালাল বলল, “তাই নাকি? রনি ভাই, আপনি এতো বড় একটা খবর কেমন করে চেপে গেলেন? আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম ভাবীর ভাই সিনিয়র পাইলট।”
রনি হাসল। “সবাই এটা নিয়ে এতো মাতামাতি করছে যে বলতে লজ্জাই লাগছিল।”
লতা চেঁচামেচি করে বেলাকে ডাকল। “বেলা ভাবী, এদিকে আসেন।”
বেলা টেবিলে খাবার দেবার জন্য ব্যস্ত ছিল। তারপরও দ্রুত পায়ে এলো। “কি সমস্যা?”
জালাল বলল, “কোন সমস্যা নেই ভাবী। শুনলাম আপনার ভাই নাকি বিমানের ঐতিহাসিক ঢাকা – টরন্টো ফ্লাইটের পাইলট ছিলেন। আপনার তো এখন আর গর্বে মাটিতে পা পড়বে না।”
বেলা হাসতে লাগল। “এটা নিয়ে গর্ব করার কি আছে! ভাইয়া যে এসেছে সেটাই ভালো লাগছে। বেশ কিছুদিন দেখা হয় নি। দুপুরের দিকে ঝট করে গিয়ে ঘুরে এসেছিলাম। ডাউন টাউনে হোটেল হলিডে ইনে উঠেছে ওরা। ফ্লাইটটা চালু হলে ভালোই হবে। মাঝে মাঝেই দেখা হবে।”
সাইদ বলল, “শুনলাম সপ্তাহে নাকি তিনটা করে ফ্লাইট চলবে। এতো প্যাসেঞ্জার পাবে মনে হয়?”
বেলা বলল, “পড়লাম তো কানাডায় নাকি এক লাখ বাংলাদেশী আছে। বাংলাদেশ সরকার নিশ্চয় হিসাব-কিতাব করে দেখেছে কতগুলো ফ্লাইট দিলে ভালো হবে। কিন্তু এতো লম্বা সময় কি প্লেনে বসে থাকতে ভালো লাগবে? পনের-ষোল ঘন্টা!”
রনি বলল, “শেষ যে বার গিয়েছিলাম, সাত-আট ঘন্টার ফ্লাইটেই আমার পায়ে কিড়বিড় করে কামড়াতে শুরু করেছিল। ইকনমি ক্লাসে এতো চাপাচাপি। ভালো করে পা খুলে তো বসাই যায় না।”
রুমাও এসে যোগ দিল ওদের সাথে। বলল, “আমি কিন্তু বিমানেই যাবো। আমারও বসে থাকতে কষ্ট লাগে কিন্তু তারপরও পরিচিত মানুষ জনের সাথে যাওয়া যাবে, এয়ার হোস্টেজরা বাংলায় কথাবার্তা বলবে। খুব এটা দেশের আমেজ পাওয়া যাবে।”
জালাল বলল, “ভাবী, তিনটা ক্লাশ থাকবে। ইকনমি, প্রিমিয়াম ইকনমি আর বিজনেস ক্লাশ। আপনি সাইদ ভাইকে বলবেন বিজনেস ক্লাশে টিকিট কাটতে। শুয়ে শুয়ে চলে যাবেন। কোন কষ্টই হবে না। কষ্ট তো করব আমরা, গরীব মানুষেরা।”
রুমা ছদ্ম কোপ দেখিয়ে বলল, “ঐ কিপটা কাটবে বিজনেস ক্লাশ আমার জন্য? ইকনমি ক্লাশে বসিয়ে নিয়ে যাবে। বেশী কষ্ট হলে বলবে এইতো আর একটু।”
সবাই হেসে উঠলো।
সাইদ বলল, “আরে, আমরা কানাডার ছা-পোষা মানুষ। বিজনেস ক্লাসে যাবার আমদের কি সামর্থ্য আছে।”
জিত বলল,“আপনি দাদা যে ক্লাশেই যান, বউদিকে বিজনেস ক্লাশে তুললেই হল।”
রুমা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “ঐ আশায় গুড়ে বালি! কিপটার কিপটা!”
রনি বলল, “আমার ভায়রা ভাইয়ের সাথে আলাপ হচ্ছিল। এইবার প্লেনে মানুষ তত বেশী ছিল না। কিন্তু হেড উইন্ডের কারণে দেড় দুই ঘন্টা বেশী লেগেছে। তারপর আবার রাশিয়ার আকাশ সীমা দিয়ে আসতে পারে নি। ইনস্যুরেন্স কম্পানি অনুমতি দেয় নি। ফলে ঘুরে আসতে হয়েছে। সেখানেও ঘন্টা দুয়েক বেশী লেগে গেছে। সব মিলিয়ে বলল প্রায় উনিশ ঘন্টার মত লেগেছে। ফুয়েল খুব বেশী বাকী ছিল না। প্লেন ভর্তি প্যাসেঞ্জার এবং মালামাল থাকলে তখন নন-স্টপ আসা যাবে কিনা সেই ব্যাপারে কিছু সন্দেহ আছে। হয়ত রিফুয়েলিংয়ের জন্য কোথাও থামতে হতে পারে। বিশেষ করে টরন্টো আসার পথে। যাবার সময় টেইল উইন্ড থাকবে। পনের ঘন্টায় চলে যাওয়া যাবে।”
সাইদ বলল, “ঐ সব কিছু পর্যবেক্ষণ করবার জন্যই তো এই ট্রিপ। যদি রিফুয়েলিং করবার জন্য কোথাও অল্প কিছুক্ষণের জন্য থামতেও হয় তাতেও বা সমস্যা কি?”
লতা প্রসঙ্গ পালটে বলল, “রনি ভাই, সারাক্ষণ তো মুভি দেখেন। আজ অস্কার হচ্ছে দেখলেন না?”
রনি শ্রাগ করল। “এই বার অধিকাংশ মুভিই বেশী ভালো লাগে নি। অবশ্য এই প্যান্ডেমিকের মধ্যে মুভি বানানো হয়ত খুব একটা সহজ ছিল না। যে কারণে অস্কারের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ পাই নি। এখনও বোধ হয় চলছে। আপনারা দেখছেন নাকি?”
বেলা বলল, “কি কান্ড হয়েছে তোমরা কেউ জানো না? উইল স্মিথ তো ক্রিস রকের মুখে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছে। ওর বউকে নিয়ে কি একটা জোক করেছিল।“
লতা তার মুখ থেকে কথা লুফে নিয়ে বলল, “ওর বউ পিঙ্কেটের এলোপিশা আছে। চুল সব উঠে যাচ্ছে যে কারণে মাথা ন্যাড়া করে ফেলেছে। জি. আই. জেন মুভিতে ওর মাথা ন্যাড়া ছিল। তাই নিয়ে জোক করেছিল। উইল স্মিথ মঞ্চে উঠে গিয়ে এক থাপ্পড় লাগিয়ে দিয়েছে। ইউ টিউবে নিশ্চয় কেউ এতক্ষণে লোড করে দিয়েছে।”
কবীর ঝটপট ইন্টারনেটে গিয়ে একটা ভিডিও বের করে ফেলল। থাপ্পড়ের দৃশ্য দেখে সবাই একটু আশ্চর্যই হল।
জিত বলল, “কমেডিয়ানরা অনেক সময় বেশী বেশী বলে ফেলে, বুঝলাম, কিন্তু তাই বলে এই জাতীয় একটা প্রোগ্রামে কাউকে গিয়ে মারাটা কি ঠিক? পনের মিলিয়ন মানুষ দেখেছে। হলিউডের জাত মারা গেল।”
বেলা সাথে সাথে প্রতিবাদ করল, “ক্রিস রকের দোষ আছে। মেয়েটার অসুখ আছে। চুল পড়ে যাচ্ছে। এটা কি খুশীর কিছু? এইসব নিয়ে হাসি-ঠাট্টার তো কোন দরকার নাই। মানুষকে হাসানোর কি আর কোন বিষয় নেই? আমি তো বলি ভালোই হয়েছে।”
সাইদ হেসে ফেলল। “আরে কমেডিয়ানদেরকে যদি মানুষ জোক পছন্দ হয় নি বলে মারতে শুরু করে তাহলে বেচারারা তো মার খেয়ে ভুত হয়ে যাবে। না মেরে মুখে ওয়ার্নিং দিলেই হত।”
লতা বলল, “আমিও সেটাই বলছি। মারাটা ঠিক হয় নি। ও আবার বেস্ট এক্টরও হয়েছে।”
রনি শ্রাগ করল। “ক্রিস রক ২০১৬ সালে যখন অস্কার হোস্ট করেছিল তখনও পিঙ্কেটকে নিয়ে একটা জোক করেছিল। উইল স্মিথ আর পিঙ্কেট দু জনাই ঐ অস্কার বয়কট করেছিল অস্কারে সাদাদের অতিমাত্রায় প্রাধান্যের প্রতিবাদ করার জন্য। সেই সময় রক খোঁচা দিয়ে বলেছিল – জাডা অস্কার বয়কট করা আর আমার রিহানার প্যন্টি বয়কট করা একই ব্যাপার। আমাকে কেউ নিমন্ত্রণ জানায় নি। যাই হোক, অস্কার কমিটি যে কোন একশন নেয় নি দেখে অবাকই হলাম। তবে কিং রিচার্ড মুভির জন্য বেস্ট এক্টরের অস্কার পেয়েছে উইল স্মিথ, সেটাতে আমি খুব খুশী হয়েছি। চমৎকার অভিনয় করেছে।”
“বেস্ট পিকচার হয়েছে কোডা। দেখেছেন?” লতা বলল।
রনি বলল, “দেখেছি। দারুণ মুভি। বোবা এবং বধির মানুষেরা যে কিভাবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে সেটাই দেখার মত।”
বেলা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি আমাকে ছাড়াই দেখে ফেলেছ?”
রনি মাথা দোলাল। “স্ট্রিমিং সাইট থেকে দেখেছি, ফ্রি। তোমাকেও দেখিয়ে দেব ক্ষনে। এখনও নিশ্চয় আছে।”
বেলা বিরক্ত হয়ে বলল, “যখন দেখেছিলে আমাকে ডাকতে পার নি? যাই হোক। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। খেতে আসেন সবাই। কাল আবার কাজ কর্ম আছে সবার।”
প্রায় মাঝরাত। সবাই উঠল। টরন্টোতে পার্টি মানে এই রকমই। আসতেও দেরী হয়, যেতেও দেরী হয়।
খাবার নিতে নিতে জিত বলল, “একটা ছোট্ট জোক বলি।”
এক দম্পতি খুব সুখী, কখন ঝগড়া ঝাটি করে না। তাদের ২৫তম বিবাহ বার্ষিকীতে বন্ধুরা জানতে চাইল, তোমাদের এই সুখী দাম্পত্যের রহস্যটা কি?
স্বামী বলল, “আমরা হানিমুন করতে সিমলা গিয়েছিলাম। বউ ঘোড়ায় উঠল। ঘোড়াটা পাজি। বউকে ফেলে দিল। বউ বলল, এটা প্রথমবার। সে আবার উঠল ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়া আবার ফেলে দিল। বউ বলল, এটা দ্বিতীয়বার। সে আবার ঘোড়ায় উঠল। একটু যাবার পর ঘোড়াটা আবার তাকে ফেলে দিল। বউ হ্যান্ডব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে ঘোড়াটাকে গুলি করে মেরে ফেলল। আমি খুব রেগে গিয়ে বললাম, এটা তুমি কি করলে? মেরেই ফেললে ঘোড়াটাকে? সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা প্রথমবার। তারপর থেকে আমাদের সংসারে শুধু শান্তি আর সুখ।”
শুজা রশীদ
কথা সাহিত্যিক ও কলামিস্ট
টরন্টো